পাগলী সেজে চলে যেতেন শত্রু ক্যাম্পে
কুড়িগ্রামের
রাজীবপুর উপজেলার শঙ্কমাধবপুরে জন্ম নেয়া ১৩-১৪ বছরের কিশোরী তারামন সারা
দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াত, মাছ ধরত, মাঝে মাঝে অন্যের বাড়িতে
ফাই-ফরমায়েশ খাটত। এ সময় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ক্রমশ দেশের চারদিকে যুদ্ধ
ছড়িয়ে পড়ে। পাকসেনারা তখন হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনে মত্ত। তখনও রাজীবপুরে
যুদ্ধের আঁচ লাগেনি। পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জে এ সময় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়।
পুড়িয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। নির্যাতনের শিকার সন্তান-স্বামীহারা কয়েকটি
পরিবার এ অঞ্চলে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের বুকফাটা কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।
এই কান্না দেখে বুকের মধ্যে ক্ষোভের তাড়না অনুভব করে কিশোরী তারামন। সে মনে
মনে এ অন্যায়ের প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর কিশোরীর
জীবনে আসে নতুন সম্ভাবনার দ্বার। তার মামাতো ভাই খলিল ইসলাম মেয়েটির মাকে
এসে বলে, বুবু রাজীবপুরে মুক্তিবাহিনী নতুন ক্যাম্প করেছে, সেখানে রান্নার
লোক দরকার। তারামন এ কাজ ভালো পারবে। ওকে আমাদের দরকার। তারামনের মা কুলসুম
বিবি বলেন, ‘এ মাইয়া আমি কার হাতে তুইলা দিমু।’ সে সময় এগিয়ে এলেন
মুক্তিফৌজ কমান্ডার মুহিব হালদার। তিনি তারামনকে ধর্মমেয়ে হিসেবে গ্রহণ
করলেন।
অনাদর-অবহেলায় বেড়ে ওঠা তারামন দীপ্ত শপথ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরে চলে এল দশগৃহ পাড়ার আজিত মাস্টারের বাড়িতে। এটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ক্যাম্প। এখানে প্রায় এক মণ চাল রান্না হতো। এ খাবার চলে যেত পাশের তিনটি ক্যাম্পে। এভাবেই কিশোরী তারামনের নতুন সংগ্রামী জীবনের শুরু হয়। কিছুদিন পর ক্যাম্প ছেড়ে রাজীবপুর মুন্সিপাড়া (পশ্চিমে) ইনসাফ আলী মেম্বারের বাড়িতে ২য় ক্যাম্প হয়। এরপর অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে কোদালকাটি চরে চলে আসে দলটি। তারপর ৪র্থ ক্যাম্প গঠন করা হল খারুয়ার চরের খালিপাড়ায়। এভাবেই সাধারণ এক কিশোরী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী হয়ে উঠল। সে রান্না করত, মুক্তিযোদ্ধাদের কাপড় কেচে দিত, তাদের খোঁজখবর নিত, অস্ত্রশস্ত্র এগিয়ে দিত। আর রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের বার্তা শুনে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার শপথ নিত।
তারামনের ধর্মবাবা মুহিব হালদার যুদ্ধের অবসরে একদিন তাকে ডেকে বলেন, তারামন তোকে অস্ত্র চালানো শিখাতে চাই। এ কথা শুনে তারামন উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল। সে বলল, আমি পারব! শুরু হল তারামনের জীবনের নতুন অধ্যায়। সে কাজের ফাঁকে বিভিন্ন অস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান নিতে থাকে। এরপর গুলি চালানো শেখে। তারামনের স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন সে রাইফেলে গুলি ছোড়া শিখল; সেদিন বুকের ওপর রাইফেলের ধাক্কায় ব্যথায় ককিয়ে ওঠে সে। অস্ত্র চালানো শেখার পর তারামনের বুকে সাহস বেড়ে যায়। সে তার ধর্মবাবাকে বলে, বাবা আমি যুদ্ধে যাব।
একদিন ভোরবেলা পাকসেনাদের একটি বিমান টহল দিচ্ছিল। তারামনরা মুহূর্তেই ক্যাম্পের মাটির কুটুরিতে আশ্রয় নেয়। নদীতে তখন একটি নৌকা আপ্রাণভাবে দাঁড় টেনে তীরে আসার চেষ্টা করছিল। এ সময় বিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হয়। আধা ঘণ্টা পর মুক্তিযোদ্ধারা এসে দেখেন সাধারণ কয়েকটি পরিবার নৌকায় ছিল। তাদের কেউ বেঁচে নেই।
এরপর কিশোরী তারামনের শুরু হল গোয়েন্দা জীবনের। সে সাঁতরে সোনাভরি নদী পেরিয়ে চোখে-মুখে কালি মেখে, চুলে ময়লা মেখে চলে যেত পাকসেনাদের ক্যাম্পে। পাগলী সেজে কান্নাকাটি করত, খাবার চাইত। আর ফাঁকে ফাঁকে পাকসেনাদের অবস্থান, সংখ্যা, অস্ত্রের খোঁজ-খবর নিত। পাকসেনারা দূর দূর করে তাকে তাড়িয়ে দিত। কখনও খাবার ছুড়ে দিত। এভাবেই পাকসেনাদের খবরাখবর নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আনত সে। মাঝে মধ্যে যুদ্ধেও তাকে নিয়ে যাওয়া হতো। ক্রমে দলে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে তারামন।
তারামন বিবি বললেন, আমরা কালাসোনা কেতনটারীতে থাকতে দেশ স্বাধীন হয়। আমার ধর্মবাবা মুহিব হালদার আমাদের নিয়ে গাইবান্ধা জেলার কামারজানি ও পলাশবাড়ী হয়ে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে অস্ত্র জমা দিতে যান। তিনি আর্মিতে যোগ দেয়ায় সেখানে আমি ১ বছর থাকার পর আবার শঙ্কমাধবপুরে চলে আসি।
‘বীরপ্রতীক’ খেতাব পাওয়া তারামন বিবি অনেকদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন। ইতিহাস গবেষকরা নব্বইয়ের দশকে তাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। অসুস্থ তারামন বিবির শেষ ইচ্ছা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যাওয়া। তিনি বলেন, ‘আমি এদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে মরতে চাই। আর অপেক্ষা নয়, বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক। হত্যাকারী, ইজ্জত হরণকারী রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের ক্ষমা নাই।’
অনাদর-অবহেলায় বেড়ে ওঠা তারামন দীপ্ত শপথ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরে চলে এল দশগৃহ পাড়ার আজিত মাস্টারের বাড়িতে। এটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ক্যাম্প। এখানে প্রায় এক মণ চাল রান্না হতো। এ খাবার চলে যেত পাশের তিনটি ক্যাম্পে। এভাবেই কিশোরী তারামনের নতুন সংগ্রামী জীবনের শুরু হয়। কিছুদিন পর ক্যাম্প ছেড়ে রাজীবপুর মুন্সিপাড়া (পশ্চিমে) ইনসাফ আলী মেম্বারের বাড়িতে ২য় ক্যাম্প হয়। এরপর অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে কোদালকাটি চরে চলে আসে দলটি। তারপর ৪র্থ ক্যাম্প গঠন করা হল খারুয়ার চরের খালিপাড়ায়। এভাবেই সাধারণ এক কিশোরী মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গী হয়ে উঠল। সে রান্না করত, মুক্তিযোদ্ধাদের কাপড় কেচে দিত, তাদের খোঁজখবর নিত, অস্ত্রশস্ত্র এগিয়ে দিত। আর রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের বার্তা শুনে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার শপথ নিত।
তারামনের ধর্মবাবা মুহিব হালদার যুদ্ধের অবসরে একদিন তাকে ডেকে বলেন, তারামন তোকে অস্ত্র চালানো শিখাতে চাই। এ কথা শুনে তারামন উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল। সে বলল, আমি পারব! শুরু হল তারামনের জীবনের নতুন অধ্যায়। সে কাজের ফাঁকে বিভিন্ন অস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান নিতে থাকে। এরপর গুলি চালানো শেখে। তারামনের স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন সে রাইফেলে গুলি ছোড়া শিখল; সেদিন বুকের ওপর রাইফেলের ধাক্কায় ব্যথায় ককিয়ে ওঠে সে। অস্ত্র চালানো শেখার পর তারামনের বুকে সাহস বেড়ে যায়। সে তার ধর্মবাবাকে বলে, বাবা আমি যুদ্ধে যাব।
একদিন ভোরবেলা পাকসেনাদের একটি বিমান টহল দিচ্ছিল। তারামনরা মুহূর্তেই ক্যাম্পের মাটির কুটুরিতে আশ্রয় নেয়। নদীতে তখন একটি নৌকা আপ্রাণভাবে দাঁড় টেনে তীরে আসার চেষ্টা করছিল। এ সময় বিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ করা হয়। আধা ঘণ্টা পর মুক্তিযোদ্ধারা এসে দেখেন সাধারণ কয়েকটি পরিবার নৌকায় ছিল। তাদের কেউ বেঁচে নেই।
এরপর কিশোরী তারামনের শুরু হল গোয়েন্দা জীবনের। সে সাঁতরে সোনাভরি নদী পেরিয়ে চোখে-মুখে কালি মেখে, চুলে ময়লা মেখে চলে যেত পাকসেনাদের ক্যাম্পে। পাগলী সেজে কান্নাকাটি করত, খাবার চাইত। আর ফাঁকে ফাঁকে পাকসেনাদের অবস্থান, সংখ্যা, অস্ত্রের খোঁজ-খবর নিত। পাকসেনারা দূর দূর করে তাকে তাড়িয়ে দিত। কখনও খাবার ছুড়ে দিত। এভাবেই পাকসেনাদের খবরাখবর নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর আনত সে। মাঝে মধ্যে যুদ্ধেও তাকে নিয়ে যাওয়া হতো। ক্রমে দলে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে তারামন।
তারামন বিবি বললেন, আমরা কালাসোনা কেতনটারীতে থাকতে দেশ স্বাধীন হয়। আমার ধর্মবাবা মুহিব হালদার আমাদের নিয়ে গাইবান্ধা জেলার কামারজানি ও পলাশবাড়ী হয়ে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে অস্ত্র জমা দিতে যান। তিনি আর্মিতে যোগ দেয়ায় সেখানে আমি ১ বছর থাকার পর আবার শঙ্কমাধবপুরে চলে আসি।
‘বীরপ্রতীক’ খেতাব পাওয়া তারামন বিবি অনেকদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিলেন। ইতিহাস গবেষকরা নব্বইয়ের দশকে তাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসেন। অসুস্থ তারামন বিবির শেষ ইচ্ছা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যাওয়া। তিনি বলেন, ‘আমি এদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে মরতে চাই। আর অপেক্ষা নয়, বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক। হত্যাকারী, ইজ্জত হরণকারী রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের ক্ষমা নাই।’
No comments