সোলার প্যানেলে পুড়ল হাজার কোটি টাকা
নিম্নমানের
ও ত্রুটিপূর্ণ সোলার প্যানেল কেনার নামে হাজার কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হচ্ছে।
সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায়, সোলার প্যানেল বিক্রির জন্য গ্রামগঞ্জে গড়ে
উঠেছে শত শত প্রতিষ্ঠান। এরা নিুমানের প্যানেল আমদানি করে মিথ্যা তথ্য
দিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। এতে একদিকে প্রতারিত হচ্ছে গ্রামের নিরীহ
মানুষ। অপরদিকে ব্যাহত হচ্ছে গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার সরকারি
উদ্যোগ। সব মিলে নিুমানের সোলার প্যানেল বিক্রির কারণে পুরো খাতটিই
বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সূত্র জানায়, ২০১৪ সাল পর্যন্ত নবায়নযোগ্য
জ্বালানি থেকে কমপক্ষে ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা। এজন্য এ খাতে এরই
মধ্যে এক হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে পাওয়া গেছে
মাত্র এক থেকে দেড়শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। অভিযোগ উঠেছে দুর্নীতি, লুটপাট আর
নিম্নমানের সোলার প্যানেল অবাধে বিক্রি হওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী
বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। বসানোর পরপরই যন্ত্রিক ক্রুটির কারণে বন্ধ,
ব্যাটারি নষ্ট হওয়াসহ নানা কারণে অধিকাংশ প্যানেল অকেজো হয়ে গেছে। ফলে
কাক্সিক্ষত বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। যে প্যানেলগুলো থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া
যাচ্ছে সেগুলো আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা আছে। তখন এই
এক-দেড়শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎও পাওয়া যাবে না। অথচ এই পরিমাণ টাকা খরচ করে
জাতীয় গ্রিডে যোগ করা যেত কমপক্ষে ৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যার স্থায়িত্ব হতো
কমপক্ষে ৫০ বছরের অধিককাল।
জানা গেছে, আগামী ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ খাতে আরও ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে দাতা সংস্থাগুলো। এছাড়া চলতি বছর থেকে টিআর কাবিখা কাটছাঁট করে আরও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা যোগ হচ্ছে এই সেক্টরে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য মূলত টিআর কাবিখা ও দাতা সংস্থার টাকা লুটেপুটে খাওয়ার জন্য একটি চক্র সোলার এনার্জির নামে অবৈধ বাণিজ্যে নেমেছে। অভিযোগ এই চক্রের অধিকাংশ সদস্য সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপি ও স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতাকর্মী। কতিপয় দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে মূলত এই সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। এই সিন্ডিকেট গ্রামগঞ্জে গড়ে ওঠা দলীয় লোকজনের প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্নমানের সোলার প্যানেল কিনবে। এজন্যই তারা টিআর কাবিখার মতো দুস্থবান্ধব প্রকল্পের অর্ধেক টাকা বের করে নিচ্ছে। উন্নয়ন সহযোগীদের টাকায় এ ধরনের কাজ করলে নানা ধরনের জবাবদিহিতার প্রশ্ন থাকে। কিন্তু সরকারের টাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে নিুমানের পণ্য কেনা হলে কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। সোলার প্যানেল থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে কিনা, সরকারর মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। এসব চিন্তা থেকেই বর্তমানে টিআর কাবিখার টাকা থেকে সোলার প্যানেল কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন।
বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল অ্যানার্জি অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসআরইএ) সভাপতি দিপাল চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, হঠাৎ করে গ্রামগঞ্জে ব্যাংকের ছাতার মতো শত শত সোলার কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এদের স্থাপিত সোলার প্যানেলের মান খুবই খারাপ। ৬-৭ মাসের মধ্যে প্যানেলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিুমানের ও ক্রুটিযুক্ত সোলার প্যানেল আমদানির কারণে পুরো সেক্টরটি এখন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানির ক্ষেত্রে কোনো রেগুলেশন নেই। ফলে যে কেউ এলসি খুলে আমদানি করতে পারছে। চায়না থেকে ২ হাজার টাকার পার্টস ৫শ’ টাকায় বানিয়ে নিয়ে আসছে। এগুলোর নজরদারির কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে কেবল গ্রাহকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, গোটা সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থার ভাবমূর্তি হুমকির মুখে পড়বে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গ্রামের সোলার সিস্টেম এখন রাজধানীর ডিস সংযোগের মতো সরকারি দলের নেতাকর্মীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারাই এখন নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে সোলার সংযোগ দিচ্ছে। এসব প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার কারণে দেশের অধিকাংশ জায়গায় এখন ইডকলের সদস্যরা কাজ করতে পারছে না। সোলার প্যানেল বসানোকে কেন্দ্র করে দেশের অনেক জায়গায় মারধর-হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের চাপে ভালো কোম্পানিগুলো গ্রামে থাকতে পারছে না।
আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রি করা সৌরবিদ্যুতের সোলার প্যানেলের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. গোলাম হোসেন। সম্প্রতি তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘অত্যন্ত নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করেন অসাধু সোলার ব্যবসায়ীরা। যেসব প্যানেল দেন, তা সব দুই নম্বর। ভালো পণ্য দেয়ার কথা বলে ক্রেতাদের খারাপ পণ্য দেন। সবাই নামিদামি দেশের নাম করে চায়নার পণ্য বিক্রি করেন। জার্মানি ও ইতালি থেকে সোলার প্যানেল আমদানি করা হয় বলে দাবি করা হয়। তবে আমরা জানি, এসব দেশ থেকে আমদানি হয় না। হলেও খুবই সামান্য। গোলাম হোসেন আরও বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই সোলার খুব ভালোভাবে চলছে। তিনি নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করা বন্ধ করার জন্যও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি সোলার প্যানেলের নষ্ট ব্যাটারি ধ্বংস করতে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সোলার বিশেষজ্ঞ জানান, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর দাবি ছিল একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের দেয়া অর্থ থেকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। এজন্য সরকার ১৯৯৭ সালে ইডকল নামে (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড) একটি কোম্পানি গঠন করে। বর্তমানে ইডকলের সঙ্গে ৪৭টি সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানি কাজ করছে। বিএসআরইএ’র সভাপতি দীপাল চন্দ্র বড়–য়া বলেন, ইডকলের সহযোগী কোম্পানিগুলোর দেয়া সোলার প্যানেলের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাদেও দেয়া প্যানেলের ব্যাটারির ক্ষেত্রে ৩ বছরের ওয়ারেন্ট ছাড়াও পুরো প্যানেলের ওয়ারেন্টি থাকে কমপক্ষে ২০ বছর। অথচ এখন এমন অনেক কোম্পানি গ্রামগঞ্জে সোলার প্যানেল বসাচ্ছে যেগুলোর কোনো ওয়ারেন্টি থাকে না। ১ থেকে দেড় বছরের মধ্যে প্যানেলগুলোর কোনো অস্তিত্বই থাকছে না। গ্রামের প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের কোনো জবাবদিহিতাও নেই।
সোলার কোম্পানি গ্রিনফিনিটি এনার্জির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম বাকী মাসুদ বলেন, চীন থেকে আনা ৮০-১০০ ওয়াটের প্যানেলে স্টিকার বসিয়ে তা ১২০-১৫০ ওয়াটের বানানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ডিপিডিসি, ডেসকো, বিএসটিআই, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইডকল কারও কাছেই কোনো টেস্টিং ল্যাব কিংবা ফ্যাসিলিটিজ নেই। আবাসন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ডিপিডিএস, ডেসকোর ইঞ্জিনিয়ারদের অনৈতিক চুক্তি থাকে বলে অভিযোগ আছে। কম পয়সায় লোক দেখানো সৌর প্যানেল বসিয়ে লোড স্যাংশনের কাগজ হাতে পেলেই তাদের স্বার্থ উদ্ধার হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংও হচ্ছে।
আভা রিনিউয়েবল এনার্জির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একে আজাদ বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে বহুতল ভবন মালিকরা ভাড়া করা প্যানেলও ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, এই ডিজিটাল যুগেও ডিপিডিসি, ডেসকোর কর্মকর্তারা গজ-ফিতা দিয়ে প্যানেলের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে সৌর প্যানেলের ক্যাপাসিটি নির্ধারণ করছেন। এটা সত্যিই হাস্যকর।
জানা গেছে, নিম্নমানের ও ক্রুটিযুক্ত সোলার প্যানেল বসানোর কারণে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সচিবালয় ও সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন রাস্তায় সোলার প্যানেল বসিয়েও সুফল পাওয়া যায়নি। প্রায় ২শ’ কোটি টাকা খরচ করে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে রাজধানীর ৫শ’ বহুতল ভবনে যে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে প্রায় সবগুলো প্যানেলই এখন অকেজো। একাধিক ভবনের মালিকের অভিযোগ সরকার জোরপূর্বক তাদের এই সোলার প্যানেল বসাতে বাধ্য করেছে। সোলারের নামে মূলত টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছে। অভিযোগ এসব প্যানেলের অধিকাংশই সরকারি দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ক্রয় করতে বাধ্য হয়েছেন ভবন মালিকরা।
ডিএসসিসির একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) জানান, রাজধানীর কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। সাবেক ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) তিন কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে কাকরাইল মসজিদ থেকে আরামবাগ পর্যন্ত এ সোলার প্যানেল স্থাপন করে। এর আওতায় ১২০টি পিলারে দুটি করে ৬০ ওয়াটের বাতি লাগানো হয়। কিন্তু সরেজমিন দেখা গেছে, বেশির ভাগ সোলার প্যানেলই অকেজো হয়ে পড়েছে। প্যানেলগুলোর ওপর ধুলা পড়ে তা আর প্রয়োজনীয় সূর্যতাপ গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে বাতিগুলোও ঠিকভাবে জ্বলছে না।
সম্প্রতি ২০ কোটি টাকা খরচ করে বাংলাদেশ সচিবালয়েও একটি সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শুরুতে এই প্যানেল থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যেত এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মতো ইতিমধ্যে অনেকগুলো প্যানেল নষ্ট হয়ে গেছে।
জানা গেছে, আগামী ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ খাতে আরও ৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে দাতা সংস্থাগুলো। এছাড়া চলতি বছর থেকে টিআর কাবিখা কাটছাঁট করে আরও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা যোগ হচ্ছে এই সেক্টরে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য মূলত টিআর কাবিখা ও দাতা সংস্থার টাকা লুটেপুটে খাওয়ার জন্য একটি চক্র সোলার এনার্জির নামে অবৈধ বাণিজ্যে নেমেছে। অভিযোগ এই চক্রের অধিকাংশ সদস্য সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপি ও স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতাকর্মী। কতিপয় দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে মূলত এই সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। এই সিন্ডিকেট গ্রামগঞ্জে গড়ে ওঠা দলীয় লোকজনের প্রতিষ্ঠান থেকে নিম্নমানের সোলার প্যানেল কিনবে। এজন্যই তারা টিআর কাবিখার মতো দুস্থবান্ধব প্রকল্পের অর্ধেক টাকা বের করে নিচ্ছে। উন্নয়ন সহযোগীদের টাকায় এ ধরনের কাজ করলে নানা ধরনের জবাবদিহিতার প্রশ্ন থাকে। কিন্তু সরকারের টাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে নিুমানের পণ্য কেনা হলে কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। সোলার প্যানেল থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে কিনা, সরকারর মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না। এসব চিন্তা থেকেই বর্তমানে টিআর কাবিখার টাকা থেকে সোলার প্যানেল কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন।
বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল অ্যানার্জি অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসআরইএ) সভাপতি দিপাল চন্দ্র বড়ুয়া বলেন, হঠাৎ করে গ্রামগঞ্জে ব্যাংকের ছাতার মতো শত শত সোলার কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এদের স্থাপিত সোলার প্যানেলের মান খুবই খারাপ। ৬-৭ মাসের মধ্যে প্যানেলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিুমানের ও ক্রুটিযুক্ত সোলার প্যানেল আমদানির কারণে পুরো সেক্টরটি এখন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানির ক্ষেত্রে কোনো রেগুলেশন নেই। ফলে যে কেউ এলসি খুলে আমদানি করতে পারছে। চায়না থেকে ২ হাজার টাকার পার্টস ৫শ’ টাকায় বানিয়ে নিয়ে আসছে। এগুলোর নজরদারির কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে কেবল গ্রাহকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, গোটা সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থার ভাবমূর্তি হুমকির মুখে পড়বে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গ্রামের সোলার সিস্টেম এখন রাজধানীর ডিস সংযোগের মতো সরকারি দলের নেতাকর্মীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারাই এখন নামে-বেনামে কোম্পানি খুলে সোলার সংযোগ দিচ্ছে। এসব প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার কারণে দেশের অধিকাংশ জায়গায় এখন ইডকলের সদস্যরা কাজ করতে পারছে না। সোলার প্যানেল বসানোকে কেন্দ্র করে দেশের অনেক জায়গায় মারধর-হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের চাপে ভালো কোম্পানিগুলো গ্রামে থাকতে পারছে না।
আমদানি করে দেশের বাজারে বিক্রি করা সৌরবিদ্যুতের সোলার প্যানেলের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. গোলাম হোসেন। সম্প্রতি তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘অত্যন্ত নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করেন অসাধু সোলার ব্যবসায়ীরা। যেসব প্যানেল দেন, তা সব দুই নম্বর। ভালো পণ্য দেয়ার কথা বলে ক্রেতাদের খারাপ পণ্য দেন। সবাই নামিদামি দেশের নাম করে চায়নার পণ্য বিক্রি করেন। জার্মানি ও ইতালি থেকে সোলার প্যানেল আমদানি করা হয় বলে দাবি করা হয়। তবে আমরা জানি, এসব দেশ থেকে আমদানি হয় না। হলেও খুবই সামান্য। গোলাম হোসেন আরও বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই সোলার খুব ভালোভাবে চলছে। তিনি নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করা বন্ধ করার জন্যও সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি সোলার প্যানেলের নষ্ট ব্যাটারি ধ্বংস করতে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সোলার বিশেষজ্ঞ জানান, বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলোর দাবি ছিল একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের দেয়া অর্থ থেকে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। এজন্য সরকার ১৯৯৭ সালে ইডকল নামে (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড) একটি কোম্পানি গঠন করে। বর্তমানে ইডকলের সঙ্গে ৪৭টি সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানি কাজ করছে। বিএসআরইএ’র সভাপতি দীপাল চন্দ্র বড়–য়া বলেন, ইডকলের সহযোগী কোম্পানিগুলোর দেয়া সোলার প্যানেলের মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তাদেও দেয়া প্যানেলের ব্যাটারির ক্ষেত্রে ৩ বছরের ওয়ারেন্ট ছাড়াও পুরো প্যানেলের ওয়ারেন্টি থাকে কমপক্ষে ২০ বছর। অথচ এখন এমন অনেক কোম্পানি গ্রামগঞ্জে সোলার প্যানেল বসাচ্ছে যেগুলোর কোনো ওয়ারেন্টি থাকে না। ১ থেকে দেড় বছরের মধ্যে প্যানেলগুলোর কোনো অস্তিত্বই থাকছে না। গ্রামের প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের কোনো জবাবদিহিতাও নেই।
সোলার কোম্পানি গ্রিনফিনিটি এনার্জির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম বাকী মাসুদ বলেন, চীন থেকে আনা ৮০-১০০ ওয়াটের প্যানেলে স্টিকার বসিয়ে তা ১২০-১৫০ ওয়াটের বানানো হচ্ছে। তিনি বলেন, ডিপিডিসি, ডেসকো, বিএসটিআই, বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইডকল কারও কাছেই কোনো টেস্টিং ল্যাব কিংবা ফ্যাসিলিটিজ নেই। আবাসন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ডিপিডিএস, ডেসকোর ইঞ্জিনিয়ারদের অনৈতিক চুক্তি থাকে বলে অভিযোগ আছে। কম পয়সায় লোক দেখানো সৌর প্যানেল বসিয়ে লোড স্যাংশনের কাগজ হাতে পেলেই তাদের স্বার্থ উদ্ধার হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংও হচ্ছে।
আভা রিনিউয়েবল এনার্জির ব্যবস্থাপনা পরিচালক একে আজাদ বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে বহুতল ভবন মালিকরা ভাড়া করা প্যানেলও ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, এই ডিজিটাল যুগেও ডিপিডিসি, ডেসকোর কর্মকর্তারা গজ-ফিতা দিয়ে প্যানেলের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে সৌর প্যানেলের ক্যাপাসিটি নির্ধারণ করছেন। এটা সত্যিই হাস্যকর।
জানা গেছে, নিম্নমানের ও ক্রুটিযুক্ত সোলার প্যানেল বসানোর কারণে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সচিবালয় ও সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন রাস্তায় সোলার প্যানেল বসিয়েও সুফল পাওয়া যায়নি। প্রায় ২শ’ কোটি টাকা খরচ করে বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে রাজধানীর ৫শ’ বহুতল ভবনে যে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে প্রায় সবগুলো প্যানেলই এখন অকেজো। একাধিক ভবনের মালিকের অভিযোগ সরকার জোরপূর্বক তাদের এই সোলার প্যানেল বসাতে বাধ্য করেছে। সোলারের নামে মূলত টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছে। অভিযোগ এসব প্যানেলের অধিকাংশই সরকারি দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ক্রয় করতে বাধ্য হয়েছেন ভবন মালিকরা।
ডিএসসিসির একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) জানান, রাজধানীর কিছু এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। সাবেক ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) তিন কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে কাকরাইল মসজিদ থেকে আরামবাগ পর্যন্ত এ সোলার প্যানেল স্থাপন করে। এর আওতায় ১২০টি পিলারে দুটি করে ৬০ ওয়াটের বাতি লাগানো হয়। কিন্তু সরেজমিন দেখা গেছে, বেশির ভাগ সোলার প্যানেলই অকেজো হয়ে পড়েছে। প্যানেলগুলোর ওপর ধুলা পড়ে তা আর প্রয়োজনীয় সূর্যতাপ গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে বাতিগুলোও ঠিকভাবে জ্বলছে না।
সম্প্রতি ২০ কোটি টাকা খরচ করে বাংলাদেশ সচিবালয়েও একটি সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শুরুতে এই প্যানেল থেকে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যেত এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মতো ইতিমধ্যে অনেকগুলো প্যানেল নষ্ট হয়ে গেছে।
No comments