উন্মুক্ত হচ্ছে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে গ্যাস সংযোগ
অবশেষে
উন্মুক্ত হচ্ছে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে গ্যাস সংযোগ। দীর্ঘ ৩ বছর বন্ধ
থাকার পর সরকার আবারও ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে গ্যাস সংযোগ উন্মুক্ত করার
সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয় একটি সারসংক্ষেপ তৈরি
করেছে। প্রাথমিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৌখিক নির্দেশনা পেয়ে
জ্বালানি বিভাগ তা তৈরি করে। এটি অনুমোদনের জন্য শিগগির প্রধানমন্ত্রীর
দফতরে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, আগামী এপ্রিলে
আমদানিকৃত ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) যুক্ত হবে
জাতীয় গ্রিডে। এরপরই ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ উন্মুক্ত করার টার্গেট রয়েছে
সরকারের। বর্তমানে ঢাকাসহ সারা দেশে ২২শ’ ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট রয়েছে।
এগুলোতে ৩০০-৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস লাগছে। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি
উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে শিল্পে গ্যাস সংযোগ দেয়ার জন্য
গঠিত বিশেষ কমিটির কাছে বর্তমানে ৭ শতাধিক ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে গ্যাস
সংযোগের আবেদন জমা আছে। এর মধ্যে নতুন সংযোগের আবেদন ৩শ’। বাকিগুলো পুরনো
ক্যাপটিভ প্লান্ট এক্সটেনশনের আবেদন। কিন্তু এ খাতে গ্যাস অপচয়ের অজুহাত
দেখিয়ে ২০১৫ সালের প্রথমদিকে ক্যাপটিভে নতুন সংযোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়
সরকার। একই সঙ্গে ক্যাপটিভ প্লান্টের গ্যাসের দাম এক লাফে দ্বিগুণের বেশি
বাড়িয়ে দেয়। এতে বিপাকে পড়েন সারা দেশের ছোট-বড় ২২শ’র বেশি শিল্পকারখানার
মালিক। সরকারের আকস্মিক এ সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে যায় শত শত শিল্পকারখানা।
কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে শিল্প স্থাপন সংক্রান্ত সব কাজ গুছিয়ে আনার পর
সরকারের এ সিদ্ধান্তে বহু শিল্পোদ্যোক্তা চরম বিপাকে পড়েন। এতে নতুন
শিল্পকারখানাগুলো শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে। নুতন শিল্প স্থাপনে আগ্রহ হারিয়ে
ফেলেন অনেক উদ্যোক্তা। এর প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে। জ্বালানি বিভাগ
সূত্রে জানা গেছে, ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস সংযোগ বন্ধ ঘোষণার পর ২০১৫ সালের
৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় পরিদর্শন শেষে
দ্রুত শিল্প ও বাণিজ্যিক কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেয়ার নির্দেশনা দেন। শিল্প
প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় তিনি জ্বালানি বিভাগের কার্যক্রম নিয়ে
অসন্তোষও প্রকাশ করেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
ফাইলবন্দি ছিল। পেট্রোবাংলার এক পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে
ওই সময় বলেছিলেন, ২০১৫ সালে টানা অবরোধ ও হরতালে নাশকতার কারণে শিল্প খাতে
ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল এক লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। ঠিক ওই মুহূর্তে
ক্যাপটিভ পাওয়ারে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে এ খাতটিকে বিপর্যয়ের মুখে
ঠেলে দিয়েছিল সরকারের মধ্যে থাকা একটি চক্র। তিনি বলেন, সরকারের নতুন এ
সিদ্ধান্তে আবারও ঘুরে দাঁড়াবেন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা। তার মতে,
ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্ট থাকলে শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়া
সম্ভব। পাশাপাশি কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
এতে পণ্য উৎপাদন সহজ ও
খরচ কম পড়ে। কিন্তু ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ বন্ধ হয়ে পড়ার পর থেকে এই
সেক্টরে বড় ধরনের ধস নামতে শুরু করে। ২০০৯ সালের ২১ জুলাই থেকে শিল্প ও
বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার পর শিল্পোদ্যোক্তারা নিজেদের উদ্যোগে
ক্যাপটিভ জেনারেটর বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেন। তবে এর আগে থেকেও বড়
বড় শিল্পকারখানা ক্যাপটিভ পাওয়ারের মাধ্যমে চলছে। ওই সময় অনুমোদন পাওয়া
ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টের সংখ্যা ২২শ’। এরা ছয়টি বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে
গ্যাস পাচ্ছে। তিতাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, শিল্পে গ্যাস সংযোগ বন্ধ
করে দেয়ার পরও সরকার মাঝারি থেকে বড় শিল্পকারখানাগুলোকে ক্যাপটিভ পাওয়ারে
উৎসাহিত করে আসছিল। এ কারণে ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে গ্যাস সংযোগ দেয়ার
জন্য অনেকেই বিতরণ কোম্পানিগুলোতে আবেদন করেন। বর্তমানে সারা দেশে ১৫শ’র
বেশি শিল্পে গ্যাস সংযোগের আবেদন জমা আছে। এর মধ্যে ক্যাপটিভের সংখ্যাই
৭শ’। তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক
প্রকৌশলী মীর মশিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শিল্পকারখানায়
গ্যাস সংযোগ বন্ধ আছে। তবে সরকারের বিশেষ কমিটির অনুমোদন নিয়ে অনেকে শিল্পে
গ্যাস সংযোগ নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে শিল্পকারখানা চালাচ্ছেন। বর্তমানে
তিতাসের আওতায় প্রায় হাজার খানেক ক্যাপটিভ পাওয়ার রয়েছে। ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’
মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস লাগছে এসব ক্যাপটিভ পাওয়ারে। আরও ৩-৪শ’ ক্যাপটিভ
পাওয়ারের আবেদন তিতাসের বিবেচনাধীন আছে। তিনি বলেন, নতুন করে সংযোগ চালু
হলে কারখানাগুলো চালু করা সম্ভব হবে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের এক
কর্মকর্তা বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে মানসম্মত ও
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রয়োজন। একমাত্র ক্যাপটিভ থেকেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ
পাওয়ার সুযোগ আছে। এ অবস্থায় ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ উন্মুক্ত করাকে তিনি
স্বাগত জানান। ৬ বছর ধরে শিল্প ক্ষেত্রে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় নতুন
শিল্পকারখানা চালু হয়নি। এতে শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আটকে
গেছে অনেক উদ্যোক্তার বিনিয়োগ। ঋণ নিয়ে গড়া শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু করতে না
পারায় তাদের এখন কাহিল দশা। সর্বোপরি জনসংখ্যা বাড়লেও নতুন কর্মসংস্থান
সৃষ্টি হচ্ছে না। তবে শিল্পে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সংযোগ এবং লোড
বরাদ্দ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর
নেতৃত্বে ২০১১ সালের মার্চে ৬ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিলে বিদেশ থেকে ২৫০ মিলিয়ন এলএনজি
আমদানি করা হবে। এই গ্যাস তরলীকরণের পর সরাসরি জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত সব ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করেছে সরকার।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহর নেতৃত্বে একটি
উচ্চপর্যায়ের টিম আমদানিকৃত এলএনজি যাতে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত
করা যায় সে জন্য দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস
কোথায় কোন গ্রাহকের কাছে যাবে, তারও তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। সূত্র
বলছে, এলএনজি এলে প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রামের ৩শ’র বেশি শিল্পকারখানায় গ্যাস
সংযোগ দেয়া হবে। এসব শিল্পকারখানায় ২০ থেকে ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস লাগবে। এ
ছাড়া চট্টগ্রামের কর্ণফুলী পার্টিলাইজার, ঘোড়াশাল সার কারখানা, শিকলবাহা,
রাউজানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে
বাকি গ্যাস সরবরাহ করা হবে।
No comments