মাগুরার শীর্ষ সন্ত্রাসী সাঈদ মীর বিপুল অস্ত্রসহ আটক by নূর ইসলাম
মাগুরার মূর্তিমান আতঙ্ক, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও ৪১ বছরের সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মীর আবু সাঈদ ওরফে সাঈদ মীর এখন পুলিশের খাঁচায়। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ র্যাব-৬ যশোর ক্যাম্পের সদস্যরা গত রাতে তাকে যশোর বিমানবন্দর এলাকা থেকে আটক করে। এ বিষয়ে যশোর র্যাব ৬-এর কার্যালয়ে গতকাল দুপুরের এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব কমান্ডার মেজর আশরাফ সাংবাদিকদের সাঈদ মীরের ভয়ঙ্কর জীবনের কিছু চিত্র তুলে ধরেন। এ সময় মীর সাঈদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ১টি শটগান, ৩টি পিস্তল, ২৫ রাউন্ড শটগানের গুলি, ৩ রাউন্ড পিস্তলের গুলিও সাংবাদিকদের সামনে প্রদর্শন করা হয়। র্যাব কমান্ডার জানান, গত শুক্রবার (২৮শে নভেম্বর) রাতে যশোর বিমানবন্দর থেকে সাঈদ মীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যায় র্যাব। এ সময় মাগুরার শ্রীপুর এলাকার বড়ালদাহ গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে তার শয়নকক্ষের ভেতর একটি ট্যাংকি থেকে উল্লিখিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। র্যাব জানায়, এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ৫টি হত্যাসহ মোট ১৮টি মামলার নথি র্যাবের হাতে পৌঁছেছে। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় ইতিমধ্যে তার যাবজ্জীবনসহ মোট ৪১ বছরের সাজা হয়েছে। হত্যা, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণ, গুম, সরকারি কাজে বাঁধা, অস্ত্র, হত্যাপ্রচেষ্টাসহ বিভিন্ন অপরাধে সে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হিসেবে অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত হয়ে আছে। সে মাগুরার রাজন হত্যা মামলারও প্রধান আসামি। রাজন ছিলেন মাগুরা জেলা ছাত্রলীগের নেতা । গত ২৮শে অক্টোবর কিলার সাঈদ, তার ভাই সজল মীর ও কিলার হায়না রুবেল প্রকাশেও সরকারি কলেজ মাঠে তাকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে।
এদিকে ভয়ঙ্কর এই সন্ত্রাসীর আটকের খবরে গতকাল রাতে ও আজ দিনভর মাগুরা, শ্রীপুর, শালিখা, হাজিপুর, খানপাড়া, মোল্যাপাড়া, কলেজপাড়া, স্টেডিয়ামপাড়া, পাল্লা, নতুন বাজার এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে মিষ্টি বিতরণ করেছেন। অনেক এলাকায় মসজিদ ও মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। একই সঙ্গে রাজনের পরিবারসহ সাঈদ মীরের বাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তরা তার ফাঁসির দাবিতে শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। মাগুরা জেলা ছাত্রলীগ সাঈদ মীর ও তার দক্ষিণ হস্ত বলে পরিচিত হায়না রুবেলের শাস্তির দাবিতে শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। কিলার সাঈদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, জেলা বাস-মিনিবাস মালিক ও শ্রমিক সমিতির নেতৃবৃন্দও। শোকার্ত পরিবারের ব্যানারে সকালে মাগুরা-ঢাকা সড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন করেছেন কয়েক শ’ মানুষ।
কে এই মীর সাঈদ?
মাগুরা সদরের মীর পাড়ার কুদ্দুস মীর ওরফে ডাকাত কুদ্দুসের ছেলে সাঈদ মীর। ছোটবেলা থেকেই সে ডানপিটে স্বভাবের। পিতার পথ ধরে অল্প বয়সেই ঢুকে পড়ে অপরাধ জগতে। তখন থেকেই চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদকদ্রব্য বিকিকিনি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ছাত্রজীবনেও ছিল সহপাঠীদের কাছে আতঙ্কের নাম। কারণে অকারণে সে সহপাঠীদের ওপর চড়াও হতো। মারপিট করতো। অনেক সময় বিভিন্ন অজুহাতে ছাত্রদের কাছ থেকে কেড়ে নিতো টাকা-পয়সাসহ তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র। এসব ঘটনায় বহুবার সে জেল খেটেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সাঈদ মীর এ পর্যন্ত মোট ১৪ বারে প্রায় ১০ বছর জেল খেটেছে। এছাড়া ওয়ান ইলেভেনের সময় ক্রসফায়ার আতঙ্কে সে ১৪ মাস স্বেচ্ছায় কারাবরণ করে বলেও জানা গেছে।
কিলার সাঈদ মীরের উত্থান
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মাগুরার এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার ছত্রছায়ায় রাতারাতি মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আর্বিভূত হয়। পরিণত হয় অপরাধ জগতের নতুন ডন। অবৈধ অস্ত্র আর অর্থের জোরে রাতারাতি গড়ে তোলে নিজস্ব বাহিনী। স্থানীয় ভাবে সাঈদ বাহিনী বলে পরিচিত এই গ্রুপে চরমপন্থি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সশস্ত্র ক্যাডাররা আত্মরক্ষার্থে শেল্টার নেয়া শুরু করে। রাতে চরমপন্থি আর দিনে সাঈদের লোক বলে পরিচিত এসব ক্যাডারের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। কিন্তু ওই জনপ্রতিনিধি নেতার কারণে কারও টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। মাগুরার সব টেন্ডার এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে সাঈদ মীর। পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির কৌশল হিসেবে এ সময় সে বাসের ব্যবসায় নামে। রাতারাতি যশোর-মাগুরা ও মাগুরা-ফরিদপুর রুটে কয়েকটি নতুন পুরাতন বাস নামিয়ে বনে যায় পরিবহন সেক্টরের নেতা। সে সময়ের এমপি বীরেন শিকদারের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার কারণে সাঈদ মীর ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, নারী ও শিশু পাচারের মতো জঘন্য সব অপকর্মের শেল্টারদাতা হয়ে ওঠে। মাগুরার রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে, এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত সার্কেল থেকে শুরু করে সব সরকারি-বেসরকারি সেক্টরের অধিকর্তা বনে যায় সে। পৌরসভার কোটি কোটি টাকার টেন্ডার এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করে রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠে সাঈদ মীর। সে মাগুরা জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে লড়াই করে হেরে গিয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। শুরু হয় তার কিলার জীবন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভেবে এ সময়ে সে এলাকার বহুজনকে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়। তার এ অপকর্মের প্রতিবাদ করায় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী-২ (এপিএস-২) সাইফুজ্জামান শেখরের মাগুরা শহরের ঢাকা রোডস্থ বাড়িতে হামলা চালায় সাঈদ ও তার সশস্ত্র ক্যাডাররা। এসময় তারা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে আবসাবপত্র ভাঙচুর করে। ঢাকা রোড অবরোধ করে এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে সাঈদ মীরের ক্যাডাররা। পরে বিষয়টি নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের মধ্যস্থতায় কোন রকমে মীমাংসা হয়।
রাজন হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কাহিনী
ছাত্রলীগ নেতা রাজন ছিলেন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। সাঈদ বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডার হায়না রুবেল ও জুয়েল কলেজ রোডের বেশ কয়েকটি দোকানে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। বিষয়টি দোকানিরা রাজনকে জানায়। রাজন এর প্রতিবাদ করে দোকানিদের পক্ষ অবলম্বন করেন। তারই প্রতিশোধ নিতে গত ২৮শে অক্টোবর দুপুরে সরকারি কলেজ মাঠে প্রকাশ্যে সাঈদ মীর, তার ভাই সজল মীর ও তার ক্যাডার কিলার হায়না রুবেল কুপিয়ে ও গুলি করে রাজনকে হত্যা করে। সে সময় কলেজে উপস্থিত শ’ শ’ ছাত্র এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও প্রতিবাদ করার সাহস কারও ছিল না। রাজন হত্যার প্রতিবাদে সরকারি দল আওয়ামী লীগ পর দিন রাস্তায় নামে। গর্জে ওঠে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কয়েক শ’ সদস্য। সাঈদ মীরকে প্রধান আসামি করে পুত্র হত্যার মামলা করেন রাজনের পিতা আবদুল ওহাব খান। ঘটনার পর থেকে সাঈদ মীর আত্মগোপন করে।
১৮ মামলার আসামি সাঈদ মীর
র্যাব ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাগুরার ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কিলার সাঈদের বিরুদ্ধে মাগুরা সদর, মোহাম্মদপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শ্রীপুর, শালিখা ও কুষ্টিয়ার মীরপুর থানায় অস্ত্র, মাদক, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধে মোট ১৮টি মামলা আছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে মাগুরা সদর থানায় দায়েরকৃত ৩৯/২০০৭ নম্বর মামলায় যাবজ্জীবন, ৩৮/২০০৭ নম্বর মামলায় ১০ বছর, শ্রীপুর থানার ২১/২০০৯ নম্বর মামলায় ১০ বছর ও শালিখা থানায় দায়েরকৃত একটি হত্যা মামলায় ১০ বছরের জেল হয়েছে সাঈদ মীরের। বর্তমানে যাবজ্জীবনসহ ৪১ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল সাঈদ মীর।
যেভাবে আটক হয় কিলার সাঈদ
রাজন হত্যার পর সাঈদ মীর গা-ঢাকা দেয়। আত্মগোপনে চলে যায় তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা। ভয়ঙ্কর এ সন্ত্রাসীকে আটকে অভিযানে নামে র্যাব ও পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে- গ্রেপ্তার এড়াতে সাঈদ ঢাকায় গিয়ে স্থানীয় এক মন্ত্রীর শেল্টারে ওঠে। ওই মন্ত্রীর আশীর্বাদ ও অভয়বাণী শুনে গত শুক্রবার সাঈদ মীর ইউএস বাংলা বিমানের সন্ধ্যার ফ্লাইটে মাগুরা যাওয়ার উদ্দেশে যশোর নামে। খবর পেয়ে র্যাব যশোর ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর আশরাফ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি অভিযানিক দল যশোর বিমানবন্দর এলাকা থেকে সাঈদ মীরকে আটক করে। পরে তার দেয়া তথ্য মতে মাগুরার শ্রীপুর এলাকার বড়ালদাহ গ্রাম থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।
সাঈদ মীরের বীভৎসতা
র্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে সাঈদ মীরের বীভৎসতার নানা দিক। মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করে সাঈদ মীরের উল্লাস নৃত্য দেখে যারা এত দিন চুপ ছিল এখন তারা সরব হতে শুরু করেছে। সাঈদের ক্যাডার হায়না রুবেল মাগুরার পারনান্দুয়ালী গ্রামের আরিফ হোসেনের একটি পা কেটে তা মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে পুরো মাগুরা শহরে ঘোরালেও এত দিন যারা টুঁ শব্দ করতে পারেনি তারা আজ আনন্দ মিছিল করেছে। টেন্ডারবাজিতে সহায়তা না করায় মাগুরা রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের এক প্রকৌশলীর পেছনে নারী লেলিয়ে দিয়ে তাকে গোটা শহরে বেইজ্জতি করে এ সাঈদ মীর। শহরের ঋষিপাড়ায় হিন্দুদের একটি মন্দির দখল করে বাড়ি করেছে সে। শুধু তাই নয় ভয়ভীতি ও মহাজনী সুদের ফাঁদে ফেলে নানা কৌশলে সেখানে থাকা অন্তত ১০টি হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে। রামনগর ও আশপাশের অনেক এলাকার হিন্দু পরিবার তার অত্যাচারে বাড়িঘর ছেড়ে ভারত চলে গেছে। সে ঋষিপাড়ায় তার বাড়ির সামনে রাতে সশস্ত্র ও মাতাল অবস্থায় নিরীহ পথচারীদের কুকুর ও তার বাহিনী দিয়ে নির্যাতন করতো। র্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর তার এসব অপকর্মের শিকার নিরীহ মানুষগুলো প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে। তাদের দাবি বহু অপকর্মের হোতা এ সাঈদ মীরের উপযুক্ত শাস্তি হোক। তার শাস্তি দেখে অন্যরা যেন আঁতকে ওঠে। অনেকে এ সন্ত্রাসীর ফাঁসিও দাবি করেন।
এদিকে ভয়ঙ্কর এই সন্ত্রাসীর আটকের খবরে গতকাল রাতে ও আজ দিনভর মাগুরা, শ্রীপুর, শালিখা, হাজিপুর, খানপাড়া, মোল্যাপাড়া, কলেজপাড়া, স্টেডিয়ামপাড়া, পাল্লা, নতুন বাজার এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষ উল্লাস প্রকাশ করে মিষ্টি বিতরণ করেছেন। অনেক এলাকায় মসজিদ ও মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। একই সঙ্গে রাজনের পরিবারসহ সাঈদ মীরের বাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তরা তার ফাঁসির দাবিতে শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। মাগুরা জেলা ছাত্রলীগ সাঈদ মীর ও তার দক্ষিণ হস্ত বলে পরিচিত হায়না রুবেলের শাস্তির দাবিতে শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। কিলার সাঈদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড, জেলা বাস-মিনিবাস মালিক ও শ্রমিক সমিতির নেতৃবৃন্দও। শোকার্ত পরিবারের ব্যানারে সকালে মাগুরা-ঢাকা সড়ক অবরোধ করে মানববন্ধন করেছেন কয়েক শ’ মানুষ।
কে এই মীর সাঈদ?
মাগুরা সদরের মীর পাড়ার কুদ্দুস মীর ওরফে ডাকাত কুদ্দুসের ছেলে সাঈদ মীর। ছোটবেলা থেকেই সে ডানপিটে স্বভাবের। পিতার পথ ধরে অল্প বয়সেই ঢুকে পড়ে অপরাধ জগতে। তখন থেকেই চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদকদ্রব্য বিকিকিনি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ছাত্রজীবনেও ছিল সহপাঠীদের কাছে আতঙ্কের নাম। কারণে অকারণে সে সহপাঠীদের ওপর চড়াও হতো। মারপিট করতো। অনেক সময় বিভিন্ন অজুহাতে ছাত্রদের কাছ থেকে কেড়ে নিতো টাকা-পয়সাসহ তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র। এসব ঘটনায় বহুবার সে জেল খেটেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সাঈদ মীর এ পর্যন্ত মোট ১৪ বারে প্রায় ১০ বছর জেল খেটেছে। এছাড়া ওয়ান ইলেভেনের সময় ক্রসফায়ার আতঙ্কে সে ১৪ মাস স্বেচ্ছায় কারাবরণ করে বলেও জানা গেছে।
কিলার সাঈদ মীরের উত্থান
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মাগুরার এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার ছত্রছায়ায় রাতারাতি মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আর্বিভূত হয়। পরিণত হয় অপরাধ জগতের নতুন ডন। অবৈধ অস্ত্র আর অর্থের জোরে রাতারাতি গড়ে তোলে নিজস্ব বাহিনী। স্থানীয় ভাবে সাঈদ বাহিনী বলে পরিচিত এই গ্রুপে চরমপন্থি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সশস্ত্র ক্যাডাররা আত্মরক্ষার্থে শেল্টার নেয়া শুরু করে। রাতে চরমপন্থি আর দিনে সাঈদের লোক বলে পরিচিত এসব ক্যাডারের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। কিন্তু ওই জনপ্রতিনিধি নেতার কারণে কারও টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না। মাগুরার সব টেন্ডার এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে সাঈদ মীর। পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির কৌশল হিসেবে এ সময় সে বাসের ব্যবসায় নামে। রাতারাতি যশোর-মাগুরা ও মাগুরা-ফরিদপুর রুটে কয়েকটি নতুন পুরাতন বাস নামিয়ে বনে যায় পরিবহন সেক্টরের নেতা। সে সময়ের এমপি বীরেন শিকদারের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার কারণে সাঈদ মীর ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, নারী ও শিশু পাচারের মতো জঘন্য সব অপকর্মের শেল্টারদাতা হয়ে ওঠে। মাগুরার রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে, এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, গণপূর্ত সার্কেল থেকে শুরু করে সব সরকারি-বেসরকারি সেক্টরের অধিকর্তা বনে যায় সে। পৌরসভার কোটি কোটি টাকার টেন্ডার এক হাতে নিয়ন্ত্রণ করে রাতারাতি অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে ওঠে সাঈদ মীর। সে মাগুরা জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে লড়াই করে হেরে গিয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। শুরু হয় তার কিলার জীবন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভেবে এ সময়ে সে এলাকার বহুজনকে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়। তার এ অপকর্মের প্রতিবাদ করায় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী-২ (এপিএস-২) সাইফুজ্জামান শেখরের মাগুরা শহরের ঢাকা রোডস্থ বাড়িতে হামলা চালায় সাঈদ ও তার সশস্ত্র ক্যাডাররা। এসময় তারা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে আবসাবপত্র ভাঙচুর করে। ঢাকা রোড অবরোধ করে এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে সাঈদ মীরের ক্যাডাররা। পরে বিষয়টি নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের মধ্যস্থতায় কোন রকমে মীমাংসা হয়।
রাজন হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কাহিনী
ছাত্রলীগ নেতা রাজন ছিলেন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। সাঈদ বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডার হায়না রুবেল ও জুয়েল কলেজ রোডের বেশ কয়েকটি দোকানে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। বিষয়টি দোকানিরা রাজনকে জানায়। রাজন এর প্রতিবাদ করে দোকানিদের পক্ষ অবলম্বন করেন। তারই প্রতিশোধ নিতে গত ২৮শে অক্টোবর দুপুরে সরকারি কলেজ মাঠে প্রকাশ্যে সাঈদ মীর, তার ভাই সজল মীর ও তার ক্যাডার কিলার হায়না রুবেল কুপিয়ে ও গুলি করে রাজনকে হত্যা করে। সে সময় কলেজে উপস্থিত শ’ শ’ ছাত্র এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও প্রতিবাদ করার সাহস কারও ছিল না। রাজন হত্যার প্রতিবাদে সরকারি দল আওয়ামী লীগ পর দিন রাস্তায় নামে। গর্জে ওঠে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কয়েক শ’ সদস্য। সাঈদ মীরকে প্রধান আসামি করে পুত্র হত্যার মামলা করেন রাজনের পিতা আবদুল ওহাব খান। ঘটনার পর থেকে সাঈদ মীর আত্মগোপন করে।
১৮ মামলার আসামি সাঈদ মীর
র্যাব ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাগুরার ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কিলার সাঈদের বিরুদ্ধে মাগুরা সদর, মোহাম্মদপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শ্রীপুর, শালিখা ও কুষ্টিয়ার মীরপুর থানায় অস্ত্র, মাদক, চাঁদাবাজি, অপহরণ, নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধে মোট ১৮টি মামলা আছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে মাগুরা সদর থানায় দায়েরকৃত ৩৯/২০০৭ নম্বর মামলায় যাবজ্জীবন, ৩৮/২০০৭ নম্বর মামলায় ১০ বছর, শ্রীপুর থানার ২১/২০০৯ নম্বর মামলায় ১০ বছর ও শালিখা থানায় দায়েরকৃত একটি হত্যা মামলায় ১০ বছরের জেল হয়েছে সাঈদ মীরের। বর্তমানে যাবজ্জীবনসহ ৪১ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে প্রকাশ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছিল সাঈদ মীর।
যেভাবে আটক হয় কিলার সাঈদ
রাজন হত্যার পর সাঈদ মীর গা-ঢাকা দেয়। আত্মগোপনে চলে যায় তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা। ভয়ঙ্কর এ সন্ত্রাসীকে আটকে অভিযানে নামে র্যাব ও পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে- গ্রেপ্তার এড়াতে সাঈদ ঢাকায় গিয়ে স্থানীয় এক মন্ত্রীর শেল্টারে ওঠে। ওই মন্ত্রীর আশীর্বাদ ও অভয়বাণী শুনে গত শুক্রবার সাঈদ মীর ইউএস বাংলা বিমানের সন্ধ্যার ফ্লাইটে মাগুরা যাওয়ার উদ্দেশে যশোর নামে। খবর পেয়ে র্যাব যশোর ক্যাম্পের ইনচার্জ মেজর আশরাফ উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি অভিযানিক দল যশোর বিমানবন্দর এলাকা থেকে সাঈদ মীরকে আটক করে। পরে তার দেয়া তথ্য মতে মাগুরার শ্রীপুর এলাকার বড়ালদাহ গ্রাম থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে।
সাঈদ মীরের বীভৎসতা
র্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে সাঈদ মীরের বীভৎসতার নানা দিক। মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করে সাঈদ মীরের উল্লাস নৃত্য দেখে যারা এত দিন চুপ ছিল এখন তারা সরব হতে শুরু করেছে। সাঈদের ক্যাডার হায়না রুবেল মাগুরার পারনান্দুয়ালী গ্রামের আরিফ হোসেনের একটি পা কেটে তা মোটরসাইকেলের পেছনে বেঁধে পুরো মাগুরা শহরে ঘোরালেও এত দিন যারা টুঁ শব্দ করতে পারেনি তারা আজ আনন্দ মিছিল করেছে। টেন্ডারবাজিতে সহায়তা না করায় মাগুরা রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের এক প্রকৌশলীর পেছনে নারী লেলিয়ে দিয়ে তাকে গোটা শহরে বেইজ্জতি করে এ সাঈদ মীর। শহরের ঋষিপাড়ায় হিন্দুদের একটি মন্দির দখল করে বাড়ি করেছে সে। শুধু তাই নয় ভয়ভীতি ও মহাজনী সুদের ফাঁদে ফেলে নানা কৌশলে সেখানে থাকা অন্তত ১০টি হিন্দু পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে। রামনগর ও আশপাশের অনেক এলাকার হিন্দু পরিবার তার অত্যাচারে বাড়িঘর ছেড়ে ভারত চলে গেছে। সে ঋষিপাড়ায় তার বাড়ির সামনে রাতে সশস্ত্র ও মাতাল অবস্থায় নিরীহ পথচারীদের কুকুর ও তার বাহিনী দিয়ে নির্যাতন করতো। র্যাবের হাতে আটক হওয়ার পর তার এসব অপকর্মের শিকার নিরীহ মানুষগুলো প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে। তাদের দাবি বহু অপকর্মের হোতা এ সাঈদ মীরের উপযুক্ত শাস্তি হোক। তার শাস্তি দেখে অন্যরা যেন আঁতকে ওঠে। অনেকে এ সন্ত্রাসীর ফাঁসিও দাবি করেন।
No comments