ডাকাতির সাহস, সাফল্য ও সর্বনাশ by আফজাল হোসেন
দস্যু
বনহুর, দস্যু বাহরাম, দস্যু মোহন—এসব কল্পিত ডাকাতের গল্প আমাদের খুবই
প্রিয় ছিল একসময়। তাদের ডাকাতি আমরা ভালোবাসতাম। কারণ, তারা ছিল ভালো
ডাকাত। বড়লোকদের অর্থসম্পদ লুট করে গরিব-দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিত। অনেক
পাঠকই তখন ভেবেছে, বড় হয়ে নামকরা ডাকাত হতে হবে। এখন দস্যু অমুক, দস্যু
তমুক বা দস্যুতার বানানো গল্পের আকর্ষণ তেমন নেই, কিন্তু মানুষ প্রায় রোজই
জানতে পারে হরেক রকম সত্যিকারের ডাকাতির কথা। এখনকার ডাকাতদের সঙ্গে তুলনা
করলে দস্যু মোহন, বাহরাম বা বনহুরকে দুর্বল, পানসে ডাকাত মনে হবে। অথচ তখন
ডাকাতি পাঠের সময় তাদের বুদ্ধিমত্তা, সাহস ও দয়ালু মনের নিত্যনতুন উদাহরণ
পেয়ে মনে হতো শুধু দস্যু হিসেবে নয়, মানুষ পরিচয়েও তারা শ্রেষ্ঠ। তাদের
ডাকাতি ছাপিয়ে ভালো কাজ প্রধান করে তুলতেন লেখকেরা। পাঠক তাই বইয়ের
ডাকাতদের ডাকাতি আমলে না নিয়ে তাদের মহত্ত্বে মুগ্ধ হতো। আগে যেসব দস্যুতার
গল্প পড়া হয়েছে, তার প্রায় সবই ঘটত রাতের আঁধারে। ডাকাতেরা অন্ধকারে মিশে
থাকার জন্য কালো পোশাক পরত। মুখ থাকত ঢাকা। এখন দস্যুতা চলে দিনের আলোয়।
কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকাও লাগে না। ঘোড়া ছিল দস্যুদের প্রধান সঙ্গী।
এখনকার
বিখ্যাতদেরও ঘোড়া থাকতে হয়। তবে এ ঘোড়া হ্রেষাধ্বনি জানা মানুষের চেনা চার
পায়ের ঘোড়া নয়। অদৃশ্য সে ঘোড়া, কিন্তু তার পিঠে সওয়ার হতে পারলে যাদের
টের পাওয়ানো দরকার, টের পেয়ে যায়। জেনে যায় সওয়ারি রাম, শ্যাম, যদু, মধু
গোছের কেউ নয়। এই ভাব প্রকাশ হয়ে পড়া মানে, সব সাধন হয়ে যায় আঙুলের তুড়িতে।
এখনকার ডাকাতির গল্পগুলোতে মুগ্ধতা নেই। ডাকাতদের ডাকাতই ভাবে সাধারণেরা।
ডাকাতির কাঁড়ি কাঁড়ি উদাহরণে হতাশায় ডোবার পাশাপাশি দেশজুড়ে মানুষের নানা
অসাধারণ কাজের গল্প জেনে ও শুনে জ্বলে ওঠে আশার আলো। পেটের আহার জোগাতে
হিমশিম খাওয়া মানুষ লেখাপড়া শিখতে পারেনি বলে নিজ গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠার
কথা ভাবে। নিজের সামান্য জমি স্কুলের জন্য দান করে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে
ফেলেছে। রিকশা চালিয়ে গ্রামে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছে, এমন বিস্ময়-জাগানো
মানুষ এবং তাঁর স্বপ্ন সার্থক করা গল্প জেনে মানুষ গৌরববোধ করে। দেশটাকে
আদর করে সোনার বাংলা বলা হয়, এসব মানুষই সোনার বাংলার সোনার মানুষ। দেশটা
যে ঝলমলে, দেশটাকে নিয়ে যে গর্ববোধ করা হয়ে থাকে, তা এ রকম অসংখ্য মানুষের
অসাধারণ নিষ্ঠা, দায়িত্ব, কর্তব্য ও চিন্তাশীল মনের জন্য। এমন অজস্র
গৌরবগাথার পাশাপাশি শিউরে ওঠার মতো ঘটনাও ঘটছে। কেউ অসুস্থতা নিয়ে রাজধানীর
বিখ্যাত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানানো হলো, প্রায়
বন্ধ হয়ে যাওয়া হৃদয়ের তিনটি রক্তনালিতে রিং পরাতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
জরুরি ভিত্তিতে তা করা হলেও অসুস্থতা একেবারে দূর হলো না। রোগীকে নিয়ে
যাওয়া হলো বিদেশে। বিদেশি ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অবাক হলেন। রোগী
দাবি করছে তাকে তিনটি রিং পরানো হয়েছে, ডাক্তার খুঁজে পান মাত্র একটি। এমন
ঘটনা শুধু একজন ডাক্তার বা একটা হাসপাতালের প্রতারণা নয়।
দেশ ও
চিকিৎসাব্যবস্থা এমন অসততায় কতটা হেয় হয়, দস্যুরা তা আমলে নেওয়ার মানুষ নয়।
ডাকাতি, লুট, প্রতারণা-এসব ঘৃণার ভাবা হলেও সময়ের পরিবর্তনে ঘৃণার ঘনত্ব
অনেকটা কমে গেছে। ওসবে দ্রুত অর্থবৃদ্ধি ঘটে। অর্থের জোর চারপাশে জুটিয়ে
দেয় অসংখ্য হাত কচলানো মানুষ। সমাজ, সংসার সব আশ্রয় থেকে যখন প্রশ্রয় মেলে
অপরাধ, অন্যায় তখন আর মনে দাগ ফেলতে পারে না। দেশ বা সমাজের মতো বড় পরিসরে
না গিয়ে আরও ছোট পরিসর থেকে অন্যায় হজম করার দৃষ্টান্ত তলিয়ে দেখা যায়।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, নিয়মিত কোরআন পাঠ করা স্ত্রী হয়তো ৩০ বছর ধরে
একটা স্বাভাবিক আয়ের সংসার ঠেলে চলেছেন। তিনি হঠাৎ করেই খেয়াল করলেন স্বামী
আলাদিনের চেরাগ পায়নি কিন্তু ব্যাংকে, ঘরে টাকার ছড়াছড়ি। এমন আঁতকে ওঠার
মতো ঘটনায় কী করবেন স্ত্রী? এমন সংসারে দু-তিনজন পুত্র-কন্যা যদি থাকে,
তাদেরও হঠাৎ সংসারে টাকাপয়সার এমন ঝনঝনানি দেখে কোনোই প্রতিক্রিয়া হয় না।
তাদের মনে প্রশ্ন জাগবে না, এত দিনের চেনা পিতা হঠাৎ কীভাবে কোন শক্তির বলে
এত রোজগেরে হয়ে উঠেছে। স্বামী, পিতা বা বন্ধু কোনো অন্যায় পথে অনৈতিকতার
সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ দুঃখ বা অপমানে আক্রান্ত না হয়ে ভোগে লিপ্ত হয়ে ওঠাই
স্বাভাবিক ঘটনা। ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’ প্রবাদের সত্যতাও মেলে।
এক
অন্যায়কারী নিজের মতো অসংখ্যকে খুঁজে পায় কাছে বা দূরে। তাদের ঘনিষ্ঠতা
বাড়ে দ্রুত। তারা মনে করে নিতে পারে আমরাই যোগ্যতর, আমরাই বেশি, আমাদের
মুঠোতেই সমস্ত জগৎ-সংসার। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা প্রহরীর
প্রহরা থাকে। থাকে অসংখ্য সিসি ক্যামেরা। অফিস নিরাপদ থাকলেও এমন
বন্দোবস্তের মধ্যে দস্যুতা চলে গৌরবে। ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, বিপদে ফেলে,
ফাইল আটকে রোজগার, নিত্যকার ডাকাতির ঘটনা। সম্মানী লোকের অসম্মান ঘটানো,
তা-ও একপ্রকার ডাকাতি। অপ্রীতিকর মানুষ, তবু স্বার্থের হিসাব কষে
বিবেকবর্জিত প্রীতিকর উপস্থাপনা চলছে। এসবই দস্যুতা, ডাকাতির একেকটা ধরন।
মানুষের যে সাধারণ অধিকার তা থেকে বঞ্চিত করা, সে-ও ডাকাতি। অফিসে কর্তা
অসন্তুষ্ট বা উন্নতির ফুঁ দেওয়া মানুষ পেছনে নেই বলে চাকরিতে উন্নতি ঘটে
না, কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের অপছন্দের হওয়ায় পরীক্ষায় উপযুক্ত ফল
লাভ হয়নি-সবই দস্যুতা। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন রকমের দস্যুতা যে কতটা
মর্মান্তিক ফল বয়ে আনছে, তা ভেবে দেখা হয় না। যারা স্বাভাবিকতায় বেঁচে
থাকতে চায়, অস্বাভাবিকতার দাপটে তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হয়ে চলেছে
নাস্তানাবুদ। তাদের ক্ষোভ বাড়ছে, বেড়েই চলেছে হতাশা। তার প্রতিক্রিয়া রোজ
দৃশ্যমান। মানুষের চেহারায় চেহারায় বিরক্তি। মনে মনে ক্ষোভের পাহাড়। কারও
সাফল্যে কেউ আনন্দিত হয় না। পেছনে কথা বলা আনন্দের। চারদিকে অসহিষ্ণুতা।
এ
ধমকাচ্ছে ওকে, ও ধমকাচ্ছে তাকে। রোজ রাস্তা যানজটে আটকে পড়ে থাকতে হচ্ছে।
স্বেচ্ছাচারিতা, দায়িত্বহীনতা, বিশৃঙ্খল মানসিকতা জনে জনে। যে যেখানে যেমন
আছে সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যকে এগোতে না দেওয়া, ঠকানোর বুদ্ধি বের করে চলেছে।
হয়রানি বাড়ছে, অসহায়বোধও বেড়ে চলেছে। ডাকাতির গল্প জানছে মানুষ, বড় বড়
অন্যায় বুক চিতিয়ে ঘটছে। সাধারণের মনে ঘটছে পরিবর্তন। মনে প্রশ্নের উদয় হয়,
বড়দের বড় অন্যায় যদি নির্বিঘ্নে হতে পারে, ছোটখাটো অন্যায় কি এমন দোষের?
জোরঅলাদের অন্যায়ের ধাক্কায় রাস্তার ফেরিওয়ালাও হয়ে উঠছে অন্যায়কারী।
ছোটখাটো ফলবিক্রেতা হয়ে উঠছে প্রতারক। গৃহকর্মীও ভাবছে কীভাবে ঝোপ বুঝে কোপ
মেরে বড় হওয়া যাবে। বাড়ছে, বেড়েই চলেছে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ, অবিশ্বাস।
মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের প্রধান উপাদানগুলোয় ধরেছে ঘুণ। ঘুণে ধরা
মানুষেরা ঘরের খুঁটি হওয়ার প্রণোদনা পায়, সে-ও দস্যুতা। ছোটকালে ডাকাতির
গল্পে বীরত্ব, মহত্ত্ব খুঁজে পাওয়া যেত। বড়বেলায় যদি সেই মন দিয়ে অন্যায়কে
ভালোর জন্য অন্যায় ভেবে আত্মতুষ্টি ঘটে, তাতে প্রমাণিত হয়ে যায়, বয়সে বড়
হওয়া হয়েছে, তা বড় হওয়া মোটেও নয়।
আফজাল হোসেন: অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক ও নির্দেশক
afzalhossain1515@yahoo.com
আফজাল হোসেন: অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক ও নির্দেশক
afzalhossain1515@yahoo.com
No comments