দুর্বৃত্তায়নের ভয়াবহ রূপ by আসিফ রশীদ
অরবিন্দ রায় একজন বস্ত্র প্রকৌশলী ছিলেন।
আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। পরে নিজেই ছোটখাটো একটা বস্ত্র
কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। তার আরও একটা পরিচয় ছিল- তিনি ছিলেন একজন সুলেখক।
যুগান্তরে লিখতেন। তার লেখার মধ্যে গতানুগতিকতার বাইরে ভিন্ন চিন্তার ছাপ
থাকত। বেশ ঝরঝরে গদ্য লিখতেন। তাকে বলতাম, আজকাল সরকারি-বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক কিংবা তথাকথিত পণ্ডিত, সাহিত্যিক বা গবেষকরা
পত্রিকায় লেখা পাঠান। তাদের অধিকাংশের লেখায় নতুন কিছু দেখি না, চিন্তার
গভীরতা থাকে না, অনেকে তো শুদ্ধ করে বাক্যও লিখতে পারেন না। সে তুলনায় আপনি
একজন ব্যবসায়ী হয়েও বেশ ভালো লেখেন। শুনে লাজুক হাসি হাসতেন অরবিন্দ। শুধু
গদ্য নয়, ছড়া লেখারও হাত ছিল তার। রাতে প্রায়ই ফোন করে পড়ে শোনাতেন।
সেই অরবিন্দ হঠাৎ করেই চলে গেলেন অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে। সাধারণত ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচল করতেন তিনি। সেদিন তার ড্রাইভার ছুটিতে ছিলেন। তাই বাসে করে মতিঝিল থেকে টঙ্গীতে বাসায় ফিরছিলেন। সঙ্গে ৪০ হাজার টাকা ছিল। পথিমধ্যে কী ঘটেছে কে জানে! বাসযাত্রীরা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পায়। পকেটে শুধু মোবাইল ফোনটি পাওয়া যায়। সেখান থেকে নম্বর বের করে কেউ একজন অরবিন্দের কোনো পরিচিতজনকে খবর দেন। স্বজনরা এসে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। কিন্তু অরবিন্দের আর জ্ঞান ফেরেনি।
এভাবে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে কারও কারও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর আজকাল প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায়। পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর অন্তত ৫০০ মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছিলেন। তাদের একটি অংশ শেষ পর্যন্ত আর সুস্থ হয়ে ফিরে আসেননি। সম্ভবত মাত্রাহীন চেতনানাশক ব্যবহারই এর কারণ। মানুষকে অজ্ঞান করে টাকা লুটে নেয়াই দুর্বৃত্তদের উদ্দেশ্য। সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান পার্টির ৩১ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। তাদের একজন আবার ওষুধ ব্যবসায়ী! তার কাজ ছিল অজ্ঞান পার্টির কাছে চেতনানাশক সরবরাহ করা। ভাবুন, কতটা অধঃপতন ঘটলে টাকার জন্য কারও মৃত্যুর কারণ হতেও বিবেকে বাধে না এসব লোকের, যাদের মধ্যে তথাকথিত শিক্ষিতরাও রয়েছে।
আশ্চর্যজনকই বটে, এই দুর্বৃত্ত চক্রগুলো এখনও নির্বিঘ্নে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ওই ৩১ দুর্বৃত্ত ধরা পড়ার পর আশা করেছিলাম, অন্তত কিছুদিন অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য বন্ধ থাকবে। কিন্তু দুদিন পরই সংবাদপত্রে আবারও এক ব্যক্তির অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে বড় অংকের টাকা খোয়ানোর খবর এসেছে। অর্থাৎ একটি চক্রের কিছু সদস্যের ধরা পড়ার ঘটনাকে ওরা থোড়াই কেয়ার করছে! ধৃত ৩১ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত সাজা দিয়েছে। তাদের কী শাস্তি হয়েছে জানি না। তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায়, তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে প্রতারণা মামলায়। কারণ পুলিশের বর্ণনায় তাদের প্রতারকই বলা হয়েছে এবং সেভাবেই সংবাদপত্রে খবরটি এসেছে। সেক্ষেত্রে অল্প কিছুদিন জেল খেটেই তারা বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা। তারপর? তারপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে আগের পেশায়, কিংবা আরও নিকৃষ্ট কোনো কর্মকাণ্ডে।
প্রশ্ন হল, এই দুবর্ৃৃত্তরা কি স্রেফ প্রতারক? এরা তো একেকজন সাক্ষাৎ খুনি। তাই এদের শাস্তি হওয়া উচিত অত্যন্ত কঠোর। অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে সহজে বেরিয়ে আসার কারণেই দেশে ছিনতাই, ডাকাতি, খুন-খারাবি বাড়ছে। এসব রোধ করতে চাইলে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। সমাজে অপরাধের ধরন ও কৌশল বদলেছে। বিদ্যমান আইন যখন করা হয়েছিল, তখন অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, গামছা পার্টি, হ্যান্ডশেক পার্টি ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল না। কাজেই পুরনো আইন দিয়ে নতুন অপরাধের বিচার করলে প্রতিকার আসবে না। এ অপরাধ দমনের আইন ও কৌশল হতে হবে যুগোপযোগী।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের আগে ছয়শ বছর ধরে ভয়ংকর একটি পেশার অস্তিত্ব ছিল। এ পেশায় নিয়োজিতদের বলা হতো ঠগ বা ঠগী। তারা বংশপরম্পরায় এ পেশায় নিয়োজিত থাকত। ঠগীরা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলাচলকারী মানুষদের গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করে তাদের টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী লুটে নিত। গোটা ভারতে এ অপরাধ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, তৎকালীন শাসকরা কোনোভাবেই এটি দমন করতে পারছিল না। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় কথাটি সম্ভবত এ থেকেই এসেছে। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডসের তথ্য অনুযায়ী, ঠগীদের হাতে প্রাণ হারায় অন্তত ২০ লাখ মানুষ। ব্রিটিশ শাসকরা ভারতবর্ষে শাসনক্ষমতা দখলের পর এ অপরাধ দমনে দৃষ্টি দেয়। তারা ১৮৩৫ সালে ঠগী ও ডাকাতি বিভাগ নামে একটি পুলিশি সংস্থা গঠন করে। একই সঙ্গে ঠগী ও ডাকাতি দমন আইন, ১৮৩৬-১৮৪৮ নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে। ঠগী ও ডাকাতি বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয় উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যানকে। তার নেতৃত্বে ১৮৭০-এর দশকে ঠগীদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে যেসব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল তার অন্যতম ছিল ধৃত ঠগীদের কাছ থেকে তাদের পেশার আদ্যোপান্ত তথ্য সংগ্রহ এবং রাজ সাক্ষ্য ব্যবহার করা।
বর্তমানে দেশে অজ্ঞান পার্টির কর্মকাণ্ড এবং অন্য অনেক অপরাধ দমনে এ কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। কিন্তু আদৌ তা করা হবে কি? কেন এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছি সে বিষয়ে পরে আসছি।
২.
অজ্ঞান পার্টির কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়; কিন্তু বর্তমানে সমাজে ভদ্র মানুষের মুখোশধারীদের দ্বারা এমন অনেক কর্মকাণ্ড ঘটছে যেগুলো এ দুর্বৃত্তপনাকে ছাড়িয়ে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না কোনো ব্যবস্থা। লোভ, দুর্নীতি, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের নানা চেষ্টা, প্রশাসনে প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিলের বন্দোবস্ত করা- এভাবেই দুর্বৃত্তায়িত হচ্ছে সমাজ। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার কথাই ধরুন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উপেক্ষিত হয়ে আছে রেল খাত। বহু বছর আগে ব্রিটিশরা যে ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়ে গেছে, বলা যায় তার আর তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। কী এর কারণ? রেল ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে সাধারণ মানুষ স্বল্প ভাড়ায় নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবে। রেলে পণ্য পরিবহনও সাশ্রয়ী। এতে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠবে ট্রেন। ফলে বন্ধ হয়ে যাবে সড়ক পরিবহন ব্যবসার মনোপলি। এ ব্যবসার সঙ্গে অনেক মন্ত্রী-এমপি তথা প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। তারা কেন চাইবেন রেলের উন্নয়ন? তাই রেলের পরিধি, সেবার মান, সিডিউল- সবকিছুই নির্ধারিত হয় তাদের স্বার্থে।
রাজধানীর সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় যে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার পেছনেও কাজ করছে প্রভাবশালীদের লাভালাভের হিসাব-নিকাশ। বিভিন্ন রুটে মন্ত্রী-এমপি-রাজনৈতিক নেতার মালিকানাধীন বাস চলাচলে মনোপলি সৃষ্টির জন্য কৌশলে অন্যদের সার্ভিসে বাধা সৃষ্টি করা হয় নানাভাবে। তারপর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে নিংড়ে নেয়া হয় একচেটিয়া ব্যবসার সুবিধা। সিএনজি বেবিট্যাক্সিতে মিটার বসানো থাকলেও সবাই জানে, ওটা লোক দেখানো। যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হয় কয়েক গুণ। কর্তৃপক্ষ নীরব।
দেশের স্বাস্থ্য খাত ও ওষুধ শিল্পে বিরাজ করছে ভয়াবহ অরাজকতা। সরকারি হাসপাতালে দালালদের ঘুষ না দিলে রোগীর জন্য বেড মেলে না। বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু হলে লাশ আটকে রাখা হয় টাকার জন্য। দেশের ফার্মেসিগুলোয় গত কয়েক বছর ধরে জীবনরক্ষাকারীসহ সব ধরনের ওষুধের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পত্রপত্রিকায় রিপোর্টের পর রিপোর্ট, সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হলেও সরকার এ ব্যাপারে নির্বিকার। কারণ দেশের ওষুধ শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এসব কি দুর্বৃত্তপনা নয়? অভিধানে দুর্বৃত্ত কথাটির একটি অর্থ দুশ্চরিত্র। এসব কর্মকাণ্ড আর যাই হোক, চরিত্রবান মানুষের কাজ নয়।
৩.
অজ্ঞান পার্টির কর্মকাণ্ডসহ অপরাধ দমনে কেন সংশয় প্রকাশ করেছি, এবার তা বলি। প্রথমত, দেশের আইন-শৃংখলা বাহিনীর একটি অংশও হয়ে পড়েছে দুর্বৃত্তায়িত। তাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেসব না হয় বাদই দিলাম। ইদানীং প্রায় প্রতিটি অপরাধের তদন্তেই আইন-শৃংখলা বাহিনীর কোনো না কোনো সদস্যের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসছে। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দ্বিতীয়ত, একটি সমাজ যখন আইন-শৃংখলা বাহিনীসহ দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়ে, তখন তা সংশোধন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সেই সমাজে যে কোনো অপরাধ গা-সওয়া হয়ে যায়। ফলে অপরাধ দমনকারীদের ওপর সামাজিক চাপটি তত জোরালো হয় না। দেশে এখন প্রায় এমন একটি পরিস্থিতিই বিরাজ করছে। অর্থাৎ সবকিছু আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে।
সমাজকে দুর্বৃত্তায়ন থেকে বের করে আনা
না গেলে একপর্যায়ে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। আমি, আপনি, যে-কেউ যে কোনো সময় এর শিকার হতে পারি। যেমন হয়েছেন অরবিন্দ। ঘটনার আগের রাতেও তার সঙ্গে যখন ফোনে কথা হচ্ছিল, তখন কি কল্পনাও করতে পেরেছিলাম পরদিন এমন একটি খবর শুনতে হবে?
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
সেই অরবিন্দ হঠাৎ করেই চলে গেলেন অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে। সাধারণত ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচল করতেন তিনি। সেদিন তার ড্রাইভার ছুটিতে ছিলেন। তাই বাসে করে মতিঝিল থেকে টঙ্গীতে বাসায় ফিরছিলেন। সঙ্গে ৪০ হাজার টাকা ছিল। পথিমধ্যে কী ঘটেছে কে জানে! বাসযাত্রীরা তাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পায়। পকেটে শুধু মোবাইল ফোনটি পাওয়া যায়। সেখান থেকে নম্বর বের করে কেউ একজন অরবিন্দের কোনো পরিচিতজনকে খবর দেন। স্বজনরা এসে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। কিন্তু অরবিন্দের আর জ্ঞান ফেরেনি।
এভাবে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়ে কারও কারও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর আজকাল প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায়। পরিসংখ্যান বলছে, এ বছর অন্তত ৫০০ মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছিলেন। তাদের একটি অংশ শেষ পর্যন্ত আর সুস্থ হয়ে ফিরে আসেননি। সম্ভবত মাত্রাহীন চেতনানাশক ব্যবহারই এর কারণ। মানুষকে অজ্ঞান করে টাকা লুটে নেয়াই দুর্বৃত্তদের উদ্দেশ্য। সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান পার্টির ৩১ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। তাদের একজন আবার ওষুধ ব্যবসায়ী! তার কাজ ছিল অজ্ঞান পার্টির কাছে চেতনানাশক সরবরাহ করা। ভাবুন, কতটা অধঃপতন ঘটলে টাকার জন্য কারও মৃত্যুর কারণ হতেও বিবেকে বাধে না এসব লোকের, যাদের মধ্যে তথাকথিত শিক্ষিতরাও রয়েছে।
আশ্চর্যজনকই বটে, এই দুর্বৃত্ত চক্রগুলো এখনও নির্বিঘ্নে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ওই ৩১ দুর্বৃত্ত ধরা পড়ার পর আশা করেছিলাম, অন্তত কিছুদিন অজ্ঞান পার্টির দৌরাত্ম্য বন্ধ থাকবে। কিন্তু দুদিন পরই সংবাদপত্রে আবারও এক ব্যক্তির অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে বড় অংকের টাকা খোয়ানোর খবর এসেছে। অর্থাৎ একটি চক্রের কিছু সদস্যের ধরা পড়ার ঘটনাকে ওরা থোড়াই কেয়ার করছে! ধৃত ৩১ জনকে ভ্রাম্যমাণ আদালত সাজা দিয়েছে। তাদের কী শাস্তি হয়েছে জানি না। তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায়, তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে প্রতারণা মামলায়। কারণ পুলিশের বর্ণনায় তাদের প্রতারকই বলা হয়েছে এবং সেভাবেই সংবাদপত্রে খবরটি এসেছে। সেক্ষেত্রে অল্প কিছুদিন জেল খেটেই তারা বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা। তারপর? তারপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে আগের পেশায়, কিংবা আরও নিকৃষ্ট কোনো কর্মকাণ্ডে।
প্রশ্ন হল, এই দুবর্ৃৃত্তরা কি স্রেফ প্রতারক? এরা তো একেকজন সাক্ষাৎ খুনি। তাই এদের শাস্তি হওয়া উচিত অত্যন্ত কঠোর। অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে সহজে বেরিয়ে আসার কারণেই দেশে ছিনতাই, ডাকাতি, খুন-খারাবি বাড়ছে। এসব রোধ করতে চাইলে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। সমাজে অপরাধের ধরন ও কৌশল বদলেছে। বিদ্যমান আইন যখন করা হয়েছিল, তখন অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, গামছা পার্টি, হ্যান্ডশেক পার্টি ইত্যাদির অস্তিত্ব ছিল না। কাজেই পুরনো আইন দিয়ে নতুন অপরাধের বিচার করলে প্রতিকার আসবে না। এ অপরাধ দমনের আইন ও কৌশল হতে হবে যুগোপযোগী।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের আগে ছয়শ বছর ধরে ভয়ংকর একটি পেশার অস্তিত্ব ছিল। এ পেশায় নিয়োজিতদের বলা হতো ঠগ বা ঠগী। তারা বংশপরম্পরায় এ পেশায় নিয়োজিত থাকত। ঠগীরা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে চলাচলকারী মানুষদের গলায় গামছা পেঁচিয়ে হত্যা করে তাদের টাকা-পয়সা ও অন্যান্য সামগ্রী লুটে নিত। গোটা ভারতে এ অপরাধ এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, তৎকালীন শাসকরা কোনোভাবেই এটি দমন করতে পারছিল না। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় কথাটি সম্ভবত এ থেকেই এসেছে। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডসের তথ্য অনুযায়ী, ঠগীদের হাতে প্রাণ হারায় অন্তত ২০ লাখ মানুষ। ব্রিটিশ শাসকরা ভারতবর্ষে শাসনক্ষমতা দখলের পর এ অপরাধ দমনে দৃষ্টি দেয়। তারা ১৮৩৫ সালে ঠগী ও ডাকাতি বিভাগ নামে একটি পুলিশি সংস্থা গঠন করে। একই সঙ্গে ঠগী ও ডাকাতি দমন আইন, ১৮৩৬-১৮৪৮ নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে। ঠগী ও ডাকাতি বিভাগের সুপারিনটেন্ডেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয় উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যানকে। তার নেতৃত্বে ১৮৭০-এর দশকে ঠগীদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে যেসব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল তার অন্যতম ছিল ধৃত ঠগীদের কাছ থেকে তাদের পেশার আদ্যোপান্ত তথ্য সংগ্রহ এবং রাজ সাক্ষ্য ব্যবহার করা।
বর্তমানে দেশে অজ্ঞান পার্টির কর্মকাণ্ড এবং অন্য অনেক অপরাধ দমনে এ কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। কিন্তু আদৌ তা করা হবে কি? কেন এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছি সে বিষয়ে পরে আসছি।
২.
অজ্ঞান পার্টির কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়; কিন্তু বর্তমানে সমাজে ভদ্র মানুষের মুখোশধারীদের দ্বারা এমন অনেক কর্মকাণ্ড ঘটছে যেগুলো এ দুর্বৃত্তপনাকে ছাড়িয়ে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হয় না কোনো ব্যবস্থা। লোভ, দুর্নীতি, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের নানা চেষ্টা, প্রশাসনে প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিলের বন্দোবস্ত করা- এভাবেই দুর্বৃত্তায়িত হচ্ছে সমাজ। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার কথাই ধরুন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উপেক্ষিত হয়ে আছে রেল খাত। বহু বছর আগে ব্রিটিশরা যে ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়ে গেছে, বলা যায় তার আর তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। কী এর কারণ? রেল ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে সাধারণ মানুষ স্বল্প ভাড়ায় নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পারবে। রেলে পণ্য পরিবহনও সাশ্রয়ী। এতে মানুষ ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠবে ট্রেন। ফলে বন্ধ হয়ে যাবে সড়ক পরিবহন ব্যবসার মনোপলি। এ ব্যবসার সঙ্গে অনেক মন্ত্রী-এমপি তথা প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত। তারা কেন চাইবেন রেলের উন্নয়ন? তাই রেলের পরিধি, সেবার মান, সিডিউল- সবকিছুই নির্ধারিত হয় তাদের স্বার্থে।
রাজধানীর সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় যে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার পেছনেও কাজ করছে প্রভাবশালীদের লাভালাভের হিসাব-নিকাশ। বিভিন্ন রুটে মন্ত্রী-এমপি-রাজনৈতিক নেতার মালিকানাধীন বাস চলাচলে মনোপলি সৃষ্টির জন্য কৌশলে অন্যদের সার্ভিসে বাধা সৃষ্টি করা হয় নানাভাবে। তারপর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে নিংড়ে নেয়া হয় একচেটিয়া ব্যবসার সুবিধা। সিএনজি বেবিট্যাক্সিতে মিটার বসানো থাকলেও সবাই জানে, ওটা লোক দেখানো। যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হয় কয়েক গুণ। কর্তৃপক্ষ নীরব।
দেশের স্বাস্থ্য খাত ও ওষুধ শিল্পে বিরাজ করছে ভয়াবহ অরাজকতা। সরকারি হাসপাতালে দালালদের ঘুষ না দিলে রোগীর জন্য বেড মেলে না। বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর মৃত্যু হলে লাশ আটকে রাখা হয় টাকার জন্য। দেশের ফার্মেসিগুলোয় গত কয়েক বছর ধরে জীবনরক্ষাকারীসহ সব ধরনের ওষুধের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পত্রপত্রিকায় রিপোর্টের পর রিপোর্ট, সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হলেও সরকার এ ব্যাপারে নির্বিকার। কারণ দেশের ওষুধ শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এসব কি দুর্বৃত্তপনা নয়? অভিধানে দুর্বৃত্ত কথাটির একটি অর্থ দুশ্চরিত্র। এসব কর্মকাণ্ড আর যাই হোক, চরিত্রবান মানুষের কাজ নয়।
৩.
অজ্ঞান পার্টির কর্মকাণ্ডসহ অপরাধ দমনে কেন সংশয় প্রকাশ করেছি, এবার তা বলি। প্রথমত, দেশের আইন-শৃংখলা বাহিনীর একটি অংশও হয়ে পড়েছে দুর্বৃত্তায়িত। তাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেসব না হয় বাদই দিলাম। ইদানীং প্রায় প্রতিটি অপরাধের তদন্তেই আইন-শৃংখলা বাহিনীর কোনো না কোনো সদস্যের সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসছে। এ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দ্বিতীয়ত, একটি সমাজ যখন আইন-শৃংখলা বাহিনীসহ দুর্বৃত্তায়িত হয়ে পড়ে, তখন তা সংশোধন করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সেই সমাজে যে কোনো অপরাধ গা-সওয়া হয়ে যায়। ফলে অপরাধ দমনকারীদের ওপর সামাজিক চাপটি তত জোরালো হয় না। দেশে এখন প্রায় এমন একটি পরিস্থিতিই বিরাজ করছে। অর্থাৎ সবকিছু আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে।
সমাজকে দুর্বৃত্তায়ন থেকে বের করে আনা
না গেলে একপর্যায়ে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। আমি, আপনি, যে-কেউ যে কোনো সময় এর শিকার হতে পারি। যেমন হয়েছেন অরবিন্দ। ঘটনার আগের রাতেও তার সঙ্গে যখন ফোনে কথা হচ্ছিল, তখন কি কল্পনাও করতে পেরেছিলাম পরদিন এমন একটি খবর শুনতে হবে?
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
No comments