সাত ব্যাংকের বেপরোয়া ব্যাংকিং নির্দেশনা মানছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
ঋণ
আমানতের সুদের ব্যবধান (স্প্রেড) কোনোক্রমেই ৫ শতাংশের ওপরে হওয়া যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দীর্ঘ দিন ধরেই এ নির্দেশনা দিয়ে আসছে। কিন্তু কিছু
ব্যাংক বরাবরই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নির্দেশনা অমান্য করে
আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের এ নির্দেশনাকে অবজ্ঞা করে ৭ ব্যাংক তাদের ঋণ আমানতের সুদ হারের
ব্যবধান সাড়ে ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর
মধ্যে পাঁচটিই বিদেশী। দু’টি স্থানীয় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ
ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঋণের সুদ হার নির্ধারিত সীমার মধ্যে
ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুদের ব্যাপ্তি বেঁধে দেয়া হয়। এর দুই
ধরনের ইতিবাচক দিক রয়েছে। প্রথমত কম সুদে আমানত নিয়ে বেশি সুদে বিনিয়োগ করা
যায় না। অর্থাৎ ঋণের সুদ হার বেশি হলে আমানতের সুদহারও ওই হারে বাড়াতে হয়।
এতে আমানতকারীরা লাভবান হন। দ্বিতীয়ত ব্যাংকগুলো আগ্রাসী ব্যাংকিং করতে
পারে না। অর্থাৎ ফ্রি স্টাইলে ঋণ দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে সুদ আদায় করতে
পারে না। এতে শিল্প বিনিয়োগ ব্যয় নির্ধারিত সীমার মধ্যেই থাকে। জানা গেছে,
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ আমানতের সুদ হারের ব্যবধান ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে
আনতে বরাবরই ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
কিন্তু বরাবরই কিছু ব্যাংক
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা অমান্য করে থাকে। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয়
ব্যাংকেরও যেন করার কিছু নেই। মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে বরাবরই ওই
সব ব্যাংককে ছাড় দেয়া হচ্ছে। যেমন- বিদেশী কয়েকটি ব্যাংক আমানতকারীদের কাছ
থেকে খুব কম সুদে আমানত সগ্রহ করে। কিন্তু ঋণ দেয়া হয় বাজার হারেই। অর্থাৎ
সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত যে হারে বিনিয়োগ করে এসব ব্যাংক ওই একই হারে বিনিয়োগ
করে থাকে। অর্থাৎ এক দিকে ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের ঠকাচ্ছে, অন্য দিকে
বেশি সুদে ঋণ দিয়ে বাড়তি মুনাফা তুলে নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারির তথ্য নিয়ে
বাংলাদেশ ব্যাংক সর্বশেষ একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ঋণ আমানতের সুদহার
নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ওই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, স্ট্যান্ডার্ড
চার্টার্ড ব্যাংক সামগ্রিকভাবে গড়ে ১ দশমিক ২৬ শতাংশ হারে আমানত সংগ্রহ
করেছে। কিন্তু গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণ দিয়ে গড়ে সুদ আদায় করেছে প্রায় সাড়ে ৯
শতাংশ হারে। এখানে ব্যাংকটির ৩১ জানুয়ারিতে স্প্রেড ছিল ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ,
যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে ৫ শতাংশের নিচে রাখতে হবে। ১০০
টাকা আমানত সংগ্রহ করতে ১ টাকারও কম খরচ পড়ে সিটি ব্যাংক এনএ ও উরি
ব্যাংকের। যেমন- সিটি ব্যাংক এনএর ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহ করতে গড়ে ব্যয়
হয়েছে ৩৯ পয়সা, ব্যাংকটির স্প্রেড হলো ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। অন্য দিকে উরি
ব্যাংকের ১০০ টাকা আমানত সংগ্রহে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৯৮ পয়সা, যেখানে ব্যাংকটির
স্প্রেড ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আরেকটি বিদেশী ব্যাংক এইচএসবিসির গড় আমানত
সংগ্রহের ব্যয় ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ, অথচ ব্যাংকটির স্প্রেড ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ।
অন্য দিকে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গড় আমানত ব্যয় ২ দশমিক ৭২ শতাংশ, অথচ
ব্যাংকটির স্প্রেড ৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বিদেশী পাঁচ ব্যাংকের মতো, বেপরোয়া
ব্যাংকিং করছে বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। ব্র্যাক
ব্যাংকের গড় আমানত ব্যয় ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ, যেখানে ঋণের গড় সুদহার ১১ দশমিক
৬৬ শতাংশ। ফলে ব্যাংকটির স্প্রেড রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত সীমার
চেয়ে বেশি অর্থাৎ ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের গড় আমানত ব্যয় ২
দশমিক ২৭ শতাংশ, যেখানে ব্যাংকটির স্প্রেড ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশ
ব্যাংকের নির্দেশনা মানলে কমে সুদে ঋণ বিতরণ করা যেত। বাংলাদেশ ব্যাংকের
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিদেশী ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের কম মুনাফা
দিচ্ছে। উল্টো দিকে ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিচ্ছে। ফলে এ মুনাফার বড়
একটি অংশ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ওই সূত্র জানিয়েছে, দেশের স্বার্থেই
নির্দেশনা পরিপালনে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো কঠোর হতে হবে। তা না হলে ঋণের
সুদহার কমবে না, বরং দিন দিন বাড়বে।
No comments