সুন্দরের নিরন্তর সাধক by সৈয়দ আজিজুল হক
(শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ৯ মার্চ বিরাশি পেরিয়ে তিরাশিতে পা দিলেন। এই শিল্পী স্বাধীনতা পদক পেলেন কয়েক দিন আগে। তাঁর মুকুটে যুক্ত হলো আরেকটি নন্দিত পালক) (ছবি:-মুঠোফোনে শিল্পী যোগেন চৌধুরীর ছবি তুলছেন কাইয়ুম চৌধুরী। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
আত্মপ্রতিকৃতি ২০১৪, কাইয়ুম চৌধুরী) ১৯৩২ সালে জন্ম নেওয়া কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর ৬৫ বছরের সাধনার মাধ্যমে শুধু আমাদের চিত্রশিল্পের জগৎকেই উৎকর্ষমণ্ডিত করেননি, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সমগ্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকেই তাঁর অগ্রসর চিন্তার আলোকে উদ্দীপিত রেখেছেন। বিরাশি-উত্তর জীবনেও তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক ভুবনে যৌবনকালের মতোই সক্রিয় এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ছয় দশক ধরে এই শিল্পী আমাদের প্রকাশনার জগৎকে তাঁর বিপুল সৃষ্টির মাধ্যমে যেভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন, তার কোনো তুলনা মেলে না। আমাদের শিল্প ও সাংস্কৃতিক জগৎকে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সুরুচির আলোয় আলোকিত করে চলেছেন। আর এভাবেই তিনি পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের এক সার্থক শিল্পী-ব্যক্তিত্বে। এই সার্থকতার পেছনে তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার পাশাপাশি সক্রিয় গভীরতর নিষ্ঠা ও একাগ্রতা।
শিল্প ও সংস্কৃতির সব ধারা থেকে রস আহরণ করে কাইয়ুম চৌধুরী নিরন্তর পরিপুষ্ট করে চলেছেন নিজ সৃজনশক্তিকে। আর এর স্বীকৃতিও পেয়েছেন রাষ্ট্র, জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি সর্বশেষ ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা পদকে’। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তাঁর স্বীকৃতি লাভ যেন পূর্ণতা অর্জন করল। কেননা, এর আগে তিনি পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমী প্রদত্ত শিল্পকলার জাতীয় পুরস্কার (১৯৭৭), মনোনীত হয়েছেন বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো এবং লাভ করেছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক (১৯৮৬)। তারও আগে বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে তিনি দু-দুবার রেলওয়ের টাইমটেবলের প্রচ্ছদের জন্য সেরা পুরস্কার পেয়েছেন (১৯৫৯, ১৯৬১), পেয়েছেন শিল্পকলায় পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার (১৯৬১-৬২), পঞ্চম তেহরান বিয়েনাল থেকে রাজকীয় দরবার পুরস্কার (১৯৬৬) এবং বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পের জন্য সাতবার গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার (১৯৬৪-৭৬) ও স্বর্ণপদক (১৯৭৫)।
এবারের স্বাধীনতা পদকের আরও তাৎপর্য হলো, এর মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনভাবনা ও জীবনাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করল। পদকপ্রাপ্তির সংবাদ-প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশের সব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী শিল্পী হিসেবেই তিনি এ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। আমরা তাঁর জীবনেতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ১৯৪৯ সালে ঢাকার শিল্প শিক্ষালয়ের ছাত্র হওয়ার পর জয়নুল আবেদিনসহ শিক্ষকদের সাহচর্যে যেমন তাঁর জীবনানুভবে অঙ্কুরিত হয়েছিল দেশাত্মবোধের বীজ, তেমনি বন্ধু শিল্পী আমিনুল ইসলাম ও মুর্তজা বশীরের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে তিনি বামপন্থী রাজনীতির চিন্তাস্রোতের নিবিড় সংস্পর্শ লাভ করে নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন উচ্চতর মানবতার বোধে। সেই তারুণ্য থেকে শুরু; তারপর ছয় দশকের বেশি সময় ধরে এই দেশ ও এর শুভবোধসম্পন্ন মানুষের কল্যাণার্থে উৎসর্গীকৃত হয়েছে শিল্পীর সব চিন্তা, কর্ম ও সৃষ্টি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বাধিকার ও স্বাধীনতাকেন্দ্রিক এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সব সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে তিনি সক্রিয় থেকেছেন। ষাটের দশকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে সর্বজনাব মতিউর রহমান, মফিদুল হক, আবুল হাসনাত, আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখ যখনই শিল্পসংশ্লিষ্ট কোনো কাজের দাবি নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছেন, তখনই তা আনন্দচিত্তে পূরণ করেছেন। এমনকি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় তাঁদেরই কেউ কেউ রাতে কারফিউর মধ্যে সরকারবিরোধী প্রচার ও প্রকাশনার শিল্পবিষয়ক কাজের জন্য তাঁর বাসায় উপস্থিত হলে তিনিও নির্ভীকচিত্তে সেসব কাজ সম্পাদন করেছেন। ষাটের দশকের নানা প্রতিবাদী প্রকাশনা সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর শিল্পের ছোঁয়ায়।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশের চারু ও কারুশিল্পীদের যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী ও মুর্তজা বশীর। এই সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগেই ১৯৭১-এর মার্চে ‘স্বাধীনতা’ শীর্ষক চারু-কারুশিল্পীদের একটি ঐতিহাসিক মিছিল ঢাকার রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। তারপর মুক্তিযুদ্ধকালীন অনুভূতি নিয়ে অনেক ছবি এঁকেছেন তিনি। রাজশাহীর বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে করেছেন মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক মোজাইক ম্যুরাল। আজও তাঁর শিল্পকর্মে মুক্তিযোদ্ধার ইমেজ একটি পরিচিত অনুষঙ্গ। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে স্বৈরতন্ত্র, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সব আন্দোলনের সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত। সুতরাং তাঁর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিশ্চিতভাবে এক আনন্দদায়ক ঘটনা।
জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান প্রমুখ পথিকৃৎ শিল্পীর পর বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম কাইয়ুম চৌধুরী। প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে তাঁর বিপুল খ্যাতি সর্বদাই এক ঈর্ষণীয় ঘটনা। স্মরণীয় যে বাংলাদেশের ব্যবহারিক শিল্পকলায় পথিকৃৎ হিসেবে কাজী আবুল কাসেম ও জয়নুল আবেদিনের ভূমিকা থাকলেও এই ধারা কামরুল হাসানের হাতেই বিকশিত ও রসমণ্ডিত হয়েছে। এবং স্বীকার না করে উপায় নেই যে এটি পূর্ণায়ত রূপ লাভ করেছে কাইয়ুম চৌধুরীর নিরবচ্ছিন্ন সৃজনশীল সাধনার মাধ্যমে। ছয় দশক ধরে তিনি এই ক্ষেত্রটিকে বিপুল ও বিচিত্রভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। অন্যদিকে তাঁর শিল্পকর্মের জমিনে রং ও রূপের যে বিন্যাস, তাতে দারুণভাবে প্রাণবন্ত হয়ে আছে বাংলার নিসর্গ ও জীবনের সদাচঞ্চল রূপ। জন্মভূমির প্রতি প্রবল মমত্ববোধ তাঁর শিল্পচেতনাকে করেছে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। প্রগতির ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট এই শিল্পীর ধর্মনিরপেক্ষ জীবনবোধ মুক্তবুদ্ধির আকাঙ্ক্ষায়ও সর্বদা উচ্চকিত। ব্যাপক সাহিত্যপাঠ, সংগীত ও চলচ্চিত্র অনুরাগ তাঁর জীবনজিজ্ঞাসাকে করেছে ইতিবাচক, বৈচিত্র্যসন্ধানী ও উন্নত রুচির আকর।
পিতার বদলিপ্রবণ চাকরিসূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে তাঁর স্কুলজীবন অতিবাহিত হওয়ায় দেশের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির যে নিবিড় সাহচর্য তিনি লাভ করেন, তাতে নিসর্গের প্রতি তাঁর মনে সৃষ্টি হয় গভীর অনুরাগ। বিশেষ করে চিত্রা নদীর তীরবর্তী নড়াইলের জীবন তাঁর প্রকৃতিপাঠের ক্ষেত্রে এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পত্রিকা ও গ্রন্থপাঠ এবং চলচ্চিত্র ও সংগীতের প্রতি পিতার আগ্রহের ফলে বাল্য বয়স থেকে কাইয়ুম চৌধুরীও এসবের প্রতি অনুরাগী হন, যা তাঁর রুচিশীল মানস গঠনে সহায়ক হয়। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই বইয়ের প্রতি গড়ে ওঠে তাঁর তীব্র আকর্ষণ। তখন থেকেই বইয়ের প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ইলাস্ট্রেশন তাঁর ভেতরের শিল্পীসত্তাকে জাগিয়ে তোলে। ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষকদের প্রভাবের পাশাপাশি একঝাঁক প্রতিভাবান সহপাঠীর সান্নিধ্য তাঁর শিল্পীসত্তার বিকাশকে করে তোলে অবাধ।
জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের মতো কাইয়ুম চৌধুরীর মধ্যেও রয়েছে স্বাজাত্যবোধ, নিজ চিত্রে দেশের রূপ-রসকে পরস্ফুিটিত করার নিরন্তর প্রয়াস এবং লোক-ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকার। প্রচ্ছদ-নকশা ও অলংকরণের ক্ষেত্রে যে সুরুচি ও সৌন্দর্যের নতুন ধারার সূচনা তিনি করেছেন, তা তাঁর চিত্রশিল্পের জমিনকেও প্রভাবিত করেছে। কাইয়ুম চৌধুরীর সব ধরনের কাজে বাংলাদেশের গ্রাম জনপদের উপস্থিতি বিশেষ তাৎপর্যবহ। তাঁর প্রিয় বিষয়ের মধ্যে রয়েছে নদী, আকাশ আর মাটি। দেশের নানা সংকটে তাঁর বিপর্যস্ত মন গ্রামবাংলার জীবনচিত্রের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পায়; এবং গ্রামজীবন তাঁর অন্তর্গত সত্তায় এমন একধরনের অনুভূতির জন্ম দেয়, যা তাঁর সৃষ্টিশীল উদ্যমকে ওই জীবননির্ভর চিত্রাঙ্কনে প্রাণিত করে। ওইরূপ অনুভূতি তাঁর দেশাত্মবোধেরও উৎস।
লোক-ঐতিহ্যের প্রতি জয়নুল আবেদিনের সুতীব্র অনুরাগ কাইয়ুম চৌধুরীর মনেও লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে নন্দলাল বসুর হরিপুরা চিত্রমালা, যামিনী রায় ও কামরুল হাসানের চিত্রসমষ্টিও তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস। আর এভাবে তাঁর কাছে লোকশিল্প হয়ে উঠেছে আমাদের ঐতিহ্যেরই এক স্থায়ী ঠিকানা। লোকশিল্পের বিচিত্র মোটিফ রং ও ভাষাকে তিনি তাঁর শিল্পকর্মে সৃজনশীলভাবে অঙ্গীকার করেছেন। ঐতিহ্যবাহী পটচিত্র, কালীঘাটের পট, শখের হাঁড়ি, লক্ষ্মীর সরা, নকশিকাঁথা ও পাখা প্রভৃতির বিষয় ও প্রকরণপদ্ধতি অনুসরণ করার পাশাপাশি তিনি লোকজ ফর্ম ভেঙে তাকে আরও মিনিমাইজ করে এবং প্রাথমিক রঙের সমান্তরালে মিশ্র রং ব্যবহার প্রভৃতির মাধ্যমে এর আধুনিক প্রয়োগে প্রয়াসী হয়েছেন। কালীঘাটের পটের ড্রয়িংয়ে যে সংক্ষিপ্ততা বা লিরিক্যাল কোয়ালিটি বিদ্যমান, তার প্রতিও তিনি গভীরভাবে আকৃষ্ট।
কাইয়ুম চৌধুরীর প্রতিটি ছবির কম্পোজিশনই এক প্রকার ডিজাইন। এই নকশাধর্মিতা লোকজশিল্পেরও অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বাস্তবতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজের কর্মধারা চিত্রশিল্পী ও ডিজাইনার হিসেবে তাঁর দুই সত্তাকে পরস্পরের পরিপূরক করে তুলেছে। ছবির জমিনে অবয়ব ভাঙার যেসব কলাকৌশল বা রঙের ওভারল্যাপিংয়ের আশ্রয় তিনি নেন, তা একইভাবে প্রচ্ছদ ও অলংকরণেও অনুসরণ করেন। ফলে চিত্রশিল্পী ও ডিজাইনার হিসেবে তাঁর দুই সত্তাকে আর পৃথক করা যায় না। এ দুই সত্তা পরস্পরের জন্য দ্বন্দ্বাত্মক না হয়ে তাঁর ক্ষেত্রে শক্তিবর্ধক হয়েছে। তা ছাড়া প্রচ্ছদে হস্তলিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সার্থকতার চূড়া স্পর্শ করেছেন। এই সিদ্ধির কারণ প্রচ্ছদকে শুধু দৃষ্টিশোভন করা নয়, গ্রন্থের বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার বিবেচনাটিও তাঁর কাছে সব সময়ই মুখ্য।
লাল, আলট্রা মেরিন ব্লু, ক্যাডমিয়াম ইয়েলো এবং ভিরিডিয়াম গ্রিন—এসব রঙের প্রতি রয়েছে তাঁর বিশেষ দুর্বলতা। তাঁর সব ছবিতেই রয়েছে এসব রঙের প্রাধান্য। মৌলিক রঙের প্রতি পটচিত্রীদের আগ্রহসূত্রেই তাঁরও মধ্যে এই আকর্ষণ ও পক্ষপাতের জন্ম। তবে একাধিক রঙের মিশ্রণের মাধ্যমে নতুন রঙের আবহ সৃষ্টিতেও তিনি কম আগ্রহী নন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে প্রভাবিত করেছে পাশ্চাত্যের ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা। রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা দৃষ্টিভঙ্গির যে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসেন, তাকে তিনি সচেতনভাবে অনুসরণ করেন। লেওনার্দো দা ভিঞ্চি ও মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর পর তাঁর প্রিয় শিল্পীর তালিকায় আছেন ভ্যান গঘ, পল গগা ও পাবলো পিকাসো।
কাইয়ুম চৌধুরীর ছবিতে কর্কশতা বা নির্মমতা নেই, নেই সমকালীন জীবনের যন্ত্রণা, অর্থাৎ মানুষের তীব্র দুঃখ-কষ্ট, সন্ত্রাস, খুনোখুনি, নির্যাতন-নিপীড়ন প্রভৃতির অভিব্যক্তি। তাঁর ছবি সব সময় লালিত্যময়। গঠনবিন্যাসের সৌন্দর্যই এই লালিত্যের কারণ। সমকালকে অতিক্রম করে নিজ চিত্রকর্মকে এক চিরকালীন আবেদনে ব্যঞ্জিত করার দিকেই শিল্পীর আগ্রহ। এই আগ্রহ তাঁকে সুন্দরের এক সাধকে পরিণত করেছে। অরূপরতনের আশায় যেন তিনি রূপসাগরে ডুব দিয়েছেন। আর এই রূপের তৃষ্ণায়ই তিনি আমাদের চারুশিল্পের ভুবনকে উদ্ভাসিত করেছেন দেশাত্মবোধের উজ্জ্বল আলোয়, আমাদের প্রকাশনাশিল্পকে সৌন্দর্যদীপ্ত করে উন্নীত করতে প্রয়াসী হয়েছেন আন্তর্জাতিক মানে। এই দুই ক্ষেত্রেই তাঁর সাফল্য তাঁকে অবিসংবাদিত রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তি উপলক্ষে আমরা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক ভুবনে তিনি প্রতিনিয়ত সুন্দরের যে সুধা বর্ষণ করে চলেছেন, তা আরও বহু-বহুকাল ধরে অব্যাহত থাকুক, সেটাই আমাদের একান্ত কামনা।
আত্মপ্রতিকৃতি ২০১৪, কাইয়ুম চৌধুরী) ১৯৩২ সালে জন্ম নেওয়া কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর ৬৫ বছরের সাধনার মাধ্যমে শুধু আমাদের চিত্রশিল্পের জগৎকেই উৎকর্ষমণ্ডিত করেননি, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সমগ্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকেই তাঁর অগ্রসর চিন্তার আলোকে উদ্দীপিত রেখেছেন। বিরাশি-উত্তর জীবনেও তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক ভুবনে যৌবনকালের মতোই সক্রিয় এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ছয় দশক ধরে এই শিল্পী আমাদের প্রকাশনার জগৎকে তাঁর বিপুল সৃষ্টির মাধ্যমে যেভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন, তার কোনো তুলনা মেলে না। আমাদের শিল্প ও সাংস্কৃতিক জগৎকে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সুরুচির আলোয় আলোকিত করে চলেছেন। আর এভাবেই তিনি পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের এক সার্থক শিল্পী-ব্যক্তিত্বে। এই সার্থকতার পেছনে তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার পাশাপাশি সক্রিয় গভীরতর নিষ্ঠা ও একাগ্রতা।
শিল্প ও সংস্কৃতির সব ধারা থেকে রস আহরণ করে কাইয়ুম চৌধুরী নিরন্তর পরিপুষ্ট করে চলেছেন নিজ সৃজনশক্তিকে। আর এর স্বীকৃতিও পেয়েছেন রাষ্ট্র, জনগণ ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। সম্প্রতি সর্বশেষ ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা পদকে’। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে তাঁর স্বীকৃতি লাভ যেন পূর্ণতা অর্জন করল। কেননা, এর আগে তিনি পেয়েছেন শিল্পকলা একাডেমী প্রদত্ত শিল্পকলার জাতীয় পুরস্কার (১৯৭৭), মনোনীত হয়েছেন বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো এবং লাভ করেছেন রাষ্ট্রীয় একুশে পদক (১৯৮৬)। তারও আগে বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে তিনি দু-দুবার রেলওয়ের টাইমটেবলের প্রচ্ছদের জন্য সেরা পুরস্কার পেয়েছেন (১৯৫৯, ১৯৬১), পেয়েছেন শিল্পকলায় পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার (১৯৬১-৬২), পঞ্চম তেহরান বিয়েনাল থেকে রাজকীয় দরবার পুরস্কার (১৯৬৬) এবং বাংলাদেশের প্রচ্ছদশিল্পের জন্য সাতবার গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার (১৯৬৪-৭৬) ও স্বর্ণপদক (১৯৭৫)।
এবারের স্বাধীনতা পদকের আরও তাৎপর্য হলো, এর মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনভাবনা ও জীবনাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করল। পদকপ্রাপ্তির সংবাদ-প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা দেশের সব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী শিল্পী হিসেবেই তিনি এ সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। আমরা তাঁর জীবনেতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, ১৯৪৯ সালে ঢাকার শিল্প শিক্ষালয়ের ছাত্র হওয়ার পর জয়নুল আবেদিনসহ শিক্ষকদের সাহচর্যে যেমন তাঁর জীবনানুভবে অঙ্কুরিত হয়েছিল দেশাত্মবোধের বীজ, তেমনি বন্ধু শিল্পী আমিনুল ইসলাম ও মুর্তজা বশীরের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে তিনি বামপন্থী রাজনীতির চিন্তাস্রোতের নিবিড় সংস্পর্শ লাভ করে নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়েছিলেন উচ্চতর মানবতার বোধে। সেই তারুণ্য থেকে শুরু; তারপর ছয় দশকের বেশি সময় ধরে এই দেশ ও এর শুভবোধসম্পন্ন মানুষের কল্যাণার্থে উৎসর্গীকৃত হয়েছে শিল্পীর সব চিন্তা, কর্ম ও সৃষ্টি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত স্বাধিকার ও স্বাধীনতাকেন্দ্রিক এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সব সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে তিনি সক্রিয় থেকেছেন। ষাটের দশকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে সর্বজনাব মতিউর রহমান, মফিদুল হক, আবুল হাসনাত, আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখ যখনই শিল্পসংশ্লিষ্ট কোনো কাজের দাবি নিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছেন, তখনই তা আনন্দচিত্তে পূরণ করেছেন। এমনকি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় তাঁদেরই কেউ কেউ রাতে কারফিউর মধ্যে সরকারবিরোধী প্রচার ও প্রকাশনার শিল্পবিষয়ক কাজের জন্য তাঁর বাসায় উপস্থিত হলে তিনিও নির্ভীকচিত্তে সেসব কাজ সম্পাদন করেছেন। ষাটের দশকের নানা প্রতিবাদী প্রকাশনা সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর শিল্পের ছোঁয়ায়।
১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব অসহযোগ আন্দোলনের সময় দেশের চারু ও কারুশিল্পীদের যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, তার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী ও মুর্তজা বশীর। এই সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগেই ১৯৭১-এর মার্চে ‘স্বাধীনতা’ শীর্ষক চারু-কারুশিল্পীদের একটি ঐতিহাসিক মিছিল ঢাকার রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। তারপর মুক্তিযুদ্ধকালীন অনুভূতি নিয়ে অনেক ছবি এঁকেছেন তিনি। রাজশাহীর বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনে করেছেন মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক মোজাইক ম্যুরাল। আজও তাঁর শিল্পকর্মে মুক্তিযোদ্ধার ইমেজ একটি পরিচিত অনুষঙ্গ। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে স্বৈরতন্ত্র, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সব আন্দোলনের সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত। সুতরাং তাঁর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিশ্চিতভাবে এক আনন্দদায়ক ঘটনা।
জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান প্রমুখ পথিকৃৎ শিল্পীর পর বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম কাইয়ুম চৌধুরী। প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে তাঁর বিপুল খ্যাতি সর্বদাই এক ঈর্ষণীয় ঘটনা। স্মরণীয় যে বাংলাদেশের ব্যবহারিক শিল্পকলায় পথিকৃৎ হিসেবে কাজী আবুল কাসেম ও জয়নুল আবেদিনের ভূমিকা থাকলেও এই ধারা কামরুল হাসানের হাতেই বিকশিত ও রসমণ্ডিত হয়েছে। এবং স্বীকার না করে উপায় নেই যে এটি পূর্ণায়ত রূপ লাভ করেছে কাইয়ুম চৌধুরীর নিরবচ্ছিন্ন সৃজনশীল সাধনার মাধ্যমে। ছয় দশক ধরে তিনি এই ক্ষেত্রটিকে বিপুল ও বিচিত্রভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন। অন্যদিকে তাঁর শিল্পকর্মের জমিনে রং ও রূপের যে বিন্যাস, তাতে দারুণভাবে প্রাণবন্ত হয়ে আছে বাংলার নিসর্গ ও জীবনের সদাচঞ্চল রূপ। জন্মভূমির প্রতি প্রবল মমত্ববোধ তাঁর শিল্পচেতনাকে করেছে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। প্রগতির ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট এই শিল্পীর ধর্মনিরপেক্ষ জীবনবোধ মুক্তবুদ্ধির আকাঙ্ক্ষায়ও সর্বদা উচ্চকিত। ব্যাপক সাহিত্যপাঠ, সংগীত ও চলচ্চিত্র অনুরাগ তাঁর জীবনজিজ্ঞাসাকে করেছে ইতিবাচক, বৈচিত্র্যসন্ধানী ও উন্নত রুচির আকর।
পিতার বদলিপ্রবণ চাকরিসূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে তাঁর স্কুলজীবন অতিবাহিত হওয়ায় দেশের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির যে নিবিড় সাহচর্য তিনি লাভ করেন, তাতে নিসর্গের প্রতি তাঁর মনে সৃষ্টি হয় গভীর অনুরাগ। বিশেষ করে চিত্রা নদীর তীরবর্তী নড়াইলের জীবন তাঁর প্রকৃতিপাঠের ক্ষেত্রে এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পত্রিকা ও গ্রন্থপাঠ এবং চলচ্চিত্র ও সংগীতের প্রতি পিতার আগ্রহের ফলে বাল্য বয়স থেকে কাইয়ুম চৌধুরীও এসবের প্রতি অনুরাগী হন, যা তাঁর রুচিশীল মানস গঠনে সহায়ক হয়। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই বইয়ের প্রতি গড়ে ওঠে তাঁর তীব্র আকর্ষণ। তখন থেকেই বইয়ের প্রচ্ছদ এবং ভেতরের ইলাস্ট্রেশন তাঁর ভেতরের শিল্পীসত্তাকে জাগিয়ে তোলে। ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটে শিক্ষকদের প্রভাবের পাশাপাশি একঝাঁক প্রতিভাবান সহপাঠীর সান্নিধ্য তাঁর শিল্পীসত্তার বিকাশকে করে তোলে অবাধ।
জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের মতো কাইয়ুম চৌধুরীর মধ্যেও রয়েছে স্বাজাত্যবোধ, নিজ চিত্রে দেশের রূপ-রসকে পরস্ফুিটিত করার নিরন্তর প্রয়াস এবং লোক-ঐতিহ্যের প্রতি অঙ্গীকার। প্রচ্ছদ-নকশা ও অলংকরণের ক্ষেত্রে যে সুরুচি ও সৌন্দর্যের নতুন ধারার সূচনা তিনি করেছেন, তা তাঁর চিত্রশিল্পের জমিনকেও প্রভাবিত করেছে। কাইয়ুম চৌধুরীর সব ধরনের কাজে বাংলাদেশের গ্রাম জনপদের উপস্থিতি বিশেষ তাৎপর্যবহ। তাঁর প্রিয় বিষয়ের মধ্যে রয়েছে নদী, আকাশ আর মাটি। দেশের নানা সংকটে তাঁর বিপর্যস্ত মন গ্রামবাংলার জীবনচিত্রের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পায়; এবং গ্রামজীবন তাঁর অন্তর্গত সত্তায় এমন একধরনের অনুভূতির জন্ম দেয়, যা তাঁর সৃষ্টিশীল উদ্যমকে ওই জীবননির্ভর চিত্রাঙ্কনে প্রাণিত করে। ওইরূপ অনুভূতি তাঁর দেশাত্মবোধেরও উৎস।
লোক-ঐতিহ্যের প্রতি জয়নুল আবেদিনের সুতীব্র অনুরাগ কাইয়ুম চৌধুরীর মনেও লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহ ও আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এ ক্ষেত্রে নন্দলাল বসুর হরিপুরা চিত্রমালা, যামিনী রায় ও কামরুল হাসানের চিত্রসমষ্টিও তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস। আর এভাবে তাঁর কাছে লোকশিল্প হয়ে উঠেছে আমাদের ঐতিহ্যেরই এক স্থায়ী ঠিকানা। লোকশিল্পের বিচিত্র মোটিফ রং ও ভাষাকে তিনি তাঁর শিল্পকর্মে সৃজনশীলভাবে অঙ্গীকার করেছেন। ঐতিহ্যবাহী পটচিত্র, কালীঘাটের পট, শখের হাঁড়ি, লক্ষ্মীর সরা, নকশিকাঁথা ও পাখা প্রভৃতির বিষয় ও প্রকরণপদ্ধতি অনুসরণ করার পাশাপাশি তিনি লোকজ ফর্ম ভেঙে তাকে আরও মিনিমাইজ করে এবং প্রাথমিক রঙের সমান্তরালে মিশ্র রং ব্যবহার প্রভৃতির মাধ্যমে এর আধুনিক প্রয়োগে প্রয়াসী হয়েছেন। কালীঘাটের পটের ড্রয়িংয়ে যে সংক্ষিপ্ততা বা লিরিক্যাল কোয়ালিটি বিদ্যমান, তার প্রতিও তিনি গভীরভাবে আকৃষ্ট।
কাইয়ুম চৌধুরীর প্রতিটি ছবির কম্পোজিশনই এক প্রকার ডিজাইন। এই নকশাধর্মিতা লোকজশিল্পেরও অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই বাস্তবতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নিজের কর্মধারা চিত্রশিল্পী ও ডিজাইনার হিসেবে তাঁর দুই সত্তাকে পরস্পরের পরিপূরক করে তুলেছে। ছবির জমিনে অবয়ব ভাঙার যেসব কলাকৌশল বা রঙের ওভারল্যাপিংয়ের আশ্রয় তিনি নেন, তা একইভাবে প্রচ্ছদ ও অলংকরণেও অনুসরণ করেন। ফলে চিত্রশিল্পী ও ডিজাইনার হিসেবে তাঁর দুই সত্তাকে আর পৃথক করা যায় না। এ দুই সত্তা পরস্পরের জন্য দ্বন্দ্বাত্মক না হয়ে তাঁর ক্ষেত্রে শক্তিবর্ধক হয়েছে। তা ছাড়া প্রচ্ছদে হস্তলিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সার্থকতার চূড়া স্পর্শ করেছেন। এই সিদ্ধির কারণ প্রচ্ছদকে শুধু দৃষ্টিশোভন করা নয়, গ্রন্থের বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার বিবেচনাটিও তাঁর কাছে সব সময়ই মুখ্য।
লাল, আলট্রা মেরিন ব্লু, ক্যাডমিয়াম ইয়েলো এবং ভিরিডিয়াম গ্রিন—এসব রঙের প্রতি রয়েছে তাঁর বিশেষ দুর্বলতা। তাঁর সব ছবিতেই রয়েছে এসব রঙের প্রাধান্য। মৌলিক রঙের প্রতি পটচিত্রীদের আগ্রহসূত্রেই তাঁরও মধ্যে এই আকর্ষণ ও পক্ষপাতের জন্ম। তবে একাধিক রঙের মিশ্রণের মাধ্যমে নতুন রঙের আবহ সৃষ্টিতেও তিনি কম আগ্রহী নন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে প্রভাবিত করেছে পাশ্চাত্যের ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা। রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীরা দৃষ্টিভঙ্গির যে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসেন, তাকে তিনি সচেতনভাবে অনুসরণ করেন। লেওনার্দো দা ভিঞ্চি ও মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর পর তাঁর প্রিয় শিল্পীর তালিকায় আছেন ভ্যান গঘ, পল গগা ও পাবলো পিকাসো।
কাইয়ুম চৌধুরীর ছবিতে কর্কশতা বা নির্মমতা নেই, নেই সমকালীন জীবনের যন্ত্রণা, অর্থাৎ মানুষের তীব্র দুঃখ-কষ্ট, সন্ত্রাস, খুনোখুনি, নির্যাতন-নিপীড়ন প্রভৃতির অভিব্যক্তি। তাঁর ছবি সব সময় লালিত্যময়। গঠনবিন্যাসের সৌন্দর্যই এই লালিত্যের কারণ। সমকালকে অতিক্রম করে নিজ চিত্রকর্মকে এক চিরকালীন আবেদনে ব্যঞ্জিত করার দিকেই শিল্পীর আগ্রহ। এই আগ্রহ তাঁকে সুন্দরের এক সাধকে পরিণত করেছে। অরূপরতনের আশায় যেন তিনি রূপসাগরে ডুব দিয়েছেন। আর এই রূপের তৃষ্ণায়ই তিনি আমাদের চারুশিল্পের ভুবনকে উদ্ভাসিত করেছেন দেশাত্মবোধের উজ্জ্বল আলোয়, আমাদের প্রকাশনাশিল্পকে সৌন্দর্যদীপ্ত করে উন্নীত করতে প্রয়াসী হয়েছেন আন্তর্জাতিক মানে। এই দুই ক্ষেত্রেই তাঁর সাফল্য তাঁকে অবিসংবাদিত রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্তি উপলক্ষে আমরা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক ভুবনে তিনি প্রতিনিয়ত সুন্দরের যে সুধা বর্ষণ করে চলেছেন, তা আরও বহু-বহুকাল ধরে অব্যাহত থাকুক, সেটাই আমাদের একান্ত কামনা।
No comments