বাড়িভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে by ধীরাজ কুমার নাথ
শহরে বসবাস করার অনেক সমস্যা। শুধু যে যানবাহনে বিড়ম্বনা, ভেজাল খাদ্যের ভীতি এবং অপহরণের আশংকায় সন্ত্রস্ত থাকতে হয় পথচারীকে তাই নয়, বসবাসের দুর্ভোগ এবং বাড়িওয়ালাদের উপদ্রব শহরবাসীকে তটস্থ করে চলেছে। সম্প্র্রতি উৎকণ্ঠার বিষয় হয়েছে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি। ঢাকা শহরে দুবছর আগে যে বাড়িভাড়া ছিল প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা, এখন তা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। খবর বের হয়েছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণ হতে পারে। এমন খবরে স্বল্প আয়ের জনগণ অত্যন্ত বিব্রত ও বেসামাল হয়ে পড়েছে। অনেকে ভাবছে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে কোথাও মেসে গিয়ে থাকবে। কিন্তু ব্যাচেলর বা পরিবার ছাড়া বিবাহিতদের ভাড়া পাওয়া আরও কঠিন। শহরের নির্দিষ্ট আয়ের লোকজন আতংকগ্রস্ত হয়ে অল্প ভাড়ায় কোথায় থাকা যায়, এরই মধ্যে তা খুঁজতে শুরু করেছে।
ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব শহরে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক গুণ বেশি। অনেকের উপার্জনের প্রায় অর্ধেক চলে যায় বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে। বাড়িভাড়া সম্পর্কিত আইন ও বিধিমালা কার্যত সঠিকভাবে প্রয়োগযোগ্য না থাকায় বা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তদারকির দায়িত্ব পালনে দৃশ্যমান কোনো দফতর না থাকার কারণে বর্তমানে দেশে বিশেষত ঢাকা মহানগরীতে বাড়িভাড়ার সমস্যা একটি বিশাল নাগরিক সমস্যায় রূপলাভ করেছে। স্বল্প ও মধ্য আয়ের লোকজন, যাদের নিজস্ব কোনো আবাসিক গৃহনির্মাণের সক্ষমতা বা নিজস্ব নিবাস নেই, তাদের জীবনযাত্রা দুঃসহ হয়ে পড়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গনে আলোচনার ঝড় উঠেছে।
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে আদায়ের ব্যাপারে জনস্বার্থে একটি রিট মামলা হয়েছিল এবং ওই রিটের শুনানি শেষ হয় ২৯ নভেম্বর ২০১২। অর্থাৎ দুবছর আগে। শোনা যায়, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ আছে। শুনানির পর অনেক দিন চলে গেল কিন্তু রায় চূড়ান্ত হয়নি এখনও। দুষ্ট লোকদের ধারণা, মালিকরা সংখ্যায় বেশি বলে ভাড়াটিয়ারা অসহায়।
প্রচলিত আইন প্রিমিসেস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট ১৯৯১-এর অধীনে একটি স্টান্ডার্ড রেন্ট নির্ধারণের নিয়ম প্রচলিত আছে। কিন্তু কোন কর্তৃপক্ষ তা নির্ধারণ করবে বা কীভাবে এ ধরনের বিরোধ মীমাংসায় উপনীত হবে, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার অভাব আছে।
অনেকে মনে করেন, বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিষয়াবলি জেলা প্রশাসনের কাজ। যদি তাই হয়, তবে এ আইন প্রয়োগ করা দুরূহ। জেলা প্রশাসনের পক্ষে এ মহানগরীতে এ ধরনের ব্যাপক বিস্তৃত একটি আইন বলবৎ করা বা তার নিয়মিত তদারক করা অথবা এ আইনের আওতায় অভিযোগ গ্রহণ করে তার সুরাহা করা এক জটিল কর্মকাণ্ড। তদুপরি মেট্রোপলিটন সিটি হওয়ার পর জেলা প্রশাসকের এখতিয়ার কতটুকু আছে মহানগরীতে তাও বিবেচ্য। এ জন্য কোন মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর দায়ী সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো কিছু দৃশ্যত উল্লেখ নেই।
এ ক্ষেত্রে অনেক বিষয় প্রণিধানযোগ্য। যেমন, কোনো ভাড়াটিয়া যদি ভাড়া দিতে না চায় অথবা কোনো মালিক যদি কোনো সুপ্ত কারণে ভাড়া গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে অথবা কিছু ভাড়া ব্যাংক অথবা কিছু ভাড়া নগদ নিতে চায়, তখন কীভাবে এর সুরাহা হবে? ভাড়াটিয়ার ঘর থেকে বের হওয়া বা চলাচলের পথ সুগম না হওয়া এবং এ নিয়ে যদি বিরোধ বাধে, তবে এ বিরোধ মীমাংসার পদ্ধতি কী হবে? এ ব্যাপারে আইনে উল্লেখ আছে; তবে তা প্রয়োগের ব্যাপারে আরও স্পষ্টতার দাবি রাখে।
বাড়ির মালিক যদি প্রিমিয়াম বা সালামি দাবি করে অথবা অনেক বছরের ভাড়া অগ্রিম দাবি করে অথবা ভাড়ার চুক্তি বহাল থাকা অবস্থায় ভাড়াটিয়াকে জোর করে উচ্ছেদ করে এবং বেআইনি পন্থা অবলম্বন করে, তখন কী হবে? এ ছাড়া বিলম্বে ভাড়া পরিশোধ করলে বা অনাবশ্যকভাবে বিলম্ব করলে জরিমানা দিতে হবে কি-না, যদি দিতে হয় তবে কী হারে তা হবে, এ ধরনের বিষয়াবলির সুরাহার পথ ও পন্থা স্পষ্ট হওয়া দরকার।
কয়েকদিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয় ভাড়াটিয়া পর্ষদ নামক একটি সংগঠন অনেক লোকের স্বাক্ষর নিতে শুরু করে। তারা এ ব্যাপারে ১৫টি দাবি সরকারের কাছে উত্থাপন করে। দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বাড়িভাড়া আইনকে সহজতর ও অধিক গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে হবে। তাদের অভিমত, বিষয়টি এখন একটি সামাজিক সমস্যা নয়, একটি বৃহৎ জাতীয় সমস্যা হিসেবে রূপলাভ করেছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তারা উল্লেখ করেছে তা হল, প্রত্যেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ির মালিককে ভাড়ার রসিদ দিতে হবে।
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এর সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি জড়িত। বাড়ির মালিক এ জন্য আয়কর পরিশোধ করে কি-না অথবা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি ও অবৈধ অর্থের উৎস আছে কি-না এর সঙ্গে তা দেখা প্রয়োজন। তদুপরি যিনি বাড়ির ভাড়া গ্রহণ করছেন তিনিই বাড়ির মালিক কি-না এ বিষয়টিও সম্পৃক্ত আছে। তবে আইনের ১৩নং অনুচ্ছেদে বাড়িভাড়ার রসিদ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও অনেকেই তা প্রতিপালন করছে না বলেই এ বিরোধ ব্যাপক আকার ধারণ করছে।
এ ছাড়াও প্রচলিত আইনে রেন্ট কন্ট্রোলারের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রত্যেক ওয়ার্ডে রেন্ট কন্ট্রোলার আছে কি-না, থাকলে কোথায় তার অবস্থান অনেকেই জানেন না। মূলত সরকার বা কর্তৃপক্ষ জনগণকে অবহিত না করলে জনগণ জানবে কী করে? ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রেভিনিউ অফিসার এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে জানান, সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তিনি সঠিক বলেছেন।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এবং যোগাযোগের সুবিধাজনক অবস্থানে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কোনো হিসাব নেই, দরাদরিও নেই। ছেলেমেয়েদের স্কুল বা কর্মস্থলের কাছাকাছি হলে কোনো দরকষাকষির সুযোগও গ্রহণ করে না আগ্রহী ভাড়াটিয়া। অবস্থার শিকার হয়ে বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া অধিক মূল্য দিতেও রাজি থাকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, চলাচলের দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাওয়া। কী হারে বাড়িভাড়া বাড়তে পারে এবং কোন স্থানে কত ভাড়া হতে পারে, এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে সরকারকে। বাড়ির মালিকরা বলছে, বাড়ি তৈরির খরচ বেড়েছে অনেক। রক্ষণাবেক্ষণের দায়-দায়িত্বও ব্যয়বহুল। কোনো ধরনের মেরামতের প্রয়োজন হলে অনেক খরচ। ভাড়াটিয়ারা বাড়ির যত্ন নেয় না। পক্ষান্তরে ভাড়াটিয়ারা বলছে, বাড়ির মালিক নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করে কিন্তু কোনো সার্ভিস দেয় না। অনেক সময় পরিচ্ছন্নতার বিষয়টির প্রতিও সঠিক নজর দেয় না বাড়ির মালিক।
তারপর আছে আপিল আদালত, মামলা-মোকদ্দমার বিষয়। বলা আছে, ৬ মাসের মধ্যে কোনো অভিযোগ দাখিল করতে না পারলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ বিষয়টিও বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। তা ছাড়া আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, মামলা করার অর্থ এমন এক ঝামেলাকে গ্রহণ করা, যার ফলাফল অর্থদণ্ড, বিড়ম্বনা ও দীর্ঘসূত্রতা।
খেয়াল রাখতে হবে, বর্তমানে প্রচলিত প্রিমিসেস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট, ১৯৯১ জারি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে। এ আইন প্রণীত হয়েছে যখন কোনো গণমুখী সরকার এ দেশের শাসন ব্যবস্থায় আসীন ছিল না। জনগণের ভাষা বা তাদের অভিমত এ আইনে স্থান পেয়েছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। কাদের স্বার্থে বা তদবিরে এ আইন তখন প্রণীত হয়েছিল তাও বোঝা যায় না সঠিকভাবে। ২৩ বছরে নাগরিক জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে, নগরমুখী অভিবাসন বেড়েছে ব্যাপক হারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, বসবাসের স্থান নির্ধারণে নতুন চাহিদা ও পদ্ধতির জন্ম নিয়েছে। তাই এখন আর বিলম্ব নয়, বাড়িভাড়ার বিষয়টিকে দেখতে হবে নগর জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে, সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করার লক্ষ্যে।
বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বর্তমান আইনের পরিবর্তন করতে হবে অবশ্যই। বাড়িভাড়াবিষয়ক আইন ও বিধিমালার পুনর্বিন্যাস করে জবাবদিহিতার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে জরুরিভাবে। সুশাসনের অর্থ শুধু রাস্তায় আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণ নয়। যেসব বিষয় আইনশৃংখলার জটিলতা সৃষ্টি করে তা নির্মূল করতে হবে। সরকারকে দৃশ্যমান করতে হবে, সরকার জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর- কথায় নয়, কাজে।
ধীরাজ কুমার নাথ : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব শহরে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক গুণ বেশি। অনেকের উপার্জনের প্রায় অর্ধেক চলে যায় বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে। বাড়িভাড়া সম্পর্কিত আইন ও বিধিমালা কার্যত সঠিকভাবে প্রয়োগযোগ্য না থাকায় বা এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তদারকির দায়িত্ব পালনে দৃশ্যমান কোনো দফতর না থাকার কারণে বর্তমানে দেশে বিশেষত ঢাকা মহানগরীতে বাড়িভাড়ার সমস্যা একটি বিশাল নাগরিক সমস্যায় রূপলাভ করেছে। স্বল্প ও মধ্য আয়ের লোকজন, যাদের নিজস্ব কোনো আবাসিক গৃহনির্মাণের সক্ষমতা বা নিজস্ব নিবাস নেই, তাদের জীবনযাত্রা দুঃসহ হয়ে পড়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গনে আলোচনার ঝড় উঠেছে।
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে আদায়ের ব্যাপারে জনস্বার্থে একটি রিট মামলা হয়েছিল এবং ওই রিটের শুনানি শেষ হয় ২৯ নভেম্বর ২০১২। অর্থাৎ দুবছর আগে। শোনা যায়, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ আছে। শুনানির পর অনেক দিন চলে গেল কিন্তু রায় চূড়ান্ত হয়নি এখনও। দুষ্ট লোকদের ধারণা, মালিকরা সংখ্যায় বেশি বলে ভাড়াটিয়ারা অসহায়।
প্রচলিত আইন প্রিমিসেস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট ১৯৯১-এর অধীনে একটি স্টান্ডার্ড রেন্ট নির্ধারণের নিয়ম প্রচলিত আছে। কিন্তু কোন কর্তৃপক্ষ তা নির্ধারণ করবে বা কীভাবে এ ধরনের বিরোধ মীমাংসায় উপনীত হবে, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার অভাব আছে।
অনেকে মনে করেন, বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বিষয়াবলি জেলা প্রশাসনের কাজ। যদি তাই হয়, তবে এ আইন প্রয়োগ করা দুরূহ। জেলা প্রশাসনের পক্ষে এ মহানগরীতে এ ধরনের ব্যাপক বিস্তৃত একটি আইন বলবৎ করা বা তার নিয়মিত তদারক করা অথবা এ আইনের আওতায় অভিযোগ গ্রহণ করে তার সুরাহা করা এক জটিল কর্মকাণ্ড। তদুপরি মেট্রোপলিটন সিটি হওয়ার পর জেলা প্রশাসকের এখতিয়ার কতটুকু আছে মহানগরীতে তাও বিবেচ্য। এ জন্য কোন মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর দায়ী সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো কিছু দৃশ্যত উল্লেখ নেই।
এ ক্ষেত্রে অনেক বিষয় প্রণিধানযোগ্য। যেমন, কোনো ভাড়াটিয়া যদি ভাড়া দিতে না চায় অথবা কোনো মালিক যদি কোনো সুপ্ত কারণে ভাড়া গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে অথবা কিছু ভাড়া ব্যাংক অথবা কিছু ভাড়া নগদ নিতে চায়, তখন কীভাবে এর সুরাহা হবে? ভাড়াটিয়ার ঘর থেকে বের হওয়া বা চলাচলের পথ সুগম না হওয়া এবং এ নিয়ে যদি বিরোধ বাধে, তবে এ বিরোধ মীমাংসার পদ্ধতি কী হবে? এ ব্যাপারে আইনে উল্লেখ আছে; তবে তা প্রয়োগের ব্যাপারে আরও স্পষ্টতার দাবি রাখে।
বাড়ির মালিক যদি প্রিমিয়াম বা সালামি দাবি করে অথবা অনেক বছরের ভাড়া অগ্রিম দাবি করে অথবা ভাড়ার চুক্তি বহাল থাকা অবস্থায় ভাড়াটিয়াকে জোর করে উচ্ছেদ করে এবং বেআইনি পন্থা অবলম্বন করে, তখন কী হবে? এ ছাড়া বিলম্বে ভাড়া পরিশোধ করলে বা অনাবশ্যকভাবে বিলম্ব করলে জরিমানা দিতে হবে কি-না, যদি দিতে হয় তবে কী হারে তা হবে, এ ধরনের বিষয়াবলির সুরাহার পথ ও পন্থা স্পষ্ট হওয়া দরকার।
কয়েকদিন আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয় ভাড়াটিয়া পর্ষদ নামক একটি সংগঠন অনেক লোকের স্বাক্ষর নিতে শুরু করে। তারা এ ব্যাপারে ১৫টি দাবি সরকারের কাছে উত্থাপন করে। দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, বাড়িভাড়া আইনকে সহজতর ও অধিক গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে হবে। তাদের অভিমত, বিষয়টি এখন একটি সামাজিক সমস্যা নয়, একটি বৃহৎ জাতীয় সমস্যা হিসেবে রূপলাভ করেছে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তারা উল্লেখ করেছে তা হল, প্রত্যেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ির মালিককে ভাড়ার রসিদ দিতে হবে।
এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এর সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়টি জড়িত। বাড়ির মালিক এ জন্য আয়কর পরিশোধ করে কি-না অথবা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি ও অবৈধ অর্থের উৎস আছে কি-না এর সঙ্গে তা দেখা প্রয়োজন। তদুপরি যিনি বাড়ির ভাড়া গ্রহণ করছেন তিনিই বাড়ির মালিক কি-না এ বিষয়টিও সম্পৃক্ত আছে। তবে আইনের ১৩নং অনুচ্ছেদে বাড়িভাড়ার রসিদ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হলেও অনেকেই তা প্রতিপালন করছে না বলেই এ বিরোধ ব্যাপক আকার ধারণ করছে।
এ ছাড়াও প্রচলিত আইনে রেন্ট কন্ট্রোলারের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু প্রত্যেক ওয়ার্ডে রেন্ট কন্ট্রোলার আছে কি-না, থাকলে কোথায় তার অবস্থান অনেকেই জানেন না। মূলত সরকার বা কর্তৃপক্ষ জনগণকে অবহিত না করলে জনগণ জানবে কী করে? ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান রেভিনিউ অফিসার এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে জানান, সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তিনি সঠিক বলেছেন।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এবং যোগাযোগের সুবিধাজনক অবস্থানে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির কোনো হিসাব নেই, দরাদরিও নেই। ছেলেমেয়েদের স্কুল বা কর্মস্থলের কাছাকাছি হলে কোনো দরকষাকষির সুযোগও গ্রহণ করে না আগ্রহী ভাড়াটিয়া। অবস্থার শিকার হয়ে বেশিরভাগ ভাড়াটিয়া অধিক মূল্য দিতেও রাজি থাকে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, চলাচলের দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাওয়া। কী হারে বাড়িভাড়া বাড়তে পারে এবং কোন স্থানে কত ভাড়া হতে পারে, এ ব্যাপারে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে সরকারকে। বাড়ির মালিকরা বলছে, বাড়ি তৈরির খরচ বেড়েছে অনেক। রক্ষণাবেক্ষণের দায়-দায়িত্বও ব্যয়বহুল। কোনো ধরনের মেরামতের প্রয়োজন হলে অনেক খরচ। ভাড়াটিয়ারা বাড়ির যত্ন নেয় না। পক্ষান্তরে ভাড়াটিয়ারা বলছে, বাড়ির মালিক নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করে কিন্তু কোনো সার্ভিস দেয় না। অনেক সময় পরিচ্ছন্নতার বিষয়টির প্রতিও সঠিক নজর দেয় না বাড়ির মালিক।
তারপর আছে আপিল আদালত, মামলা-মোকদ্দমার বিষয়। বলা আছে, ৬ মাসের মধ্যে কোনো অভিযোগ দাখিল করতে না পারলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ বিষয়টিও বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। তা ছাড়া আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, মামলা করার অর্থ এমন এক ঝামেলাকে গ্রহণ করা, যার ফলাফল অর্থদণ্ড, বিড়ম্বনা ও দীর্ঘসূত্রতা।
খেয়াল রাখতে হবে, বর্তমানে প্রচলিত প্রিমিসেস রেন্ট কন্ট্রোল অ্যাক্ট, ১৯৯১ জারি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২৩ বছর আগে। এ আইন প্রণীত হয়েছে যখন কোনো গণমুখী সরকার এ দেশের শাসন ব্যবস্থায় আসীন ছিল না। জনগণের ভাষা বা তাদের অভিমত এ আইনে স্থান পেয়েছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে না। কাদের স্বার্থে বা তদবিরে এ আইন তখন প্রণীত হয়েছিল তাও বোঝা যায় না সঠিকভাবে। ২৩ বছরে নাগরিক জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে, নগরমুখী অভিবাসন বেড়েছে ব্যাপক হারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, বসবাসের স্থান নির্ধারণে নতুন চাহিদা ও পদ্ধতির জন্ম নিয়েছে। তাই এখন আর বিলম্ব নয়, বাড়িভাড়ার বিষয়টিকে দেখতে হবে নগর জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে, সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব করার লক্ষ্যে।
বাড়িভাড়া সংক্রান্ত বর্তমান আইনের পরিবর্তন করতে হবে অবশ্যই। বাড়িভাড়াবিষয়ক আইন ও বিধিমালার পুনর্বিন্যাস করে জবাবদিহিতার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে জরুরিভাবে। সুশাসনের অর্থ শুধু রাস্তায় আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণ নয়। যেসব বিষয় আইনশৃংখলার জটিলতা সৃষ্টি করে তা নির্মূল করতে হবে। সরকারকে দৃশ্যমান করতে হবে, সরকার জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর- কথায় নয়, কাজে।
ধীরাজ কুমার নাথ : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক সচিব
No comments