দায়িত্ব গ্রহণের আগেই হস্তক্ষেপ! by পলাশ কুমার রায়
ঢাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোনীত নতুন
রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া স্টিফেনস বুম বার্নিকাট ১৮ জুলাই মার্কিন সিনেটের
বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির শুনানিতে বলেছেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন
নিঃসন্দেহে ত্র“টিপূর্ণ ছিল। তাই বাংলাদেশে আরও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার
গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে সংলাপে বসা দরকার।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২২ মে মার্শিয়া বার্নিকাটকে ঢাকায়
মার্কিন পঞ্চদশ রাষ্ট্রদূতের পদে মনোনীত করেন। মার্শিয়া বার্নিকাট নিয়োগ
প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির শুনানিতে এ মন্তব্য
দেন। মার্শিয়া বার্নিকাটের মন্তব্য যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক, সে বিচার
বিশ্লেষণ না করে আমরা সোজা-সাপটা বলতে পারি- একজন পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে
তিনি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এমন তির্যক মন্তব্য করেন কীভাবে? দেশের
বৃহত্তর মঙ্গল ও কল্যাণের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হওয়া
অপরিহার্য কিনা- সেটা দেশের জনগণই নির্ধারণ করবে। একজন ভিনদেশী কূটনীতিকের এ
ব্যাপারে মন্তব্য করা সাজে না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও নির্বাচনোত্তর বেশকিছু
বিতর্ক শোনা গিয়েছিল। তাই বলে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত
বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত সে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যাপারে অযথা
হস্তক্ষেপ কিংবা মন্তব্য করেছিলেন? করেননি। তাহলে বার্নিকাট এমনটি করলেন
কেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ব্যাপক নিরাপত্তাবলয়ে সারা দেশ ঘুরে সাংবাদিকদের কাছে আমাদের দেশ নিয়ে অসংখ্য অসংলগ্ন ও শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য রেখেছেন। আমাদের ধারণা ছিল, সরকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠাবে এবং ওইসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের কৈফিয়ত চাইবে। তা তো হলই না, বরং তিনি সমহিমায় ২০১২ সালের নভেম্বর থেকে অদ্যাবধি বহাল তবিয়তে থেকে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দাদাগিরির ভূমিকা পালন করলেন। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য ভীষণ লজ্জার এবং অপমানজনকও বটে। সরকার ড্যান মজিনাকে প্রশ্রয় দিয়েছে বলে মার্শিয়া বার্নিকাট বাংলাদেশে এসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনেক আগেই আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সাহস পেয়েছেন। তার বক্তব্য শুধু অশোভনীয়ই নয়, বরং এক ধরনের ধৃষ্টতা। তার এ অসৌজন্যমূলক বক্তব্যে গোটা দেশের সচেতন মানুষ ব্যথিত; কিন্তু ক্ষমতাসীন ও অতীতে ক্ষমতায় ছিলেন এমন রাজনীতিকরা ব্যথা কিংবা লজ্জা কোনো কিছুই উপলব্ধি করেননি। কেন? কারণটা হয়তো ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকা না থাকার হিসাব-নিকাশ। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে আমরা অতিথিপরায়ণ, তাই বলে অতিথি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোয় হস্তক্ষেপ করবে আর আমি তাকে পাগলের মতো সমর্থন করব- তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো আমলেই বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ছিল না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা যখন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি, তখন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের চিরশত্রু পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর প্রক্রিয়া চালিয়েছিল। সেদিন রাশিয়া আমাদের পক্ষে না থাকলে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি ভিন্ন হতো ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও ব্যাপক হতো। গবেষকরা একটু বিলম্বে হলেও তথ্য উদ্ঘাটনে সমর্থ হয়েছে যে, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল। ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে মার্কিনিদের পরোক্ষ মদদ ছিল বলেও অনেকে বলে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের চিরশত্র“ পাকিস্তানের বন্ধু, তাই পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করা বোকামি ছাড়া আর কী?
আমরা বাংলাদেশীরা নিজেরাই নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করি। আমরা ধান চাষ করি, মৎষ্য চাষ করি। আমরা গায়ে-গতরে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারি এবং করি। আমাদের কৃষকরা সাত সকালে লাঙ্গল কাঁধে মাঠে জমি চাষাবাদের কাজে যোগ দেয়। আমাদের কৃষানিরাও কৃষিকাজে ঘরে-বাইরে ব্যাপকভাবে পরিশ্রম করে। আমাদের নারী শ্রমিকরা গার্মেন্ট শিল্পে স্বল্প মজুরিতে উৎসাহ-উদ্দীপনায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। প্রবাসী ভাইবোনেরা শত শত মাইল দূরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈধ পথে আয়-রোজগার করছে। আমাদের বীর সৈনিকরা জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে। তারা আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চাঙ্গা রেখেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চরম মন্দা সত্ত্বেও এর প্রভাব বাংলাদেশে খুব বেশি পড়েনি- কারণ বাংলাদেশীরা পরিশ্রমী এবং সব পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে বলে। আমরা এসব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য গর্বিত। আমরা ধন্য যে, আমাদের জন্ম বাংলাদেশে।
আমরা মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ পেয়েছি। ১৬ কোটি বাংলাদেশী আজ সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করছি (যদিও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এবং অস্থিরতা আমাদের জন্য একটা বড় বাধা)। কিন্তু আমরা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি- এতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিক তখন পৃথিবীর বড় দাদা (!) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এদেশীয় রাষ্ট্রদূত পদে মনোনীত ব্যক্তি আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাগ গলাতে শুরু করেছেন- এটা বড়ই বেমানান। আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক বিধিবিধান অনুযায়ী একজন রাষ্ট্রদূত অপর কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এভাবে প্রকাশ্য মন্তব্য করতে পারেন না। যদি করেন তাহলে সেটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত ও নিন্দনীয় কাজ হিসেবেই বিবেচিত হবে। শুধু ড্যান মজিনা নয়, অতীতে ড্যান মজিনার মতো অসংখ্য রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এর চেয়েও নোংরা এবং অশালীন ভাষায় মন্তব্য করার পরও বাংলাদেশে পূর্ণ মেয়াদে রাষ্ট্রদূতের সময়কাল অতিবাহিত করেছেন।
সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে এসব অপকর্ম করেও বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করেন কীভাবে?। কারণ আমাদের ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলে থাকা রাজনীতিকরা আজীবন তথা বংশপরম্পরায় ক্ষমতায় থাকার জন্য দাদা দেশের রাষ্ট্রদূতদের ঘি-মাখন দিয়ে সকাল-বিকাল তেল মারেন। তেল মারা যাদের অভ্যাস, তারা কি খুব সহজে সব কাজে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে? কারণ তাদের কাছে দেশের মান-সম্মান-ইজ্জতের চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতালোভী, চাটুকার, অযোগ্য রাজনীতিকদের দিয়ে আর যা-ই হোক দেশের মানসম্মান রক্ষা কিংবা পুনরুদ্ধার করা যায় না- রাজনীতিকরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে অতীতের মতো এবারও তা প্রমাণ করে দিলেন।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কোনো কূটনীতিক এত খোলামেলা ও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো সাহস রাখেন কি? উত্তরটা সবারই জানা। কারণ, সেখানকার রাষ্ট্রদূতরা জানেন, বৃহত্তম এ গণতন্ত্রচর্চাকারী দেশের ব্যাপারে নাক গলালেই বহিষ্কার হতে হবে। শুধু ভারত কেন, পৃথিবীর সব দেশেই একই নিয়ম। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিও তাই। কিন্তু আমাদের গুটিকয়েক রাজনীতিকের দুর্বলতার কারণে ভিনদেশী রাষ্ট্রদূতরা এত বাজে মন্তব্য করার সুযোগ পাচ্ছে। অনেকে বলেন, সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা, যাদের ভিনদেশী রাষ্ট্রদূতদের অশোভনীয় মন্তব্যের জন্য জোরালো প্রতিবাদ জানানোর কথা, তারাই ক্ষমতাধর ওইসব দেশের রাষ্ট্রদূতদের বাসায় সকালের চা-নাস্তা আর রাতের ডিনার সারেন। এ চাটুকারী শুধু ক্ষমতাসীনরাই নয়, বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতারাও নিয়মমাফিক করেন বৈকি! অনেকে এটাকে ঘরোয়া আড্ডা, অনেকে আবার চা-কফির আমন্ত্রণ বলেও অভিহিত করেন।
আমরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাই না পরি? তারা কি আমাদের অভিভাবক? কেন তাদের অপ্রাসঙ্গিক কথা আমাদের শুনতে হবে? তাদের দোয়া-দরুদ ছাড়া আমরা চলতে পারব না? ১৯৭১ সালে পারলে, এখন এবং ভবিষ্যতেও পারব। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে পরস্পর পরস্পরের পাশে থাকি, তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। বার্নিকাটকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করাই এখন এদেশের জনগণের অন্যতম দায়িত্ব।
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী, আহ্বায়ক, সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (সুপ্রা)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা ব্যাপক নিরাপত্তাবলয়ে সারা দেশ ঘুরে সাংবাদিকদের কাছে আমাদের দেশ নিয়ে অসংখ্য অসংলগ্ন ও শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য রেখেছেন। আমাদের ধারণা ছিল, সরকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে পাঠাবে এবং ওইসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের কৈফিয়ত চাইবে। তা তো হলই না, বরং তিনি সমহিমায় ২০১২ সালের নভেম্বর থেকে অদ্যাবধি বহাল তবিয়তে থেকে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দাদাগিরির ভূমিকা পালন করলেন। এটা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য ভীষণ লজ্জার এবং অপমানজনকও বটে। সরকার ড্যান মজিনাকে প্রশ্রয় দিয়েছে বলে মার্শিয়া বার্নিকাট বাংলাদেশে এসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনেক আগেই আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সাহস পেয়েছেন। তার বক্তব্য শুধু অশোভনীয়ই নয়, বরং এক ধরনের ধৃষ্টতা। তার এ অসৌজন্যমূলক বক্তব্যে গোটা দেশের সচেতন মানুষ ব্যথিত; কিন্তু ক্ষমতাসীন ও অতীতে ক্ষমতায় ছিলেন এমন রাজনীতিকরা ব্যথা কিংবা লজ্জা কোনো কিছুই উপলব্ধি করেননি। কেন? কারণটা হয়তো ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকা না থাকার হিসাব-নিকাশ। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে আমরা অতিথিপরায়ণ, তাই বলে অতিথি আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোয় হস্তক্ষেপ করবে আর আমি তাকে পাগলের মতো সমর্থন করব- তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো আমলেই বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু ছিল না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা যখন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি, তখন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের চিরশত্রু পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর প্রক্রিয়া চালিয়েছিল। সেদিন রাশিয়া আমাদের পক্ষে না থাকলে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি ভিন্ন হতো ও জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও ব্যাপক হতো। গবেষকরা একটু বিলম্বে হলেও তথ্য উদ্ঘাটনে সমর্থ হয়েছে যে, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল। ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে মার্কিনিদের পরোক্ষ মদদ ছিল বলেও অনেকে বলে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের চিরশত্র“ পাকিস্তানের বন্ধু, তাই পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করা বোকামি ছাড়া আর কী?
আমরা বাংলাদেশীরা নিজেরাই নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করি। আমরা ধান চাষ করি, মৎষ্য চাষ করি। আমরা গায়ে-গতরে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারি এবং করি। আমাদের কৃষকরা সাত সকালে লাঙ্গল কাঁধে মাঠে জমি চাষাবাদের কাজে যোগ দেয়। আমাদের কৃষানিরাও কৃষিকাজে ঘরে-বাইরে ব্যাপকভাবে পরিশ্রম করে। আমাদের নারী শ্রমিকরা গার্মেন্ট শিল্পে স্বল্প মজুরিতে উৎসাহ-উদ্দীপনায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। প্রবাসী ভাইবোনেরা শত শত মাইল দূরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈধ পথে আয়-রোজগার করছে। আমাদের বীর সৈনিকরা জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে। তারা আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চাঙ্গা রেখেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে চরম মন্দা সত্ত্বেও এর প্রভাব বাংলাদেশে খুব বেশি পড়েনি- কারণ বাংলাদেশীরা পরিশ্রমী এবং সব পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে বলে। আমরা এসব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য গর্বিত। আমরা ধন্য যে, আমাদের জন্ম বাংলাদেশে।
আমরা মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ পেয়েছি। ১৬ কোটি বাংলাদেশী আজ সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করছি (যদিও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এবং অস্থিরতা আমাদের জন্য একটা বড় বাধা)। কিন্তু আমরা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি- এতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিক তখন পৃথিবীর বড় দাদা (!) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এদেশীয় রাষ্ট্রদূত পদে মনোনীত ব্যক্তি আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাগ গলাতে শুরু করেছেন- এটা বড়ই বেমানান। আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক বিধিবিধান অনুযায়ী একজন রাষ্ট্রদূত অপর কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এভাবে প্রকাশ্য মন্তব্য করতে পারেন না। যদি করেন তাহলে সেটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত ও নিন্দনীয় কাজ হিসেবেই বিবেচিত হবে। শুধু ড্যান মজিনা নয়, অতীতে ড্যান মজিনার মতো অসংখ্য রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এর চেয়েও নোংরা এবং অশালীন ভাষায় মন্তব্য করার পরও বাংলাদেশে পূর্ণ মেয়াদে রাষ্ট্রদূতের সময়কাল অতিবাহিত করেছেন।
সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে এসব অপকর্ম করেও বিদেশী রাষ্ট্রদূতরা বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করেন কীভাবে?। কারণ আমাদের ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলে থাকা রাজনীতিকরা আজীবন তথা বংশপরম্পরায় ক্ষমতায় থাকার জন্য দাদা দেশের রাষ্ট্রদূতদের ঘি-মাখন দিয়ে সকাল-বিকাল তেল মারেন। তেল মারা যাদের অভ্যাস, তারা কি খুব সহজে সব কাজে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে? কারণ তাদের কাছে দেশের মান-সম্মান-ইজ্জতের চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতালোভী, চাটুকার, অযোগ্য রাজনীতিকদের দিয়ে আর যা-ই হোক দেশের মানসম্মান রক্ষা কিংবা পুনরুদ্ধার করা যায় না- রাজনীতিকরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে অতীতের মতো এবারও তা প্রমাণ করে দিলেন।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কোনো কূটনীতিক এত খোলামেলা ও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো সাহস রাখেন কি? উত্তরটা সবারই জানা। কারণ, সেখানকার রাষ্ট্রদূতরা জানেন, বৃহত্তম এ গণতন্ত্রচর্চাকারী দেশের ব্যাপারে নাক গলালেই বহিষ্কার হতে হবে। শুধু ভারত কেন, পৃথিবীর সব দেশেই একই নিয়ম। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিও তাই। কিন্তু আমাদের গুটিকয়েক রাজনীতিকের দুর্বলতার কারণে ভিনদেশী রাষ্ট্রদূতরা এত বাজে মন্তব্য করার সুযোগ পাচ্ছে। অনেকে বলেন, সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা, যাদের ভিনদেশী রাষ্ট্রদূতদের অশোভনীয় মন্তব্যের জন্য জোরালো প্রতিবাদ জানানোর কথা, তারাই ক্ষমতাধর ওইসব দেশের রাষ্ট্রদূতদের বাসায় সকালের চা-নাস্তা আর রাতের ডিনার সারেন। এ চাটুকারী শুধু ক্ষমতাসীনরাই নয়, বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতারাও নিয়মমাফিক করেন বৈকি! অনেকে এটাকে ঘরোয়া আড্ডা, অনেকে আবার চা-কফির আমন্ত্রণ বলেও অভিহিত করেন।
আমরা কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাই না পরি? তারা কি আমাদের অভিভাবক? কেন তাদের অপ্রাসঙ্গিক কথা আমাদের শুনতে হবে? তাদের দোয়া-দরুদ ছাড়া আমরা চলতে পারব না? ১৯৭১ সালে পারলে, এখন এবং ভবিষ্যতেও পারব। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে পরস্পর পরস্পরের পাশে থাকি, তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না। বার্নিকাটকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করাই এখন এদেশের জনগণের অন্যতম দায়িত্ব।
পলাশ কুমার রায় : আইনজীবী, আহ্বায়ক, সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন (সুপ্রা)
No comments