রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ঠেকাতে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠছে উগ্রবাদী বৌদ্ধরা
মিয়ানমারের
জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে গত বছরের আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও এখনো
ফেরত পাঠানো যায়নি একজনকেও। ঢাকা-নেপিডো চুক্তি সম্পন্ন হলেও রোহিঙ্গা
প্রত্যাবাসন এখনো শুরু হয়নি। কেউ ফিরে যাওয়ার আগেই সেখানকার রাখাইনের
উগ্রবাদী বৌদ্ধরা এর বিরোধিতা শুরু করেছে। মংডু জেলার ছয়টি স্থানে ফেরত
নেয়া রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্তে সহিংসতার আশঙ্কা জানিয়েছে তারা।
অরিগনভিত্তিক মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউরোএশিয়ারিভিউ জানিয়েছে, ওই
সম্প্রদায়ের পক্ষে একটি নাগরিক প্রতিনিধিদল মিয়ানমার সরকারকে এরই মধ্যে
তাদের আপত্তির জায়গাগুলো জানিয়েছে। রাখাইন প্রতিনিধিরা অবশ্য দাবি করছেন,
তারা প্রত্যাবাসনের বিরোধী নয়, কেবল যথাযথ যাচাই-বাছাই নিশ্চিত করার পক্ষে।
পালিয়ে আসার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি
স্বাক্ষর করেছে মিয়ানমার। মার্কিন সংবাদমাধ্যমটির খবরে বলা হয়েছে,
প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইনের মংডু
জেলার ছয়টি স্থানে বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে মিয়ানমার। এ পরিকল্পনার
বিরুদ্ধে অবস্থান জানাতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানী সিত্তেতে মিয়ানমার
সরকারের সঙ্গে এক বৈঠকে বসে রাখাইন সম্প্রদায়ের ৮০ জন নাগরিক প্রতিনিধি। গত
বছরের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলাকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে
রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণ বলা হলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও
সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে
এবং তাদের ফেরার সমস্ত পথ বন্ধ করতে আরসার হামলার আগে থেকেই পরিকল্পিত
সেনা-অভিযান শুরু হয়েছিল। অতীতের ধারাবাহিকতায় স্থানীয়দের রোহিঙ্গাবিদ্বেষী
করে তুলতে সেখানে সেনা-প্রচারণা হয়েছে এবারের নিধনযজ্ঞেও। মিয়ানমারের
ডি-ফ্যাক্টো সরকারের পক্ষ থেকে বারবার স্থানীয়দের রোহিঙ্গাবিদ্বেষী
মনোভাবের কথা সামনে আনার চেষ্টা করা হয়। তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে সমাজের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীর ছড়িয়ে দেয়া
বিদ্বেষকেই রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের কারণ হিসেবে শনাক্ত করেছে। বৈঠকে রাখাইনদের
নাগরিক প্রতিনিধি সোয়ে নাইং বলেছেন, ওই এলাকায় ১৯৪০-এর দশক থেকেই
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়দের সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ইউরোএশিয়ারিভিউকে তিনি
বলেন, ‘স্থানীয় রাখাইন জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গা
শরণার্থীদের সেখানে পুনর্বাসিত করা হলে দুই সম্প্রদায়ের একত্রে বসবাস করা
অসম্ভব।’ তিনি বলেন, ওই এলাকাটি উপকূলে অবস্থিত। সে কারণে সেখানে দেয়াল
নির্মাণ সম্ভব নয়। আর তাই বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে উদ্বেগ
বাড়ে। সোয়ে নাইং বলেন, ‘আমরা চাই বাংলাদেশ থেকে ফেরত আসা প্রত্যেককেই
সরকার খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করুক। কারণ তাদের মধ্যে
অনেক যোদ্ধা রয়ে গেছে। ফলে আমরা সার্বভৌমত্ব নিয়ে শঙ্কিত।’ বিদ্বেষী
প্রচারণার মধ্য দিয়ে রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সেখানকার রাখাইন
সম্প্রদায়ের মানুষের ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই। বিদ্বেষের শেকড় তাই
দিনকে দিন আরো শক্ত হয়েছে। মিয়ানমারের অধিবাসী হলেও রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগ
রাখাইন বৌদ্ধ বাংলাদেশ থেকে সেখানে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী দাবি করে। সরকারের
সঙ্গের বৈঠকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব ও অন্যান্য অধিকারের দাবির
পেছনে রাখাইনের ভূমি দখলের অন্য রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকার অজুহাত তোলেন জাও
উইন। দাবি করেন, জাতিগত রাখাইনদের নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গাদের রাখাইনের ভূমি
দখলের রাজনৈতিক এজেন্ডায় মিয়ানমার শঙ্কিত। ইউরোএশিয়ারিভিউর খবরে বলা হয়েছে,
২০১৭ সালে শেষ থেকে মিয়ানমার সরকার ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কমপক্ষে
৪৫৫টি গ্রামের সব অবকাঠামো ও ফসলের ক্ষেত ধ্বংস করে দিয়েছে। এসব গ্রামের
বেশির ভাগই ২৫ আগস্টের পর সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ৩৬২
গ্রামের মধ্যে ছিল। সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের
বেড়া নির্মাণ করতে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অনুমোদন দিয়েছে মিয়ানমারের
পার্লামেন্ট। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড এডামস ২৩
ফেব্রুয়ারি বলেন, বুলডোজার ব্যবহার করে রোহিঙ্গা বসবাসের স্মৃতি ও
আইনগতভাবে সেখানে কারা বসবাস করত তার পরিচয় মুছে ফেলার হুমকি তৈরি করেছে
মিয়ানমার।
No comments