তিনি শাবিপ্রবির ব্র্যান্ডনেম by অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন আহমেদ
অধ্যাপক
মুহম্মদ জাফর ইকবাল পড়ন্ত বিকেলে ছিলেন মুক্তমঞ্চে। বাংলাদেশের গর্বের
প্রতিষ্ঠান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি)
শনিবার ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ট্রিপল-ই) বিভাগের
সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনিই ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কয়েকটি
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের তৈরি রোবটের মধ্যে চলছিল ফাইট। প্রথম
রাউন্ডের প্রতিযোগিতা শেষ হয়েছে কেবল। এ সময়ে সামান্য বৃষ্টি হচ্ছিল।
অনুষ্ঠানে সাময়িক বিরতি। একজন শিক্ষক পরীক্ষার জন্য চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে
তার সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় অতর্কিতে সেই ভয়ঙ্কর হামলা। ছুরিকাঘাত
করা হয়েছে পরপর কয়েকটি। মাথার পেছন দিকে খুব সংবেদনশীল স্থানেই ছুরি চালানো
হয়। বলা যায়, ভালো প্রশিক্ষণ না থাকলে এ ধরনের আঘাত করা যায় না। ছাত্র ও
শিক্ষকরা সক্রিয় হয়ে তাদের প্রিয় শিক্ষককে রক্ষার জন্য এগিয়ে যান।
অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত পুলিশও তৎপর হয়। তিনি রক্তাক্ত ছিলেন; কিন্তু সবাইকে
শান্ত থাকতে বলেন। এমনকি আটক দুর্বৃত্তের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্যও
অনুরোধ করেন। ছাত্র-শিক্ষকরা হামলাকারীকে আটক করেন। তাকে আইন-শৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে দেওয়া হয়। কেউ কেউ বলছেন, সেখানে একাধিক
হামলাকারী থাকতে পারে। এ বিষয়টি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুসন্ধানের
বিষয়। বাংলাদেশের সর্বত্র জাফর ইকবাল নন্দিত। তিনি দেশের সেরা শিক্ষকদের
একজন হিসেবে গণ্য হন। লেখক হিসেবে জনপ্রিয়। সব বয়সের পাঠক তার বইয়ের জন্য
অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। তবে বিশেষভাবে তরুণদের মধ্যে তিনি আইডল,
অনুকরণীয়-অনুসরণীয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা কাজে তিনি
সর্বদা অগ্রণী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে তার অবদান অতুলনীয়। তার
স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হকও বরেণ্য শিক্ষক। গবেষণা কাজে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর
ইকবালের উৎসাহ অপরিসীম। অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করার কাজ তিনি করেন পরম
আন্তরিকতায়। তাকে আমরা বলে থাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ব্র্যান্ডনেম'। তার
পরিচয়েই অনেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে চেনেন। তিনি মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে
কাজ করেন। বিভিন্ন সময়ে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। বিরূপ সমালোচনাও
করা হয়েছে। কিন্তু তিনি পিছু হটতে জানেন না। অপশক্তির কাছে হার মানতে জানেন
না।
দেশের কল্যাণ ও মঙ্গল যারা চায় না, তাদের সঙ্গে আপস করতে জানেন না।
লেখনীতে, আলোচনা অনুষ্ঠানে, ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দেশের জন্য, দশের জন্য
তার আকুলতার প্রকাশ ঘটে। তাকে হত্যার জন্যই আক্রমণ চালানো হয়েছিল- এটা
সহজেই বুঝতে পারি। হামলা আকস্মিক ছিল না। মুহূর্তের উত্তেজনায় কিছু করে
ফেলেনি হামলার সময় আটক দুর্বৃত্ত ফয়জুর রহমান। সে বয়সে যুবক। যতটা জানা
গেছে, তার পিতা মাদ্রাসার শিক্ষক। সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নয়। উৎসবে
অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে তার আসারও কোনো কারণ ছিল না। এটা ধরে নিতে পারি যে,
পূর্বনির্ধারিত মিশনেই সে এসেছিল। সে কি নিজে থেকেই দেশের বরেণ্য একজন
শিক্ষাবিদকে হত্যা করতে পরিকল্পনা এঁটেছিল, নাকি তার পেছনে রয়েছে সুসংগঠিত
কোনো চক্র- সেটা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুসন্ধানে জানা যাবে। এর
আগে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন
শিক্ষার্থী আনসারউল্লাহ বাংলা টিম নামের একটি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর
সঙ্গে জড়িত। তাদের কেউ কেউ বাংলা একাডেমির বই মেলায় ড. অভিজিৎ রায়ের হত্যায়
জড়িত ছিল বলে জানা যায়। সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয়ের হত্যাকাণ্ডেও তাদের
কারও কারও সংশ্নিষ্টতা ছিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় তাদের
কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছে। কেউ কেউ নিখোঁজ রয়েছে। অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর
হামলায় জড়িত ফয়জুর রহমানের সঙ্গে এসব সন্ত্রাসীর যোগাযোগ রয়েছে কি-না সেটা
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে জানা যাবে। আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের
সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে যারা আটক হয়েছিল, তাদের কেউ কেউ জামিনে মুক্ত
হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়টি এখন অনুসন্ধানের আওতায় আসতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদসহ যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী
কর্মকাণ্ডে যেন জড়িত না হয়, সে বিষয়ে আমরা সচেতন রয়েছি। কেউ একনাগাড়ে অনেক
দিন শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকলে তার বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। পরিবারকে
প্রয়োজনে জানানো হয়। কেউ কেউ হঠাৎ করে জঙ্গি হয়ে যায় না। সাধারণত এটা একটি
প্রক্রিয়ার ব্যাপার। কারও মধ্যে এ ধরনের পরিবর্তন দেখা দিলে সেটা পরিবারের
সদস্যরা ধরতে পারেন, বন্ধু ও সহপাঠীদের নজরে পড়ে। ফয়জুর রহমান নামের যে
দুর্বৃত্ত হামলায় জড়িত, সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়। কিন্তু
সে তো আমাদের সমাজেরই একজন। কাজেই আমাদের সচেতন থাকতে হবে শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ও বাইরে। এদের কারণে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ
হয়। হলি আর্টিসানে হামলায় ইতালি ও জাপানের কয়েকজন নাগরিক খুন হয়েছিলেন। এর
প্রভাব পড়ার শঙ্কা ছিল আমাদের রফতানি বাণিজ্যে। বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার
জন্য যাওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা হয়। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এ ধরনের সন্ত্রাসবাদ দমনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ
কাজে সব মানুষের সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে যেন
সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী কেউ আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়, সেটা নিশ্চিত করব। এ পথ
ভুল। এতে নিজের ক্ষতি হয়, পরিবার ও সমাজ বিপন্ন হয়। আমি গতকাল রোববার ঢাকার
সিএমএইচে অধ্যাপক জাফর ইকবালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি সুস্থ হয়ে
উঠছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, তিনি ঝুঁকিমুক্ত। তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করি।
তিনি অচিরেই তার প্রিয় ক্যাম্পাসে ছাত্র ও সহকর্মীদের কাছে ফিরে আসবেন-
এটাই কামনা। আগেই বলেছি, তাকে দিয়েই আমাদের এ বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকে চেনে।
আমরা দেশের ভেতরে কিংবা বাইরে কোথাও গেলে অনেক সময় তার পরিচয়ের কারণেই
আমাদের চেনাতে হয়। একজন শিক্ষকের চেয়ে এর চেয়ে সম্মান ও মর্যাদার আর কিছু
হতে পারে না। তিনি সবার ভালোবাসায় সিক্ত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গুণী
শিক্ষক ও গবেষক আছেন। কিন্তু দেশ-বিদেশে প্রথমেই আসে জাফর ইকবালের কথা।
তিনি আমাদের গর্ব। ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রেরণা। সবাইকে তিনি উজ্জীবিত করতে
পারেন। যেখানে যান বিশেষভাবে কিশোর-তরুণরা তার সান্নিধ্য হয়। তার সঙ্গে কথা
বলে আনন্দ পায়। দেশের জন্য তার যে অপরিসীম ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার
যে গর্ব, সেটা তিনি সহজেই অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়
পরিবারের সবাই তাকে ভালোবাসেন। আমরা দ্রুত তাকে আমাদের মাঝে ফিরে পেতে চাই।
আর যে হিংস্র দানবশক্তি তার ওপর হামলা চালিয়েছে, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও
পরোক্ষভাবে যুক্ত সকলের চাই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
উপাচার্য, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
উপাচার্য, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
No comments