টুনটুনি’র জন্য রাজপথে কাঁদলেন পিতা-মাতা
চার বছরের শিশু স্নিগ্ধা দেব জয়ী ওরফে টুনটুনি অপহরণের ১৬ মাসেও উদ্ধার না হওয়ায় সিলেটে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। আর এ ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা চালানো হয়েছে। এ কারণে অপহরণের ঘটনায় জড়িত সেবিকা অনিতা ভট্টাচার্যকে মারধরের নাটক সাজানো হয়েছে। গতকাল শিশু টুনটুনিকে উদ্ধারের দাবিতে সিলেটের আয়োজিত মানববন্ধন ও সমাবেশে বক্তারা এ কথা বলেন। এ সময় বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ আইজিপি’র কাছে স্মারকলিপি দেন। ২০১৩ সালের ২১শে জুলাই সিলেট নগরীর ভাঙ্গাটিকর এলাকা থেকে চার বছরের টুনটুনি নিখোঁজ হয়ে যায়। এ ঘটনার পর টুনটুনি’র পিতা সন্তোষ দাস বাদী হয়ে সিলেটের কোতোয়ালি থানায় জিডি করেন। ঘটনাটি নাড়া দেয় সিলেটবাসীকে। এ কারণে শিশু টুনটুনিকে উদ্ধারের জন্য আন্দোলন দানা বাঁধে। টানা আন্দোলন কর্মসূচি পালনের পর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ শিশু টুনটুনিকে উদ্ধারের জন্য তদন্তে নামে। এর অংশ হিসেবে মামলার তদন্তকারী লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই সিরাজুল ইসলাম ভাঙ্গাটিকর বসবাসকারী রবিউল ইসলাম নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে। পরে রবিউল আদালতে জবানবন্দি দিয়ে জানায়, একই এলাকার শঙ্কর দাম ও সেবিকা অনিতা ভট্টাচার্য ঘটনার দিন টুনটুনিকে অপহরণ করে। অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পথে সে দেখে ফেলায় ৫০০০ টাকা দেয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশ শঙ্করকে আটক করলেও অনিতাকে খুঁজে পায়নি। ওদিকে, শঙ্কর দাম এ ঘটনায় জামিন পেয়ে যায়। পরে পুলিশ শঙ্করকে অন্য মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করে। একই সঙ্গে পুলিশ জবানবন্দির সূত্র ধরে পলাতক থাকা নার্স অনিতাকে ৭ই নভেম্বর তারিখে শ্রীমঙ্গলের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। এ মামলায় অনিতাকে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ নির্যাতন চালায়। এতে অনিতা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনিতাকে নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশের অতি-উৎসাহী মনোভাবের কারণে শিশু টুনটুনি উদ্ধার নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। এজন্য গতকাল সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে বেশ কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। মানববন্ধনে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, হিউমেন রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটি-এইচআরবিসিএম, হিন্দু মহাজোট, মানবাধিকার কমিশন, সিলেট জেলা প্রশাসকের কর্মচারীরা অংশ নেন। এ মানববন্ধনে টুনটুনির মা সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মচারী সর্বাণী দাস ১৬ মাসেও তার মেয়ে উদ্ধার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বলেন, আমি জানি না আমার সোনামণি কোথায় আছে, কোন অবস্থায় আছে। কোন মা তার সন্তান ছাড়া কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে সেটিও হয়তো অনেকেই জানেন না। তিনি বলেন, আমার জীবনের মূল্য দিয়ে হলেও আমি আমার টুনটুনিকে ফিরে পেতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়া হয়েছে। এর পরও আমার মেয়ে উদ্ধার না হওয়ায় আমরা শঙ্কিত।’ মানববন্ধনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন পিতা সন্তোষ দাস। তিনি বলেন, ‘১৬ মাস ধরে আমরা মেয়ের সন্ধানে পাগল অবস্থায় আছি। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে মেয়েকে খুঁজছি। পুলিশ জয়ী অপহরণের ক্লু উদ্ঘাটন করলেও উদ্ধার হয়নি সে।’ সমাবেশে উপস্থিত সিলেটের সুধীজনরা বলেন, ‘টুনটুনিকে খুঁজে বের না করলে সিলেটজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’ মানববন্ধনে একাত্মতা প্রকাশ করে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। বলেন, ‘টুনটুনি অপহরণ মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করবেন না। সত্যি ঘটনাকে কখনও ধামাচাপা দেয়ার পরিণাম শুভ হয় না।’ মানববন্ধন চলাকালে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিলেট জেলা বারের আইনজীবী এডভোকেট এবাদুর রহমান, প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতা স্বপন দাশ, জেলা প্রশাসনের কর্মচারী পরিষদের নেতা পান্না লাশ চৌধুরী, অমর কান্ত চাকমা, এইচআরসিবিএমের সেক্রেটারি রাকেশ রায়, জয়েন্ট সেক্রেটারি মনীন্দ্র রঞ্জন দে, হিন্দু যুব মহাজোটের সুমন রঞ্জন দাস, ছাত্র মহাজোটের জয়দেব পালন, শিক্ষিকা রাজনা বেগম, বিলকিস আক্তার, শ্যামলী দত্ত, শিপ্রা দে, কলেজ ছাত্রী রিমি রানী দেব, শিক্ষক প্রতিনিধি তরুণ দেব, প্রাণেশ দাস, শামসুল আলম, অজিত পাল, অজয় দেব, লাল মোহন দাস নান্টু, শিউলী পুরকায়স্থ, মিনতী চৌধুরী, নূর আনাম, ফুল মিয়া, সন্তু কান্ত দাস, কাজী জাহানার ইয়াসমিন বীণা, সাবিত্রী রানী দাস প্রমুখ। এদিকে মানববন্ধন ও সমাবেশ শেষে মিছিল সহকারে পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে যান উপস্থিত লোকজন। তারা পুলিশের কমিশনারের মাধ্যমে আইজিপি’র কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। তিন শতাধিক মানুষের স্মাক্ষর সংবলিত স্মারকলিপিতে বলা হয়, টুকটুক নিখোঁজ হয়নি, অপহৃত হয়েছে। সেটি তথ্য পুলিশ ইতিমধ্যে খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু এখনও উদ্ধার করা হয়নি টুনটুনিকে। অবিলম্বে তারা অপহৃত হওয়া শিশুটির উদ্ধার দাবি করেন।
No comments