বাস্তবের পথে পদ্মা সেতু by আনোয়ার হোসেন
পদ্মা
বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ১৪ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এর বেশির ভাগই
সংযোগ সড়ক, পুনর্বাসন ও প্রকল্প এলাকার উন্নয়নকাজ। এখন শুরু হয়েছে মূল
সেতু নির্মাণের কাজ। সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত
প্রকল্পের মাওয়া সংযোগ সড়কের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ।
জাজিরার সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণকাজের অগ্রগতি হয়েছে যথাক্রমে ২০
দশমিক ৫ ও ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ এগিয়ে গেলে
অগ্রগতির হার আরও বেড়ে যাবে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এখন
মূল সেতুর জন্য নদীর বিভিন্ন অংশে মাটি পরীক্ষা চলছে। এরপর হবে পরীক্ষামূলক
পাইলিংয়ের (ভিত্তি) কাজ। এর বাইরে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ
মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা প্রশাসনকে দেওয়া হয়েছে এক হাজার
৭০ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য প্লট তৈরি করা
হয়েছে দুই হাজার ৫৯২টি। অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে
৭৯০টি প্লট হস্তান্তর করা হয়েছে।
২০১৮ সালে সেতু দিয়ে যুগপৎভাবে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করবে—এই পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সবকিছু। সম্প্রতি প্রকল্পের মাওয়া অংশে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মার দুই পাড়ে কর্মযজ্ঞ চলছে। মাওয়ায় বড় বড় বার্জে ক্রেন বসানো হয়েছে নির্মাণসামগ্রী ওঠানো-নামানোর জন্য। বড় বড় যন্ত্রে মাটি কাটা ও সমান করা হচ্ছে। চলছে সড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণের কাজ। পাড়ে গাছ কাটা হচ্ছে। নদীতে চলছে ড্রেজার। মানুষ আসছে চাকরির খোঁজে, ব্যবসার আশায়।
নির্মাণ অঙ্গনে (কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড) শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের থাকার জন্য প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা ঘর বানানো হচ্ছে। কয়েক শ শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। কেউ ইট ভাঙছেন। কেউ ভবন বানাচ্ছেন। নিরাপত্তা হেলমেট পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নির্দেশনা দিচ্ছেন। (স্বপ্নের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসছে পদ্মা সেতু by আনোয়ার হোসেন)
একই রকম কর্মমুখর পরিবেশ শরীয়তপুরের জাজিরা ও শিবচরে। সেখানে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে পাথর-বালু-ইট এনে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। একটু পর পর ইট-বালু-সিমেন্ট-পাথর-মাটি নিয়ে বড় বড় ট্রাক প্রবেশ করছে নির্মাণ এলাকায়। বড় বড় যন্ত্র দিয়ে মাটি সমান করার কাজ চলছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ। ওই বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমীক্ষা হয়েছিল জাপানি সংস্থা জাইকার অর্থে। নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দাতারা সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলে জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ডলার জোগান দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়।
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতু নির্মিত হবে কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে। ওপর দিয়ে যানবাহন আর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ চার বছরের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের। তবে বড় ধরনের কারিগরি সমস্যা কিংবা রাজনৈতিক বিপর্যয় নেমে না এলে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার আশ্বাস দিয়েছেন ঠিকাদারেরা।
সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য সাড়ে তিন বছর সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কাজ তদারকির জন্য একদল কর্মকর্তা প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করছেন। আর বনানীর সেতু ভবনে যাঁরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছেন, তাঁরাও বন্ধের দিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করছেন।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। বড় বড় চ্যালেঞ্জ পাড়ি দিতে হয়েছে। এখন শুধু কাজ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। ২০১৮ সালে ট্রেন ও যানবাহন চলবে। তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে শূন্য সহনশীলতা (জিরো টলারেন্স) দেখানো হবে। শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।’
পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ ছয় ভাগে (প্যাকেজ) ভাগ করা হয়েছে। পাঁচটি ভৌত কাজের এবং একটি তদারকি পরামর্শকসংক্রান্ত। ভৌত কাজগুলো হলো মূল সেতু, নদীশাসন, দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো। এসব কাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে।
মূল সেতু নির্মাণে গত জুনে চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। প্রকল্পের কাজ তদারকির দায়িত্বে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণ পর্যায়ে কারিগরি নানা জটিল বিষয় আসতে পারে। তবে সবকিছুই ঠিকঠাকমতো এগোচ্ছে। কাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে বলে আশা করা যায়।
পাঁচটি ভৌত ও দুটি তদারক প্যাকেজ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। নদীর তীর রক্ষা, ফেরিঘাট সরানো ও নিরাপত্তাব্যবস্থা রক্ষার ব্যয় ধরলে তা ২৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছাবে। সব ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্প প্রস্তাব আবার সংশোধন করতে হবে বলে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ভৌত কাজের ঠিকাদারদের প্রত্যেককে শুরুতেই চুক্তিমূল্যের ১৫ শতাংশ হারে অগ্রিম অর্থ দেওয়া হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ১০ শতাংশ। সব আন্তর্জাতিক দরপত্রেই যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও প্রকল্প এলাকার উন্নয়নের জন্য অগ্রিম অর্থ দেওয়ার নিয়ম আছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রে ঠিকাদারের পাওনার একটি বড় অংশ ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এটা চুক্তির সময় উল্লেখও থাকে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ পাওনা ডলারে পরিশোধ করতে হবে বলে সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রায় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকায় প্রথম পদ্মা সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। ২০১১ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারিভাবে এখনো ২০১১ সালে ধরা ব্যয়ই বহাল আছে।
সেতু বিভাগ থেকে গত এপ্রিলের শেষের দিকে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দিয়ে প্রকল্প সংশোধনসংক্রান্ত নির্দেশনা থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধনসংক্রান্ত সরকারের পরিপত্র অনুসারে একটি প্রকল্প সর্বোচ্চ দুবার সংশোধন করা যাবে। তৃতীয়বার করা যাবে পরিকল্পনামন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনায়।
সরকারের একটি সূত্র জানায়, দুই কারণে সরকার এই প্রকল্পটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রথমত, এর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে সরকারের তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটাকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের সক্ষমতাকেও তুলে ধরতে চায় সরকার। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ২০০৮ সালে। আগামী নির্বাচনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে রাজনৈতিকভাবে সরকার বিশেষ সুবিধা পাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে।
এ প্রকল্পের বিষয়ে সরকারের স্পর্শকাতরতার উদাহরণ দিতে গিয়ে সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, মাওয়া ফেরিঘাট সরানোর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কয়েকবার তাগিদ দিয়েছে। এরপর গত ২০ নভেম্বরের মধ্যে ঘাট সরানোর সময় বেঁধে দেওয়া হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তারা ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চায়। এটা জেনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তাৎক্ষণিক ঘাট সরানোর নির্দেশ দেয় এবং ২৭ নভেম্বরই ঘাট সরানো হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এও জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে সফরে গেলে এসেই প্রথমে পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
২০১৮ সালে সেতু দিয়ে যুগপৎভাবে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করবে—এই পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সবকিছু। সম্প্রতি প্রকল্পের মাওয়া অংশে গিয়ে দেখা যায়, পদ্মার দুই পাড়ে কর্মযজ্ঞ চলছে। মাওয়ায় বড় বড় বার্জে ক্রেন বসানো হয়েছে নির্মাণসামগ্রী ওঠানো-নামানোর জন্য। বড় বড় যন্ত্রে মাটি কাটা ও সমান করা হচ্ছে। চলছে সড়ক নির্মাণ ও সম্প্রসারণের কাজ। পাড়ে গাছ কাটা হচ্ছে। নদীতে চলছে ড্রেজার। মানুষ আসছে চাকরির খোঁজে, ব্যবসার আশায়।
নির্মাণ অঙ্গনে (কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড) শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের থাকার জন্য প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা ঘর বানানো হচ্ছে। কয়েক শ শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। কেউ ইট ভাঙছেন। কেউ ভবন বানাচ্ছেন। নিরাপত্তা হেলমেট পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নির্দেশনা দিচ্ছেন। (স্বপ্নের খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আসছে পদ্মা সেতু by আনোয়ার হোসেন)
একই রকম কর্মমুখর পরিবেশ শরীয়তপুরের জাজিরা ও শিবচরে। সেখানে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে পাথর-বালু-ইট এনে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। একটু পর পর ইট-বালু-সিমেন্ট-পাথর-মাটি নিয়ে বড় বড় ট্রাক প্রবেশ করছে নির্মাণ এলাকায়। বড় বড় যন্ত্র দিয়ে মাটি সমান করার কাজ চলছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ। ওই বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমীক্ষা হয়েছিল জাপানি সংস্থা জাইকার অর্থে। নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে। মূল প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দাতারা সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলে জটিলতা তৈরি হয়। একপর্যায়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ডলার জোগান দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়।
পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতলবিশিষ্ট এই সেতু নির্মিত হবে কংক্রিট আর স্টিল দিয়ে। ওপর দিয়ে যানবাহন আর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন।
সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ চার বছরের মধ্যে শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের। তবে বড় ধরনের কারিগরি সমস্যা কিংবা রাজনৈতিক বিপর্যয় নেমে না এলে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ করার আশ্বাস দিয়েছেন ঠিকাদারেরা।
সংযোগ সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকাজের জন্য সাড়ে তিন বছর সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কাজ তদারকির জন্য একদল কর্মকর্তা প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করছেন। আর বনানীর সেতু ভবনে যাঁরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে রয়েছেন, তাঁরাও বন্ধের দিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করছেন।
জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়, দৃশ্যমান বাস্তবতা। বড় বড় চ্যালেঞ্জ পাড়ি দিতে হয়েছে। এখন শুধু কাজ। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হবে। ২০১৮ সালে ট্রেন ও যানবাহন চলবে। তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে শূন্য সহনশীলতা (জিরো টলারেন্স) দেখানো হবে। শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য।’
পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ ছয় ভাগে (প্যাকেজ) ভাগ করা হয়েছে। পাঁচটি ভৌত কাজের এবং একটি তদারকি পরামর্শকসংক্রান্ত। ভৌত কাজগুলো হলো মূল সেতু, নদীশাসন, দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো। এসব কাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে।
মূল সেতু নির্মাণে গত জুনে চীনের চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। প্রকল্পের কাজ তদারকির দায়িত্বে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেসওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
জানতে চাইলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণ পর্যায়ে কারিগরি নানা জটিল বিষয় আসতে পারে। তবে সবকিছুই ঠিকঠাকমতো এগোচ্ছে। কাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে বলে আশা করা যায়।
পাঁচটি ভৌত ও দুটি তদারক প্যাকেজ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। নদীর তীর রক্ষা, ফেরিঘাট সরানো ও নিরাপত্তাব্যবস্থা রক্ষার ব্যয় ধরলে তা ২৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছাবে। সব ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্প প্রস্তাব আবার সংশোধন করতে হবে বলে সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ভৌত কাজের ঠিকাদারদের প্রত্যেককে শুরুতেই চুক্তিমূল্যের ১৫ শতাংশ হারে অগ্রিম অর্থ দেওয়া হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে ১০ শতাংশ। সব আন্তর্জাতিক দরপত্রেই যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও প্রকল্প এলাকার উন্নয়নের জন্য অগ্রিম অর্থ দেওয়ার নিয়ম আছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রে ঠিকাদারের পাওনার একটি বড় অংশ ডলারে পরিশোধ করতে হয়। এটা চুক্তির সময় উল্লেখও থাকে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রায় ৭০ শতাংশ পাওনা ডলারে পরিশোধ করতে হবে বলে সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) প্রায় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকায় প্রথম পদ্মা সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। ২০১১ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, সরকারিভাবে এখনো ২০১১ সালে ধরা ব্যয়ই বহাল আছে।
সেতু বিভাগ থেকে গত এপ্রিলের শেষের দিকে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি দিয়ে প্রকল্প সংশোধনসংক্রান্ত নির্দেশনা থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পকে অব্যাহতি দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধনসংক্রান্ত সরকারের পরিপত্র অনুসারে একটি প্রকল্প সর্বোচ্চ দুবার সংশোধন করা যাবে। তৃতীয়বার করা যাবে পরিকল্পনামন্ত্রীর বিশেষ বিবেচনায়।
সরকারের একটি সূত্র জানায়, দুই কারণে সরকার এই প্রকল্পটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রথমত, এর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে সরকারের তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এটাকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের সক্ষমতাকেও তুলে ধরতে চায় সরকার। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ২০০৮ সালে। আগামী নির্বাচনে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে রাজনৈতিকভাবে সরকার বিশেষ সুবিধা পাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে।
এ প্রকল্পের বিষয়ে সরকারের স্পর্শকাতরতার উদাহরণ দিতে গিয়ে সেতু বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, মাওয়া ফেরিঘাট সরানোর জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কয়েকবার তাগিদ দিয়েছে। এরপর গত ২০ নভেম্বরের মধ্যে ঘাট সরানোর সময় বেঁধে দেওয়া হয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ)। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তারা ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় চায়। এটা জেনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তাৎক্ষণিক ঘাট সরানোর নির্দেশ দেয় এবং ২৭ নভেম্বরই ঘাট সরানো হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এও জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদেশে সফরে গেলে এসেই প্রথমে পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
No comments