ভাগ্যবিড়ম্বিত শিক্ষার্থীদের প্রতি সদয় হোন by বিমল সরকার
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী টানা ২৪ বছর আমাদের শাসন-শোষণ করেছে। কেবল শোষণই যে তারা করেছে তা কিন্তু নয়। শাসন করতে গিয়ে তাদের প্রশংসনীয় কিছু কর্মকাণ্ডের কথা আজও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়, যেমন হয় ইংরেজ আমলের কথাও। কীভাবে, সে কথায় পরে আসছি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে আস্থা ও বিশ্বাসে চিড় ধরাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। অথচ বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ আমরা নানা সংশয়-সন্দেহ, অনাস্থা-অবিশ্বাস ও অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্য দিয়ে চলেছি। এসব থেকে কোনোভাবেই যেমন মুক্ত নয় সরকার (যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন), তেমনি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ আরও অনেকেরই দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
যেকোনো স্তরেই হোক, আমাদের মতো দেশে শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থী হওয়া মানেই দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা, ভোগান্তি আর অনিশ্চয়তাকে নিত্যসঙ্গী হিসেবে মেনে নেয়া। এ ছাড়া অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সার্বক্ষণিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়টি তো রয়েছেই। কখনও কখনও মনের মাঝে আতংকও এসে ভর করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একেবারে প্রাথমিক স্তরে ভর্তি থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত পরীক্ষাটির ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত গোটা শিক্ষাজীবনই বলতে গেলে এভাবে অতিবাহিত করতে হয়। তবে কেউ স্বীকার করুন আর না করুন, এ বছর ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা স্তরে অনার্স এবং বিভিন্ন প্রফেশনাল কোর্সে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার বিষয়টি বোধকরি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ৩ এপ্রিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর দিন থেকে যা ভর করেছিল, আট মাস পর এখন পর্যন্তও ঘাড় থেকে তা নামছে না।
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হতে না হতেই ঘটতে থাকে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা বা গুজব (?)। ‘সিরিজ আকারে’ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বা গুজবে (?) বিভ্রান্ত হয়ে কত হাজার কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের স্বপ্নসাধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই সঠিকভাবে বলতে পারবেন। আগের পরীক্ষা পরে আর পরেরটা আগে। দু’দিন ধরে এক বিষয়ের প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তের ঘোষণা শুনে যদি অন্য বিষয়ের পরীক্ষায় বসতে হয়, তবে এটাকে কেবল ছন্দপতন বলাই কি যথেষ্ট? ১৩ আগস্ট পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হল। ১০টি বোর্ডে গড়ে শতকরা ৭৮.৩৩ ভাগ পাস করল আর জিপিএ-৫ পেল সাড়ে ৭০ হাজার শিক্ষার্থী। এইচএসসি স্তরে পরীক্ষায় পাসের উচ্চহার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির নিরিখে বলা যায় রেকর্ড সৃষ্টি। কিন্তু এ নিয়েও অনাকাক্সিক্ষত বিতর্কের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হল শিক্ষার্থীদের। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হল, দেশে শিক্ষার মান বেড়েছে আর শিক্ষাবিদরা বলেছেন- মান নয়, পাসের হার বা সংখ্যা ‘বাড়ানো হয়েছে’। এই বিতর্ক শেষ হয়নি, সহজে শেষ হওয়ার নয়ও। এরই মাঝে সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ভর্তিযুদ্ধ’। মেডিকেল কলেজগুলোর মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রথমদিকে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার কথা আলোচনায় এলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে, এবার তাদের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা লাঘব হবে, অর্থের সাশ্রয় হবে। কিন্তু উদ্যোগ, উদ্যম ও প্রধানত সদিচ্ছার অভাবে শেষ পর্যন্ত তা আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। শুরু হয় ছোটাছুটি। ভর্তি পরীক্ষা কোনটা আগে আর কোনটা পরে কিংবা কোনটা বাদ দিয়ে কোনটায় অংশ নেবে এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ে যায় গোলকধাঁধায়। ভর্তির আগেই অভিভাবকরা গুনতে থাকেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এর মাঝে যুক্ত হয় হরতাল বিড়ম্বনা। শত রকমের বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতার মাঝেও যে ইচ্ছাশক্তিকে সম্বল করে তারা এক একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নেয়, আকস্মিক আহূত হরতাল তা লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এ যেন অনেকটাই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল? অন্যান্য বিভাগে যেমন-তেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ১২৫টি আসনে লড়ে মাত্র দু’জন শিক্ষার্থী পাস নম্বর পেয়েছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে শতকরা দুই ভাগেরও কম শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতের মতো দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ না দেয়ার সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে বলা হয়, এতে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা বেশি হারে ভর্তির সুযোগ পাবে। দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ দিলে প্রতিবছরই অপেক্ষাকৃত কম পছন্দের বিপুলসংখ্যক আসন খালি পড়ে থাকে। এ ছাড়া এর ফলে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের যোগসাজশে ভর্তি জালিয়াতিও রোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। প্রথমে রাজু ভাস্কর্য ও পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। একপর্যায়ে শুরু করে আমরণ অনশন। অবশ্য এক সপ্তাহ চলার পর আপাতত প্রত্যাহার করে নেয় আন্দোলন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ না দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পেছনে অবশ্যই যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তবে এক বছর আগে, নিদেনপক্ষে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ২০১৪-১৫ সেশনে প্রথমবর্ষ অনার্স ভর্তি পরীক্ষার আগেও যদি সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেয়া হতো, তাহলে হয়তো এমন বিপত্তি সৃষ্টি হতো না। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা সেভাবেই মানসিক প্রস্তুতির সুযোগ পেত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে পরীক্ষার নির্ধারিত শিডিউল বিপর্যয়, সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র ও আলোচিত-সমালোচিত ফলাফল এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় অন্তত দুই মাস আগেই অনুষ্ঠিত অনার্স ভর্তি পরীক্ষা, সর্বোপরি ভর্তি পরীক্ষার সময় আহূত হরতালের খক্ষ- সবদিক থেকেই ২০১৪-১৫ সেশনে ভর্তিচ্ছুরা হতভাগ্য। একে ললাট লিখন (!) ছাড়া আর কী ভাবা যায়!
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দু’বছর আগে বিষয়টি অবহিত করে তবেই সিদ্ধান্তটি কার্যকর করা হয়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিষয়টি আগেভাগে জানার কারণে কাজটি করতে সহজ হয়েছে। কোনোদিক থেকে আওয়াজ ওঠেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও পারে ‘ভাগ্যবিড়ম্বিত’ ওই সেশনের শিক্ষার্থীদের প্রতি সদয় হয়ে অন্তত ২০১৫ সাল পর্যন্ত সিদ্ধান্তটি স্থগিত রাখতে।
পাকিস্তান আমলের শেষদিকে ১৯৬৮ সালে সরকার আকস্মিক সিদ্ধান্ত নেয়, তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করা হবে না। সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত এ সিদ্ধান্ত দুই বছর পর ‘১৯৭০ সাল থেকে কার্যকর করা হবে’ বলেও শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আগেভাগে জানিয়ে দেয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা একের পর এক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করতে থাকে। ১৯৬৮ সালের ২৮ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছাতেও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি বড় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের একটাই দাবি- তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না করার সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। এ সময় উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পশ্চিমা শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ঘনীভূত হয়। আইয়ুব খানের পতনসহ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের সাধারণ নির্বাচন পাক সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সবশেষ শুরু হয় একাত্তরের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। এ সবকিছুর ফলে পাকিস্তানি শাসনের শেষদিন পর্যন্তও সরকারের পক্ষে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে তৃতীয় বিভাগধারীদের উপেক্ষা করার সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। স্মরণযোগ্য যে, আইয়ুবের জমানায় কালবিলম্ব না করে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা খুবই সহজসাধ্য হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের স্বার্থে সরকার দুটি বছর সময় দিয়েছিল।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
শিক্ষা ক্ষেত্রে আস্থা ও বিশ্বাসে চিড় ধরাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। অথচ বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ আমরা নানা সংশয়-সন্দেহ, অনাস্থা-অবিশ্বাস ও অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্য দিয়ে চলেছি। এসব থেকে কোনোভাবেই যেমন মুক্ত নয় সরকার (যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন), তেমনি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকসহ আরও অনেকেরই দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
যেকোনো স্তরেই হোক, আমাদের মতো দেশে শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থী হওয়া মানেই দুর্ভোগ, বিড়ম্বনা, ভোগান্তি আর অনিশ্চয়তাকে নিত্যসঙ্গী হিসেবে মেনে নেয়া। এ ছাড়া অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সার্বক্ষণিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়টি তো রয়েছেই। কখনও কখনও মনের মাঝে আতংকও এসে ভর করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একেবারে প্রাথমিক স্তরে ভর্তি থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায়ে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত পরীক্ষাটির ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত গোটা শিক্ষাজীবনই বলতে গেলে এভাবে অতিবাহিত করতে হয়। তবে কেউ স্বীকার করুন আর না করুন, এ বছর ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা স্তরে অনার্স এবং বিভিন্ন প্রফেশনাল কোর্সে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার বিষয়টি বোধকরি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ৩ এপ্রিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর দিন থেকে যা ভর করেছিল, আট মাস পর এখন পর্যন্তও ঘাড় থেকে তা নামছে না।
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হতে না হতেই ঘটতে থাকে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা বা গুজব (?)। ‘সিরিজ আকারে’ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বা গুজবে (?) বিভ্রান্ত হয়ে কত হাজার কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের স্বপ্নসাধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই সঠিকভাবে বলতে পারবেন। আগের পরীক্ষা পরে আর পরেরটা আগে। দু’দিন ধরে এক বিষয়ের প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষার ঠিক আগ মুহূর্তের ঘোষণা শুনে যদি অন্য বিষয়ের পরীক্ষায় বসতে হয়, তবে এটাকে কেবল ছন্দপতন বলাই কি যথেষ্ট? ১৩ আগস্ট পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হল। ১০টি বোর্ডে গড়ে শতকরা ৭৮.৩৩ ভাগ পাস করল আর জিপিএ-৫ পেল সাড়ে ৭০ হাজার শিক্ষার্থী। এইচএসসি স্তরে পরীক্ষায় পাসের উচ্চহার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির নিরিখে বলা যায় রেকর্ড সৃষ্টি। কিন্তু এ নিয়েও অনাকাক্সিক্ষত বিতর্কের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হল শিক্ষার্থীদের। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হল, দেশে শিক্ষার মান বেড়েছে আর শিক্ষাবিদরা বলেছেন- মান নয়, পাসের হার বা সংখ্যা ‘বাড়ানো হয়েছে’। এই বিতর্ক শেষ হয়নি, সহজে শেষ হওয়ার নয়ও। এরই মাঝে সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে গেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ভর্তিযুদ্ধ’। মেডিকেল কলেজগুলোর মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও প্রথমদিকে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার কথা আলোচনায় এলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এই ভেবে আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে, এবার তাদের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা লাঘব হবে, অর্থের সাশ্রয় হবে। কিন্তু উদ্যোগ, উদ্যম ও প্রধানত সদিচ্ছার অভাবে শেষ পর্যন্ত তা আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। শুরু হয় ছোটাছুটি। ভর্তি পরীক্ষা কোনটা আগে আর কোনটা পরে কিংবা কোনটা বাদ দিয়ে কোনটায় অংশ নেবে এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ে যায় গোলকধাঁধায়। ভর্তির আগেই অভিভাবকরা গুনতে থাকেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। এর মাঝে যুক্ত হয় হরতাল বিড়ম্বনা। শত রকমের বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতার মাঝেও যে ইচ্ছাশক্তিকে সম্বল করে তারা এক একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নেয়, আকস্মিক আহূত হরতাল তা লণ্ডভণ্ড করে দেয়। এ যেন অনেকটাই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। আর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল? অন্যান্য বিভাগে যেমন-তেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ১২৫টি আসনে লড়ে মাত্র দু’জন শিক্ষার্থী পাস নম্বর পেয়েছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে শতকরা দুই ভাগেরও কম শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতের মতো দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ না দেয়ার সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে বলা হয়, এতে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা বেশি হারে ভর্তির সুযোগ পাবে। দ্বিতীয়বার ভর্তির সুযোগ দিলে প্রতিবছরই অপেক্ষাকৃত কম পছন্দের বিপুলসংখ্যক আসন খালি পড়ে থাকে। এ ছাড়া এর ফলে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের যোগসাজশে ভর্তি জালিয়াতিও রোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। প্রথমে রাজু ভাস্কর্য ও পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। একপর্যায়ে শুরু করে আমরণ অনশন। অবশ্য এক সপ্তাহ চলার পর আপাতত প্রত্যাহার করে নেয় আন্দোলন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ না দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পেছনে অবশ্যই যৌক্তিক কারণ রয়েছে। তবে এক বছর আগে, নিদেনপক্ষে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ২০১৪-১৫ সেশনে প্রথমবর্ষ অনার্স ভর্তি পরীক্ষার আগেও যদি সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেয়া হতো, তাহলে হয়তো এমন বিপত্তি সৃষ্টি হতো না। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা সেভাবেই মানসিক প্রস্তুতির সুযোগ পেত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে পরীক্ষার নির্ধারিত শিডিউল বিপর্যয়, সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র ও আলোচিত-সমালোচিত ফলাফল এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় অন্তত দুই মাস আগেই অনুষ্ঠিত অনার্স ভর্তি পরীক্ষা, সর্বোপরি ভর্তি পরীক্ষার সময় আহূত হরতালের খক্ষ- সবদিক থেকেই ২০১৪-১৫ সেশনে ভর্তিচ্ছুরা হতভাগ্য। একে ললাট লিখন (!) ছাড়া আর কী ভাবা যায়!
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দু’বছর আগে বিষয়টি অবহিত করে তবেই সিদ্ধান্তটি কার্যকর করা হয়। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিষয়টি আগেভাগে জানার কারণে কাজটি করতে সহজ হয়েছে। কোনোদিক থেকে আওয়াজ ওঠেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও পারে ‘ভাগ্যবিড়ম্বিত’ ওই সেশনের শিক্ষার্থীদের প্রতি সদয় হয়ে অন্তত ২০১৫ সাল পর্যন্ত সিদ্ধান্তটি স্থগিত রাখতে।
পাকিস্তান আমলের শেষদিকে ১৯৬৮ সালে সরকার আকস্মিক সিদ্ধান্ত নেয়, তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি করা হবে না। সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত এ সিদ্ধান্ত দুই বছর পর ‘১৯৭০ সাল থেকে কার্যকর করা হবে’ বলেও শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আগেভাগে জানিয়ে দেয়া হয়। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা একের পর এক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করতে থাকে। ১৯৬৮ সালের ২৮ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছাতেও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি বড় বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের একটাই দাবি- তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না করার সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। এ সময় উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পশ্চিমা শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ঘনীভূত হয়। আইয়ুব খানের পতনসহ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের সাধারণ নির্বাচন পাক সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সবশেষ শুরু হয় একাত্তরের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। এ সবকিছুর ফলে পাকিস্তানি শাসনের শেষদিন পর্যন্তও সরকারের পক্ষে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে তৃতীয় বিভাগধারীদের উপেক্ষা করার সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। স্মরণযোগ্য যে, আইয়ুবের জমানায় কালবিলম্ব না করে সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করা খুবই সহজসাধ্য হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের স্বার্থে সরকার দুটি বছর সময় দিয়েছিল।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
No comments