কোথায় যায় এত টিকিট? by তারেক মাহমুদ

এই ছবিটা বাংলাদেশ দলের আসল অনুশীলনের নয়।
মুঠোফোন কোম্পানি রবির একটা বিজ্ঞাপনের জন্য
মাশরাফিদের দাঁড়াতে হলো ক্যামেরার সামনে।
কাল মিরপুর স্টেডিয়ামে l প্রথম আলো
হাতে একটা মাত্র টিকিট। কিন্তু গায়ে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক! বাধা দেওয়ার সাধ্য কার? পেছন পেছন আসা শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণী মিলিয়ে সাত-আটজনের দলটা তাই বিনা বাধায় ঢুকে পড়ল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মূল গেট দিয়ে। কেউ আটকাল না, কেউ দেখতে চাইল না টিকিট। আশপাশে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আর ওয়াকিটকি হাতে বিসিবির মৌসুমি নিরাপত্তাকর্মীরা সবকিছু দেখেও যেন উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে আছে।
ঘটনাটা গত পাকিস্তান সিরিজের সময়ের হলেও এ রকম দৃশ্য এখন মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে নিয়মিত। খেলার নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁদের বাইরেও প্রতি ম্যাচেই বিনা টিকিটে ঢুকে পড়ে ও রকম ইউনিফর্মধারী আর তাদের সঙ্গীরা। টিকিট না থাকায় গ্যালারিতে গিয়ে বসেন অন্যের চেয়ারে। চেয়ারের আসল মালিককে বাধ্য হয়েই খেলা দেখতে হয় দাঁড়িয়ে। ইউনিফর্মধারী অনাহূত দর্শক আর তাঁদের আত্মীয়স্বজনের খেলা দেখার জায়গা হয়ে উঠেছে প্রেসবক্সের ছাদও।
ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে কখনোই কম ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাবাহিক সাফল্য আসায় সেটা এখন তুঙ্গে। এরই অনুষঙ্গ—টিকিটের জন্য হাহাকার। আন্তর্জাতিক ম্যাচের টিকিট সাধারণ দর্শক-সমর্থকদের জন্য ক্রমেই হয়ে উঠছে সোনার হরিণ। ২০১১ বিশ্বকাপের আগে স্টেডিয়ামগুলোর গ্যালারিতে চেয়ার বসানো এর একটা বড় কারণ। দেশের সব আন্তর্জাতিক ভেন্যুর দর্শক ধারণক্ষমতাই কমে গেছে ১০-১২ হাজার করে। প্রায় ৩৬ হাজার দর্শকের মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে এখন যেমন বসার জায়গা হয় ২৫ হাজারের কিছু বেশি দর্শকের।
এই টিকিটের ৩০-৩৫ শতাংশ আবার বিসিবিকে বিলি করতে হয় সৌজন্য টিকিট হিসেবে। তাতে সাধারণ দর্শকেরা যেমন খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত হন, বিসিবিও বঞ্চিত হয় মোটা অঙ্কের আয় থেকে। সদ্য শেষ হওয়া ভারত সিরিজে সৌজন্য টিকিট বাদেই টিকিট বিক্রি থেকে প্রায় ২ কোটি টাকার মতো আয় করেছে বিসিবি। সৌজন্য টিকিট না থাকলে অঙ্কটা আরও অনেক বাড়ত।
বিসিবির একটি সূত্রে জানা গেছে, বিনা মূল্যের ‘সৌজন্য’ টিকিটগ্রহীতাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, বিডিআর, সচিবালয়, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, ওয়াসা, ডেসা, ডেসকো, সিটি করপোরেশন, এমনকি সিভিল সার্জনের অফিস পর্যন্ত আছে। এ ছাড়া রীতি অনুযায়ী জাতীয় দলের সাবেক-বর্তমান খেলোয়াড়-অধিনায়ক, ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব, স্পনসর এবং জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থাগুলোও সৌজন্য টিকিট পায়। খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে অবশ্য সংখ্যাটা খুবই নগণ্য—প্রতি ম্যাচে দেওয়া হয় ৩৫০টির মতো টিকিট।
বিভিন্ন ভিআইপি ব্যক্তি ও সংস্থাকে বিনা মূল্যে টিকিট দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বিসিবির টিকিট ও সিটিং কমিটির প্রধান ইসমাইল হায়দার মল্লিক। তবে এতে তিনি অন্যায় কিছু দেখছেন না। ‘শুধু বাংলাদেশেই নয়, আমরা ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মতো দেশেও দেখেছি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টিকিট সৌজন্য হিসেবে দেওয়া হয়। তা ছাড়া আমরা যাদের সৌজন্য টিকিট দিই, তারা সবাই বিসিবির স্টেকহোল্ডার। খেলার সময় তারা আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে। তাদের তো কিছু টিকিট দিতেই হবে’—কাল প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেছেন টিকিট ও সিটিং কমিটির প্রধান।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিবির বেশ কজন পরিচালক বলেছেন, এসব সৌজন্য টিকিট যতটা না সৌজন্যতার খাতিরে দেওয়া হয়, তার চেয়ে বেশি দেওয়া হয় ভয় আর আতঙ্কে। বিনা মূল্যে টিকিট না পেয়ে সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া বা খেলায় সমস্যা সৃষ্টির নজিরও যে আছে! সূত্র জানিয়েছে, সদ্য শেষ হওয়া ভারত সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডের দিন চাহিদা অনুযায়ী টিকিট না পাওয়ার ‘ক্ষোভে’ স্টেডিয়ামের বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ করে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের এক কর্মচারী। পরে তাঁকে পুলিশ দিয়ে ধরে এনে সমস্যার সমাধান করা হয়। অভিযোগ আছে, চাহিদা অনুযায়ী সৌজন্য টিকিট না দেওয়ায় বিসিবির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেক সময় হয়রানির শিকার হতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতেও।
সূত্র জানিয়েছে, সৌজন্য টিকিট দিয়ে বাকি টিকিটের ৪৫ শতাংশ সাধারণ দর্শকদের জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। বাকিটা বিসিবি নিজেরাই বিক্রি করে। টিকিটের এই অংশেও আছে দুটি ভাগ। কিছু টিকিট খেলার দিন স্টেডিয়ামের বাইরের বুথে বিক্রি হয়। আর কিছু বিসিবির হিসাব বিভাগ থেকে সরাসরি কিনে নেন বোর্ড পরিচালক, খেলোয়াড় ও বিসিবি-সংশ্লিষ্ট অন্যরা। কদাচিৎ সুযোগটি উন্মুক্ত থাকে সাংবাদিকদের জন্যও।
অবশ্য ঠিক কী পরিমাণ টিকিট বুথে আর কী পরিমাণ টিকিট হিসাব বিভাগ থেকে বিক্রি হয়, তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। টিকিট ও সিটিং কমিটির প্রধানের দাবি, হিসাব বিভাগ থেকে প্রতি ম্যাচে সাত-আট শ টিকিট বিক্রি হয়। তবে বাস্তবতা উল্টোও হতে পারে। কারণ খেলার দিন সকাল সকালই বুথের টিকিট ‘শেষ’ হয়ে যাওয়ার অভিযোগ অনেক পুরোনো। সরিষায় ভূত থাকার সন্দেহটা বাড়ায় ম্যাচের দিন কালোবাজারিদের ভিড়ে বিসিবির অনেক কর্তাব্যক্তির গাড়িচালক আর কর্মচারীদের উপস্থিতিও।
২৫০০০
মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে দর্শক আসন সংখ্যা ২৫ হাজারের কিছু বেশি
৩০-৩৫%
মোট টিকিটের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বিসিবিকে বিলি করতে হয় সৌজন্য টিকিট হিসেবে
৪৫%
সৌজন্য টিকিটের বাইরে বাকি টিকিটের ৪৫ শতাংশ সাধারণ দর্শকদের জন্য ব্যাংকের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়

No comments

Powered by Blogger.