বিশ্বের একটি বাস-অযোগ্য শহর থেকে বলছি... by আনিসুল হক
আজকাল
এমন হয়েছে, হরতাল বা অবরোধের মধ্যেও যানজট হয়, আর কোনো একটা দিন যদি
রাজনৈতিক কর্মসূচির বাইরে স্বাভাবিক দিন পাওয়া যায়, তাহলে সেই দিনে
রাস্তাঘাটের হাল হয়ে ওঠে ভয়াবহ। ঢাকা শহরে ভীষণ যানজট লেগে যায়। ঢাকার
বাইরেও অনেক শহরে যানজট এখন বড় সমস্যা। আর মহাসড়কগুলোতেও লেগে যায়
মাইলের পর মাইল যানজট। কয়েক দিন পরেই ঈদ উপলক্ষে লোকে ছুটবে যার যার
বাড়িতে, মহাসড়কগুলোয় তাদের আট ঘণ্টার পথে আটকে থাকতে হতে পারে দেড় দিন
পর্যন্ত।
এখন ঢাকার যা অবস্থা, এটা একেবারে গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, স্বাভাবিক দিনে যানজট হবে অস্বাভাবিক রকম। একটা কারণ সবাই জানি, আমাদের রাস্তার পরিমাণ ৮ ভাগ, এটা হওয়া উচিত ২৫ ভাগ। কিন্তু উন্নত দেশে, যেখানে রাস্তার পরিমাণ বেশি, সেখানে কি যানজট বাধে না? নিউইয়র্কে খুব যানজট হয়!
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহপাঠী ছিলেন সুকমল মোদক। সিভিল ডিপার্টমেন্টে আমাদের ক্লাসে তিনি ছিলেন ফার্স্টবয়। এখন সান ফ্রান্সিসকো এলাকায় থাকেন। বছর কয়েক আগে আমি সান ফ্রান্সিসকো গেলে তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যাবেন। আমাকে বললেন, তুমি কি ট্রেনে করে অমুক স্টেশন পর্যন্ত আসতে পারবে? আমি তা-ই করলাম। তারপর তাঁর গাড়িতে উঠে তাঁর বাড়িতে গেলাম। ড. মোদক (http://www.bdiusa.org/sukomal-modak-ph-d) বললেন, এই যে তুমি ট্রেনে এলে, এর বদলে ধরো তুমি একটা গাড়িতেই তোমার হোটেল থেকে রওনা হলে, তাহলে তোমার অন্তত এক-দেড় ঘণ্টা বেশি সময় লাগত, কারণ এই সময়টায় ভীষণ যানজট হয়! এরপর সুকমল মোদক আমাকে যে কথাটা বলেছেন, অত্যন্ত মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত এই প্র্যাকটিসিং ইঞ্জিনিয়ারের কথাকে আমি মূল্যবান বলে মনে করি—রাস্তার পরিমাণ তুমি যতই বাড়াও না কেন, গাড়ির পরিমাণ তার চেয়ে বেশি হবে। কাজেই সড়কপথে যানজট হবেই।
আসলেই তো। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত উন্নততর হচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হতে চায়। এই অবস্থায় কয়েক লাখ টাকা হলেই আমরা যা করি, একটা গাড়ি কিনে ফেলি। না কিনে উপায়ও নেই, কারণ আমাদের দেশে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে প্রায় কিছুই নেই। আমাদের নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত ক্যাটাগরিতে ওঠার প্রতীক হলো একটা গাড়ি থাকা। রাস্তা নেই। কিন্তু গাড়ি আছে। ঢাকার রাস্তায় আছে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। গাড়ি আছে, কিন্তু নেই কোনো পরিকল্পনা, নেই পরিকল্পনার সমন্বয়। আপনি কারওয়ান বাজারের ভেতরের রাস্তাগুলো দেখুন, প্রশস্ত পথ, কিন্তু দুই পাশে তার অর্ধেকটা দখল করে রেখেছে নানা ধরনের দোকান, তার পরের অংশটা ব্যবহার করা হচ্ছে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য, ৮০ ফুট রাস্তার ৬০ ফুট বেদখল, আর কুড়ি ফুটে কোনোরকমে দুটো গাড়ি চলাচলের চেষ্টা করছে, তার মধ্যে দুটো দাঁড়িয়ে পড়েছে পার্কিং না পেয়ে, কাজেই বসে থাকতে হচ্ছে। রাস্তা অচল হয়ে পড়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আগে ঢাকার কোনো কোনো রাস্তায় রিকশা চলাচল নিষেধ ছিল, অবরোধের পর ওই নিষেধাজ্ঞা আর কেউ মানে না। একই রাস্তায় নানা গতির যান। হাঁটারও জায়গা নেই, কারণ সবগুলো ফুটপাত বেদখল। আর আছে সমন্বয়হীনতা। একটা মাস্টারপ্ল্যান আছে, ঢাকা মহানগরের যোগাযোগ নিয়ে, কিন্তু যখন কোনো প্রকল্প করা হয়, সেই মাস্টারপ্ল্যান মাথায় রাখা হয় না, ইচ্ছেমতো ফুটওভার ব্রিজ, ইচ্ছেমতো ফ্লাইওভার করা হচ্ছে। র্যাংগস ভবন ভেঙে বানানো নতুন রাস্তাটা বিজয় সরণির মোড়ে যানজট বাড়িয়েছে। খেয়ালখুশিমতো নতুন রাস্তা বা ফ্লাইওভার বানালেই সমস্যার সমাধান হবে না। একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা ধরে এগোতে হবে, যে কাজটা বিদেশি তহবিল খরচ করে সুন্দর করে তৈরি করা আছে। আবার সেটা নিয়ে বসলে বিশেষজ্ঞরা ঢাকার যানজট সমস্যা সমাধানের একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা হালনাগাদ করে দিতেও পারবেন।
ঢাকার একটা বড় সমস্যা—অতিরিক্ত জনসংখ্যা। সবকিছু এখন ঢাকামুখী। ঢাকার বাইরে থাকলে নাকি ছেলেপুলেদের লেখাপড়া হয় না। বলি, আমরা ঢাকার বাইরে পড়াশোনা করিনি? আমরা কি মানুষ হইনি? উপজেলা শহর, জেলা শহর আর বিভাগীয় শহরগুলোকে স্বাবলম্বী করারও একটা মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোনো দরকার, দরকার ঢাকামুখী জনস্রোত বন্ধ করার। দিনাজপুরের আশপাশে দেখলাম অনেকগুলো বোর্ডিং স্কুল হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগেই। আমাদের রাজশাহী কিংবা রংপুর হোক না শিক্ষার শহর, সিরাজগঞ্জ কিংবা ময়মনসিংহ বিখ্যাত হোক না চিকিৎসার জন্য!
আর যা-ই করি না কেন, বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থা হতে হবে নৌপথ ও রেলপথনির্ভর। আমাদের আরেক বন্ধু স্থপতি ইকবাল হাবিব অবশ্য খুব জোর দেন ঢাকার রাস্তায় হাঁটার সুবিধা করে দেওয়ার ওপরে। তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ রেলও এই শহরের যোগাযোগ স্বাভাবিক ও সুন্দর করতে পারবে না, কারণ এখনো বেশির ভাগ মানুষ হেঁটে চলাচল করে এবং তাদের ভূগর্ভস্থ রেলের টিকিট কেনার সামর্থ্য থাকবে না। আর আমার দুটো চিন্তা আছে, ঢাকা শহরে প্রায় চার লাখ রিকশা চলে, আর গত বছর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে সংখ্যাটা বলা হচ্ছে আড়াই লাখ, যার বেশি ভাগ অনুমোদনহীন। মানুষ রিকশা টানে, এটাকে আমার অমানবিক বলে মনে হয়, কাজেই আমাদের একটা গবেষণা হওয়া উচিত বিদ্যুৎ–চালিত ছোট যানবাহন প্রবর্তনের, যার গতি থাকবে ভালো, যা হবে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। এটা প্রবর্তন করে রিকশা ঢাকা শহর থেকে তুলে দিতে হবে, আজ হোক, কাল হোক। ঢাকা শহরে চার লাখ রিকশা চালান আট লাখ রিকশাওয়ালা। দ্বিতীয় চিন্তা হলো ঢাকা শহরের তৈরি পোশাকের কারখানাগুলোকে একটা মেয়াদের পরে সরিয়ে দেওয়া। আমাদের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক আসে বিদেশ থেকে, তৈরি হয়ে পোশাক যায় বিদেশে, কিন্তু কারখানাগুলো কেন ঢাকায়, তার উত্তর আমার জানা নেই। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের কাছাকাছি বড় গার্মেন্টস জোন করে দেওয়া যায় নাকি? এই দুটো জিনিস করা গেলে ঢাকা শহর থেকে মানুষের চাপও কমবে অনেকটাই।
আমাদের রাস্তা বাড়াতে হবে, ফুটপাত বাড়াতে হবে, ফ্লাইওভার বানাতে হবে, কিন্তু আমরা যত রাস্তাই বানাই না কেন, গাড়ির সংখ্যা রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হবেই, কাজেই আমাদের যোগাযোগব্যবস্থাটা নৌপথ ও রেলপথভিত্তিক করতেই হবে। আর তা নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান ধরে নতুন করে এগোনোর সময় এখনই।
আমার গত সপ্তাহের গদ্যকার্টুনে ঢাকার যানজট আর জলজট নিয়ে খানিকটা কাব্যিপনা করেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন থেকে শ্রদ্ধেয় প্রকৌশলী ও সংবাদপাঠক সিরাজুল মজিদ মামুন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি আপনার লেখার সাহিত্যগুণ নিয়ে কথা বলব না। আমি হিউস্টনে এসেছি ফুসফুসের চিকিৎসা নিতে আর এসে আটকে পড়েছি। দুই সপ্তাহ আগে চার ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, যানবাহন জলমগ্ন হয়ে পড়ে, চার ঘণ্টা লেগেছিল সেই পানি নেমে যেতে।
‘তারও দুই সপ্তাহ আগে নুরুল আলম চৌধুরী নামের একজন প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ থেকে ফিরছিলেন গাড়ি নিয়ে। হঠাৎ আসা বৃষ্টির ঢলে তার গাড়ি ভেসে যায় এবং তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের নিষ্কাশনব্যবস্থা খারাপ। তবে হিউস্টনের মতো খারাপ নয়।’
একটুখানি বৃষ্টি হলেই ঢাকা বা চট্টগ্রামের রাস্তা যে জলমগ্ন হয়, তার অনেক কারণ আছে। আমরা সব নিচু জায়গা ভরাট করেছি। মিরপুরের রূপনগরে প্রশিকা ভবনের পেছন দিকে একটা বিল ছিল চার বছর আগেও, জল টলমল করত, এখন সেটার পুরোটাই দখল করে বাঁশের ঘরবাড়ি বানানো হয়েছে, তারপর বড় রাস্তা থেকে দেয়াল তুলে সেসব জায়গায় হচ্ছে বহুতল ভবন, এটা আমি নিজের চোখে দেখছি, অথচ আমাদের আইন আছে জলাধার ভরাট করা যাবে না। নগরে জলাবদ্ধতার আরেকটা কারণ আমরা বড় বেশি রাস্তায় ময়লা ফেলি এবং পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার। এসব না হলে সাধারণ বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমার কথা নয়, বেশি বৃষ্টি হলে আধঘণ্টা-এক ঘণ্টার মধ্যেই পানি নেমে যাওয়ার কথা, অনেক জায়গায় যায়ও।
আমাদের সহপাঠী সুকমল মোদকের আরেকটা পর্যবেক্ষণ ও উদ্বেগের কথা আপনাদের জানিয়ে রাখি। বাংলাদেশের মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত হচ্ছে, হলেই তারা তাদের টিনের ঘরটাকে ইটের ঘর বানাতে চাইবে, খুব স্বাভাবিক। মধ্য আয়ের দেশের মানুষের সবার বাড়ি যদি ইটের হয়, তাহলে বাংলাদেশের সব মাটি পুড়িয়ে ইট বানাতে হবে, দেশের পরিবেশের তাহলে বারোটা বেজে যাবেই। ড. মোদক তাই গবেষণা করছেন, ইটের বিকল্প গৃহনির্মাণসামগ্রী কী হতে পারে।
অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো সমস্যা আসবে, নদীদূষণ, বন ধ্বংস, কৃষিজমি ধ্বংস, জলাভূমি ভরাট—যে দেশ চলে লুণ্ঠনতন্ত্র দিয়ে, সে দেশে এগুলো অনেক বড় সমস্যাই বাধাবে। এমনিতেই ঢাকা পৃথিবীর বসবাস-অযোগ্য শহরের তালিকায় এক–দুই নম্বরে ওঠানামা করছে কয়েক বছর ধরে। সেখান থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আর একমুহূর্ত দেরি না করে সমন্বিত সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে, প্রতিটা সমস্যারই কারিগরি সমাধান আছে, দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দূরদর্শিতা। ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বাস-অযোগ্য শহর হতে পারে, কিন্তু এত সুন্দর দেশ, এত ভালো মানুষের দেশ আমরা আর কোথায় পাব? এই দেশে জন্মেছি, এই দেশেই মরতে চাই, মরার আগে এই দেশটাকে সুন্দর দেখতে চাই, সুন্দর করে গড়ে তুলতে অবদান রাখতে চাই, আমরা সবাই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
এখন ঢাকার যা অবস্থা, এটা একেবারে গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, স্বাভাবিক দিনে যানজট হবে অস্বাভাবিক রকম। একটা কারণ সবাই জানি, আমাদের রাস্তার পরিমাণ ৮ ভাগ, এটা হওয়া উচিত ২৫ ভাগ। কিন্তু উন্নত দেশে, যেখানে রাস্তার পরিমাণ বেশি, সেখানে কি যানজট বাধে না? নিউইয়র্কে খুব যানজট হয়!
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহপাঠী ছিলেন সুকমল মোদক। সিভিল ডিপার্টমেন্টে আমাদের ক্লাসে তিনি ছিলেন ফার্স্টবয়। এখন সান ফ্রান্সিসকো এলাকায় থাকেন। বছর কয়েক আগে আমি সান ফ্রান্সিসকো গেলে তিনি আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যাবেন। আমাকে বললেন, তুমি কি ট্রেনে করে অমুক স্টেশন পর্যন্ত আসতে পারবে? আমি তা-ই করলাম। তারপর তাঁর গাড়িতে উঠে তাঁর বাড়িতে গেলাম। ড. মোদক (http://www.bdiusa.org/sukomal-modak-ph-d) বললেন, এই যে তুমি ট্রেনে এলে, এর বদলে ধরো তুমি একটা গাড়িতেই তোমার হোটেল থেকে রওনা হলে, তাহলে তোমার অন্তত এক-দেড় ঘণ্টা বেশি সময় লাগত, কারণ এই সময়টায় ভীষণ যানজট হয়! এরপর সুকমল মোদক আমাকে যে কথাটা বলেছেন, অত্যন্ত মেধাবী ও উচ্চশিক্ষিত এই প্র্যাকটিসিং ইঞ্জিনিয়ারের কথাকে আমি মূল্যবান বলে মনে করি—রাস্তার পরিমাণ তুমি যতই বাড়াও না কেন, গাড়ির পরিমাণ তার চেয়ে বেশি হবে। কাজেই সড়কপথে যানজট হবেই।
আসলেই তো। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত উন্নততর হচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হতে চায়। এই অবস্থায় কয়েক লাখ টাকা হলেই আমরা যা করি, একটা গাড়ি কিনে ফেলি। না কিনে উপায়ও নেই, কারণ আমাদের দেশে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলতে প্রায় কিছুই নেই। আমাদের নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত ক্যাটাগরিতে ওঠার প্রতীক হলো একটা গাড়ি থাকা। রাস্তা নেই। কিন্তু গাড়ি আছে। ঢাকার রাস্তায় আছে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। গাড়ি আছে, কিন্তু নেই কোনো পরিকল্পনা, নেই পরিকল্পনার সমন্বয়। আপনি কারওয়ান বাজারের ভেতরের রাস্তাগুলো দেখুন, প্রশস্ত পথ, কিন্তু দুই পাশে তার অর্ধেকটা দখল করে রেখেছে নানা ধরনের দোকান, তার পরের অংশটা ব্যবহার করা হচ্ছে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য, ৮০ ফুট রাস্তার ৬০ ফুট বেদখল, আর কুড়ি ফুটে কোনোরকমে দুটো গাড়ি চলাচলের চেষ্টা করছে, তার মধ্যে দুটো দাঁড়িয়ে পড়েছে পার্কিং না পেয়ে, কাজেই বসে থাকতে হচ্ছে। রাস্তা অচল হয়ে পড়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আগে ঢাকার কোনো কোনো রাস্তায় রিকশা চলাচল নিষেধ ছিল, অবরোধের পর ওই নিষেধাজ্ঞা আর কেউ মানে না। একই রাস্তায় নানা গতির যান। হাঁটারও জায়গা নেই, কারণ সবগুলো ফুটপাত বেদখল। আর আছে সমন্বয়হীনতা। একটা মাস্টারপ্ল্যান আছে, ঢাকা মহানগরের যোগাযোগ নিয়ে, কিন্তু যখন কোনো প্রকল্প করা হয়, সেই মাস্টারপ্ল্যান মাথায় রাখা হয় না, ইচ্ছেমতো ফুটওভার ব্রিজ, ইচ্ছেমতো ফ্লাইওভার করা হচ্ছে। র্যাংগস ভবন ভেঙে বানানো নতুন রাস্তাটা বিজয় সরণির মোড়ে যানজট বাড়িয়েছে। খেয়ালখুশিমতো নতুন রাস্তা বা ফ্লাইওভার বানালেই সমস্যার সমাধান হবে না। একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা ধরে এগোতে হবে, যে কাজটা বিদেশি তহবিল খরচ করে সুন্দর করে তৈরি করা আছে। আবার সেটা নিয়ে বসলে বিশেষজ্ঞরা ঢাকার যানজট সমস্যা সমাধানের একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা হালনাগাদ করে দিতেও পারবেন।
ঢাকার একটা বড় সমস্যা—অতিরিক্ত জনসংখ্যা। সবকিছু এখন ঢাকামুখী। ঢাকার বাইরে থাকলে নাকি ছেলেপুলেদের লেখাপড়া হয় না। বলি, আমরা ঢাকার বাইরে পড়াশোনা করিনি? আমরা কি মানুষ হইনি? উপজেলা শহর, জেলা শহর আর বিভাগীয় শহরগুলোকে স্বাবলম্বী করারও একটা মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোনো দরকার, দরকার ঢাকামুখী জনস্রোত বন্ধ করার। দিনাজপুরের আশপাশে দেখলাম অনেকগুলো বোর্ডিং স্কুল হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোগেই। আমাদের রাজশাহী কিংবা রংপুর হোক না শিক্ষার শহর, সিরাজগঞ্জ কিংবা ময়মনসিংহ বিখ্যাত হোক না চিকিৎসার জন্য!
আর যা-ই করি না কেন, বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থা হতে হবে নৌপথ ও রেলপথনির্ভর। আমাদের আরেক বন্ধু স্থপতি ইকবাল হাবিব অবশ্য খুব জোর দেন ঢাকার রাস্তায় হাঁটার সুবিধা করে দেওয়ার ওপরে। তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ রেলও এই শহরের যোগাযোগ স্বাভাবিক ও সুন্দর করতে পারবে না, কারণ এখনো বেশির ভাগ মানুষ হেঁটে চলাচল করে এবং তাদের ভূগর্ভস্থ রেলের টিকিট কেনার সামর্থ্য থাকবে না। আর আমার দুটো চিন্তা আছে, ঢাকা শহরে প্রায় চার লাখ রিকশা চলে, আর গত বছর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে সংখ্যাটা বলা হচ্ছে আড়াই লাখ, যার বেশি ভাগ অনুমোদনহীন। মানুষ রিকশা টানে, এটাকে আমার অমানবিক বলে মনে হয়, কাজেই আমাদের একটা গবেষণা হওয়া উচিত বিদ্যুৎ–চালিত ছোট যানবাহন প্রবর্তনের, যার গতি থাকবে ভালো, যা হবে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী। এটা প্রবর্তন করে রিকশা ঢাকা শহর থেকে তুলে দিতে হবে, আজ হোক, কাল হোক। ঢাকা শহরে চার লাখ রিকশা চালান আট লাখ রিকশাওয়ালা। দ্বিতীয় চিন্তা হলো ঢাকা শহরের তৈরি পোশাকের কারখানাগুলোকে একটা মেয়াদের পরে সরিয়ে দেওয়া। আমাদের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক আসে বিদেশ থেকে, তৈরি হয়ে পোশাক যায় বিদেশে, কিন্তু কারখানাগুলো কেন ঢাকায়, তার উত্তর আমার জানা নেই। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের কাছাকাছি বড় গার্মেন্টস জোন করে দেওয়া যায় নাকি? এই দুটো জিনিস করা গেলে ঢাকা শহর থেকে মানুষের চাপও কমবে অনেকটাই।
আমাদের রাস্তা বাড়াতে হবে, ফুটপাত বাড়াতে হবে, ফ্লাইওভার বানাতে হবে, কিন্তু আমরা যত রাস্তাই বানাই না কেন, গাড়ির সংখ্যা রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হবেই, কাজেই আমাদের যোগাযোগব্যবস্থাটা নৌপথ ও রেলপথভিত্তিক করতেই হবে। আর তা নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান ধরে নতুন করে এগোনোর সময় এখনই।
আমার গত সপ্তাহের গদ্যকার্টুনে ঢাকার যানজট আর জলজট নিয়ে খানিকটা কাব্যিপনা করেছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন থেকে শ্রদ্ধেয় প্রকৌশলী ও সংবাদপাঠক সিরাজুল মজিদ মামুন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি আপনার লেখার সাহিত্যগুণ নিয়ে কথা বলব না। আমি হিউস্টনে এসেছি ফুসফুসের চিকিৎসা নিতে আর এসে আটকে পড়েছি। দুই সপ্তাহ আগে চার ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, যানবাহন জলমগ্ন হয়ে পড়ে, চার ঘণ্টা লেগেছিল সেই পানি নেমে যেতে।
‘তারও দুই সপ্তাহ আগে নুরুল আলম চৌধুরী নামের একজন প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ থেকে ফিরছিলেন গাড়ি নিয়ে। হঠাৎ আসা বৃষ্টির ঢলে তার গাড়ি ভেসে যায় এবং তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের নিষ্কাশনব্যবস্থা খারাপ। তবে হিউস্টনের মতো খারাপ নয়।’
একটুখানি বৃষ্টি হলেই ঢাকা বা চট্টগ্রামের রাস্তা যে জলমগ্ন হয়, তার অনেক কারণ আছে। আমরা সব নিচু জায়গা ভরাট করেছি। মিরপুরের রূপনগরে প্রশিকা ভবনের পেছন দিকে একটা বিল ছিল চার বছর আগেও, জল টলমল করত, এখন সেটার পুরোটাই দখল করে বাঁশের ঘরবাড়ি বানানো হয়েছে, তারপর বড় রাস্তা থেকে দেয়াল তুলে সেসব জায়গায় হচ্ছে বহুতল ভবন, এটা আমি নিজের চোখে দেখছি, অথচ আমাদের আইন আছে জলাধার ভরাট করা যাবে না। নগরে জলাবদ্ধতার আরেকটা কারণ আমরা বড় বেশি রাস্তায় ময়লা ফেলি এবং পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার। এসব না হলে সাধারণ বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমার কথা নয়, বেশি বৃষ্টি হলে আধঘণ্টা-এক ঘণ্টার মধ্যেই পানি নেমে যাওয়ার কথা, অনেক জায়গায় যায়ও।
আমাদের সহপাঠী সুকমল মোদকের আরেকটা পর্যবেক্ষণ ও উদ্বেগের কথা আপনাদের জানিয়ে রাখি। বাংলাদেশের মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত হচ্ছে, হলেই তারা তাদের টিনের ঘরটাকে ইটের ঘর বানাতে চাইবে, খুব স্বাভাবিক। মধ্য আয়ের দেশের মানুষের সবার বাড়ি যদি ইটের হয়, তাহলে বাংলাদেশের সব মাটি পুড়িয়ে ইট বানাতে হবে, দেশের পরিবেশের তাহলে বারোটা বেজে যাবেই। ড. মোদক তাই গবেষণা করছেন, ইটের বিকল্প গৃহনির্মাণসামগ্রী কী হতে পারে।
অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো সমস্যা আসবে, নদীদূষণ, বন ধ্বংস, কৃষিজমি ধ্বংস, জলাভূমি ভরাট—যে দেশ চলে লুণ্ঠনতন্ত্র দিয়ে, সে দেশে এগুলো অনেক বড় সমস্যাই বাধাবে। এমনিতেই ঢাকা পৃথিবীর বসবাস-অযোগ্য শহরের তালিকায় এক–দুই নম্বরে ওঠানামা করছে কয়েক বছর ধরে। সেখান থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আর একমুহূর্ত দেরি না করে সমন্বিত সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে, প্রতিটা সমস্যারই কারিগরি সমাধান আছে, দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দূরদর্শিতা। ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বাস-অযোগ্য শহর হতে পারে, কিন্তু এত সুন্দর দেশ, এত ভালো মানুষের দেশ আমরা আর কোথায় পাব? এই দেশে জন্মেছি, এই দেশেই মরতে চাই, মরার আগে এই দেশটাকে সুন্দর দেখতে চাই, সুন্দর করে গড়ে তুলতে অবদান রাখতে চাই, আমরা সবাই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments