জাপার পরিচয় সঙ্কট ও রওশন এরশাদের আর্তনাদ by জি. মুনীর
সম্প্রতি
জাতীয় পার্টির (জাপা) পরিচয় সঙ্কট নিয়ে দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান
বর্তমান সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে জাতীয় সংসদে হা-হুতাশ আর
আর্তনাদ করতে দেখা গেছে। জাতীয় পার্টিকে বাঁচানোর জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার কাছে কাকুতি-মিনতি প্রকাশ করেছেন। এ সময় তাকে মনে হয়েছে তার
মতো অসহায় মানুষ বুঝি বাংলাদেশে আর দ্বিতীয় কেউ নেই। এর পরদিন সবক’টি জাতীয়
দৈনিকে এ ঘটনার খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত খবর মতে- জাতীয় পার্টির
সম্মান বাঁচাতে মন্ত্রিসভা থেকে দলটির সদস্যদের পদত্যাগ করার নির্দেশ দিতে
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন নানা বিতর্কে বিতর্কিত বর্তমান সংসদের
ততোধিক বিতর্কিত তথাকথিত বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। তিনি নিজেই মনে করেন-
তিনি নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না কিংবা সংসদের
বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে পরিচয় দিতে তার লজ্জা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জাতীয়
পার্টিকে কাগজ-কলমে বর্তমান সংসদের বিরোধী দল হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, এই
দলটির একজন পূর্ণমন্ত্রী ও দুইজন প্রতিমন্ত্রী বর্তমান সরকারের
মন্ত্রিসভায় রয়েছেন, যা নজিরবিহীন। এর বাইরে দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন
মুহম্মদ এরশাদ মন্ত্রীর মর্যাদায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষদূত। ফলে শুরু
থেকেই প্রশ্ন ওঠে জাতীয় পার্টি সরকারি দল না বিরোধী দল? সেই প্রশ্নটিই
রওশন এরশাদ এবার জাতীয় সংসদে তুললেন। সাধারণ্যে বলা হয়ে থাকে, জাতীয় পার্টি
সরকারেও আছে, আবার বিরোধী দলেও আছেÑ দলটি গাছেও খায়, আবার তলায়ও কুড়ায়।
আবার কট্টর সমালোচকেরা বলেন, জাতীয় পার্টি হচ্ছে বর্তমান সংসদে সরকারের
গৃহপালিত বিরোধী দল। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের
ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে রওশন এরশাদ সরকারে থাকা জাপার
মন্ত্রীদের সরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর
উদ্দেশে প্রশ্ন রাখেন- ‘আমরা সরকারি দল না বিরোধী দল, কোনটা আমরা?
সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে লজ্জা লাগে।’ এ সময় তিনি বলেন, তারা দেশে-বিদেশে
নিজেদের পরিচয় দিতে পারেন না। কারণ, সবাই জানতে চায়, জাতীয় পার্টি সরকারি
দল না বিরোধী দল। এ সময় তিনি আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, আমাদের
মন্ত্রীদের উইথড্র করে নিন।
আমাদের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে দিন।
কিন্তু আমি জানি না, কেন সেটা হয়নি। এভাবে টানাটানি করে বিরোধী দল হওয়া যায়
না। আমরা হয় বিরোধী দল হবো, না হয় সরকারে থাকব। না হয় আমাদের ৪০ জন সংসদ
সদস্যকে সরকারে নিয়ে নিন। বিরোধী দল দরকার নেই।’ রওশন এরশাদ আরো বলেন,
‘আপনি (প্রধানমন্ত্রী) যদি বলতে পারতেন, ঠিক আছে- সবাই মন্ত্রিত্ব ছাড়ো।
মন্ত্রিত্বে থাকার দরকার নেই। এটি যদি আপনি করতেন, জাতীয় পার্টি বেঁচে যেত।
জাতীয় পার্টি সম্মানের সাথে থাকতে পারত। আমরা এখন সম্মানের সাথে নেই। আরো
এক বছর সময় আছে, সেটা দেখুন।’ এ সময় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
মাইক চালু না করে কিছু একটা বলেন। জবাবে রওশন এরশাদ বলেন, ‘আপনি নির্দেশ
দিলে মানবে না কে? না, আপনি দিলেন না তো। না, দেননি। নইলে সবাইকে নিয়ে নিন,
সবাইকে মন্ত্রী বানিয়ে দিন।’ এ সময় কেউ একজন পাশ থেকে বিষয়টি বাদ দেয়ার
কথা বললে রওশন এরশাদ বলেন, ‘এটি তো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বাদ দেবো কেন?’ তিনি
তখন হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা যখন বাইরে যাই, তখন সবাই বলে, তুমি
কোথায় আছ, সরকারে, না বিরোধী দলে? আমরা তো বলতে পারি না।’ রওশন এরশাদ
সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ করে প্রশ্ন রাখেন, ‘আপনারা যখন বিদেশে
যান বলতে পারেন, বিরোধী দলে কারা আছে? বলতে পারেন না। আমরাও বলতে পারি না।
সে জন্য আমি কোনোখানে ইন্টারভিঊ দিই না। সাংবাদিকদের সাথে কথা বলি না। কথা
বললে প্রথমেই ধরে এটি। কী করব আমি?’ রওশন এরশাদের কাছে বিবেকবান মানুষের
প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার দল সরকারে, না বিরোধী দলে আছে- সুদীর্ঘ চার বছর পর কেন
আপনি আজ এসব প্রশ্ন তুলছেন? জাতীয় পার্টি যে আজ একটি সরকারি দলের গৃহপালিত
দলে পরিণত হয়েছে, দলটির ভূত-ভবিষ্যৎ যে আপনার কিংবা চেয়ারম্যান এরশাদের
হাতে নেই, সেটা কি আজ আপনি উপলব্ধি করতে পারেন? চার বছর আগেই তো জাতীয়
পার্টির স্টিয়ারিং সরকারি দল আওয়ামী লীগের হাতে আপনিই তো দিয়ে দিয়েছেন। ফলে
জাতীয় পার্টিকে সেভাবেই চলতে হবে, যেভাবে আওয়ামী লীগ চাইবে। এখন এ নিয়ে
হা-হুতাশ করে কোনো লাভ নেই। আপনার দলের স্টিয়ারিং যদি আপনি কিংবা জেনারেল
এরশাদের হাতে থাকত, তাহলে আপনি বা চেয়ারম্যান এরশাদ নির্দেশ দিলেই আপনার
দলের বর্তমান মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা সাথে সাথে পদত্যাগ করতেন, আপনাকে অন্য
কারো মুখ চেয়ে থাকতে হতো না। আপনাকে আজকের এই অসহায় অবস্থায় জাতীয় সংসদে
দাঁড়িয়ে এভাবে হা-হুতাশ করতে হতো না।
আপনার দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগের জন্য
আপনাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো অনুরোধ জানাতে হতো না। কারণ, একটি দলের
সংসদ সদস্যরা দলীয় নেতাদের নির্দেশ মেনেই সংসদে থাকতে হবে, নইলে সংসদ
সদস্যপদ হারাতে হবে- আমাদের সংবিধান এমনটি বলে। কিন্তু দেশবাসী দেখেছে-
২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যখন দেশের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি নিবন্ধিত
রাজনৈতিক দল বয়কট করে, তখন ওই বিনা ভোটের নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে
৪০ আসন নিয়ে সরকারের সাথে সমঝোতা করেছিলেন আপনি নিজে, এমনকি আপনি তখন এ
কাজটি করেছিলেন দলের চেয়ারম্যান এরশাদকে অনেকটা মাইনাস করে। তখন জেনারেল
এরশাদকে বাগে আনতে নাটক তো কম হয়নি। সেদিন আপনার ভূমিকা ছিল দেশের সাধারণ
মানুষের ইচ্ছার পুরোপুরি বিপরীতে। সেদিন আপনি আপনার দলের কিছু নেতাকে নিয়ে
আসন ভাগাভাগির ও ভোটোরবিহীন নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন জনগণের ইচ্ছার
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। সেসব কিছু সংসদ সদস্যকে সাথে নিয়ে এমন একটি সংসদকে
বাঁচিয়ে রাখতে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন, যে সংসদের অর্ধেকের বেশি সংসদ সদস্য
ভোটের আগেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষিত হয়েছিলেন। আসলে সেদিনই
আপনি নিজেকে পরিচিত করেছিলেন একজন খলনায়ক হিসেবে, গণতন্ত্রের শত্রু হিসেবে।
নিজেকে করে তুলেছিলেন হাসির পাত্র। আপনি কি লক্ষ করেছেন, আপনি যখন আজ এসব
কথা সংসদে আক্ষেপের সাথে বলছিলেন, তখন আপনার পাশে বসেই আপনার দলের সংসদ
সদস্য ও বর্তমান সরকারের স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমানকে মৃদু
হাসতে দেখা গেছে। তখন জাপার আরেক সংসদ সদস্য পরিবেশ ও বনমন্ত্রী তাকিয়ে
তাকিয়ে হয়তো আপনার অসহায় অবস্থাটাই পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সাথে ছিল সরকারি
দলের সংসদ সদস্যদেরও উপহাসের হাসিও।
আপনি এখন ভুগছেন পরিচয় সঙ্কটে, সেই
সাথে পরিচয় সঙ্কটে ভুগছে আপনার দলও। পরিচয় গড়ে ওঠে কাজের মধ্য দিয়ে।
ব্যক্তির পরিচয় তার কাজে, তেমনি একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় এর রাজনৈতিক
কর্মকাণ্ডের মাঝে, একই সাথে দলটির নীতি-নৈতিকতা ও জনগণের প্রতি এর
প্রতিশ্রুতিশীল থাকার মধ্য দিয়ে। কখনো কি ভেবে দেখেছেন আপনার দল আপনার
নেতৃৃত্ব জনগণের প্রতি ও গণতন্ত্রের প্রতি কতটুকু প্রতিশ্রুতিশীল থাকতে
পেরেছেন? পারেননি, ভবিষ্যতেও পারবেন না। কারণ, একটি রাজনৈতিক দল যখন আরেকটি
রাজনৈতিক দলের কাছে সবকিছু সপে দেয়- কাঁচা কথায়, বাছুর শুদ্ধ গাইগরু দিয়ে
দেয়, তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। জাতীয় পার্টির অবস্থাটা হচ্ছে তাই। ফলে
এখন হা-হুতাশ করা ছাড়া জাতীয় পার্টির আর কিছু করার আছে বলে মনে হয় না।
রওশন এরশাদের এই বক্তব্য দেয়ার পাঁচ দিনের মাথায় গত ২ মার্চ জাতীয় পার্টির
চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন- ‘আমি বর্তমান সরকারের মন্ত্রী
পদমর্যাদায় আছি, আমার জাতীয় পার্টির তিনজন মন্ত্রী আছেন। কিছু দিনের মধ্যে
আমি ও আমার পার্টির মন্ত্রীরা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করব। তিনি আরো বলেন,
পদত্যাগ করার বিষয়টি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এ
ধরনের ঘোষণা আরো কয়েকবারই দিয়েছেন; কিন্তু তখন এর বাস্তবায়ন এ দেশের মানুষ
দেখতে পায়নি। জানি না, কেন তা বাস্তবায়ন হয়নি। এর ব্যাখ্যাও দেশবাসী জাতীয়
পার্টি থেকে পায়নি। এবারো এমনটি ঘটে কিনা, সে প্রশ্ন রয়েই গেল। শুধু এটিই
নয়, জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অনেক কথাই বলেন, কিন্তু
করেনটা এর ঠিক উল্টো। ফলে তার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের একটি ধারণা জন্মেছে
এমন- তিনি সকালে বলেন এক কথা, আর বিকেলে বলেন আরেক কথা। ফলে দেশের মানুষ
তার কথার কোনো কিছুতেই আস্থা রাখতে পারছেন না। রওশন এরশাদের উদ্দেশে বলছি-
আপনি কি সত্যি-সত্যিই জাতীয় পার্টিকে বাঁচাতে চান, জাতীয় পার্টিকে সম্মানের
সাথে চালাতে চান?- যদি তা চান, তবে অন্য কোনো দলের নেতার কাছে
কাকুতি-মিনতি করে তা পারবেন না। নিজের দলকে বাঁচাতে চাইলে নিজের দলকে
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর নীতি-নৈতিকতার সড়কপথে হাঁটতে দিন। নীতি নৈতিকতা
বিসর্জন দিয়ে ফাকতালে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগের চেষ্টায় থাকলে নিজের রাজনৈতিক
দলকে সম্মানের সাথে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। সেই সাথে নেতাদের ভুগতে হয় পরিচয়
সঙ্কটে। তখন দলের জন্য সরকারের কৃপাই হয় একমাত্র ভরসা। আজকের জাতীয়
পার্টিই ঠিক এটিই, যা সম্মানজনক নয়। আপনার বক্তব্য থেকে অনুমান করি, সেটি
আপনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তাই এ পথ ছাড়ুন, দেখবেন আপনার দলের প্রতি
সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়বে।
দলে জনসম্পৃক্ততা বাড়বে। দল প্রাণ ফিরে পাবে।
অতএব, দলের রুট পরিবর্তন করুন। কিন্তু আপনার দলের নেতাদের মাথায় তেমনটি আছে
বলে তো মনে হয় না। এখনো আগের মতোই জাতীয় পার্টির নেতারা শুধু ফাঁক খোঁজার
তালে আছেন। দেশের বাইরে ও ভেতরের সবাই যখন বলছে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও
সুষ্ঠু নির্বাচন হবেÑ এমন পরিবেশ বাংলাদেশে নেই, তখন হুসইন মুহম্মদ এরশাদ
বলছেন বর্তমান সংবিধানের আওতায়ই তিনি আগামী নির্বাচন করতে চান। কেন তিনি
এমনটি বলছেন, তা বোঝার জন্য খুব একটা বুদ্ধি খরচ করতে হবে না। আসলে তিনি
চান ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির মতো আরেকটি ভোটারবিহীন নির্বাচন। তখন তার দল
আবার বিরোধী দলে বসার সুযোগ পাবে, তা ছাড়া কয়েকজনকে পাঠানো যাবে
মন্ত্রিসভায়, দলের নেতা নিজেও মন্ত্রীর পদমর্যাদা ভোগ করবেন এবারের মতো
অন্য কোনো সরকারি পদমর্যাদা, তখন গাছেও খাওয়া যাবে, তলায়ও কুড়ানো যাবে।
কারণ, তিনি ধরে নিয়েছেন, বর্তমান সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন হলে বিএনপি ও এর
নেতৃত্বাধীন জোট এ নির্বাচন বয়কট করবে। আর তখন খালি মাঠে গোল দেয়া যাবে।
তা ছাড়া তার কথাবার্তায় আভাস পাওয়া যায়, খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়াটাকে
তিনি বাড়তি সুযোগ বলে বিবেচনা করছেন। রওশন এরশাদ ও একই সাথে হুসেইন মুহম্মদ
এরশাদকে আবারো বলছি, এভাবে জাতীয় পার্টিকে যেমন বাঁচানো যাবে না, তেমনি
ঘুচবে না আপনাদের পরিচয় সঙ্কটও। অতএব সাধু সাবধান। বাঁকাপথ ছেড়ে সোজা পথে
চলহে সুজন।
No comments