হেঁটেছি এতটা দূর by সুমনা শারমীন
মনের মধ্যে ছবি আঁকার আকাঙ্ক্ষাটা তৈরি করে দিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রং আর তুলিতে সমান সক্রিয় ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। শিল্পীর ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে এ লেখাটি লিখেছিলেন সুমনা শারমীন। ২০১২ সালের ১০ মার্চ এটিই ছিল ছুটির দিনের মূল রচনা।
‘আমি তখন ঢাকার নয়াপল্টনে থাকি। ১৯৬০-৬১ সালের কথা। পুকুরের এই পাড়ে আমার বাড়ির জানালা দিয়ে ওই পাড়ের যে বাড়িটা দেখা যায়, সেটা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বাড়ি। আমাকে একদিন তিনি বললেন, কাইয়ুম, রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত তোমার ঘরে বাতি জ্বলে। প্রায়ই ঘুম ভেঙে গেলে পানি খেতে উঠে দেখি, তোমার ঘরে আলো জ্বলছে। কেন?
‘তখন আমি অবজারভার গ্রুপে কাজ করি। বললাম, আমি তো দিনে চাকরি করি, সময় পাই না। তাই রাত জেগে কাজ করি।
‘তিনি বললেন, এইটার ফল একদিন তুমি পাইবা।
‘তখন রোববার ছুটি ছিল। আমি আর আমার স্ত্রী তাহেরা একদিন ছুটির দিনে আজিমপুরে ওর মায়ের বাড়ি এসে খেয়েদেয়ে রাতে ফিরেছি। দরজায় ঠক ঠক ঠক। দেখি জনাবুল ইসলাম। জয়নুল আবেদিনের ছোট ভাই। বললেন, এখনই চলেন। মিয়া ভাই ডাকে। বলেছেন, যখনই আসবে, তখনই ধইরা নিয়া আসবা।
‘আমি তো অবাক। গেলাম। দেখি তিনি খালি গায়ে রকে বসে আছেন। এত রাতে?
‘কাছে যেতেই ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। তারপর জড়িয়ে ধরে জানালেন, সন্ধ্যায় একটা টেলিগ্রাম এসেছে। লাহোর জাতীয় প্রদর্শনীতে আমি প্রথম স্থান পেয়েছি।
‘তখন আমার কানে শুধু বেজেছিল স্যারের কথাটা, এইটার ফল একদিন পাইবা।’
গায়ে লাল টি-শার্ট চাপিয়ে গত সোমবার বিকেলে আজিমপুরের বাসায় বসে গল্পটা শোনালেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী; যিনি বিশ্বাস করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন কিছু গ্রহণ করতে না পারলে আটকে যেতে হয়। তাই তো তিনি হেঁটে এসেছেন এতটা পথ, তবু তরুণ।
গতকাল ৯ মার্চ তাঁর ছিল জন্মদিন। ৮০ বছর আগে ১৯৩২ সালে জন্মেছিলেন তিনি। ফেনীতে।
কাইয়ুম চৌধুরী অকপটে বললেন, মনের মধ্যে ছবি আঁকার আকাঙ্ক্ষাটা তৈরি করে দিয়েছিলেন জয়নুল আবেদিন। রোববার ছুটির দিনে আবেদিন স্যারের বাড়িতে আড্ডা দিতেন মোহাম্মদ মনসুরউদ্দীন, কবি জসীমউদ্দীন, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ্। আমি পাশে বসে শুনতাম। একদিন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সানডে অবজারভার-এর ম্যাগাজিন শাখায় দেখলাম নৌকার গলুইয়ে চোখ। ইলাস্ট্রেশনটা কে করেছে?’ বললাম, ‘আমি। সিলেট অঞ্চলে এ রকম নৌকা দেখেছিলাম।’
‘তুমি তাহলে এ ধরনের ছবি আঁকো কেন? অনেক নৌকা, অনেক চোখ এমন কম্পোজিশনে ছবি আঁকবা। আঁকলে ভালো করবা।’ ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করলাম। আবেদিন স্যারের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে সাংঘাতিক অনুপ্রাণিত হতাম। জীবিকার প্রয়োজনে তখন ইলাস্ট্রেশন করা, প্রচ্ছদ করা। বাড়িতে গিয়ে তাহেরাকে বললাম, ‘আমার রঙের প্যালেট কই? ইজেল কই? বের হলো ধুলো জমা হার্ডবোর্ড; তখন হার্ডবোর্ডেই আঁকতাম।’
‘১৯৬৪-৬৫ সালের কথা। শিল্পী আমিনুল ইসলাম একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন ঢাকার জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। আমি সেই নৌকার গলুইয়ের কম্পোজিশনে ছবি দিলাম। তখন জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক স্টিবার সেই নৌকার ছবি দেখে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। একজন বিদেশির চোখেও সেই নৌকার গলুই ভালো লাগল। সৈয়দ শামসুল হক এই ছবি নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন “হিজল কাঠের নাও”।’
এখনো হাতের ছোঁয়া
জীবনে অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। সেই ১৯৫৪ থেকে ২০১২ সাল। কাজটা শুরু হয় জীবিকার প্রয়োজনেই। কিন্তু একসময় এমন হয়ে দাঁড়াল যে, কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ মানেই ‘বিশেষ প্রচ্ছদ’। বললেন, ‘আমার সৌভাগ্য, আমার বন্ধুবান্ধবেরা আমাকে দিয়েই প্রচ্ছদ আঁকাতেন। এত যে প্রযুক্তির ধাক্কা, আমি নিজেও কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহার করি, কিন্তু আমার কাছে সবার চাওয়া, প্রচ্ছদে থাকবে হাতের ছোঁয়া, থাকবে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার।’
—এ বছর কয়টা বইয়ের প্রচ্ছদ করলেন?
প্রথমা প্রকাশনেরই তো ৩০টার মতো।
সব মিলিয়ে ৫০টার মতো হবে।
—নিজের করা সারা জীবনের এত এত প্রচ্ছদ থেকে যদি চট করে একটা প্রচ্ছদ বাছতে বলি, পারবেন?
—সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বই একদা এক রাজ্যে।
প্রথম একক প্রথম সীমানা পেরিয়ে
শিল্পীজীবনের শুরুটা মোটেও মসৃণ ছিল না কাইয়ুম চৌধুরীর। বললেন, ‘শিল্পসমালোচকেরা বলতেন, আমার ছবি “ছবি” হয় না। একই প্রদর্শনীতে ইলাস্ট্রেশনের পাশে ছবি ঝোলাবে না বলে আমার বন্ধুরা দেয়াল থেকে ছবি পর্যন্ত নামিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু প্রেরণা জাগানো ঘটনাও ঘটেছে। নয়াপল্টনে থাকার সময় একদিন আবেদিন স্যারের বাড়িতে ডাক পড়ল। একজন বিদেশি ভদ্রমহিলা আমার সঙ্গে নাকি দেখা করতে চান। তত্কালীন পাকিস্তানের একজন সচিব মঈনুদ্দিন সাহেবের আমেরিকান স্ত্রী বারবারা মঈনুদ্দিন। তিনি রাওয়ালপিন্ডির এক গ্যালারিতে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পীদের প্রদর্শনী থেকে আমার দুটো কাজ সংগ্রহ করেছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি আবেদিন স্যারের কাছে আমার খোঁজ করে দেখা করেছিলেন। দেখা হলো। বললেন, তোমার ছবি দুটো আমার খুব পছন্দ হয়েছে। একটি রেখেছি ড্রয়িংরুমে, একটি বেডরুমে। কথাবার্তা বলে তিনি চলে যাওয়ার পর আবেদিন স্যার আমাকে বলেছিলেন, তুমি তো লোক ভালো না। ভদ্রমহিলার বেডরুমে ঢুকে গেলে! সেই আমি প্রথম একক প্রদর্শনী করি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে। সবাই খুব প্রশংসা করলেন। সেই প্রদর্শনীতে “শৈশব স্মৃতি” শিরোনামে একটা সিরিজ করেছিলাম। তারই একটি এখনো আমার কাছে আছে। (হাত তুলে দেখালেন খাবার টেবিলের পেছনের দেয়ালে ঝুলছে ছবিটি)। কিন্তু একটাও ছবি বিক্রি হয়নি। মন খারাপ। তখন তো অর্থেরও দরকার ছিল। প্রদর্শনী দেখতে এলেন তখনকার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। বললেন, তোমার কোনো ছবি বিক্রি হয়নি কেন? আমি বললাম, সেন্টু ভাই, আমার ছবি কেউ কেনে না।
তিনি চলে গেলেন। দুই দিন পর আমার প্রায় সাত-আটটা ছবি বিক্রি হলো। সেই আমলে দেড় লাখ টাকায় ছবি বিক্রি হয়েছিল। তাহেরাকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেলাম গ্যালারি, মিউজিয়াম দেখাব বলে। তাহেরার বোন ছিল ওয়াশিংটন ডিসিতে। এর আগে তো কখনো পৃথিবী-বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম সামনাসামনি দেখিনি। ন্যাশনাল মিউজিয়ামে গেলাম। বিশাল ব্যাপার। সব তো দেখা সম্ভব নয়। আমি আমার আগ্রহের বিষয় বেছে নিলাম। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের কাজের জায়গায় গেলাম। প্রথমে পল গগাঁ, তারপর ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ। একজন হালকা রঙে কাজ করেছেন, ক্যানভাস ছেড়ে ছেড়ে গেছেন। আরেকজন চড়া রঙে ভরিয়েছেন ক্যানভাস। পুরো শরীরের মধ্যে শিহরণ অনুভব করলাম। এই এই জায়গায় গগাঁ তুলি ছুঁয়েছিলেন। হঠাত্ আমাদের সঙ্গে আসা তাহেরার বোন, আমার শ্যালিকা, আমার হাত ধরে বললেন, আপনি তো পড়ে যাবেন, আপনি কাঁপছেন! স্কাল্পচার গার্ডেনে গিয়ে মনে হলো, অন্তত একটা ভাস্কর্য ছুঁয়ে দিই। “বালজাক” নামে রদাঁর ভাস্কর্যটা ছুঁয়ে দিতেই নিরাপত্তারক্ষীর চিত্কার—ডোন্ট টাচ!’
বই আর গানের নেশা
সেই ছোটবেলায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুল দিয়ে বই পড়া শুরু। তারপর কবে যেন পত্রিকা পড়া, বই পড়াটা নেশাই হয়ে গেল তাঁর। বাবা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরীর কাছ থেকেই এসেছে পড়ার এই অভ্যাস। তিনি ছিলেন কো-অপারেটিভ ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার। বাড়িতে আসত নানা পত্রিকা। ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বঙ্গশ্রী—এসব পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন বাবা। পত্রিকাগুলোর পাতায় ছাপা হতো বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম। বলছিলেন, ‘অবনঠাকুর, গগনঠাকুর—এঁদের কাজ দেখতাম। অনেক বিখ্যাত শিল্পীর কাজও ছাপা হতো। তাঁদের মধ্য থেকে অনেক শিল্পী হয়তো হারিয়ে গেছেন। অবনঠাকুর বেঁচে আছেন। যার থাকার কথা, সে-ই থাকে। বাবার ছিল বদলির চাকরি। সেই সূত্রে বাংলাদেশের বহু জায়গায় ঘুরেছি। চট্টগ্রামে যখন, তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। পুকুরে গোসল করছিলাম, হঠাত্ কে একজন বলল, তোমার বাবা কলের গান এনেছেন। কলের গান! উঠেই ভোঁ-দৌড় বাড়িতে। গায়ে যে কাপড় নেই, সেদিকে খেয়াল নেই। সেই থেকে গান শোনা আর এলপি রেকর্ড জমানোর নেশা। ১৯৭১ সালে যখন বাড়ি ছেড়ে গেলাম, তখন কিছুই নিইনি সঙ্গে। শুধু এক ট্রাংক এলপি রেকর্ড। আর ছেলেবেলায় যখন চলচ্চিত্র দেখতাম, তখন ছবিটা যে চলছে, এই জিনিসটা আমাকে সাংঘাতিক আলোড়িত করত। বিশেষ করে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে—এই দৃশ্য দেখলেই আমি শিহরিত হতাম।’
সত্যজিত্ রায়ের পথের পাঁচালী কয়বার দেখেছেন?
‘১৫-২০ বার। সেই ট্রেন, সেই শিহরণ। মনে আছে, গুলিস্তান সিনেমা হলে যখন পথের পাঁচালী দেখতাম, প্রথম কয়েকটি দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যেত। তারপর পুরোটাই চোখের জলে ঝাপসা। কাঁদতে কাঁদতে ছবি দেখা।’
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
জয়নুল আবেদিনের কথায় অনুপ্রাণিত যে ছাত্র ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী’ হলেন, ছবি আঁকলেন, ছবি এঁকে যাচ্ছেন—তিনি কি পেরেছেন তাঁর কাজ আর কথা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দিতে?
মাথা নাড়লেন কাইয়ুম চৌধুরী। শিক্ষক কাইয়ুম চৌধুরীর কোনো অনুসারী নেই। যেমন অনেকে মোহাম্মদ কিবরিয়ার মতো ছবি আঁকেন। তাঁর রং, তাঁর কম্পোজিশন, তাঁর বুনোট, তাঁর রঙের প্রয়োগ অনুসরণ করেন। সবারটাই যে মানোত্তীর্ণ হয়, তা নয়। কাজটা সহজও নয়। তবু কিবরিয়ার ধারা বলে একটা ঘরানা তো আছে। পাশে ছিলেন শিল্পী অশোক কর্মকার। বললেন, স্যার, সরাসরি না হলেও আপনার রং, আপনার ফর্ম অনেককে অনুপ্রাণিত করে। তাহেরা চৌধুরী বললেন, গ্রাফিক ডিজাইনে তোমার কাজের সরাসরি অনুসারী আছে। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরী বিনয়ের সঙ্গে আবারও বললেন, তিনি শিল্পী হিসেবে যতটা সফল, শিক্ষক হিসেবে ততটা নন।
তাঁকে প্রশ্ন করি, আপনি তো হাঁটলেন আশি বছর। সুস্থ দেহে আরও অনেক বছর হাঁটবেন। ছবি আঁকবেন। কিন্তু হঠাত্ দেখলেন পরবর্তী প্রজন্মের কোনো এক শিল্পী ঠিক কাইয়ুম চৌধুরীর মতো করেই কাজ করছেন। সাধারণ চোখে ধরাই পড়ে না কোনটা কাইয়ুম চৌধুরীর, কোনটা না। কেমন লাগবে? খুশি হবেন?
ঘরটা হঠাত্ নীরব। এতক্ষণ চঞ্চল যে দুই শিশু—অতসী ও অতনু (তাহেরা চৌধুরীর ভাতিজা-ভাতিজি) ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তারাও কী মনে করে শিল্পীর মুখের দিকে চেয়ে থাকল।
উত্তর শোনার অধীর অপেক্ষায় যেন বারান্দার পাশের গাছ থেকে পাখিরাও একটু বিশ্রাম নিল। কোনো কিচিরমিচির নেই। তিনি বললেন, ‘কষ্ট পাব। আমি যেখানে থামলাম, পরের প্রজন্ম যদি আরেকটু এগিয়ে যায়, তবেই আমার আনন্দ।
‘আমি তখন ঢাকার নয়াপল্টনে থাকি। ১৯৬০-৬১ সালের কথা। পুকুরের এই পাড়ে আমার বাড়ির জানালা দিয়ে ওই পাড়ের যে বাড়িটা দেখা যায়, সেটা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বাড়ি। আমাকে একদিন তিনি বললেন, কাইয়ুম, রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত তোমার ঘরে বাতি জ্বলে। প্রায়ই ঘুম ভেঙে গেলে পানি খেতে উঠে দেখি, তোমার ঘরে আলো জ্বলছে। কেন?
‘তখন আমি অবজারভার গ্রুপে কাজ করি। বললাম, আমি তো দিনে চাকরি করি, সময় পাই না। তাই রাত জেগে কাজ করি।
‘তিনি বললেন, এইটার ফল একদিন তুমি পাইবা।
‘তখন রোববার ছুটি ছিল। আমি আর আমার স্ত্রী তাহেরা একদিন ছুটির দিনে আজিমপুরে ওর মায়ের বাড়ি এসে খেয়েদেয়ে রাতে ফিরেছি। দরজায় ঠক ঠক ঠক। দেখি জনাবুল ইসলাম। জয়নুল আবেদিনের ছোট ভাই। বললেন, এখনই চলেন। মিয়া ভাই ডাকে। বলেছেন, যখনই আসবে, তখনই ধইরা নিয়া আসবা।
‘আমি তো অবাক। গেলাম। দেখি তিনি খালি গায়ে রকে বসে আছেন। এত রাতে?
‘কাছে যেতেই ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। তারপর জড়িয়ে ধরে জানালেন, সন্ধ্যায় একটা টেলিগ্রাম এসেছে। লাহোর জাতীয় প্রদর্শনীতে আমি প্রথম স্থান পেয়েছি।
‘তখন আমার কানে শুধু বেজেছিল স্যারের কথাটা, এইটার ফল একদিন পাইবা।’
গায়ে লাল টি-শার্ট চাপিয়ে গত সোমবার বিকেলে আজিমপুরের বাসায় বসে গল্পটা শোনালেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী; যিনি বিশ্বাস করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন কিছু গ্রহণ করতে না পারলে আটকে যেতে হয়। তাই তো তিনি হেঁটে এসেছেন এতটা পথ, তবু তরুণ।
গতকাল ৯ মার্চ তাঁর ছিল জন্মদিন। ৮০ বছর আগে ১৯৩২ সালে জন্মেছিলেন তিনি। ফেনীতে।
কাইয়ুম চৌধুরী অকপটে বললেন, মনের মধ্যে ছবি আঁকার আকাঙ্ক্ষাটা তৈরি করে দিয়েছিলেন জয়নুল আবেদিন। রোববার ছুটির দিনে আবেদিন স্যারের বাড়িতে আড্ডা দিতেন মোহাম্মদ মনসুরউদ্দীন, কবি জসীমউদ্দীন, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ্। আমি পাশে বসে শুনতাম। একদিন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সানডে অবজারভার-এর ম্যাগাজিন শাখায় দেখলাম নৌকার গলুইয়ে চোখ। ইলাস্ট্রেশনটা কে করেছে?’ বললাম, ‘আমি। সিলেট অঞ্চলে এ রকম নৌকা দেখেছিলাম।’
‘তুমি তাহলে এ ধরনের ছবি আঁকো কেন? অনেক নৌকা, অনেক চোখ এমন কম্পোজিশনে ছবি আঁকবা। আঁকলে ভালো করবা।’ ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করলাম। আবেদিন স্যারের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে সাংঘাতিক অনুপ্রাণিত হতাম। জীবিকার প্রয়োজনে তখন ইলাস্ট্রেশন করা, প্রচ্ছদ করা। বাড়িতে গিয়ে তাহেরাকে বললাম, ‘আমার রঙের প্যালেট কই? ইজেল কই? বের হলো ধুলো জমা হার্ডবোর্ড; তখন হার্ডবোর্ডেই আঁকতাম।’
‘১৯৬৪-৬৫ সালের কথা। শিল্পী আমিনুল ইসলাম একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন ঢাকার জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। আমি সেই নৌকার গলুইয়ের কম্পোজিশনে ছবি দিলাম। তখন জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক স্টিবার সেই নৌকার ছবি দেখে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। একজন বিদেশির চোখেও সেই নৌকার গলুই ভালো লাগল। সৈয়দ শামসুল হক এই ছবি নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন “হিজল কাঠের নাও”।’
এখনো হাতের ছোঁয়া
জীবনে অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী। সেই ১৯৫৪ থেকে ২০১২ সাল। কাজটা শুরু হয় জীবিকার প্রয়োজনেই। কিন্তু একসময় এমন হয়ে দাঁড়াল যে, কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ মানেই ‘বিশেষ প্রচ্ছদ’। বললেন, ‘আমার সৌভাগ্য, আমার বন্ধুবান্ধবেরা আমাকে দিয়েই প্রচ্ছদ আঁকাতেন। এত যে প্রযুক্তির ধাক্কা, আমি নিজেও কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহার করি, কিন্তু আমার কাছে সবার চাওয়া, প্রচ্ছদে থাকবে হাতের ছোঁয়া, থাকবে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার।’
—এ বছর কয়টা বইয়ের প্রচ্ছদ করলেন?
প্রথমা প্রকাশনেরই তো ৩০টার মতো।
সব মিলিয়ে ৫০টার মতো হবে।
—নিজের করা সারা জীবনের এত এত প্রচ্ছদ থেকে যদি চট করে একটা প্রচ্ছদ বাছতে বলি, পারবেন?
—সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার বই একদা এক রাজ্যে।
প্রথম একক প্রথম সীমানা পেরিয়ে
শিল্পীজীবনের শুরুটা মোটেও মসৃণ ছিল না কাইয়ুম চৌধুরীর। বললেন, ‘শিল্পসমালোচকেরা বলতেন, আমার ছবি “ছবি” হয় না। একই প্রদর্শনীতে ইলাস্ট্রেশনের পাশে ছবি ঝোলাবে না বলে আমার বন্ধুরা দেয়াল থেকে ছবি পর্যন্ত নামিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু প্রেরণা জাগানো ঘটনাও ঘটেছে। নয়াপল্টনে থাকার সময় একদিন আবেদিন স্যারের বাড়িতে ডাক পড়ল। একজন বিদেশি ভদ্রমহিলা আমার সঙ্গে নাকি দেখা করতে চান। তত্কালীন পাকিস্তানের একজন সচিব মঈনুদ্দিন সাহেবের আমেরিকান স্ত্রী বারবারা মঈনুদ্দিন। তিনি রাওয়ালপিন্ডির এক গ্যালারিতে পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পীদের প্রদর্শনী থেকে আমার দুটো কাজ সংগ্রহ করেছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি আবেদিন স্যারের কাছে আমার খোঁজ করে দেখা করেছিলেন। দেখা হলো। বললেন, তোমার ছবি দুটো আমার খুব পছন্দ হয়েছে। একটি রেখেছি ড্রয়িংরুমে, একটি বেডরুমে। কথাবার্তা বলে তিনি চলে যাওয়ার পর আবেদিন স্যার আমাকে বলেছিলেন, তুমি তো লোক ভালো না। ভদ্রমহিলার বেডরুমে ঢুকে গেলে! সেই আমি প্রথম একক প্রদর্শনী করি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে। সবাই খুব প্রশংসা করলেন। সেই প্রদর্শনীতে “শৈশব স্মৃতি” শিরোনামে একটা সিরিজ করেছিলাম। তারই একটি এখনো আমার কাছে আছে। (হাত তুলে দেখালেন খাবার টেবিলের পেছনের দেয়ালে ঝুলছে ছবিটি)। কিন্তু একটাও ছবি বিক্রি হয়নি। মন খারাপ। তখন তো অর্থেরও দরকার ছিল। প্রদর্শনী দেখতে এলেন তখনকার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। বললেন, তোমার কোনো ছবি বিক্রি হয়নি কেন? আমি বললাম, সেন্টু ভাই, আমার ছবি কেউ কেনে না।
তিনি চলে গেলেন। দুই দিন পর আমার প্রায় সাত-আটটা ছবি বিক্রি হলো। সেই আমলে দেড় লাখ টাকায় ছবি বিক্রি হয়েছিল। তাহেরাকে নিয়ে আমেরিকা চলে গেলাম গ্যালারি, মিউজিয়াম দেখাব বলে। তাহেরার বোন ছিল ওয়াশিংটন ডিসিতে। এর আগে তো কখনো পৃথিবী-বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম সামনাসামনি দেখিনি। ন্যাশনাল মিউজিয়ামে গেলাম। বিশাল ব্যাপার। সব তো দেখা সম্ভব নয়। আমি আমার আগ্রহের বিষয় বেছে নিলাম। ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের কাজের জায়গায় গেলাম। প্রথমে পল গগাঁ, তারপর ভিনসেন্ট ভ্যানগঘ। একজন হালকা রঙে কাজ করেছেন, ক্যানভাস ছেড়ে ছেড়ে গেছেন। আরেকজন চড়া রঙে ভরিয়েছেন ক্যানভাস। পুরো শরীরের মধ্যে শিহরণ অনুভব করলাম। এই এই জায়গায় গগাঁ তুলি ছুঁয়েছিলেন। হঠাত্ আমাদের সঙ্গে আসা তাহেরার বোন, আমার শ্যালিকা, আমার হাত ধরে বললেন, আপনি তো পড়ে যাবেন, আপনি কাঁপছেন! স্কাল্পচার গার্ডেনে গিয়ে মনে হলো, অন্তত একটা ভাস্কর্য ছুঁয়ে দিই। “বালজাক” নামে রদাঁর ভাস্কর্যটা ছুঁয়ে দিতেই নিরাপত্তারক্ষীর চিত্কার—ডোন্ট টাচ!’
বই আর গানের নেশা
সেই ছোটবেলায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুল দিয়ে বই পড়া শুরু। তারপর কবে যেন পত্রিকা পড়া, বই পড়াটা নেশাই হয়ে গেল তাঁর। বাবা আবদুল কুদ্দুস চৌধুরীর কাছ থেকেই এসেছে পড়ার এই অভ্যাস। তিনি ছিলেন কো-অপারেটিভ ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার। বাড়িতে আসত নানা পত্রিকা। ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বঙ্গশ্রী—এসব পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন বাবা। পত্রিকাগুলোর পাতায় ছাপা হতো বিখ্যাত শিল্পীদের চিত্রকর্ম। বলছিলেন, ‘অবনঠাকুর, গগনঠাকুর—এঁদের কাজ দেখতাম। অনেক বিখ্যাত শিল্পীর কাজও ছাপা হতো। তাঁদের মধ্য থেকে অনেক শিল্পী হয়তো হারিয়ে গেছেন। অবনঠাকুর বেঁচে আছেন। যার থাকার কথা, সে-ই থাকে। বাবার ছিল বদলির চাকরি। সেই সূত্রে বাংলাদেশের বহু জায়গায় ঘুরেছি। চট্টগ্রামে যখন, তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। পুকুরে গোসল করছিলাম, হঠাত্ কে একজন বলল, তোমার বাবা কলের গান এনেছেন। কলের গান! উঠেই ভোঁ-দৌড় বাড়িতে। গায়ে যে কাপড় নেই, সেদিকে খেয়াল নেই। সেই থেকে গান শোনা আর এলপি রেকর্ড জমানোর নেশা। ১৯৭১ সালে যখন বাড়ি ছেড়ে গেলাম, তখন কিছুই নিইনি সঙ্গে। শুধু এক ট্রাংক এলপি রেকর্ড। আর ছেলেবেলায় যখন চলচ্চিত্র দেখতাম, তখন ছবিটা যে চলছে, এই জিনিসটা আমাকে সাংঘাতিক আলোড়িত করত। বিশেষ করে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে—এই দৃশ্য দেখলেই আমি শিহরিত হতাম।’
সত্যজিত্ রায়ের পথের পাঁচালী কয়বার দেখেছেন?
‘১৫-২০ বার। সেই ট্রেন, সেই শিহরণ। মনে আছে, গুলিস্তান সিনেমা হলে যখন পথের পাঁচালী দেখতাম, প্রথম কয়েকটি দৃশ্য পরিষ্কার দেখা যেত। তারপর পুরোটাই চোখের জলে ঝাপসা। কাঁদতে কাঁদতে ছবি দেখা।’
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে
জয়নুল আবেদিনের কথায় অনুপ্রাণিত যে ছাত্র ‘শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী’ হলেন, ছবি আঁকলেন, ছবি এঁকে যাচ্ছেন—তিনি কি পেরেছেন তাঁর কাজ আর কথা দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই অনুপ্রেরণা ছড়িয়ে দিতে?
মাথা নাড়লেন কাইয়ুম চৌধুরী। শিক্ষক কাইয়ুম চৌধুরীর কোনো অনুসারী নেই। যেমন অনেকে মোহাম্মদ কিবরিয়ার মতো ছবি আঁকেন। তাঁর রং, তাঁর কম্পোজিশন, তাঁর বুনোট, তাঁর রঙের প্রয়োগ অনুসরণ করেন। সবারটাই যে মানোত্তীর্ণ হয়, তা নয়। কাজটা সহজও নয়। তবু কিবরিয়ার ধারা বলে একটা ঘরানা তো আছে। পাশে ছিলেন শিল্পী অশোক কর্মকার। বললেন, স্যার, সরাসরি না হলেও আপনার রং, আপনার ফর্ম অনেককে অনুপ্রাণিত করে। তাহেরা চৌধুরী বললেন, গ্রাফিক ডিজাইনে তোমার কাজের সরাসরি অনুসারী আছে। কিন্তু কাইয়ুম চৌধুরী বিনয়ের সঙ্গে আবারও বললেন, তিনি শিল্পী হিসেবে যতটা সফল, শিক্ষক হিসেবে ততটা নন।
তাঁকে প্রশ্ন করি, আপনি তো হাঁটলেন আশি বছর। সুস্থ দেহে আরও অনেক বছর হাঁটবেন। ছবি আঁকবেন। কিন্তু হঠাত্ দেখলেন পরবর্তী প্রজন্মের কোনো এক শিল্পী ঠিক কাইয়ুম চৌধুরীর মতো করেই কাজ করছেন। সাধারণ চোখে ধরাই পড়ে না কোনটা কাইয়ুম চৌধুরীর, কোনটা না। কেমন লাগবে? খুশি হবেন?
ঘরটা হঠাত্ নীরব। এতক্ষণ চঞ্চল যে দুই শিশু—অতসী ও অতনু (তাহেরা চৌধুরীর ভাতিজা-ভাতিজি) ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তারাও কী মনে করে শিল্পীর মুখের দিকে চেয়ে থাকল।
উত্তর শোনার অধীর অপেক্ষায় যেন বারান্দার পাশের গাছ থেকে পাখিরাও একটু বিশ্রাম নিল। কোনো কিচিরমিচির নেই। তিনি বললেন, ‘কষ্ট পাব। আমি যেখানে থামলাম, পরের প্রজন্ম যদি আরেকটু এগিয়ে যায়, তবেই আমার আনন্দ।
No comments