ভ্রান্ত ভাবনা, ভুল পথ, সর্বনাশা পরিণতি by আবুল মোমেন
বাঙালি
ও মুসলমান—এ দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর এ দুটি প্রধান পরিচয়ের মধ্যে
সামঞ্জস্য সাধনের সচেতন চেষ্টা যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু এ নিয়ে সমাজে
বিতর্ক, বিভ্রান্তি, বিভক্তি ও সংঘাতের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো
যাচ্ছে না। এখনো নির্বাচনী রাজনীতিতে ইসলাম তুরুপের তাস হিসেবে গণ্য হয়।
মানুষের যাপিত জীবনে নিজ নিজ ধর্ম ও ধর্মসংস্কৃতির ভূমিকা ব্যাপক। সব
মানুষই নিজ নিজ মাতৃভাষা ও জন্মভূমির দানে সমৃদ্ধ হয়। ফলে কোনো সমাজে
ভাষাভিত্তিক অঙ্গীকার ও সংস্কৃতি এবং ধর্মভিত্তিক বিশ্বাস ও সংস্কৃতি যদি
পরস্পরকে খারিজ করে দেওয়ার প্রবণতায় ভোগে, তবে সেটা অকারণ বিভ্রান্তি ও
বিতর্ক জিইয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত সামাজিক বিকাশ ও জাতীয় উন্নতির পথে বাধা হয়ে
দাঁড়ায়। আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণ, আলোকিত শিক্ষিত সমাজ গঠন, জাতীয়
উন্নয়নে অভীষ্ট গতিসঞ্চার—সবই মন্থর ও স্থবির হয়ে পড়ছে।
একসময় বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলা ভাষায় অমুসলিম লেখকদের প্রাধান্যের কারণে ইসলামি চেতনার অগ্রাধিকারের দোহাই দিয়ে এসব সম্পর্কে বিরূপ প্রচারণা চলেছে। ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী দুই দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এ দেশের সাধারণ মানুষ গ্রহণ করায় ইসলামি রক্ষণশীলদের ভাষাসংক্রান্ত সাংস্কৃতিক কট্টরপন্থা কালে কালে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
কিন্তু এ নিয়ে কখনো তাত্ত্বিক আলোচনা হয়নি। ভাষাসংস্কৃতির অগ্রগামিতা সহজ ও নিশ্চিত হয়েছে মূলত পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালির প্রতি (যার সিংহভাগ ধর্মে মুসলমান) সুস্পষ্ট বৈষম্য ও লাগাতার নিপীড়ন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ ও ক্রমবর্ধমান সংগ্রামের কারণে। এই সংগ্রামে বিজয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের অনুষঙ্গ হিসেবেই বাঙালি সংস্কৃতির বিজয়ও ছিল স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এতে কট্টরপন্থীদের মনের খুঁতখুঁতানি কাটেনি। বাঙালি হতে বা বাঙালি মুসলমান পরিচয়ে তাদের কুণ্ঠা থেকে যায়।
বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে আমমানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির একটি সহজ কারণ হলো এর সঙ্গে সংস্কৃত (ও প্রাকৃত) ভাষার যোগ, যে ভাষায় হিন্দুধর্মীয় শাস্ত্রগুলো রচিত; এ ভাষার প্রথম ও প্রধান শিল্পীরা প্রায় সবাই ধর্মত হিন্দু, যা মূলত ঐতিহাসিক কারণে ঘটেছে, ধর্মীয় কারণে নয়। আমরা লক্ষ করব, বাংলার মধ্যযুগ (এবং ভারতবর্ষেরও) ইউরোপের মতো অন্ধকার নয়। এ সময় মুসলিম সুলতানেরাই বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে আনুকূল্য জুগিয়েছেন।
প্রথম যুগের মুসলিম আরব যোদ্ধারা বিজিত দেশে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের ভাষা হিসেবে আরবি প্রচলন করতে চেয়েছেন। দেখা গেছে, ধর্মান্তরকরণ যত সহজ, ভাষান্তরিত করা তত সহজ নয়। ফারসি ভাষা আরব যোদ্ধাদের সব জবরদস্তি উপেক্ষা করে টিকে গেছে। এর কারণ, এ ভাষায় উন্নত জনপ্রিয় সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল, যা ব্যাপক মানুষের নৈমিত্তিক চর্চার অংশ হয়ে পড়েছিল। আজও দেখা যাবে, বৃহত্তর পারসিক সাংস্কৃতিক ভূমিতে—সে বাকু থেকে কাবুল, বোখারা থেকে ইস্তাম্বুল, ইস্পাহান থেকে ফ্রুঞ্জে সর্বত্র—অভিজাত-নিম্নবর্ণ পণ্ডিত-মূর্খ সবাই শ্রেষ্ঠ কবিদের দু-চার পঙ্ক্তি আওড়াতে পারেন। সেই সব সাহিত্য সব সময় তৌহিদি পন্থার শর্ত শতভাগ হয়তো পূরণ করে না।
বাংলা ভাষায় প্রচুর ভাবের গান, আধ্যাত্মিক গান রয়েছে, যা মাঠপর্যায়ের খেটে খাওয়া মানুষকে যুগ যুগ ধরে ভাবুকতার খোরাক দিয়ে এসেছে। আবার পরবর্তীকালে দেশবন্দনার কাব্য ও গানও রচিত হয়েছে দেদার। ফলে বহুকালে বাঙালির এমন এক ভাবুক আধ্যাত্মিক শাশ্বত মন তৈরি হয়েছে, যা তাকে সহজাতভাবে ভাব আর সুরের রসিক করে তুলেছে। কাব্য ও গানের সূত্রে বাঙালির ভাবের ঘরে একান্ত দেশজ আদল বেশ শক্ত স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। এখানেও নিতান্ত ঐতিহাসিক কারণেই এই ভাব-সুরসম্ভারে হিন্দুদের অবদানই প্রথম এসেছে, হয়তো আজও বেশিই আছে। কিন্তু কালের নিয়মে কি সাহিত্য কি সংগীত, সবতাতেই ইসলামের প্রভাব পড়েছে, আরবি-ফারসি ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে, আর মুসলমান কবি ও সুরশিল্পীর আবির্ভাবও ঘটেছে স্বাভাবিকভাবে। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য বা বাঙালি সংস্কৃতিকে আর কোনোভাবেই নিরঙ্কুশভাবে হিন্দুর বলে ভাবা যাবে না, এটা হিন্দু-মুসলিমের যৌথ সৃষ্টি।
ভাষা ও সাহিত্যের বিষয়ে কিছুটা হাল ছাড়লেও সংগীতের ব্যাপারে কিছু কট্টরপন্থী বলতে চান, ইসলামে সংগীত বেদাত। সংগীতের মূল ভিত্তি হলো সুর। আর যখন সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত বা আজানের ধ্বনি ভেসে আসে, তখন ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে কান খাড়া করে তা শুনতে হয়। কারণ, সুরের আবেদন সর্বজনীন। পবিত্র কোরআন বা আজানের বক্তব্য কেবল মুসলমানের কাছেই গ্রাহ্য হলেও সুর এমন এক বিমূর্ত ভাষা, যা সব মানুষের, এমনকি প্রাণীদেরও প্রভাবিত করতে সক্ষম।
মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, সব সৃষ্টির মালিক আল্লাহ। তাহলে মানবজীবনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী, মানবমনকে শান্ত, সুস্থ, সমাহিত করার গুণসম্পন্ন এমন সৃষ্টিকে কেন তাঁরা উপেক্ষা করবেন? হ্যাঁ, বান্দার জন্য পরীক্ষা হলো, এই মহৎ সৃষ্টিকে তার সুমহান রূপেই সে ব্যবহার করবে, নাকি এর অপব্যবহার, অপচয় করবে। এটা ব্যক্তির এবং সেই সঙ্গে সমাজের রুচি, দক্ষতা ও ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে কে কীভাবে সম্পদকে ব্যবহার করবে। এ ধরনের হীনতাকে অপসংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে কাজ করাই হলো সঠিক পথ।
তাই মুসলমানদের বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড় করানোর প্রয়াসগুলো বস্তুত যুক্তিযুক্ত নয়। আরেকটা কথাও মনে রাখা ভালো, আরব ভূমি মূলত শুষ্ক মরু অঞ্চল, প্রচণ্ড উত্তাপ ও ভয়াবহ লু হাওয়া আর ধূলিঝড় বয়ে যায়। তাপ, লু, ধূলি আর বাতাসের শুষ্কতা থেকে আত্মরক্ষার জন্য সে দেশে নারী-পুরুষ সবাইকে জোব্বাজাতীয় পোশাক পরতে দেখা যায়। সেখানকার মুসলমান যেমন, তেমনি খ্রিষ্টান, ইহুদি সবাই এই পোশাকই পরে। (বর্তমান উন্নতির যুগে ব্যাপক ধনাগমেনর ফলে সর্বত্র ব্যাপকভাবে এসি এসেছে এবং পোশাকেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।) আমাদের এই উষ্ণমণ্ডলীয় দেশের বাতাসে আর্দ্রতা বেশি এবং বৃষ্টির প্রাচুর্যও বেশ। আর সর্বত্র নদীনালা ছড়ানো। এ ধরনের ভ্াপসা গরমে গায়ে বাতাস পেলে আরাম হয়। তাই আমাদের দেশে নিজস্ব যে পোশাকগুলো উদ্ভাবিত প্রচলিত হয়েছে, যেমন: লুঙ্গি, ধুতি, শাড়ি, চাদর, গামছা—সবগুলোই খোলামেলা, যাতে গায়ে বাতাস খেলতে পারে। কোনোটাই আঁটসাঁট নয়, নদীনালা জলা-কাদা ভেঙে পথ চলতে ওঠানো-নামানোর জন্য বেশ উপযোগী।
সংসারে মানুষকে একদিকে যেমন ঔচিত্যবোধ থেকে কাজ করতে হয়, তেমনি অন্যদিকে উপযোগিতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়। কী উচিত, তার সঙ্গে কী উপযোগী, তাকেও মেলাতে হয়।
স্বর্গচ্যুত মানুষের বসত মর্ত্যে, যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভাষাসংস্কৃতির বৈচিত্র্যও ব্যাপক। জলবায়ু ও প্রকৃতির ওপর বস্তুত মানুষের হাত নেই। দেখা যাচ্ছে, এদের ওপর বেশি খোদকারি করলে আখেরে বিপর্যয় হয়, যা ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে সামলানো কঠিন। পৃথিবীকে জলবায়ু ও প্রকৃতির দিক থেকে একাকার করা যাবে না—এটা বান্দার কর্ম নয়। এটাও বোঝা গেছে, মানবজাতির ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও ঘুচবে না। মানুষের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো এই বিবিধ বৈচিত্র্য নিয়ে পরস্পর শান্তিতে সহাবস্থান করা।
যুদ্ধবিগ্রহ চালিয়ে অপরকে পদানত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দিন বহুকাল আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন কোনো যুদ্ধই নিষ্পত্তি হয় না, চলমান থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সমাপ্ত হলে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, যুদ্ধকে জয় করা গেছে, শান্তিকে নয়।
সংঘাত ও যুদ্ধের কারণগুলো জিইয়ে রাখলে কখনো শান্তি আসবে না, সমৃদ্ধিও নয়। সেটাই ধর্মসম্মত কাজ, যা বিদ্বেষ ও আক্রোশের চর্চাকে নিরুৎসাহিত করবে, বরং বোঝাপড়া ও স্থিতিশীলতার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলায় ইংরেজ শাসন শুরু হওয়ার পর ঊনবিংশ শতকে এখানে একটি কালান্তরের সূচনা হয়েছিল। মুসলমান নেতৃত্ব সেদিন তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ধরতে পারেনি, তাদের ব্যর্থতার চড়া খেসারত গুনতে হয়েছে এ দেশের সাধারণ মুসলমানকে। এর জের আজও শেষ হয়নি। আজ পৃথিবী ও মানবসমাজ আরেক কালান্তরের সামনে। এবার ভূমণ্ডল ও মানবসমাজ ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অর্থনীতি খোলামেলাভাবে আগ্রাসী হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তি ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের ধরন পাল্টে দিচ্ছে, ভূরাজনীতিতে নতুন শক্তিকেন্দ্র ও ভিন্ন টানাপোড়েন তৈরি হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভূমি ও পানির লড়াইকে আড়াল করতে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের বুলি ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুরোনো চিন্তা ও রাজনীতির খোলস ভাঙতে না পেরে আরব ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোয় একদিকে শাসকেরা সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ হয়ে এজেন্টের কাজ করছে, আর নানান কট্টর দল ওদেরই পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আত্মঘাতী হানাহানিতে নেমেছে। এই হলো নির্বোধের ক্রোধকে পুঁজি করে তার ওপর প্রভুত্ব দীর্ঘায়িত করার পুঁজিবাদী কৌশল।
দ্রুত পরিস্থিতি অনুধাবন করা দরকার। পরিবর্তনগুলো এবং এদের প্রভাব কত গভীর ও ব্যাপ্ত হতে পারে, তা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। বিরোধ ও বিবাদের চর্চায় লিপ্ত না হয়ে সংহতি ও সম্প্রীতির সুযোগগুলো এখনই কাজে লাগাতে হবে। বাঙালি ও মুসলমানে বিরোধ হওয়ার কারণ নেই। আরবি শুধু সুন্নি মুসলমানের ভাষা নয়, আরবিভাষী শিয়াদের বাস আছে বাহরাইন, ইরাক, সিরিয়া এবং সব আরব দেশে। নানা মত-পথের খ্রিষ্টানও আছে আরবিভাষী, ইহুদিও রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, চীন, শ্রীলঙ্কা, বসনিয়াসহ কত দেশেই অনারব মুসলমান রয়েছে, যাদের মাতৃভাষা ভিন্ন ভিন্ন।
ইসলামের নবীর কাছে আল্লাহর কাছ থেকে প্রথম যে বাণীটি আসে, তা একটিমাত্র শব্দ—ইকরা (পড়ো)। পঠন হলো জ্ঞানের চাবি। জ্ঞানের নির্যাস বলা হয় পবিত্র কোরআনকে। তার গভীরতা ও ব্যাপ্তির সঠিক এবং কালোপযোগী ব্যাখ্যার সামর্থ্য যদি কোনো জনগোষ্ঠী হারিয়ে ফেলে একে কেবল একটি মুখস্থ করে আওড়ানোর গ্রন্থ মনে করে, তবে এ গ্রন্থ থেকে সমকালীন জীবনকে চালিত ও সমৃদ্ধ করার রসদ তারা খুঁজে পাবে না। তাদের জ্ঞানরাজ্য হবে মৃত এবং তারা হয়ে পড়বে তামাদি। তারা পিছিয়ে যেতে থাকবে। এ পরিস্থিতিতে স্বভাবতই পরাজিতের মনের ক্রোধ ও প্রতিহিংসায় নিজেরা জ্বলতে থাকবে এবং শত্রু তৈরি করে ঝাল ঝাড়বে। এভাবে সাম্রাজ্যবাদের তেমন ক্ষতি তারা করতে পারবে না, ভ্রাতৃঘাতী হানাহানিই সার হবে। এটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি।
আমরা কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য এ রকম পরিণতি কামনা করি না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
একসময় বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য, বাংলা ভাষায় অমুসলিম লেখকদের প্রাধান্যের কারণে ইসলামি চেতনার অগ্রাধিকারের দোহাই দিয়ে এসব সম্পর্কে বিরূপ প্রচারণা চলেছে। ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী দুই দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এ দেশের সাধারণ মানুষ গ্রহণ করায় ইসলামি রক্ষণশীলদের ভাষাসংক্রান্ত সাংস্কৃতিক কট্টরপন্থা কালে কালে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
কিন্তু এ নিয়ে কখনো তাত্ত্বিক আলোচনা হয়নি। ভাষাসংস্কৃতির অগ্রগামিতা সহজ ও নিশ্চিত হয়েছে মূলত পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালির প্রতি (যার সিংহভাগ ধর্মে মুসলমান) সুস্পষ্ট বৈষম্য ও লাগাতার নিপীড়ন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিরোধ ও ক্রমবর্ধমান সংগ্রামের কারণে। এই সংগ্রামে বিজয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের অনুষঙ্গ হিসেবেই বাঙালি সংস্কৃতির বিজয়ও ছিল স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এতে কট্টরপন্থীদের মনের খুঁতখুঁতানি কাটেনি। বাঙালি হতে বা বাঙালি মুসলমান পরিচয়ে তাদের কুণ্ঠা থেকে যায়।
বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে আমমানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির একটি সহজ কারণ হলো এর সঙ্গে সংস্কৃত (ও প্রাকৃত) ভাষার যোগ, যে ভাষায় হিন্দুধর্মীয় শাস্ত্রগুলো রচিত; এ ভাষার প্রথম ও প্রধান শিল্পীরা প্রায় সবাই ধর্মত হিন্দু, যা মূলত ঐতিহাসিক কারণে ঘটেছে, ধর্মীয় কারণে নয়। আমরা লক্ষ করব, বাংলার মধ্যযুগ (এবং ভারতবর্ষেরও) ইউরোপের মতো অন্ধকার নয়। এ সময় মুসলিম সুলতানেরাই বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে আনুকূল্য জুগিয়েছেন।
প্রথম যুগের মুসলিম আরব যোদ্ধারা বিজিত দেশে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের ভাষা হিসেবে আরবি প্রচলন করতে চেয়েছেন। দেখা গেছে, ধর্মান্তরকরণ যত সহজ, ভাষান্তরিত করা তত সহজ নয়। ফারসি ভাষা আরব যোদ্ধাদের সব জবরদস্তি উপেক্ষা করে টিকে গেছে। এর কারণ, এ ভাষায় উন্নত জনপ্রিয় সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল, যা ব্যাপক মানুষের নৈমিত্তিক চর্চার অংশ হয়ে পড়েছিল। আজও দেখা যাবে, বৃহত্তর পারসিক সাংস্কৃতিক ভূমিতে—সে বাকু থেকে কাবুল, বোখারা থেকে ইস্তাম্বুল, ইস্পাহান থেকে ফ্রুঞ্জে সর্বত্র—অভিজাত-নিম্নবর্ণ পণ্ডিত-মূর্খ সবাই শ্রেষ্ঠ কবিদের দু-চার পঙ্ক্তি আওড়াতে পারেন। সেই সব সাহিত্য সব সময় তৌহিদি পন্থার শর্ত শতভাগ হয়তো পূরণ করে না।
বাংলা ভাষায় প্রচুর ভাবের গান, আধ্যাত্মিক গান রয়েছে, যা মাঠপর্যায়ের খেটে খাওয়া মানুষকে যুগ যুগ ধরে ভাবুকতার খোরাক দিয়ে এসেছে। আবার পরবর্তীকালে দেশবন্দনার কাব্য ও গানও রচিত হয়েছে দেদার। ফলে বহুকালে বাঙালির এমন এক ভাবুক আধ্যাত্মিক শাশ্বত মন তৈরি হয়েছে, যা তাকে সহজাতভাবে ভাব আর সুরের রসিক করে তুলেছে। কাব্য ও গানের সূত্রে বাঙালির ভাবের ঘরে একান্ত দেশজ আদল বেশ শক্ত স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। এখানেও নিতান্ত ঐতিহাসিক কারণেই এই ভাব-সুরসম্ভারে হিন্দুদের অবদানই প্রথম এসেছে, হয়তো আজও বেশিই আছে। কিন্তু কালের নিয়মে কি সাহিত্য কি সংগীত, সবতাতেই ইসলামের প্রভাব পড়েছে, আরবি-ফারসি ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে, আর মুসলমান কবি ও সুরশিল্পীর আবির্ভাবও ঘটেছে স্বাভাবিকভাবে। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য বা বাঙালি সংস্কৃতিকে আর কোনোভাবেই নিরঙ্কুশভাবে হিন্দুর বলে ভাবা যাবে না, এটা হিন্দু-মুসলিমের যৌথ সৃষ্টি।
ভাষা ও সাহিত্যের বিষয়ে কিছুটা হাল ছাড়লেও সংগীতের ব্যাপারে কিছু কট্টরপন্থী বলতে চান, ইসলামে সংগীত বেদাত। সংগীতের মূল ভিত্তি হলো সুর। আর যখন সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত বা আজানের ধ্বনি ভেসে আসে, তখন ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে কান খাড়া করে তা শুনতে হয়। কারণ, সুরের আবেদন সর্বজনীন। পবিত্র কোরআন বা আজানের বক্তব্য কেবল মুসলমানের কাছেই গ্রাহ্য হলেও সুর এমন এক বিমূর্ত ভাষা, যা সব মানুষের, এমনকি প্রাণীদেরও প্রভাবিত করতে সক্ষম।
মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, সব সৃষ্টির মালিক আল্লাহ। তাহলে মানবজীবনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী, মানবমনকে শান্ত, সুস্থ, সমাহিত করার গুণসম্পন্ন এমন সৃষ্টিকে কেন তাঁরা উপেক্ষা করবেন? হ্যাঁ, বান্দার জন্য পরীক্ষা হলো, এই মহৎ সৃষ্টিকে তার সুমহান রূপেই সে ব্যবহার করবে, নাকি এর অপব্যবহার, অপচয় করবে। এটা ব্যক্তির এবং সেই সঙ্গে সমাজের রুচি, দক্ষতা ও ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে কে কীভাবে সম্পদকে ব্যবহার করবে। এ ধরনের হীনতাকে অপসংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে কাজ করাই হলো সঠিক পথ।
তাই মুসলমানদের বিপরীতমুখী অবস্থানে দাঁড় করানোর প্রয়াসগুলো বস্তুত যুক্তিযুক্ত নয়। আরেকটা কথাও মনে রাখা ভালো, আরব ভূমি মূলত শুষ্ক মরু অঞ্চল, প্রচণ্ড উত্তাপ ও ভয়াবহ লু হাওয়া আর ধূলিঝড় বয়ে যায়। তাপ, লু, ধূলি আর বাতাসের শুষ্কতা থেকে আত্মরক্ষার জন্য সে দেশে নারী-পুরুষ সবাইকে জোব্বাজাতীয় পোশাক পরতে দেখা যায়। সেখানকার মুসলমান যেমন, তেমনি খ্রিষ্টান, ইহুদি সবাই এই পোশাকই পরে। (বর্তমান উন্নতির যুগে ব্যাপক ধনাগমেনর ফলে সর্বত্র ব্যাপকভাবে এসি এসেছে এবং পোশাকেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।) আমাদের এই উষ্ণমণ্ডলীয় দেশের বাতাসে আর্দ্রতা বেশি এবং বৃষ্টির প্রাচুর্যও বেশ। আর সর্বত্র নদীনালা ছড়ানো। এ ধরনের ভ্াপসা গরমে গায়ে বাতাস পেলে আরাম হয়। তাই আমাদের দেশে নিজস্ব যে পোশাকগুলো উদ্ভাবিত প্রচলিত হয়েছে, যেমন: লুঙ্গি, ধুতি, শাড়ি, চাদর, গামছা—সবগুলোই খোলামেলা, যাতে গায়ে বাতাস খেলতে পারে। কোনোটাই আঁটসাঁট নয়, নদীনালা জলা-কাদা ভেঙে পথ চলতে ওঠানো-নামানোর জন্য বেশ উপযোগী।
সংসারে মানুষকে একদিকে যেমন ঔচিত্যবোধ থেকে কাজ করতে হয়, তেমনি অন্যদিকে উপযোগিতার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হয়। কী উচিত, তার সঙ্গে কী উপযোগী, তাকেও মেলাতে হয়।
স্বর্গচ্যুত মানুষের বসত মর্ত্যে, যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন জলবায়ু, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভাষাসংস্কৃতির বৈচিত্র্যও ব্যাপক। জলবায়ু ও প্রকৃতির ওপর বস্তুত মানুষের হাত নেই। দেখা যাচ্ছে, এদের ওপর বেশি খোদকারি করলে আখেরে বিপর্যয় হয়, যা ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে সামলানো কঠিন। পৃথিবীকে জলবায়ু ও প্রকৃতির দিক থেকে একাকার করা যাবে না—এটা বান্দার কর্ম নয়। এটাও বোঝা গেছে, মানবজাতির ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যও ঘুচবে না। মানুষের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো এই বিবিধ বৈচিত্র্য নিয়ে পরস্পর শান্তিতে সহাবস্থান করা।
যুদ্ধবিগ্রহ চালিয়ে অপরকে পদানত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দিন বহুকাল আগে শেষ হয়ে গেছে। এখন কোনো যুদ্ধই নিষ্পত্তি হয় না, চলমান থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সমাপ্ত হলে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, যুদ্ধকে জয় করা গেছে, শান্তিকে নয়।
সংঘাত ও যুদ্ধের কারণগুলো জিইয়ে রাখলে কখনো শান্তি আসবে না, সমৃদ্ধিও নয়। সেটাই ধর্মসম্মত কাজ, যা বিদ্বেষ ও আক্রোশের চর্চাকে নিরুৎসাহিত করবে, বরং বোঝাপড়া ও স্থিতিশীলতার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলায় ইংরেজ শাসন শুরু হওয়ার পর ঊনবিংশ শতকে এখানে একটি কালান্তরের সূচনা হয়েছিল। মুসলমান নেতৃত্ব সেদিন তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ধরতে পারেনি, তাদের ব্যর্থতার চড়া খেসারত গুনতে হয়েছে এ দেশের সাধারণ মুসলমানকে। এর জের আজও শেষ হয়নি। আজ পৃথিবী ও মানবসমাজ আরেক কালান্তরের সামনে। এবার ভূমণ্ডল ও মানবসমাজ ব্যাপক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অর্থনীতি খোলামেলাভাবে আগ্রাসী হয়ে পড়েছে। প্রযুক্তি ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের ধরন পাল্টে দিচ্ছে, ভূরাজনীতিতে নতুন শক্তিকেন্দ্র ও ভিন্ন টানাপোড়েন তৈরি হচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভূমি ও পানির লড়াইকে আড়াল করতে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের বুলি ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুরোনো চিন্তা ও রাজনীতির খোলস ভাঙতে না পেরে আরব ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোয় একদিকে শাসকেরা সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ হয়ে এজেন্টের কাজ করছে, আর নানান কট্টর দল ওদেরই পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আত্মঘাতী হানাহানিতে নেমেছে। এই হলো নির্বোধের ক্রোধকে পুঁজি করে তার ওপর প্রভুত্ব দীর্ঘায়িত করার পুঁজিবাদী কৌশল।
দ্রুত পরিস্থিতি অনুধাবন করা দরকার। পরিবর্তনগুলো এবং এদের প্রভাব কত গভীর ও ব্যাপ্ত হতে পারে, তা বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। বিরোধ ও বিবাদের চর্চায় লিপ্ত না হয়ে সংহতি ও সম্প্রীতির সুযোগগুলো এখনই কাজে লাগাতে হবে। বাঙালি ও মুসলমানে বিরোধ হওয়ার কারণ নেই। আরবি শুধু সুন্নি মুসলমানের ভাষা নয়, আরবিভাষী শিয়াদের বাস আছে বাহরাইন, ইরাক, সিরিয়া এবং সব আরব দেশে। নানা মত-পথের খ্রিষ্টানও আছে আরবিভাষী, ইহুদিও রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, চীন, শ্রীলঙ্কা, বসনিয়াসহ কত দেশেই অনারব মুসলমান রয়েছে, যাদের মাতৃভাষা ভিন্ন ভিন্ন।
ইসলামের নবীর কাছে আল্লাহর কাছ থেকে প্রথম যে বাণীটি আসে, তা একটিমাত্র শব্দ—ইকরা (পড়ো)। পঠন হলো জ্ঞানের চাবি। জ্ঞানের নির্যাস বলা হয় পবিত্র কোরআনকে। তার গভীরতা ও ব্যাপ্তির সঠিক এবং কালোপযোগী ব্যাখ্যার সামর্থ্য যদি কোনো জনগোষ্ঠী হারিয়ে ফেলে একে কেবল একটি মুখস্থ করে আওড়ানোর গ্রন্থ মনে করে, তবে এ গ্রন্থ থেকে সমকালীন জীবনকে চালিত ও সমৃদ্ধ করার রসদ তারা খুঁজে পাবে না। তাদের জ্ঞানরাজ্য হবে মৃত এবং তারা হয়ে পড়বে তামাদি। তারা পিছিয়ে যেতে থাকবে। এ পরিস্থিতিতে স্বভাবতই পরাজিতের মনের ক্রোধ ও প্রতিহিংসায় নিজেরা জ্বলতে থাকবে এবং শত্রু তৈরি করে ঝাল ঝাড়বে। এভাবে সাম্রাজ্যবাদের তেমন ক্ষতি তারা করতে পারবে না, ভ্রাতৃঘাতী হানাহানিই সার হবে। এটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি।
আমরা কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য এ রকম পরিণতি কামনা করি না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments