মৌলভীবাজার মুক্ত হলো ৮ই ডিসেম্বর by মাসুদ আহমেদ
পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার হিসেবে গণ্য পিটিআই এবং মৌলভীবাজার কলেজে নেই কোন প্রাণের অস্তিত্ব। মানুষ তো দূরের কথা, শিয়াল-কুকুরও গুলির শব্দে শহর ছেড়েছে। সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে পড়েছিল অর্ধনগ্ন ৭-৮ যুবতীর লাশ। সকাল ৭টায় মীর্জা আজিজ আহমদ বেগ শহরের পশ্চিমবাজারস্থ মনু নদীর খেয়াঘাট এলাকায় এলে নদীর অপর পাড়ের কয়েকজন লোককে শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণে উঁকি মারতে দেখে নিজের পরিচয় দিয়ে এপার থেকে হাঁক ছেড়ে বলেন, মৌলভীবাজার হানাদারমুক্ত হয়েছে। তখন ওপারের সুনসান নীরবতা ভেঙে স্লোগান উঠে- “জয় বাংলা”। মৌলভীবাজারের রাজনগর হানাদারমুক্ত হয় ৬ই ডিসেম্বর। আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন হয় ৭ই ডিসেম্বর। মৌলভীবাজার শহর সংলগ্ন মাতারকাপন বড়টিলা এবং কালেঙ্গা পাহাড় এলাকায় হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ রণকৌশলগত দিক থেকে ছিল দুর্ভেদ্য। জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি টিলা ও ঢালে অশনাক্ত বাংকার তৈরি করেছিল হানাদার বাহিনী। এ অবস্থায় প্রতিরক্ষাব্যূহতে করে মৌলভীবাজার শহর দখলমুক্ত করার দায়িত্ব বর্তায় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ওপর। এ সময় মিত্রবাহিনীর গাইড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রধান সারির নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মীর্জা আজিজ আহমদ বেগ। ৫ই ডিসেম্বর কালেঙ্গায় হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় মিত্রবাহিনী। ৫ ও ৬ই ডিসেম্বর উভয়পক্ষে বিরতিহীন যুদ্ধ চলে। কালেঙ্গা ও বড়টিলার কয়েকটি অশনাক্ত বাংকার থেকে হানাদার বাহিনীর আক্রমণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভারতীয় সেনা নিহত হয়। তখন আর্টিলারি ও বিমান আক্রমণ জোরদার করার পাশাপাশি অশনাক্ত বাংকার ধ্বংস করার জন্য প্রশিক্ষিত বানর বাহিনী নামানো হয়। ৬ই ডিসেম্বর সাঁড়াশি আক্রমণে হানাদার বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ফলে সেদিন বিকাল থেকেই ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে পিছু হটার আয়োজন শুরু করে হানাদার বাহিনী। রাতের আঁধারে ৬০টিরও বেশি সামরিক গাড়ি শেরপুর-সাদিপুর ফেরি অতিক্রম করে। ৭ই ডিসেম্বর বিকাল ৪টা পর্যন্ত হানাদার বাহিনী বড়টিলা, বর্ষিজোড়া ও কালেঙ্গা এলাকায় সাময়িক বিরতি শেষে থেকে থেকে গুলিবর্ষণ অব্যাহত রেখেছিল। ভারতীয় গোয়েন্দা অফিসার লে. কর্নেল সমন সিং মন্তব্য করেছিলেন, পিছু হটাকে নিষ্কণ্টক করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি বিরতির কৌশল নিয়েছে। কালেঙ্গা ও বড়টিলায় যখন প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোয়েন্দারা শেরপুর-সাদিপুরের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থান করে পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল। এ গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতেই পাকিস্তানি বাহিনীর পিছু হটার সংবাদ মিত্রবাহিনীর কাছে চলে আসছিল। কালেঙ্গা যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও সামরিক বাহিনীর মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডার মেজর জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা এ সময় সরজমিন পরিদর্শনে ছুটে এসেছিলেন। এ সময় তিনি পরবর্তী ১২ ঘণ্টার মধ্যে মৌলভীবাজার শহর দখলের নির্দেশ দিয়ে যান। নির্দেশ মোতাবেক মৌলভীবাজার শহরে প্রবেশের সহজ পথ ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গাইড ও মিত্রবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে বৈঠক হয়। জগন্নাথপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে বেজবাড়িতে যে রাস্তা মিলিত হয়েছে সেই রাস্তাকে শহরে ঢোকার পথ হিসেবে বেছে নেয়া হয়। পাহাড়ি ও ঘুরপথের এ রাস্তা সম্পর্কে রেকি করে নিশ্চিত হওয়ার পর সন্ধ্যা ৭টায় অগ্রবর্তী বাহিনী রওনা হয়। মৌলভীবাজার, দেওড়াছড়া ও গোয়ালবাড়ি ত্রিমোহনাতে পৌঁছতেই হানাদার বাহিনীর ক্ষুদ্র একটি দল গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাল্টা আক্রমণের মুখে তারা অবস্থান ত্যাগ করে পিছু হটে যায়। অগ্রবর্তী বাহিনী রাত দেড়টায় বেজবাড়িস্থ ওয়াপদা ও পিডিবি অফিস এলাকায় পৌঁছে। এ খবর জানার পর ব্রিগেডিয়ার লক্ষণ সিং এক দল মারাঠা সেনা নিয়ে মৌলভীবাজার অভিমুখে রওনা হন। হানাদার বাহিনীর সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে শেরপুর ফেরিঘাট থেকে খবর আসে রাত ১২টার পর আর কোন সামরিক যানবাহন সিলেট অভিমুখে ফেরি অতিক্রম করেনি। অপরদিকে কালেঙ্গা ও মাতারকাপন এলাকা থেকে মিত্রবাহিনীর অপর দু’টি দল মৌলভীবাজার শহরের দিকে এগোতে থাকে। রাত ৪টায় ব্রিগেডিয়ার লক্ষণ সিং ও মীর্জা আজিজ আহমদ বেগ বেজবাড়ি এলাকায় পৌঁছলে ওয়াপদা-পিডিবি রেস্ট হাউসে গ্রিন সিগন্যাল জ্বলে ওঠে। রেস্ট হাউসে উঠে এখানে তারা সাময়িক বিরতি টানেন। পূর্ব আকাশে সূর্য ওঠার আগেই মেজর ডায়ানের নেতৃত্বে দুই প্লাটুন সৈন্য নিয়ে মীর্জা আজিজ আহমদ বেগ মৌলভীবাজার শহরে ঢোকেন। সেদিন ৮ই ডিসেম্বর। পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার হিসেবে গণ্য পিটিআই এবং মৌলভীবাজার কলেজে নেই কোন প্রাণের অস্তিত্ব। ৯ই ডিসেম্বর কারফিউ তুলে নেয়া হয়। মহকুমা প্রশাসককে খুঁজে এনে প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয় এবং তার উপস্থিতিতে তৎকালীন এমপিএ আজিজুর রহমান মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
No comments