হাজারীবাগে বিষের কারখানা!
বৃহস্পতিবার
সন্ধ্যা ৭টা। রাজধানীর হাজারীবাগ কালুনগর খালের পাশে তিনটি হান্ডিতে
(ভাটি) সাজানো হল চামড়ার বর্জ্য। তাতে ঢালা হল বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য।
প্রায় একঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুতি শেষ। এবার আগুন দেয়ার পালা। কিন্তু তা না
করে ছয় শ্রমিক হান্ডির পাশে বসে আছেন। তারাই জানালেন, হান্ডিতে আগুন
জ্বালানোর ক্লিয়ারেন্স আসেনি। পুলিশের অনুমতি পেলেই মালিক মোবাইল ফোনে
জানাবেন। তারপর জ্বলবে আগুন। এই করতেই রাত ৯টা। আরও ১০ মিনিট পর প্রায় একই
সঙ্গে হান্ডিগুলোর নিচে আগুন জ্বালানো হয়। জ্বালানি হিসেবে দেয়া হল জুতার
বাতিল সোল ও চামড়ার ভুসি। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে চুলার আগুন। সেই সঙ্গে বের
হতে থাকে মানবদেহের জন্য মারাÍক ক্ষতিকর ঝাঁঝালো ও দুর্গন্ধময় ধোঁয়া। এই
ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় পুরো হাজারীবাগের আকাশ। বিকট গন্ধে ভরে যায় বাতাস। এই
চামড়ার বর্জ্য এভাবে জ্বালিয়ে তরল করার পর শুকিয়ে বানানো হয় ‘শুঁটকি’।
সেগুলো দিয়ে তৈরি করা হয় খামারের মাছ ও মুরগির খাদ্য। এই খাবারে মিশে থাকে
ক্যাডমিয়া, ক্রোমিয়াম, মার্কারির মতো বিষাক্ত উপাদান। আর শেষ পর্যন্ত তা
মাছ, মাংস ও ডিমের মাধ্যমে নীরব ঘাতকের মতো ঢুকে যাচ্ছে মানুষের শরীরে।
ডেকে আনছে ক্যান্সারের মতো আরও অনেক মারণব্যাধি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্যানারির বর্জ্য থেকে উৎপাদিত পোল্ট্রি ফিডে ক্যাডমিয়াম, লেড, মার্কারি ও ক্রোমিয়ামসহ এমন কিছু বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে যা মানুষের শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। তাছাড়া আরও অনেক মরণব্যাধির উপাদান রয়েছে এসব বর্জ্য। বিষাক্ত খাদ্য তৈরির এই কারখানাগুলো বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্টদের কঠোর পদক্ষেপ দরকার বলে মনে করেন তারা।
অন্যদিকে পরিবেশবাদীদের সব সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে হাজারীবাগের বেড়িবাঁধের দু’পাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক অবৈধ শুঁটকি কারখানা। সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালত কয়েকটি কারাখানা বন্ধ করে দেন। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেনি ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে রাতের অন্ধকারে এখনও অর্ধশতাধিক শুঁটকি কারখানা চালানো হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন হান্ডিপ্রতি পুলিশকে পাঁচশ’ টাকা চাঁদা দেয়ার পর আগুন জ্বালানোর অনুমতি পায় এই শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। পুলিশকে টাকা না দিয়ে কেউ হান্ডিতে আগুন দিতে পারে না। রাত ৯টার মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে হান্ডিগুলোতে আগুন দেয়া হয়। ভোররাত পর্যন্ত চলে এসব কারখানার কাজকর্ম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগে ট্যানারির বর্জ্য সাধারণত বিভিন্নভাবে অপসারণ করা হতো। বেশির ভাগই ফেলা হতো বুড়িগঙ্গায়। বেশ কয়েক বছর আগে এই বর্জ্য দিয়ে খামারের মাছ ও মুরগির খাদ্যের অন্যতম উপাদান শুঁটকি তৈরির ব্যবসা শুরু হয়। লাভ বেশি হওয়ায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠে একের পর এক কারখানা। যদিও ট্যানারির কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে মাছ ও মুরগির খাদ্যে মেশানোর জন্য তৈরি এ শুঁটকি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। এ খাদ্য খেয়ে বেড়ে ওঠা মাছ ও পোল্ট্রির মাংসও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এ কারখানাগুলো শুধু মানবস্বাস্থ্যের জন্যই ঝুুঁকি বহন করছে না, পরিবেশেরও মারাত্মক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আবদুল মতিন যুগান্তরকে বলেন, ট্যানারির বর্জ্য থেকে যে পোল্ট্রি খাদ্য তৈরি করা হয় তা ডেঞ্জারাস। বিষাক্ত খাদ্য মুরগির মাংস ও ডিমের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। তিনি আরও বলেন, পোল্ট্রি খাদ্য তৈরির এসব কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া মানুষের শ্বাসনালিতে যায়। এতে ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। মানুষকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে দ্রুত শুঁটকি কারখানাগুলো বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ট্যানারির উপজাত হিসেবে তৈরি বিষাক্ত পোল্ট্রি ফিড খেয়ে চাষের মাছ- মুরগির দেহে যুক্ত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম। আর এটিই মানবদেহে ক্যান্সার সংক্রমণে প্রধান ভূমিকা রাখছে। এছাড়া কিডনি ও লিভারের জটিল রোগের অন্যতম কারণও এই ক্রোমিয়াম। মুরগির খাবারেই রয়েছে উচ্চমাত্রার ক্রোমিয়াম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবুল হোসেন দীর্ঘদিন গবেষণা করে এই ভয়ংকর তথ্য পেয়েছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মানুষের শরীরে খুব সামান্য ক্রোমিয়াম প্রয়োজন। কিন্তু চাষের মাছ-মুরগির মাধ্যমে শরীরে প্রচুর পরিমাণে ক্রোমিয়াম প্রবেশ করছে- যা কিডনি, যকৃৎসহ বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করছে। তিনি বলেন, ট্যানারিগুলোতে পশুর চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রচুর ক্রোমিয়াম ব্যবহৃত হয়। উচ্চমাত্রার এই ক্রোমিয়ামসমৃদ্ধ ঝুট চামড়া দিয়ে তৈরি হচ্ছে পশু খাদ্য।
প্রবাদ আছে ‘শুঁটকির কারখানায় বিড়াল চৌকিদার।’ বাস্তবেও ট্যানারি বর্জ্য থেকে উৎপাদিত শুঁটকি কারখানাগুলো পুলিশের গোচরেই চালানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সরেজমিন হাতেনাতেই মেলে এর প্রমাণ। ওইদিন রাত ১০টা ২৫ মিনিটে কালুনগর খালের পাশে (ছামিনা ট্যানারির অদূরে) হান্ডি জ্বলার সময় হাজারীবাগ থানা পুলিশের একটি টিম দেখা যায়। ওই টিমের প্রধান ছিলেন হাজারীবাগ থানার এএসআই কামাল। তার সঙ্গে ছিলেন আরও তিন সদস্য। তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে চলে যান বেড়িবাঁধের ওপরে রাখা গাড়ির কাছে। পুর্লিশের পেছনে এই প্রতিবেদকও যান। গাড়িতে উঠে বসেন এএসআই কামাল। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবক তার সঙ্গে প্রায় ৩ মিনিট কথা বলেন। এরপর গাড়িটি চলে যায়। ওই দুই যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের নাম এনায়েত ও মাসুদ। তারা শুঁটকি ব্যবসায়ী। ঝাউচরে গ্যাস ফিল্ডের উত্তরে তাদের কারখানা। হান্ডিতে আগুন দেয়ার অনুমতি নেয়ার জন্যই তারা পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন। টাকা দিয়ে অনুমতি পাওয়ার পরই তারা কারাখানায় ফিরে হান্ডিতে আগুন দেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, হান্ডির চাঁদার টাকা থানার ওসি পর্যন্ত পৌঁছায়। তবে টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করে হাজারীবাগ থানার ওসি কাজী মাইনুল হোসেন শুক্রবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত সব বন্ধ করে দিয়ে গেছেন। এখন আর হান্ডি জ্বালাতে দেয়া হয় না। হাজারীবাগ থানা পুলিশকে টাকা দিয়ে শুঁটকি কারখানা চালানো হচ্ছে এমন অভিযোগে ওসি বলেন, এসব সত্য নয়। আমার জানা মতে, সব বন্ধ আছে। বৃহস্পতিবার রাতে একাধিক কারখানায় শুঁটকি বানাতে দেখা গেছে এবং ছামিনা ট্যানারির অদূরে এএসআই কামালকে ফোর্সসহ হান্ডিগুলোর পাশে দেখা গেছে, সেসময় হান্ডিতে আগুন জ্বলছিল- এমন তথ্য জানানোর পর ওসি বিস্ময়ের সুরে বলেন, তাই না কি! কামাল ওগুলো বন্ধ করে দেয়নি? নাকি, বন্ধ না করে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেই চলে গেছে। ওসি আরও বলেন, এটা তো হওয়ার কথা না। আমি বিষয়টি দেখছি। কামালের সঙ্গে কথা বলছি।
এদিকে ঢাকা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এমদাদুল হক তালুকদার রোববার জানান, এ ধরনের কোনো কারখানার অনুমোদন তারা দেননি। তিনি বলেন, কারখানাগুলো অবৈধভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে বেশির ভাগই সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। তারপরও কোনো কারখানায় উৎপাদন চালানোর খবর পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সরজেমিন ঘুরে দেখা গেছে-ঝাউচর গ্যাস ফিল্ডের উত্তর পাশে মাঠের মধ্যে লেবুর দু’টি, জাহাঙ্গীরের দু’টি, শাজাহান মাস্টার রোডে হান্নানের একটি, বেড়িবাঁধের পাশে জুয়েল ও রাজ্জাকের দু’টি, স্বপন ও রনির দু’টি, ছামিনা ট্যানারির অদূরে খালের পাশে সুজনের একটি, ল্যাংড়া মজিবের একটি, রকির দু’টি, এনামের একটি, বেড়িবাঁধের পাশে রানার দু’টিসহ অন্তত ৩০টি শুঁটকি কারখানায় হান্ডি জ্বলছে। এছাড়া মনির দু’টি হান্ডি, শুটকি মনির একটি, ঝাউচড়ে ইব্রাহিম একটি, রনি একটি, আবদুল একটি, ইসমাইল দু’টি, রবিন তিনটি, স্বপন দু’টি, জালাল একটি, পাকা ভাই দু’টি, মো. আলী দু’টি, নাহিদ একটি, নুর মোহাম্মদ দু’টি, হারুন একটি, ইকবাল দু’টি ও আজিজ মিয়া দু’টি ও রফিকসহ আরও কয়েকজন অবৈধভাবে কয়েকটি হান্ডি জ্বালিয়ে মুরগির খাদ্য হিসেবে শুঁটকি তৈরি করছেন। এই শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তাদের অনেকেই হাজারীবাগে তৈরি করছেন মুরগি ও মাছের খাদ্য। এছাড়া অনেকে শুধু শুঁটকি বানিয়ে তা চট্টগ্রাম, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ফিড মিলে বিক্রি করে দেন।
এলাকাবাসী বলছেন, কারখানার কালো ধোঁয়া ও বর্জ্যরে উৎকট গন্ধে বিপর্যস্ত তারা। রাত ৯টার পরপরই হাজারীবাগ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। শিশু-বৃদ্ধ সবার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। ধোঁয়ায় তাদের চোখ জ্বলে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপার্টমেন্ট অব কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (বুয়েট) বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আলী আহাম্মদ শওকত চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত সব ধরনের ধোঁয়াই ক্ষতিকর। তবে পশুর চামড়া ও কেমিক্যালের ধোঁয়া মারাÍক। শুক্রবার সকালে হাজারীবাগ ঝাউচড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাঠের মধ্যে মাটিতে ত্রিপল পেতে শুঁটকি শুকানো হচ্ছে। চামড়ার বর্জ্যের স্তূপ করে রাখা হয় খোলা জায়গায়। শ্রমিকদের হাতে-পায়ে গ্লাভস নেই। ঝাউচরের বাসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, আমরা নরকে বাস করছি। এলাকায় কোনো মানুষ নতুন এলে দুর্গন্ধে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্যানারির বর্জ্য থেকে উৎপাদিত পোল্ট্রি ফিডে ক্যাডমিয়াম, লেড, মার্কারি ও ক্রোমিয়ামসহ এমন কিছু বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে যা মানুষের শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। তাছাড়া আরও অনেক মরণব্যাধির উপাদান রয়েছে এসব বর্জ্য। বিষাক্ত খাদ্য তৈরির এই কারখানাগুলো বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্টদের কঠোর পদক্ষেপ দরকার বলে মনে করেন তারা।
অন্যদিকে পরিবেশবাদীদের সব সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে হাজারীবাগের বেড়িবাঁধের দু’পাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক অবৈধ শুঁটকি কারখানা। সম্প্রতি ভ্রাম্যমাণ আদালত কয়েকটি কারাখানা বন্ধ করে দেন। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেনি ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে রাতের অন্ধকারে এখনও অর্ধশতাধিক শুঁটকি কারখানা চালানো হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিদিন হান্ডিপ্রতি পুলিশকে পাঁচশ’ টাকা চাঁদা দেয়ার পর আগুন জ্বালানোর অনুমতি পায় এই শুঁটকি ব্যবসায়ীরা। পুলিশকে টাকা না দিয়ে কেউ হান্ডিতে আগুন দিতে পারে না। রাত ৯টার মধ্যে সব গুছিয়ে নিয়ে হান্ডিগুলোতে আগুন দেয়া হয়। ভোররাত পর্যন্ত চলে এসব কারখানার কাজকর্ম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আগে ট্যানারির বর্জ্য সাধারণত বিভিন্নভাবে অপসারণ করা হতো। বেশির ভাগই ফেলা হতো বুড়িগঙ্গায়। বেশ কয়েক বছর আগে এই বর্জ্য দিয়ে খামারের মাছ ও মুরগির খাদ্যের অন্যতম উপাদান শুঁটকি তৈরির ব্যবসা শুরু হয়। লাভ বেশি হওয়ায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠে একের পর এক কারখানা। যদিও ট্যানারির কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করে মাছ ও মুরগির খাদ্যে মেশানোর জন্য তৈরি এ শুঁটকি অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। এ খাদ্য খেয়ে বেড়ে ওঠা মাছ ও পোল্ট্রির মাংসও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। এ কারখানাগুলো শুধু মানবস্বাস্থ্যের জন্যই ঝুুঁকি বহন করছে না, পরিবেশেরও মারাত্মক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. আবদুল মতিন যুগান্তরকে বলেন, ট্যানারির বর্জ্য থেকে যে পোল্ট্রি খাদ্য তৈরি করা হয় তা ডেঞ্জারাস। বিষাক্ত খাদ্য মুরগির মাংস ও ডিমের মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। তিনি আরও বলেন, পোল্ট্রি খাদ্য তৈরির এসব কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া মানুষের শ্বাসনালিতে যায়। এতে ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। মানুষকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করতে দ্রুত শুঁটকি কারখানাগুলো বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
ট্যানারির উপজাত হিসেবে তৈরি বিষাক্ত পোল্ট্রি ফিড খেয়ে চাষের মাছ- মুরগির দেহে যুক্ত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম। আর এটিই মানবদেহে ক্যান্সার সংক্রমণে প্রধান ভূমিকা রাখছে। এছাড়া কিডনি ও লিভারের জটিল রোগের অন্যতম কারণও এই ক্রোমিয়াম। মুরগির খাবারেই রয়েছে উচ্চমাত্রার ক্রোমিয়াম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবুল হোসেন দীর্ঘদিন গবেষণা করে এই ভয়ংকর তথ্য পেয়েছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মানুষের শরীরে খুব সামান্য ক্রোমিয়াম প্রয়োজন। কিন্তু চাষের মাছ-মুরগির মাধ্যমে শরীরে প্রচুর পরিমাণে ক্রোমিয়াম প্রবেশ করছে- যা কিডনি, যকৃৎসহ বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করছে। তিনি বলেন, ট্যানারিগুলোতে পশুর চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রচুর ক্রোমিয়াম ব্যবহৃত হয়। উচ্চমাত্রার এই ক্রোমিয়ামসমৃদ্ধ ঝুট চামড়া দিয়ে তৈরি হচ্ছে পশু খাদ্য।
প্রবাদ আছে ‘শুঁটকির কারখানায় বিড়াল চৌকিদার।’ বাস্তবেও ট্যানারি বর্জ্য থেকে উৎপাদিত শুঁটকি কারখানাগুলো পুলিশের গোচরেই চালানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সরেজমিন হাতেনাতেই মেলে এর প্রমাণ। ওইদিন রাত ১০টা ২৫ মিনিটে কালুনগর খালের পাশে (ছামিনা ট্যানারির অদূরে) হান্ডি জ্বলার সময় হাজারীবাগ থানা পুলিশের একটি টিম দেখা যায়। ওই টিমের প্রধান ছিলেন হাজারীবাগ থানার এএসআই কামাল। তার সঙ্গে ছিলেন আরও তিন সদস্য। তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে চলে যান বেড়িবাঁধের ওপরে রাখা গাড়ির কাছে। পুর্লিশের পেছনে এই প্রতিবেদকও যান। গাড়িতে উঠে বসেন এএসআই কামাল। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবক তার সঙ্গে প্রায় ৩ মিনিট কথা বলেন। এরপর গাড়িটি চলে যায়। ওই দুই যুবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের নাম এনায়েত ও মাসুদ। তারা শুঁটকি ব্যবসায়ী। ঝাউচরে গ্যাস ফিল্ডের উত্তরে তাদের কারখানা। হান্ডিতে আগুন দেয়ার অনুমতি নেয়ার জন্যই তারা পুলিশের সঙ্গে কথা বলছিলেন। টাকা দিয়ে অনুমতি পাওয়ার পরই তারা কারাখানায় ফিরে হান্ডিতে আগুন দেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, হান্ডির চাঁদার টাকা থানার ওসি পর্যন্ত পৌঁছায়। তবে টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করে হাজারীবাগ থানার ওসি কাজী মাইনুল হোসেন শুক্রবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত সব বন্ধ করে দিয়ে গেছেন। এখন আর হান্ডি জ্বালাতে দেয়া হয় না। হাজারীবাগ থানা পুলিশকে টাকা দিয়ে শুঁটকি কারখানা চালানো হচ্ছে এমন অভিযোগে ওসি বলেন, এসব সত্য নয়। আমার জানা মতে, সব বন্ধ আছে। বৃহস্পতিবার রাতে একাধিক কারখানায় শুঁটকি বানাতে দেখা গেছে এবং ছামিনা ট্যানারির অদূরে এএসআই কামালকে ফোর্সসহ হান্ডিগুলোর পাশে দেখা গেছে, সেসময় হান্ডিতে আগুন জ্বলছিল- এমন তথ্য জানানোর পর ওসি বিস্ময়ের সুরে বলেন, তাই না কি! কামাল ওগুলো বন্ধ করে দেয়নি? নাকি, বন্ধ না করে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেই চলে গেছে। ওসি আরও বলেন, এটা তো হওয়ার কথা না। আমি বিষয়টি দেখছি। কামালের সঙ্গে কথা বলছি।
এদিকে ঢাকা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এমদাদুল হক তালুকদার রোববার জানান, এ ধরনের কোনো কারখানার অনুমোদন তারা দেননি। তিনি বলেন, কারখানাগুলো অবৈধভাবেই গড়ে তোলা হয়েছে। ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে বেশির ভাগই সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। তারপরও কোনো কারখানায় উৎপাদন চালানোর খবর পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সরজেমিন ঘুরে দেখা গেছে-ঝাউচর গ্যাস ফিল্ডের উত্তর পাশে মাঠের মধ্যে লেবুর দু’টি, জাহাঙ্গীরের দু’টি, শাজাহান মাস্টার রোডে হান্নানের একটি, বেড়িবাঁধের পাশে জুয়েল ও রাজ্জাকের দু’টি, স্বপন ও রনির দু’টি, ছামিনা ট্যানারির অদূরে খালের পাশে সুজনের একটি, ল্যাংড়া মজিবের একটি, রকির দু’টি, এনামের একটি, বেড়িবাঁধের পাশে রানার দু’টিসহ অন্তত ৩০টি শুঁটকি কারখানায় হান্ডি জ্বলছে। এছাড়া মনির দু’টি হান্ডি, শুটকি মনির একটি, ঝাউচড়ে ইব্রাহিম একটি, রনি একটি, আবদুল একটি, ইসমাইল দু’টি, রবিন তিনটি, স্বপন দু’টি, জালাল একটি, পাকা ভাই দু’টি, মো. আলী দু’টি, নাহিদ একটি, নুর মোহাম্মদ দু’টি, হারুন একটি, ইকবাল দু’টি ও আজিজ মিয়া দু’টি ও রফিকসহ আরও কয়েকজন অবৈধভাবে কয়েকটি হান্ডি জ্বালিয়ে মুরগির খাদ্য হিসেবে শুঁটকি তৈরি করছেন। এই শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তাদের অনেকেই হাজারীবাগে তৈরি করছেন মুরগি ও মাছের খাদ্য। এছাড়া অনেকে শুধু শুঁটকি বানিয়ে তা চট্টগ্রাম, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ফিড মিলে বিক্রি করে দেন।
এলাকাবাসী বলছেন, কারখানার কালো ধোঁয়া ও বর্জ্যরে উৎকট গন্ধে বিপর্যস্ত তারা। রাত ৯টার পরপরই হাজারীবাগ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। শিশু-বৃদ্ধ সবার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। ধোঁয়ায় তাদের চোখ জ্বলে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপার্টমেন্ট অব কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (বুয়েট) বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আলী আহাম্মদ শওকত চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত সব ধরনের ধোঁয়াই ক্ষতিকর। তবে পশুর চামড়া ও কেমিক্যালের ধোঁয়া মারাÍক। শুক্রবার সকালে হাজারীবাগ ঝাউচড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মাঠের মধ্যে মাটিতে ত্রিপল পেতে শুঁটকি শুকানো হচ্ছে। চামড়ার বর্জ্যের স্তূপ করে রাখা হয় খোলা জায়গায়। শ্রমিকদের হাতে-পায়ে গ্লাভস নেই। ঝাউচরের বাসিন্দা ফারুক হোসেন বলেন, আমরা নরকে বাস করছি। এলাকায় কোনো মানুষ নতুন এলে দুর্গন্ধে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না।
No comments