চার হাজার কোটি টাকার ফ্লাইওভার কার স্বার্থে?
গণপরিবহন
চলাচল না করলেও ২২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চট্টগ্রাম মহানগরীতে তিনটি
ফ্লাইওভার খুলে দেয়া হয়েছে আগেই। প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও একটির
নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। এসব ফ্লাইওভার দিয়ে প্রাইভেট কার ও দূরপাল্লার
ট্রাক-বাস ছাড়া গণপরিবহন বলতে কোনো যান চলাচল না করায় এ নিয়ে নানা কথা চালু
আছে। নগর পরিকল্পনাবিদ থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ সবাই যখন
এসব ফ্লাইওভার নিয়ে সমালোচনায় মুখর, ঠিক তখনই প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা
ব্যয়ে পঞ্চম ফ্লাইওভার নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
(চউক)। বলাবলি হচ্ছে, এত ফ্লাইওভারের পরও চট্টগ্রাম নগরীর যানজট আগের মতোই।
তাহলে জনগণের কষ্টার্জিত করের বিপুল অর্থ ব্যয়ে নতুন ফ্লাইওভার কেন, কার
স্বার্থে? কার্যত ‘অকার্যকর’ এসব ফ্লাইওভার নিয়ে সাধারণ মানুষ,
মন্ত্রী-এমপি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের ক্ষোভ-অসন্তোষের মধ্যেই ৩ হাজার ৮০০
কোটি টাকা ব্যয়ে লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘ আরেকটি
ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে যাচ্ছে চউক। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে
ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল)। এর আগে নগরীর বারিক বিল্ডিং মোড়
থেকে কাটগড় পর্যন্ত দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের
জন্য ডিপিপি প্রেরণ করা হলেও তা ফেরত পাঠানো হয় প্রি-একনেক সভা থেকে।
গত
বছর ডিসেম্বরে এটি ফেরত পাঠানোর পর নতুন করে ডিপিপি তৈরি করে পরিকল্পনা
মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে চউক সূত্র জানিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এভাবে
একের পর এক ‘অকার্যকর’ ফ্লাইওভার কার স্বার্থে! বড় প্রকল্পে বড় ধরনের
‘আর্থিক সুবিধা’ নাকি ‘কমিশন বাণিজ্য’? চট্টগ্রাম-৭ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী)
আসনের সংসদ সদস্য মাঈনুদ্দিন খান বাদল যুগান্তরকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে
উন্নয়নের নামে এসব ফ্লাইওভার বাজে নজির স্থাপন করছে।’ বড় প্রকল্পে বড় ধরনের
আর্থিক সুবিধা নেয়া যায় বলেই হয়তো ফ্লাইওভারেই চউকের ঝোঁক বলে মন্তব্য
করেন তিনি। বাদল আরও বলেন, যেখানে দক্ষিণ চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষের
যাতায়াতের জন্য কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কয়েকশ’ কোটি টাকা জোগাড় করা যায়
না, সেখানে গুটিকয়েক যাত্রী ও যানবাহন চলাচলের জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণে
হাজার হাজার কোটি টাকা কোথা থেকে আসছে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। কিন্তু এসব ব্যাপারে
তাকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
জনগণকে সম্পৃক্ত করার কথা বললেও নগর উন্নয়নের নামে যে হাজার হাজার কোটি
টাকার ফ্লাইওভার হচ্ছে, তা জনগণ দূরে থাক চট্টগ্রামের একজন মন্ত্রী-এমপিও
জানেন না। কেউই এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত নন। তাই লালখান বাজার থেকে
বিমানবন্দর পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের আগে চট্টগ্রামের সব এমপি, নগর
পরিকল্পনাবিদ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করা উচিত। তিনি এ
বিষয়টি দেখার জন্য সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনকে অনুরোধ জানান। পরে এ
প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের
সঙ্গে। রোববার তিনি যুগান্তরকে বলেন, শহরের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ এ
সড়কটির ওপর একাধিক ওভারব্রিজ রয়েছে। ভূগর্ভে বক্সকালভার্ট রয়েছে। কোথাও
কোথাও দুই পাশে পাহাড় রয়েছে।
এসব ধ্বংস করে, পাহাড় কেটে শহরের সৌন্দর্য
নষ্ট করে লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের
চিন্তা করাটাও অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। বরং বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে
কাটগড় পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ করে বাকি সড়ক সম্প্রসারণ ও উন্নত ট্রাফিক
ম্যানেজমেন্টের আওতায় এনে লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়ক
যোগাযোগ কীভাবে উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ব্যাপারে
তিনি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করবেন বলেও জানান। সংশ্লিষ্টরা
বলছেন, লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণ হলে
ঢেকে যাবে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ঢাকা পড়বে রাস্তার দু’পাশের
পাহাড়ের রূপ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাছাড়া দীর্ঘ এ সড়কে রয়েছে দেওয়ান হাট
ব্রিজ। এরপর রয়েছে ফ্লাইওভার, অসংখ্য বক্সকালভার্ট। সড়কের ভূগর্ভে রয়েছে
ওয়াসার পাইপলাইন। বড় ড্রেনেজ ব্যবস্থা। এসব কারণে প্রস্তাবিত এ ফ্লাইওভারের
নির্মাণে খরচ বেড়ে যাবে বহুলাংশে। চট্টগ্রাম শহর হবে ক্ষতবিক্ষত।
বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার কিংবা কদমতলী ফ্লাইওভারের মতো শহরের এ প্রধান ও
গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিও ‘কবরস্থানে’ পরিণত হবে। এর পরিবর্তে বারিক বিল্ডিং মোড়
থেকে কাটগড় পর্যন্ত যেখানে বন্দর ও ইপিজেডকেন্দ্রিক ভয়াবহ যানজট হয় সেখানে
ফ্লাইওভারের চিন্তা করা যায়। পতেঙ্গা বা কাটগড়ের দিকে জায়গা রয়েছে, সেখানে
চার লেনবিশিষ্ট সড়ক করা যায়। আগ্রাবাদ সড়কে রিকশা তুলে দিয়ে, সড়ক
সম্প্রসারণ করে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট উন্নত করে শহরের যানজট নিরসন করা যায়।
এতে খরচ যেমন অর্ধেকে নেমে আসবে, তেমনি নগরীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও ঢাকা
পড়বে না। পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম নেতা ও নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী
সুভাষ বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, যে তিনটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে,
সেগুলো অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কেননা এসব ফ্লাইওভারে গণপরিবহন চলছে না।
ফলে যানজটও আগের মতোই। এরপরও আবার কেন লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর
পর্যন্ত ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণের পথে এগোচ্ছে
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, তা অন্তত আমাদের বোধগম্য নয়। কার স্বার্থে এ
বিশাল প্রকল্প করা হচ্ছে, তা একমাত্র চউকই ভালো বলতে পারবে।
তিনি আক্ষেপ
করে বলেন, “আমরা বহু সভা-সেমিনারে বলেছি, অনেক প্রস্তাবনা দিয়েছি। কিন্তু
চউক তাতে কর্ণপাত করছে না। ফ্লাইওভারের পরিবর্তে চার লেনের সড়ক করা, সেখানে
ডেডিকেটেড বাস লেন করা, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট উন্নত করাসহ কম টাকা খরচ করে
যানজট নিরসনের বহু পন্থা অবলম্বন করা যায়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে চউক
সেদিকে না গিয়ে সেই ‘অকার্যকর’ ফ্লাইওভারেই বেশি মনোযোগী।” চট্টগ্রাম
উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে সর্বপ্রথম কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি
হিসেবে নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও ব্যবসায়ী আবদুচ সালাম নিয়োগ পান।
২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে চেয়ারম্যান হিসেবে
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। চার দফায় চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে তিনি বর্তমান
সরকারের সর্বশেষ দুই মেয়াদ সময়কাল ধরে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োজিত আছেন।
২০১০ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেন চউক
চেয়ারম্যান। সর্বপ্রথম ১৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ১ দশমিক ৪
কিলোমিটার দীর্ঘ বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার। এরপর নির্মাণ করা হয় ২৬ কোটি টাকা
ব্যয়ে দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার। ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় কদমতলী
ফ্লাইওভার। মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ৪৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫
দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের ৮৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। এটি
শিগগিরই খুলে দেয়া হবে। র্যাম্প ও লুপ ছাড়াই এ ফ্লাইওভার খুলে দেয়া হচ্ছে।
এতে করে এটির পরিণতিও বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের মতো হবে বলে জানান
সংশ্লিষ্টরা। সূত্র জানায়, লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ফ্লাইওভার
বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮০০
কোটি টাকা। ১৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১৬ দশমিক ৫ মিটার
প্রস্থবিশিষ্ট এ ফ্লাইওভারে থাকবে ২৪টি র্যাম্প। একটি জরিপের বরাত দিয়ে
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম বলছে, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক
বিমানবন্দরে ঘণ্টায় ৮ জন যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। ২৪ ঘণ্টায় যানবাহন চলাচল
করে দুই থেকে আড়াই হাজার। এ পরিমাণ যাত্রী ও গাড়ির জন্য হাজার হাজার কোটি
টাকা ব্যয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণের সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে
আসা উচিত চউকের। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের
(চুয়েট) ভিসি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম যুগান্তরকে বলেন,
চট্টগ্রামের মানুষ যানজটে অতিষ্ঠ। এ যানজট নিরসনে এরই মধ্যে তিনটি
ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
তাই নতুন করে দীর্ঘ
আরেকটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করার আগে চউকের উচিত এ বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের
সঙ্গে কথা বলা। সুধীজনদের সঙ্গে বৈঠক করা। নগরবাসীর মতামত নেয়া। এ
প্রসঙ্গে চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের
মতামত নিয়ে আগামী ১০০ বছরের কথা চিন্তা করেই চট্টগ্রাম মহানগরীতে
ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। যারা এর বিরোধিতা করছে তারা না বুঝে করছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এয়ারপোর্টে যাতায়াতের জন্য তিন-চার ধরনের যোগাযোগ
ব্যবস্থা রয়েছে। যে চট্টগ্রামকে নিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেই চট্টগ্রামের
এয়ারপোর্টে যাওয়ার বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। খুলে দেয়া তিন ফ্লাইওভার
অকার্যকর হওয়ার পরও গুটিকয়েক যাত্রী কিংবা গাড়ি চলাচলের জন্য ৩ হাজার ৮০০
কোটি টাকার প্রকল্প কেন? বিভিন্ন মহলের এমন প্রশ্নের জবাবে চউক চেয়ারম্যান
বলেন, ‘অকার্যকর’ বলতে কোনো শব্দ নেই। ভিআইপি, ভিভিআইপি, সিআইপির ক্যাটাগরি
কেন করা হয়েছে। শিল্পকারখানার মালিক যারা লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের
ব্যবস্থা করছেন, সেই গুটিকয়েক মানুষের জন্য ৩ হাজার ৮০০ কোটি কেন, ৫ হাজার
কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও সমস্যা নেই। তাছাড়া এমন প্রকল্প
বাস্তবায়নের আগে মন্ত্রী-এমপি কিংবা জনগণের সঙ্গে কথা বলা বা তাদের জানিয়ে
করতে হবে- এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বলেও জানান তিনি। চট্টগ্রাম মহানগর
আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীও এ
ফ্লাইওভারের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর
পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের কোনো প্রয়োজন নেই।
No comments