দাম বাড়ে চাপ কমে- এ ধাঁধার উত্তর কে দিতে পারে? by মোকাম্মেল হোসেন
টেলিভিশনে সিনেমা দেখানো হচ্ছে। সিনেমার নাম- তুমি আমার মন বোঝ না। কাহিনী মোচড় খেতে খেতে এমন জায়গায় এসে ঠেকেছে, নায়িকার শিল্পপতি বাবা নায়ককে প্যাকেট করে চিরবিদায় স্টোরে পাঠানোর অর্ডার দিয়ে ফেলেছেন। পিতার এ পদক্ষেপের কথা জানতে পেরে প্রেমাস্পদকে রক্ষার জন্য নায়িকা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। তার পা ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে। মাথার চুল বাতাসে উড়ছে। বুকের বসন আলগা হয়ে যাচ্ছে। কঠিন অবস্থা। তলপেটের প্রবল চাপ উপেক্ষা করে আতর আলী টেলিভিশনের সামনে বসে আছে। এরকম একটা কঠিন সময়ে আতরজান এসেছে বাজারের ব্যাগ নিয়ে! এর মানে কী? মনে হচ্ছে, কেয়ামতের আগে নারীজাতির জ্ঞান-বুদ্ধি আর বাড়বে না। হাশরের ময়দানে মাথার ৬ ইঞ্চি উপরে থাকা সূর্যের তাপে মগজ সিদ্ধ হয়ে উলট-পালট হওয়ার পর যদি এদের জ্ঞান-বুদ্ধি কিছুটা বাড়ে! আতর আলী তেরছা চোখে আতরজানকে এক নজর দেখে টেলিভিশনে নিমগ্ন হল। আতর আলীর পিঠে হাত রেখে নরম গলায় আতরজান বলল-
: সিনেমা রাইখ্যা উডুইনছে।
আল্লাহপাক পুরুষের পাঁজরের হাড় দিয়ে নারীজাতিকে সৃষ্টি করে ভুল করেছেন। মারাত্মক ভুল। নিজের শরীরের অংশ না হলে আতরজানকে কঠিন কিছু কথা বলা যেত। আফসোস! টেকনিক্যাল এ সমস্যার জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়া যাচ্ছে না। নিজেই নিজের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়া চরম বোকামি। আতর আলী এতটা বোকা নয়। বোকা হলে আতরজান এখন শক্ত উষ্ঠা খেত- এ কথা নিশ্চিত।
আতর আলী এবার ঘাড়ে চাপ অনুভব করল। তলপেটের চাপের তুলনায় মেহেদি লাগানো নরম হাতের চাপ হাওয়াই মিঠাই। আতর আলী হাওয়াই মিঠাইকে গুরুত্ব দিল না। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ তুলে আতরজান বলল-
: কী অইল, কথা কানে যাইতেছে না! উডুইন।
নাহ! নারীজাতি সম্পর্কে ফয়সালা হয়ে গেছে। গরুকে খৈল-ভুষি খাওয়ানোর সিস্টেমে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় এদের নাক ডুবিয়ে তরল ভিটামিন খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেও আক্কেল আর হবে বলে মনে হচ্ছে না! নায়কের এখন জীবন-মরণ সমস্যা চলছে, অথচ ঘটনার বিষয়বস্তুর প্রতি অবুঝ নারীজাতির কোনো খেয়াল নেই। সে উডলাইনা-উডলাইনা বলে কানের কাছে বেহালা বাজাচ্ছে। আতর আলী টেলিভিশনের পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল-
: ইট্টু পরে।
- পরে-পরে করলে চলব? রান্ধনের কুনু বাও নাই। কুমবালা বাজার আনবাইন, কুমবালা রানবাম!
: কুমবালা রানবাম মানে? তোমার তো অহন আর গোপাল পালের মণ্ডা কারখানার মতো লাকড়ি দিয়া চুলা সাজাইতে হয় না! গ্যাসের চুলায় ফতফতি আগুন জ্বলতেছে। চুলার উপরে ডাইনহাতে পাতিল রাখবা, বামহাতে নামাইবা। ব্যস, মামলা ডিসমিস!
রান্নাঘরের কাজকর্ম ভ্রাম্যমাণ আদালতের মামলা নয়। দেওয়ানি মামলা। দেওয়ানি মামলা মানে লাইফকোর্স। জীবনব্যাপী চলতে থাকা মামলা আতর আলী একবেলার জন্য ডিসমিস করতে পারে। কিন্তু পরের বেলা? আদালতের দেওয়ানি মামলায় বিবাদী পক্ষ দুই-তিন মাস পর পর কাঠগড়ায় হাজির হলেই চলে। এজন্য মহামান্য আদালতের কাছে কোনো কৈফিয়ত দিতে হয় না। রান্নাঘরের মামলায় প্রতিদিন রাঁধুনীকে অন্তত দুই বেলা তার হাজিরা নিশ্চিত করতে হয়। তা না হলে সমন জারি হয়ে যায়। এ কথা পুরুষজাতি জানার পরও ভুংভাং ধরনের কথাবার্তা বলে কীভাবে- আতরজান বুঝতে পারছে না। পুরুষজাতি খাবার টেবিলে সবকিছু রেডি অবস্থায় পায়। খাবার টেবিলে পৌঁছার আগের ইতিহাস তারা জানার প্রয়োজন মনে করে না। একজন রাঁধুনী তার জীবনের বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরের মামলায় হাজিরা দিয়ে কাটাচ্ছে, আর পুরুষজাতি খাবার টেবিলে বসে শুধু মাচুড়-মুচুড় খেয়ে যাচ্ছে-আল্লাহপাকের এ কেমন বিধান, ভেবে পায় না আতরজান। ভাবাভাবির এ পর্যায়ে বিদ্যুৎ চলে গেল। আতরজান হাততালি দিয়ে বলল-
: আল্লাহর মাইর- দুনিয়ার বাইর। অহন কেমুন অইল?
বিদ্যুৎ যাওয়ার ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বেছে বেছে ঠিক এমন একটা সময়ে বিদ্যুৎ কেন এরকম বিটলামি করল? আতর আলীর মনে হল, তার বিরুদ্ধে ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মাথা ঠিক রাখা শক্ত কাজ। আতর আলী বিদ্যুতের অপেক্ষায় ঝিম মেরে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পরও বিদ্যুতের দেখা না পেয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করতে করতে বাজারের পথ ধরল। বাজারে মাংসের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আতর আলীর কানে এলো-
: অই গ্যাস...
গ্যাস আবার কারও নাম হয় নাকি? বিষয়টা একটু পরেই পরিষ্কার হল। আতর আলী বুঝতে পারল- গ্যাস বলে যাকে সম্বোধন করা হয়েছে, তিনি গ্যাস কোম্পানির স্থানীয় অফিসে চাকরি করেন। গ্যাস নিয়ে কারবার- তাকে গ্যাস বলা যেতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। সম্বোধনকারী গ্যাসের পাশে এসে দাঁড়াতেই তাকে চিনতে পারল আতর আলী। তার নাম আফলাজ মণ্ডল। আফলাজ মণ্ডল অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। বাসা আকুয়া মণ্ডল বাড়ি। আফলাজ গ্যাস ভদ্রলোকের উদ্দেশে বললেন-
: বক্কইরা, কী খবর?
- ভালো।
: গোস কিনবা?
- হুঁ।
: ভালা কইরা দেইখ্যা লইও। ব্যাটারা এক টুকরা গোস দিয়া তিন টুকরা হাড্ডি ঢুকাইয়া দেয়।
- ঢুকানি-ফুকানির কোনো চান্স নাই। পুরা খাসিই প্যাক করতেছি।
: পুরা খাসি! মেজবানি আছে নাকি?
- আর কইও না! বাসায় তিনবেলা বিরানি চলে। আমার বউ বিরানি ছাড়া অন্যকিছু খাইতে পারে না। পোলাপানগুলাও তার মায়ের তরিকা ধরছে। ফলে টুকাইন্যা মাংস দিয়া আমার চলে না; বস্তা ভইরা কিনন লাগে।
: রেগুলার বিরানি খাওয়া তো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ!
- এইটা আমার বউয়েরে কে বোঝাবে? প্রথমে আণ্ডা দিয়া বিরানি উৎসবের সূচনা হইছিল। কিছুদিন পর মুরগি ঢুকল। এরপর গরু। বর্তমানে খাসি চলতেছে। রুচির বিবর্তনে খাসির পরে হয়তো উটের আগমন ঘটবে। তখন আমাকে উটের মাংস কেনার জন্য দৌড়াইতে হবে, হা-হা-হা।
আফলাজ মণ্ডল হাসিতে যোগ না দিয়ে বললেন-
: তোমরা উটের বিরানি খাবা, বাঘের দুধ পান করবা- এইটাই তো স্বাভাবিক। অহন কওছেন- গ্যাসের দাম কি সত্যি সত্যি বাড়ব?
- বাড়ব মানে? সবকিছু ফাইনাল।
: আমরা যারা গ্যাসের চুলা ব্যবহার করি- তাদের কি প্রতিমাসে ডাবলেরও বেশি টাকা দেওন লাগব?
- না দিয়া উপায় কী? গ্যাস খাতে সরকার ব্যাপক লস খাইতেছে।
: কী জন্য লস খাইতেছে!
: আরে! পাবলিক বেহুদা রাইত-দিন গ্যাসের চুলা জ্বালাইয়া রাখে। এতে গ্যাসের মারাত্মক অপচয় ঘটতেছে। অপচয়জনিত লস কাটাইতে হইলে দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নাই।
: আমার জানা মতে, বর্তমানে মানুষ অনেক সচেতন হইছে। তারা অকারণে গ্যাসের চুলা জ্বালাইয়া রাখে না। বড় কথা হইল- গৃহস্থালি কাজে মাত্র ১-২ পার্সেন্ট গ্যাস ব্যবহৃত হয়। সব দোষ জনসাধারণের কান্ধে চাপাইতেছ কী জন্য? যদি তোমরা মনে কর, পাবলিক গ্যাস নষ্ট করতেছে, তাইলে প্রিপেইড সিস্টেম চালু কর!
: এইটা কি সম্ভব?
- কেরে সম্ভব না? প্রিপেইড সিস্টেমের আওতায় দেশের অনেককিছু খুব চমৎকারভাবে চলতেছে। গ্যাস কোম্পানি না চলার কুনু কারণ নাই।
এসময় আরেকজন ভদ্রলোক সেখানে আসায় কথাবার্তা অন্যদিকে মোড় নিল। আতর আলী বাজার শেষ করে বাসায় ফিরে দেখল, আতরজান গালে হাত দিয়ে বসে আছে। গালে হাত মানে গভীর চিন্তার নিদর্শন। এ সময় আতরজানের দার্শনিক হয়ে উঠার কারণ কী? একটা খারাপ ভাবনা মাথায় আসতেই তার বুক ছ্যাৎ করে উঠল। আতর আলীর বয়সটা এমন- এ বয়সী মানুষের চারপাশে তার আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি বাজতে থাকে। ঘণ্টাধ্বনি শুনতে শুনতে সে নিজেই একদিন নিজের মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পায়। বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরের দরজার সামনে রেখে আতর আলী কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল-
: কী হইছে!
চোখ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির অপূর্ব নিদর্শন। চোখের একটা চাহনি দিয়ে হাজার কথার বাক্য শেষ করা যায়। নির্বোধরা চোখের এ ভাষা পড়তে পারে না। আতর আলী আতরজানের চোখের ভাষা বুঝতে পারছে না। নিজেকে তার অতি নির্বোধ প্রকৃতির মানুষ মনে হচ্ছে। ঘটনা জানার জন্য আতর আলী পুনরায় ঠোঁট ফাঁক করতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আতরজান বলল-
: বাজার আনছুইন!
- হুঁ।
: বাজার তো আনলাইন- চুলার চাপ এক্কেবারেই কইম্যা গেছে। একটা কাম করবাইন তো। বিকালে আমারে এক ব্যাগ মাটি আইন্যা দিবাইন।
- মাটি দিয়া কী করবা?
: চুলা বানাইবাম। গ্যাসের যে অবস্থা দেখতেছি, মনে অইতেছে- মাটির চুলা ছাড়া গতি নাই।
আতর আলী অবাক হয়ে বলল-
: মাটির চুলা কী দিয়া জ্বালাবা? লাকড়ি পাবা কই?
- নান্দিনা থেইক্যা ট্রেনে কইরা লাকড়ি মমিসিং শহরে আহে না!
: কেমনে আইব? গোলাপী তো দেশে নাই।
- দেশে নাই! কই গেছে?
: আরে! তুমি দেখতেছি কুনু খবরই রাখ না। গোলাপী তো অহন লন্ডনে। যে চিত্র পরিচালক গোলাপী এখন ট্রেনে নামে ফিল্ম বানাইছিল, সে এই খবর জানার পরে গোলাপী এখন বিলেতে নামে পুনরায় আরেকটা ফিল্ম বানাইয়া সংশোধনী দিছে।
- তাইলে বিরোধী দলের নেত্রী যে কিছুদিন আগে গোলাপী-গোলাপী করলেন!
: আরে উনি গোলাপী বলেন নাই! গোপালি বলছেন।
- এরা আবার কারা?
: তাদের সম্পর্কে জাইন্যা লাভ নাই। তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। লাকড়ি সাপ্লায়ের কামে তাদের পাওয়া যাবে না।
- লাকড়িও নাই, চুলায় গ্যাসের চাপও নাই- ক্যামনে কী করবাম!
চাপের কথা শুনে আতর মাথায় একটা ধাঁধার জন্ম হল। সে আতরজানের উদ্দেশে বলল-
: দাম বাড়ে চাপ কমে- এ ধাঁধার উত্তর কে দিতে পারে?
আতর আলীর কথায় আতরজান মুচকি হাসল। তারপর দু’চোখে প্রসন্নের হাসি মেখে বলল-
: হায় রে পুরুষজাতি! অংকের মাস্টাররে সরল অংকের নিয়ম জানাবার আইছুইন! আমি আপনের মতো টেলিভিশনে শুধু সিনেমা লইয়া পইড়া থাকি না। আমি খবর দেখি, টক শো শুনি। কাজেই দাদারে আদা পড়া শিখাইতে আইলে কুনু লাভ অইব না। এই ধাঁধার উত্তর তো আগেই আমি আপনেরে বইল্যা দিছি। চুলায় গ্যাসের চাপ না থাকার খবর আপনে আমার কাছেই পাইছুইন। ঠিক কিনা?
আতর আলী মাথা নাড়ল। ঠিক, ঠিক...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
: সিনেমা রাইখ্যা উডুইনছে।
আল্লাহপাক পুরুষের পাঁজরের হাড় দিয়ে নারীজাতিকে সৃষ্টি করে ভুল করেছেন। মারাত্মক ভুল। নিজের শরীরের অংশ না হলে আতরজানকে কঠিন কিছু কথা বলা যেত। আফসোস! টেকনিক্যাল এ সমস্যার জন্য তার বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়া যাচ্ছে না। নিজেই নিজের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাওয়া চরম বোকামি। আতর আলী এতটা বোকা নয়। বোকা হলে আতরজান এখন শক্ত উষ্ঠা খেত- এ কথা নিশ্চিত।
আতর আলী এবার ঘাড়ে চাপ অনুভব করল। তলপেটের চাপের তুলনায় মেহেদি লাগানো নরম হাতের চাপ হাওয়াই মিঠাই। আতর আলী হাওয়াই মিঠাইকে গুরুত্ব দিল না। চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ তুলে আতরজান বলল-
: কী অইল, কথা কানে যাইতেছে না! উডুইন।
নাহ! নারীজাতি সম্পর্কে ফয়সালা হয়ে গেছে। গরুকে খৈল-ভুষি খাওয়ানোর সিস্টেমে ঘণ্টায়-ঘণ্টায় এদের নাক ডুবিয়ে তরল ভিটামিন খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলেও আক্কেল আর হবে বলে মনে হচ্ছে না! নায়কের এখন জীবন-মরণ সমস্যা চলছে, অথচ ঘটনার বিষয়বস্তুর প্রতি অবুঝ নারীজাতির কোনো খেয়াল নেই। সে উডলাইনা-উডলাইনা বলে কানের কাছে বেহালা বাজাচ্ছে। আতর আলী টেলিভিশনের পর্দা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল-
: ইট্টু পরে।
- পরে-পরে করলে চলব? রান্ধনের কুনু বাও নাই। কুমবালা বাজার আনবাইন, কুমবালা রানবাম!
: কুমবালা রানবাম মানে? তোমার তো অহন আর গোপাল পালের মণ্ডা কারখানার মতো লাকড়ি দিয়া চুলা সাজাইতে হয় না! গ্যাসের চুলায় ফতফতি আগুন জ্বলতেছে। চুলার উপরে ডাইনহাতে পাতিল রাখবা, বামহাতে নামাইবা। ব্যস, মামলা ডিসমিস!
রান্নাঘরের কাজকর্ম ভ্রাম্যমাণ আদালতের মামলা নয়। দেওয়ানি মামলা। দেওয়ানি মামলা মানে লাইফকোর্স। জীবনব্যাপী চলতে থাকা মামলা আতর আলী একবেলার জন্য ডিসমিস করতে পারে। কিন্তু পরের বেলা? আদালতের দেওয়ানি মামলায় বিবাদী পক্ষ দুই-তিন মাস পর পর কাঠগড়ায় হাজির হলেই চলে। এজন্য মহামান্য আদালতের কাছে কোনো কৈফিয়ত দিতে হয় না। রান্নাঘরের মামলায় প্রতিদিন রাঁধুনীকে অন্তত দুই বেলা তার হাজিরা নিশ্চিত করতে হয়। তা না হলে সমন জারি হয়ে যায়। এ কথা পুরুষজাতি জানার পরও ভুংভাং ধরনের কথাবার্তা বলে কীভাবে- আতরজান বুঝতে পারছে না। পুরুষজাতি খাবার টেবিলে সবকিছু রেডি অবস্থায় পায়। খাবার টেবিলে পৌঁছার আগের ইতিহাস তারা জানার প্রয়োজন মনে করে না। একজন রাঁধুনী তার জীবনের বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরের মামলায় হাজিরা দিয়ে কাটাচ্ছে, আর পুরুষজাতি খাবার টেবিলে বসে শুধু মাচুড়-মুচুড় খেয়ে যাচ্ছে-আল্লাহপাকের এ কেমন বিধান, ভেবে পায় না আতরজান। ভাবাভাবির এ পর্যায়ে বিদ্যুৎ চলে গেল। আতরজান হাততালি দিয়ে বলল-
: আল্লাহর মাইর- দুনিয়ার বাইর। অহন কেমুন অইল?
বিদ্যুৎ যাওয়ার ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বেছে বেছে ঠিক এমন একটা সময়ে বিদ্যুৎ কেন এরকম বিটলামি করল? আতর আলীর মনে হল, তার বিরুদ্ধে ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মাথা ঠিক রাখা শক্ত কাজ। আতর আলী বিদ্যুতের অপেক্ষায় ঝিম মেরে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পরও বিদ্যুতের দেখা না পেয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করতে করতে বাজারের পথ ধরল। বাজারে মাংসের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আতর আলীর কানে এলো-
: অই গ্যাস...
গ্যাস আবার কারও নাম হয় নাকি? বিষয়টা একটু পরেই পরিষ্কার হল। আতর আলী বুঝতে পারল- গ্যাস বলে যাকে সম্বোধন করা হয়েছে, তিনি গ্যাস কোম্পানির স্থানীয় অফিসে চাকরি করেন। গ্যাস নিয়ে কারবার- তাকে গ্যাস বলা যেতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। সম্বোধনকারী গ্যাসের পাশে এসে দাঁড়াতেই তাকে চিনতে পারল আতর আলী। তার নাম আফলাজ মণ্ডল। আফলাজ মণ্ডল অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা। বাসা আকুয়া মণ্ডল বাড়ি। আফলাজ গ্যাস ভদ্রলোকের উদ্দেশে বললেন-
: বক্কইরা, কী খবর?
- ভালো।
: গোস কিনবা?
- হুঁ।
: ভালা কইরা দেইখ্যা লইও। ব্যাটারা এক টুকরা গোস দিয়া তিন টুকরা হাড্ডি ঢুকাইয়া দেয়।
- ঢুকানি-ফুকানির কোনো চান্স নাই। পুরা খাসিই প্যাক করতেছি।
: পুরা খাসি! মেজবানি আছে নাকি?
- আর কইও না! বাসায় তিনবেলা বিরানি চলে। আমার বউ বিরানি ছাড়া অন্যকিছু খাইতে পারে না। পোলাপানগুলাও তার মায়ের তরিকা ধরছে। ফলে টুকাইন্যা মাংস দিয়া আমার চলে না; বস্তা ভইরা কিনন লাগে।
: রেগুলার বিরানি খাওয়া তো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ!
- এইটা আমার বউয়েরে কে বোঝাবে? প্রথমে আণ্ডা দিয়া বিরানি উৎসবের সূচনা হইছিল। কিছুদিন পর মুরগি ঢুকল। এরপর গরু। বর্তমানে খাসি চলতেছে। রুচির বিবর্তনে খাসির পরে হয়তো উটের আগমন ঘটবে। তখন আমাকে উটের মাংস কেনার জন্য দৌড়াইতে হবে, হা-হা-হা।
আফলাজ মণ্ডল হাসিতে যোগ না দিয়ে বললেন-
: তোমরা উটের বিরানি খাবা, বাঘের দুধ পান করবা- এইটাই তো স্বাভাবিক। অহন কওছেন- গ্যাসের দাম কি সত্যি সত্যি বাড়ব?
- বাড়ব মানে? সবকিছু ফাইনাল।
: আমরা যারা গ্যাসের চুলা ব্যবহার করি- তাদের কি প্রতিমাসে ডাবলেরও বেশি টাকা দেওন লাগব?
- না দিয়া উপায় কী? গ্যাস খাতে সরকার ব্যাপক লস খাইতেছে।
: কী জন্য লস খাইতেছে!
: আরে! পাবলিক বেহুদা রাইত-দিন গ্যাসের চুলা জ্বালাইয়া রাখে। এতে গ্যাসের মারাত্মক অপচয় ঘটতেছে। অপচয়জনিত লস কাটাইতে হইলে দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নাই।
: আমার জানা মতে, বর্তমানে মানুষ অনেক সচেতন হইছে। তারা অকারণে গ্যাসের চুলা জ্বালাইয়া রাখে না। বড় কথা হইল- গৃহস্থালি কাজে মাত্র ১-২ পার্সেন্ট গ্যাস ব্যবহৃত হয়। সব দোষ জনসাধারণের কান্ধে চাপাইতেছ কী জন্য? যদি তোমরা মনে কর, পাবলিক গ্যাস নষ্ট করতেছে, তাইলে প্রিপেইড সিস্টেম চালু কর!
: এইটা কি সম্ভব?
- কেরে সম্ভব না? প্রিপেইড সিস্টেমের আওতায় দেশের অনেককিছু খুব চমৎকারভাবে চলতেছে। গ্যাস কোম্পানি না চলার কুনু কারণ নাই।
এসময় আরেকজন ভদ্রলোক সেখানে আসায় কথাবার্তা অন্যদিকে মোড় নিল। আতর আলী বাজার শেষ করে বাসায় ফিরে দেখল, আতরজান গালে হাত দিয়ে বসে আছে। গালে হাত মানে গভীর চিন্তার নিদর্শন। এ সময় আতরজানের দার্শনিক হয়ে উঠার কারণ কী? একটা খারাপ ভাবনা মাথায় আসতেই তার বুক ছ্যাৎ করে উঠল। আতর আলীর বয়সটা এমন- এ বয়সী মানুষের চারপাশে তার আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি বাজতে থাকে। ঘণ্টাধ্বনি শুনতে শুনতে সে নিজেই একদিন নিজের মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পায়। বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরের দরজার সামনে রেখে আতর আলী কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল-
: কী হইছে!
চোখ সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির অপূর্ব নিদর্শন। চোখের একটা চাহনি দিয়ে হাজার কথার বাক্য শেষ করা যায়। নির্বোধরা চোখের এ ভাষা পড়তে পারে না। আতর আলী আতরজানের চোখের ভাষা বুঝতে পারছে না। নিজেকে তার অতি নির্বোধ প্রকৃতির মানুষ মনে হচ্ছে। ঘটনা জানার জন্য আতর আলী পুনরায় ঠোঁট ফাঁক করতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আতরজান বলল-
: বাজার আনছুইন!
- হুঁ।
: বাজার তো আনলাইন- চুলার চাপ এক্কেবারেই কইম্যা গেছে। একটা কাম করবাইন তো। বিকালে আমারে এক ব্যাগ মাটি আইন্যা দিবাইন।
- মাটি দিয়া কী করবা?
: চুলা বানাইবাম। গ্যাসের যে অবস্থা দেখতেছি, মনে অইতেছে- মাটির চুলা ছাড়া গতি নাই।
আতর আলী অবাক হয়ে বলল-
: মাটির চুলা কী দিয়া জ্বালাবা? লাকড়ি পাবা কই?
- নান্দিনা থেইক্যা ট্রেনে কইরা লাকড়ি মমিসিং শহরে আহে না!
: কেমনে আইব? গোলাপী তো দেশে নাই।
- দেশে নাই! কই গেছে?
: আরে! তুমি দেখতেছি কুনু খবরই রাখ না। গোলাপী তো অহন লন্ডনে। যে চিত্র পরিচালক গোলাপী এখন ট্রেনে নামে ফিল্ম বানাইছিল, সে এই খবর জানার পরে গোলাপী এখন বিলেতে নামে পুনরায় আরেকটা ফিল্ম বানাইয়া সংশোধনী দিছে।
- তাইলে বিরোধী দলের নেত্রী যে কিছুদিন আগে গোলাপী-গোলাপী করলেন!
: আরে উনি গোলাপী বলেন নাই! গোপালি বলছেন।
- এরা আবার কারা?
: তাদের সম্পর্কে জাইন্যা লাভ নাই। তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। লাকড়ি সাপ্লায়ের কামে তাদের পাওয়া যাবে না।
- লাকড়িও নাই, চুলায় গ্যাসের চাপও নাই- ক্যামনে কী করবাম!
চাপের কথা শুনে আতর মাথায় একটা ধাঁধার জন্ম হল। সে আতরজানের উদ্দেশে বলল-
: দাম বাড়ে চাপ কমে- এ ধাঁধার উত্তর কে দিতে পারে?
আতর আলীর কথায় আতরজান মুচকি হাসল। তারপর দু’চোখে প্রসন্নের হাসি মেখে বলল-
: হায় রে পুরুষজাতি! অংকের মাস্টাররে সরল অংকের নিয়ম জানাবার আইছুইন! আমি আপনের মতো টেলিভিশনে শুধু সিনেমা লইয়া পইড়া থাকি না। আমি খবর দেখি, টক শো শুনি। কাজেই দাদারে আদা পড়া শিখাইতে আইলে কুনু লাভ অইব না। এই ধাঁধার উত্তর তো আগেই আমি আপনেরে বইল্যা দিছি। চুলায় গ্যাসের চাপ না থাকার খবর আপনে আমার কাছেই পাইছুইন। ঠিক কিনা?
আতর আলী মাথা নাড়ল। ঠিক, ঠিক...
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments