কোন পরিণতির দিকে ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’?
বাণিজ্য
যুদ্ধ যেন বাধিয়েই ছাড়বেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
একের পর এক শুল্ক বসানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি। এর আগে কোনো মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো এমন রক্ষণশীল সিদ্ধান্ত নেননি। গত বৃহস্পতিবার
ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর যথাক্রমে ২৫ ও ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের
সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্প। চলতি সপ্তাহেই এই সিদ্ধান্ত পাস হবে। এরপর আবার
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে গাড়ি আমদানির ওপর শুল্ক বসানোর হুঁশিয়ারি দিলেন
তিনি। গতকাল রোববার বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
ট্রাম্পের মতে, অন্য দেশগুলো বছরের পর বছর ‘স্টুপিড’ বাণিজ্য চুক্তির
সুবিধা নিচ্ছে। অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিলের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণার
পর ইইউ জানায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ
করবে তারা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি
করে ইইউ। ইইউয়ের এমন জবাবে আবার গাড়ির ওপর শুল্ক বসানোর হুমকি দিলেন
ট্রাম্প। এর আগে গত শুক্রবার এক টুইটে ট্রাম্প বললেন, বাণিজ্য যুদ্ধ ‘ভালো’
এবং ‘সহজেই জেতা যায়’।
অর্থাৎ, সমালোচনায় জর্জরিত হয়ে এক যুদ্ধে সহজে
জেতার বাসনা জেগেছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মনে। ট্রাম্পের বক্তব্য হলো, যখন
একটি দেশ (যুক্তরাষ্ট্র) প্রায় প্রতিটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে অনেক বিলিয়ন
ডলার হারিয়েও ব্যবসা করে, তখন বাণিজ্য যুদ্ধ ভালো এবং জয় সহজ। আমেরিকার
জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই এই শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
তবে মজার বিষয় হলো, শুরুটা চীনকে বিপাকে ফেলার জন্য হলেও এই যুদ্ধ হতাশ
করছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেরই। এটা সত্যি যে বিশ্ববাজারে প্রায় ৫০ শতাংশ
স্টিলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চীন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মোট স্টিল আমদানির
১ শতাংশ আসে চীন থাকে। বরং বড় অংশ আসে কানাডা ও ব্রাজিল থেকে। কানাডা থেকে
আমদানির পরিমাণ ১৬ শতাংশ এবং ব্রাজিলের ১৩ শতাংশ। যেখানে কানাডা এবং ইইউ
এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রে ৪৫ কোটি ডলারের স্টিল রপ্তানি করে, সেখানে চীন করে
মাত্র ১ কোটি ডলারের। অন্যদিকে, মোটামুটি এই পরিমাণ অর্থের সয়াবিন
যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে চীন। চীন যদি এখন শুল্ক বসায় লোকসান দুজনের
সমানই হবে। এ রকম হুমকি অবশ্য চীন ইতিমধ্যে দিয়েছেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের লোহা ও অ্যালুমিনিয়াম উৎপাদকদের জন্য
সুখবর হলেও অন্য যেসব খাত লোহা ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর নির্ভরশীল, তারা
ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এমনকি যেই কর্মসংস্থানের জন্য ট্রাম্প এ যুদ্ধে
মেতেছেন। সেই কর্মসংস্থানের হারও পড়বে ঝুঁকির মুখে। ক্ষিপ্ত কানাডাও জবাব
দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড
বলেন, কানাডার স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর এই বিধি আরোপ কি উচিত হয়েছে?
এতে কানাডা তাদের বাণিজ্যের আগ্রহ ও শ্রমিকের সুবিধা ভেবে পাল্টা পরিকল্পনা
নেবে। কানাডা মনে করছে, এসব শুল্ক সীমান্তের উভয় পাশে বাধা সৃষ্টি করবে।
ইইউ বলছে, ট্রাম্প যদি ইট ছোড়ে, তারা পাটকেল ছুড়তে প্রস্তুত। ইউরোপীয়
কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ-ক্লদ ইয়ুংকার বলেছেন, ‘আমেরিকার গৃহীত ব্যবস্থার
ফলে যদি আমাদের শ্রমবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব
না।’ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) ট্রাম্পের এসব হঠকারী সিদ্ধান্তের
পরিণতি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি করেছে। তারা বলছে, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামে
শুল্ক আরোপে অন্যান্য দেশের মতো ক্ষতির মুখে পড়বে যুক্তরাষ্ট্রও। বিশ্ব
বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ডিরেক্টর জেনারেল রবার্তো আজেভেদো বলেছেন,
বাণিজ্যে যুদ্ধে কারও আগ্রহ নেই। তাহলে কেন এই বাণিজ্য যুদ্ধে নামলেন
ট্রাম্প? এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে একটা বিশ্লেষণ দেওয়া যেতে পারে।
২০২০
সালে দ্বিতীয় মেয়াদের দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়ে এখনই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে
ট্রাম্পের মনে। এমনকি নির্বাচনী প্রচারণাও অন্য যেকোনো প্রেসিডেন্টের চেয়ে
তাড়াতাড়ি শুরু করেছেন তিনি। নারীঘটিত বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে ইমেজ সংকটে
ভুগছেন ট্রাম্প। এমন অবস্থায় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে মানুষের আস্থা
অর্জন করতে চাইছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে অন্যতম স্টিল উৎপাদনকারী
অঙ্গরাজ্যগুলো হলো মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, ইলিনয়, অ্যালাবামা, ওহাইও।
নির্বাচনে যেসব অঙ্গরাজ্য একেকবার একেক দলের দিকে ঝোঁকে, সেগুলোকে বলা হয়
সুইং স্টেট বা দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য। এসব রাজ্যে জিতলেই নির্বাচন জেতা হয়ে
যায়। স্টিল উৎপাদনকারী এই অঙ্গরাজ্যগুলোর বেশির ভাগই সুইং স্টেট। গত
নির্বাচনে জিততে বেশি সুইং স্টেট জিতেছিলেন ট্রাম্প। তাই এই অঙ্গরাজ্যগুলো
ভোট খুবই প্রয়োজন ট্রাম্পের জন্য। তবে এই পরিণতির বিষয়ে বাণিজ্য
বিশ্লেষকেরা কী বলছেন? ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিশ্লেষক
ব্যারি আইচেনগ্রিন ও ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডগলাস আরউইন বলেন, আগের
বাণিজ্য যুদ্ধের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এটা একেবারেই সঠিক
সিদ্ধান্ত নয়। গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় শুল্কের প্রভাব খুব বাজেভাবে পড়েছিল।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ১৯৩০-এর দশকে মহামন্দার মূল কারণ ছিল বাণিজ্য
সুরক্ষা নীতি। অর্থনীতিবিদেরা সাধারণত কোনো বিষয়ে একমত হতে না পারলেও এ
ব্যাপারে একমত যে বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ জিততে পারে না।
No comments