জাতিসংঘে রোহিঙ্গা নিপীড়নের মর্মস্পর্শী বর্ণনা ইয়াংঘি লির
মিয়ানমারে
রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নিপীড়নসহ দেশটিতে মানবাধিকার লংঘনের বিস্তারিত
তুলে ধরে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে সোমবার একটি প্রতিবেদন
উপস্থাপন করেছেন জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংঘি লি।
প্রতিবেদনে লি বলেন, ‘তাদের কাছ থেকে (নির্যাতনের) ভয়াবহ বর্ণনা শুনেছি। এর
মধ্যে রয়েছে ‘গলা কেটে হত্যা, নির্বিচারে গুলি, ঘরের ভেতর লোকজনকে বন্দি
করে আগুন দিয়ে শিশুহত্যা, গণধর্ষণ এবং অন্যান্য যৌন নিপীড়ন।’ লি বলেন, ‘এসব
ঘটনার বর্ণনার সময় লোকজন আমার সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়ে।’ মিয়ানমারের
মানবাধিকার পরিস্থিতি জানতে লি গত বছরের জুনে এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে
দেশটি সফর করেন। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে জানতে ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলাদেশ
সফর করেন। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল দক্ষিণ কোরিয়ার অধ্যাপক ইয়াংঘি লিকে
২০১৪ সালে সাবেক জান্তা শাসিত মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক বিশেষ
র্যাপোর্টিয়ার নিযুক্ত করে। গত বছরের ৯ অক্টোবর সীমান্ত চৌকিতে হামলায়
মিয়ানমারের ৯ ‘বর্ডার গার্ড পুলিশ’ (বিজিপি) নিহত হন। এর জেরে মিয়ানমারের
সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলমান অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে নিপীড়ন
চালায়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওই অভিযানে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা,
তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হয়। এ সময় প্রায়
৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। লির
প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনটি রোহিঙ্গাদের
বিরুদ্ধে ‘সুস্পস্টভাবে বৈষম্যমূলক’। বর্তমানে নাগরিকত্বের জন্য যে
যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় তার লক্ষ্য মূলত রোহিঙ্গারা। এ
প্রক্রিয়া অনুসরণ না করলে তাদের মাছ ধরার লাইসেন্স দেয়া, কোনো আন্তর্জাতিক
সংস্থায় দেশীয় স্টাফ হিসেবে কাজ করার অনুমতি দেয়া, ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায়
অংশ নেয়ার সুযোগ কিংবা খাদ্য সাহায্যও দেয়া হয় না।
তবে লি বলেন,
মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো শুধু রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইনেই ঘটছে না,
কোচিন ও শান রাজ্যেও ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লংঘন করা হচ্ছে। আর এ নিয়ে যাতে
কেউ মুখ খুলতে না পারে সেজন্য মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের ওপর
নজরদারি, তাদের হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়। ভিন্নমত দমনের জন্য ফৌজদারি
আইনের ৫০৫ ধারা এবং টেলিযোগাযোগ আইনের ৬৬ (ডি) ধারা প্রয়োগ করে গ্রেফতার ও
কারাবন্দি করা হয়। সুশীল সমাজের সদস্যদের হত্যা করার বহু ঘটনাও ঘটেছে। এ
ধরনের অভিযোগের কোনো বিচার হয় না। লি জানান, মিয়ানমার সফরকালে তাকে পদে পদে
বাধা দিয়েছে সরকার। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে তিনি কক্সবাজারে ১৪০
রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন, যারা সম্প্রতি রাখাইন থেকে পালিয়ে এসে এখানে
আশ্রয় নিয়েছে। তিনি বলেন, ঘটনার তদন্তে মিয়ানমার সরকার কয়েকটি কমিশন গঠন
করলেও তা স্বাধীন নয়। কোনো কোনো কমিটিতে সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারাও রয়েছেন,
যদিও মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেই বেশি। লি বলেন, আমি
মিয়ানমারের বন্ধু হিসেবে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করছি। যদিও মিয়ানমার আমাকে
পক্ষপাতদুষ্ট বলে মন্তব্য করেছে। কিন্তু আমি চাই মিয়ানমারে যা ঘটছে সেই
সত্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানুক। লি বলেন, এজন্য নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে
উঠে সব দেশকে মিয়ানমারের ব্যাপারে এক সুরে কথা বলতে হবে। এ ব্যাপারে একটি
তদন্ত কমিশন গঠনেরও আহ্বান জানান তিনি।
No comments