‘আমি মুজাহিদ বিয়ে করবো’ by ওয়েছ খছরু
একুশে
পা দেয়া তরুণী রাজিয়াকে তার ভাবী প্রশ্ন করলেন- ‘বিয়ে করছো না কেন?
পছন্দের কেউ আছে নাকি।’ কথা শুনে অনেকটা রেগে ওঠে রাজিয়া। বলে, ‘আমি
মুজাহিদ বিয়ে করবো। আর কাউকে নয়।’ কথা শুনে চমকে ওঠেন পাশে থাকা পরিবারের
সদস্যরা। এ কেমন উত্তর রাজিয়ার, টেনশনে পড়েন সবাই। এমন সময় চাচা আবদুল লতিফ
বসা ছিলেন পাশের ঘরে। রাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘দেশের কোন গরিব মেধাবী
ছেলেকে বিয়ে করে লন্ডনে নিয়ে যাও। তাহলে দোয়া পাবে। সওয়াবও হবে। ওসব কথা
আর বইলো না।’ কিন্তু রাজিয়ার টার্গেট একটাই। সে আইএসের সামরিক ময়দানে যাবে।
সেখানেই সে লড়াই করবে। জেদ ধরেছিল এক বছর আগেই। আর এই জেদ থেকেই পরিবারের
আরও ১১ সদস্যকে নিয়ে উধাও রাজিয়া। তাদের সর্বশেষ অবস্থান তুরস্ক বলে জানা
গিয়েছিল। ওই সময় আবদুল মান্নানের স্ত্রী মিনারা খাতুন দেশে থাকা স্বজনদের
ফোনে জানান, তারা ভাল আছেন, সুস্থ আছেন। তবে, তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন।
এ সময় দেশে থাকা স্বজনরা তাদের বারবার ফিরে আসার অনুরোধ জানান। তারা বলেন,
‘বৃটেনে যেতে না পারলে সমস্যা নেই, তোমরা দেশে ফিরে আসো। তবুও ওদিকে যেও
না। ছোট্ট বাচ্চা, বৃদ্ধ মানুষটিকে নিয়ে নিরাপদে আস।’ কিন্তু তাদের আকুতি
কারও কানে যায়নি। পরিবারের সদস্যরা জানান, ১২ সদস্যদের পরিবারের মধ্যে
আইএসের প্রতি সবচেয়ে দুর্বল ছিল একুশে পা দেয়া রাজিয়া খানম। সহকর্মী,
সহপাঠীদের দ্বারা সেই আইএসে যোগ দেয়ার প্রেরণা পায়। শুরুটা দুই বছর আগে।
বেশ ধার্মিক পরিবার আবদুল মান্নানের। বৃটেনের লুটন শহরে বসবাস করলেও তারা ৫
ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। পর্দা মতো চলাচল করেন পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু
রাজিয়া বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পরিবারের গতিরও পরিবর্তন হয়ে যায়। গত
দেড় বছর এ নিয়ে রাজিয়ার সঙ্গে দফায় দফায় দ্বন্দ্ব চলেছে পরিবারের। রাজিয়াকে
ফেরাতে চেষ্টার কমতি ছিল না। কিন্তু ফিরলো না রাজিয়া। শেষ মুহূর্তে
রাজিয়ার ফাঁদে পা দিয়েই তিন শিশুসহ নিখোঁজ হয়ে গেলেন পরিবারের সদস্যরা। বছর
খানেক আগে রাজিয়ার আচরণ ও গতিবিধি সন্দেহের চোখে দেখে বৃটিশ পুলিশ। সেই
থেকে রাজিয়ার ওপর নজরদারি শুরু হয়। ওই সময় বৃটেন পুলিশ একবার রাজিয়াদের
লুটন শহরের বেডফোর্ডশায়ারের বাসায় তল্লাশি চালায়। সেই সময় থেকে রাজিয়ার
কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে শুরু করেন পরিবারের সদস্যরা। এ কারণে গত এক বছর
ধরে তারা রাজিয়াকে ফেরাতে ব্যর্থ হন। তাকে ভালভাবে সঠিক পথের দায়িত্ব
নিয়েছিলেন মা মিনারা খাতুন ও ভাই জায়েদ হুসাইন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারাও
পরাজিত হন রাজিয়ার কাছে। এ কারণে ৯ই এপ্রিল যখন দেশের আসার জন্য বৃটেনের
বিমানবন্দরে যান আবদুল মান্নানসহ পরিবারের সদস্যরা তখনই বৃটেন পুলিশ তাদের
সন্দেহ করে। এ সময় তারা ১২ জনকেই আটক করে একটি হোটেলে নিয়ে যায়। আর ওই সময়
বাসায় চালায় তল্লাশি অভিযান। প্রায় তিন দিন হোটেলে রাখার পর পুলিশ তাদের
তুর্কি হয়ে দেশে আসার সুযোগ দেয়। বৃটেন পুলিশ থেকে ছাড়া পেয়ে দেশেই
এসেছিলেন রাজিয়া ও পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু ১৪ই মে তারা বৃটেনের হিথ্রোতে
গিয়ে পৌঁছার কথা ছিল। ১১ই মে ঢাকা থেকে উড়াল দেয়ার পর তাদের আর কোন খোঁজ
মিলেনি। বিষয়টি লন্ডন পুলিশকে জানানোর পর পুলিশ তদন্ত শুরু করে। আবদুল
মান্নানের ভাই সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে অবস্থানকারী আবদুল লতিফ গতকাল সকালে
মানবজমিকে জানিয়েছেন, ভাতিজি রাজিয়ার কারণে এমন হয়েছে। রাজিয়াকে ফেরাতে
বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যরা এ নিয়ে চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার
পর কেউ কেউ নিজে নিজেও তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারেন। তিনি বলেন, ১২ জন
সদস্যর কোন ফোন নেই আজ প্রায় ২০ দিন। তারা কেমন আছে, কিভাবে আছে সেটি জানে
না কেউ। তিনি আরও বলেন, রাজিয়ার বয়স এখন ২১ বছর। এবার দেশে আসার পর তার
বিয়ের জন্য চাপাচাপি শুরু করি। এ সময় তার চাচাত ভাইয়ের স্ত্রী বিয়ে বিষয়ে
জিজ্ঞেস করলে বলতো, সে মুজাহিদ বিয়ে করবে। তাকে আমরা বারবার বুঝানোর চেষ্টা
করেছি। কিন্তু বুঝেনি। নিখোঁজ আবদুল মান্নানের ছোট্ট ভাই লাভলু মিয়া
জানিয়েছেন, দেশে আসার পর রাজিয়া খুব পর্দানশীন থাকত। ঘরের ভেতরেও রাজিয়া ও
তার মা বোরকা পড়ে থাকতো। সব সময় তারা হাত ও পায়ে মোজা ব্যবহার করতো। এছাড়া
পরিবারের অন্য সদস্যরা স্বাভাবিক ছিলেন বলে জানান। আবদুল লফিত ও লাভলু মিয়া
জানান, তাদের ভাই আবদুল মান্নান ১৯৬২ সালের দিকে বৃটেনে যান। এরপর থেকে
তিনি লন্ডন প্রবাসী। দুই-তিন বছর পরপর দেশে আসেন। স্বজনদের সঙ্গে এক মাস
সময় কাটিয়ে ফের চলে যান। এবারও তিনি একইভাবে দেশে এসেছিলেন।
No comments