গীতাকে ভারতের জাতীয় গ্রন্থ করার দাবি নিয়ে বিতর্ক
হিন্দু
ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতাকে ভারতের জাতীয় গ্রন্থ হিসেবে ঘোষণার দাবি তুলে
বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রভাবশালী বিজেপি নেত্রী
সুষমা স্বরাজ। সংসদে আজ একাধিক বিরোধী দল মিস স্বরাজের এই প্রস্তাবের
নিন্দা করে বলেছেন এ ধরনের উদ্যোগ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিকেই বিপন্ন
করে তুলবে। ভারতের মুসলিম পার্সোনেল ল বোর্ডও এই প্রস্তাবকে সম্পূর্ণ
অপ্রয়োজনীয় বলে বর্ণনা করেছে - যদিও সংসদে বিজেপি ও তার শরিকরা বলেছে, এই
প্রস্তাবে অসুবিধার কিছু নেই! সুষমা স্বরাজের প্রস্তাব ভগবত গীতাকে নিয়ে
এই বিতর্কের সূত্রপাত রোববার দিল্লির এক অনুষ্ঠানে, যেখানে এই গ্রন্থের
৫১৫১ বর্ষপূর্তি উদযাপন করা হচ্ছিল। গীতা প্রেরণা মহোৎসব নামে সেই
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেন, ভাগবত গীতা কার্যত ভারতের
জাতীয় গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েই গেছে – আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটা শুধু বাকি! মিস
স্বরাজ তার ভাষণে বলেন, তিনি সংসদে অনেক আগেই গীতাকে রাষ্ট্রীয় গ্রন্থ
হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন। নতুন সরকার এখনও সেই ঘোষণা করেনি ঠিকই,
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমেরিকা সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট
ওবামা-র হাতে গীতা উপহার দিয়ে এই পবিত্র গ্রন্থকে বস্তুত সেই মর্যাদাই
দিয়ে দিয়েছেন। গীতা যে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার, এ কথা মোদি নিজেও
একাধিকবার বলেছেন – জাপানের সম্রাট থেকে শুরু করে অনেক রাষ্ট্রনেতার হাতেই
তিনি গীতা তুলে দিয়েছেন। কিন্তু গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ হিসেবে ঘোষণার
প্রস্তাবে তুমুল আপত্তি জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নানা ধর্মীয়
সংগঠন। বিরোধীদের যুক্তি, কোরান নয় কেন? দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের
অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ নির্মলাংশু মুখার্জি তো সরাসরি বলছেন, এটা একটা
অত্যন্ত বিপজ্জনক পদক্ষেপ। অধ্যাপক মুখার্জির যুক্তি, লক্ষ লক্ষ ভারতীয়
গীতার পাশাপাশি গীতাঞ্জলি বা কোরানও পড়ে – সেগুলোও তো জাতীয় গ্রন্থের
দাবিদার হতে পারে। তা ছাড়া কোনো একটি বইকে জাতীয় গ্রন্থ বলার অর্থ দেশে
একটি জাতির অস্তিত্ত্বই স্বীকার করা, কিন্তু তাতে ভারতের বহুত্ববাদী
সংস্কৃতিকে খাটো করা হয়। সংসদে আজ প্রায় একই যুক্তি দিয়ে বিরোধী দলগুলোও
মিস স্বরাজের প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বহুজন সমাজ পার্টি নেত্রী
মায়াবতী বলেন, গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ ঘোষণা করা হলে অন্য ধর্মের পবিত্র
গ্রন্থগুলো কী দোষ করল? সিপিআই নেতা ডি রাজা বলেন, এই ধরনের উদ্যোগ ভারতীয়
গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকেই নষ্ট করে দেবে। কংগ্রেস ও তৃণমূল
কংগ্রেসও নিন্দা জানায় প্রায় একই সুরে। অপ্রয়োজনীয় প্রস্তাব, দাবি
মুসলিম নেতাদের মুসলিম পার্সোনেল ল বোর্ডের সদস্য কামাল ফারুকি বলেছেন,
আসলে এই প্রস্তাবটাই সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত ও অপ্রয়োজনীয়। তার কথায়, ‘মানলাম
গীতা কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় – এটা একটা জীবনযাপনের পদ্ধতি বাতলানোর রাস্তা।
অনেকেই সেটা খুব আগ্রহভরে পড়ে থাকেন। কিন্তু সেটাকে যখন রাজনৈতিকভাবে
ব্যবহারের চেষ্টা হয়, তখনই প্রশ্ন জাগে এতে কি দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে
নষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও তখনই মনে হয়, আমাদের দেশ কি
আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ?’ গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ হিসেবে ঘোষণার আদৌ প্রয়োজন আছে
কি না, তা নিয়ে বিজেপি-র ভেতরেও অবশ্য মতভেদের আভাস মিলেছে। দলের
আইন-বিশেষজ্ঞ নেতা সুব্রহ্মণ্যম যেমন স্বামী বলেছেন, ঘোষণা হল কি না-হল
তাতে কিছু যায় আসে না, গীতাই ভারতের ডি-ফ্যাক্টো জাতীয় গ্রন্থ। সংসদে
বিজেপি বা তাদের শরিক শিবসেনার নেতারাও বলেছেন – গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ
হিসেবে ঘোষণা করা উচিত কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। যা থেকে ইঙ্গিত
মিলছে, পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এই ধর্মগ্রন্থ ভারতে নতুন এক রাজনৈতিক
বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসছে!
No comments