শিক্ষা, সচেতনতা ও সমন্বিত চেষ্টায় বাল্যবিবাহ বন্ধ সম্ভব -গোলটেবিল বৈঠক
বাংলাদেশের ভয়াবহ একটি সংকটের নাম বাল্যবিবাহ। শিশু বয়সে বিয়ের কারণে একটি মেয়ে তার শৈশব থেকে বঞ্চিত হয়। এরপর তাকে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। তাই বাল্যবিবাহ বন্ধ করতেই হবে। গতকাল শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। বাল্যবিবাহ বন্ধে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স কোনোভাবেই ১৮ বছরের নিচে নামানো যাবে না বলে মত আসে বৈঠকে। বৈঠকে সবাই আশা প্রকাশ করেন, নাগরিক সমাজ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ-প্রশাসন—সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব। বাল্যবিবাহ বন্ধে মেয়েদের শিক্ষা এবং ক্ষমতায়নও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ ‘বাল্যবিবাহ: দারিদ্র্য ও নিরাপত্তা প্রেক্ষিত’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ও সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মালেকা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান তানিয়া হক, অধ্যাপক নাজমুন্নেসা মাহতাব, সহযোগী অধ্যাপক আয়েশা বানু, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আশরাফুন্নেসা, ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপকমিশনার শামীমা বেগম, আইনজীবী সারা হোসেন, ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি শাবনাজ জাহেরিন ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রিনা রায় বক্তব্য দেন। সভা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘যে করেই হোক, দেশ থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতেই হবে। এ জন্য আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও এই আন্দোলনে থাকতে হবে।’
শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন: মিজানুর রহমান বলেন, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে একটি শিশুর শৈশবকে হত্যা করা হচ্ছে। নাজমা চৌধুরী বলেন, শিশু বয়সে একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে তাকে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের মুখোমুখি করে দেওয়া। মাতৃমৃত্যুর একটি বড় কারণও বাল্যবিবাহ। আয়েশা বানু বলেন, বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আশরাফুন্নেসা বলেন, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে একটি শিশুর বিকাশই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রিনা রায় বলেন, ‘দুই মাস আগে রাজশাহীর বাঘায় গিয়েছিলাম। সেখানে ১৪ বছরের একটি মেয়েকে পাই, যে বিয়ের পর নির্যাতনের কারণে বাবার বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। ধানের বোঝা বয়ে আনতে পারত না বলে মেয়েটিকে নির্যাতন করা হতো শ্বশুরবাড়িতে। কেবল শারীরিক নির্যাতন নয়, যৌন নির্যাতনও আছে।’ গোলটেবিল বৈঠকের সব বক্তাই বাল্যবিবাহের এমন নানা ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেন।
নিরাপত্তাহীনতা: মালেকা বেগম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার নিরাপত্তার কথা ভেবে। আশরাফুন্নেসা বলেন, বন্যা বা দুর্যোগের সময় দেখা যায়, অনেক মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়। নিরাপত্তাই যেন বিয়ে দেওয়ার একটি কারণ।
রীনা রায় বলেন, গ্রামে যদি ১২-১৩ বছরের একটি মেয়েকে বখাটেরা উত্ত্যক্ত করে, তবে সেই দোষও মেয়েটিকে দিয়ে দেওয়া হয় এবং বাবা-মায়েরা মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দেয়। অথচ মেয়েটির এ ক্ষেত্রে কিছু করার নেই। এই সমস্যা সমাধানে উত্ত্যক্তকরণ বন্ধ করতে হবে। মেহতাব খানম বলেন, ছেলেরা সব সময় উত্ত্যক্তের পেছনে মেয়েটিকে দায়ী করে। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘একটি শিশু উত্ত্যক্তকরণের কারণে পুকুরে ঝাঁপ দেবে—কোনোভাবেই আমরা সেটা হতে দেব না।’
বিয়ের বয়স কোনোভাবেই কমানো যায় না: মিজানুর রহমানসহ সব বক্তাই বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ১৬ করার প্রস্তাবের কড়া সমালোচনা করেন। মিজানুর রহমান বলেন, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে এটা করতে বলেছেন, তাঁরা ভুল বুঝিয়েছেন। তানিয়া হক বলেন, বর্তমান আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু অহরহ এ ঘটনা ঘটছে। এখন যদি বিয়ের বয়স কমিয়ে ১৬ করা হয়, তাহলে এটা আরও বেড়ে যাবে।
ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শাবনাজ জাহেরিন বলেন, জাতিসংঘ শিশু সনদ অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। কাজেই বাল্যবিবাহ না বলে শিশুবিবাহ বলা উচিত। তাতে হয়তো সবার কানে কথাটি লাগবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি মাথায় রেখেই বিয়ের বয়স কমানোর চিন্তা করা হচ্ছে। তবে এ নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে।
শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নেই সমাধান: বাল্যবিবাহ বন্ধে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সব বক্তাই মেয়েদের শিক্ষার ওপর জোর দেন। মিজানুর রহমান বলেন, শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যত বেশি নারীকে সম্পৃক্ত করা যাবে ততই সমস্যা কমবে। নাজমুন্নেছা মাহতাব বলেন, শিক্ষাই পারে একটি মেয়েকে আলোকিত করতে। আয়েশা বানু বলেন, এক শ বছর আগে বেগম রোকেয়া বলে গেছেন, তোমরা মেয়েদের শিক্ষিত করে ছেড়ে দাও, তারা নিজের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেবে। এখনো এটাই সমাধান। মেহতাব খানম বলেন, একটি মেয়ের যদি শিশুকালেই বিয়ের বয়স হয়ে যায়, তাহলে লেখাপড়া শিখবে কখন? আশরাফুন্নেসা বলেন, একটি মেয়ের সম্পদের ওপর অধিকার থাকা উচিত। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমিও মনে করি, শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
আইনের প্রয়োগ দরকার: মিজানুর রহমান বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে আইনের শক্ত প্রয়োগ খুব জরুরি। শামীমা বেগম আশা প্রকাশ করেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে পুলিশ কোনো ছাড় দেবে না। তিনি বলেন, কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায়, বাল্যবিবাহ বন্ধ করার ক্ষেত্রে আইনগতভাবে পুলিশের করার কিছু থাকে না। আইনমন্ত্রী বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধে যে আইন করা হবে, সেখানে এ ধরনের ঘটনার বিচার করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত করা হবে, যেন সঙ্গে সঙ্গেই বিচার করা যায়।
সমন্বিত আইন দরকার: বিয়ের বিষয়ে একটি সমন্বিত আইন করার বিষয়ে প্রস্তাব করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, আইনে বিয়ের বয়স নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। বিষয়টি সব ধর্মের সবার জন্য এক করতে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা করা দরকার।
সক্রিয় করতে হবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের: রীনা রায় বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সক্রিয় হলেই বাল্যবিবাহ কমানো সম্ভব। কিন্তু অনেক সময় ভোটের কথা চিন্তা করে তাঁরা সেটি করেন না। শাবনাজ জাহেরিন বলেন, জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি ইমামদেরও বিষয়টি বোঝানো উচিত। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যেখানেই যাই, জনপ্রতিনিধিদের বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য কাজ করতে বলি।’
সচেতন হতে হবে সবাইকে: নাজমা চৌধুরী বলেন, কেবল আইন দিয়ে হবে না, সচেতনতা সৃষ্টি করা খুব জরুরি। শামীমা বেগম বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, একটি কিশোর ছেলে বা মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করে। অভিভাবকেরা অপহরণের মামলা দেয়। এটি আরেক ধরনের সমস্যা। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে দুজনকেই বুঝতে হবে, তারা যেন ১৮ না হলে বিয়ে না করে।
পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বদলাতে হবে: বাল্যবিবাহ বন্ধে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বদলানোর কথা বললেন সব বক্তাই। মেহতাব খানম বলেন, একটি ছেলের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের প্রতি অবহেলার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। এটি বদলাতে হবে। আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কিশোর ছেলেদের জন্যও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আয়েশা বানু বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধে পুরুষের সম্পৃক্ততা খুব জরুরি। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকেই মা-বোন-স্ত্রী আছে। তাদের প্রতেকের অধিকার আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।’
প্রথম আলো ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ ‘বাল্যবিবাহ: দারিদ্র্য ও নিরাপত্তা প্রেক্ষিত’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক নাজমা চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক ও সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মালেকা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান তানিয়া হক, অধ্যাপক নাজমুন্নেসা মাহতাব, সহযোগী অধ্যাপক আয়েশা বানু, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আশরাফুন্নেসা, ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপকমিশনার শামীমা বেগম, আইনজীবী সারা হোসেন, ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি শাবনাজ জাহেরিন ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রিনা রায় বক্তব্য দেন। সভা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘যে করেই হোক, দেশ থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতেই হবে। এ জন্য আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও এই আন্দোলনে থাকতে হবে।’
শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন: মিজানুর রহমান বলেন, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে একটি শিশুর শৈশবকে হত্যা করা হচ্ছে। নাজমা চৌধুরী বলেন, শিশু বয়সে একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া মানে তাকে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের মুখোমুখি করে দেওয়া। মাতৃমৃত্যুর একটি বড় কারণও বাল্যবিবাহ। আয়েশা বানু বলেন, বাল্যবিবাহের কারণে একটি মেয়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। আশরাফুন্নেসা বলেন, বাল্যবিবাহের মাধ্যমে একটি শিশুর বিকাশই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রিনা রায় বলেন, ‘দুই মাস আগে রাজশাহীর বাঘায় গিয়েছিলাম। সেখানে ১৪ বছরের একটি মেয়েকে পাই, যে বিয়ের পর নির্যাতনের কারণে বাবার বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। ধানের বোঝা বয়ে আনতে পারত না বলে মেয়েটিকে নির্যাতন করা হতো শ্বশুরবাড়িতে। কেবল শারীরিক নির্যাতন নয়, যৌন নির্যাতনও আছে।’ গোলটেবিল বৈঠকের সব বক্তাই বাল্যবিবাহের এমন নানা ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেন।
নিরাপত্তাহীনতা: মালেকা বেগম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার নিরাপত্তার কথা ভেবে। আশরাফুন্নেসা বলেন, বন্যা বা দুর্যোগের সময় দেখা যায়, অনেক মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়। নিরাপত্তাই যেন বিয়ে দেওয়ার একটি কারণ।
রীনা রায় বলেন, গ্রামে যদি ১২-১৩ বছরের একটি মেয়েকে বখাটেরা উত্ত্যক্ত করে, তবে সেই দোষও মেয়েটিকে দিয়ে দেওয়া হয় এবং বাবা-মায়েরা মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দেয়। অথচ মেয়েটির এ ক্ষেত্রে কিছু করার নেই। এই সমস্যা সমাধানে উত্ত্যক্তকরণ বন্ধ করতে হবে। মেহতাব খানম বলেন, ছেলেরা সব সময় উত্ত্যক্তের পেছনে মেয়েটিকে দায়ী করে। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘একটি শিশু উত্ত্যক্তকরণের কারণে পুকুরে ঝাঁপ দেবে—কোনোভাবেই আমরা সেটা হতে দেব না।’
বিয়ের বয়স কোনোভাবেই কমানো যায় না: মিজানুর রহমানসহ সব বক্তাই বিয়ের বয়স ১৮ থেকে ১৬ করার প্রস্তাবের কড়া সমালোচনা করেন। মিজানুর রহমান বলেন, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে এটা করতে বলেছেন, তাঁরা ভুল বুঝিয়েছেন। তানিয়া হক বলেন, বর্তমান আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে বিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু অহরহ এ ঘটনা ঘটছে। এখন যদি বিয়ের বয়স কমিয়ে ১৬ করা হয়, তাহলে এটা আরও বেড়ে যাবে।
ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শাবনাজ জাহেরিন বলেন, জাতিসংঘ শিশু সনদ অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। কাজেই বাল্যবিবাহ না বলে শিশুবিবাহ বলা উচিত। তাতে হয়তো সবার কানে কথাটি লাগবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি মাথায় রেখেই বিয়ের বয়স কমানোর চিন্তা করা হচ্ছে। তবে এ নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে।
শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নেই সমাধান: বাল্যবিবাহ বন্ধে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী সব বক্তাই মেয়েদের শিক্ষার ওপর জোর দেন। মিজানুর রহমান বলেন, শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যত বেশি নারীকে সম্পৃক্ত করা যাবে ততই সমস্যা কমবে। নাজমুন্নেছা মাহতাব বলেন, শিক্ষাই পারে একটি মেয়েকে আলোকিত করতে। আয়েশা বানু বলেন, এক শ বছর আগে বেগম রোকেয়া বলে গেছেন, তোমরা মেয়েদের শিক্ষিত করে ছেড়ে দাও, তারা নিজের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেবে। এখনো এটাই সমাধান। মেহতাব খানম বলেন, একটি মেয়ের যদি শিশুকালেই বিয়ের বয়স হয়ে যায়, তাহলে লেখাপড়া শিখবে কখন? আশরাফুন্নেসা বলেন, একটি মেয়ের সম্পদের ওপর অধিকার থাকা উচিত। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমিও মনে করি, শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমেই অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
আইনের প্রয়োগ দরকার: মিজানুর রহমান বলেন, সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে আইনের শক্ত প্রয়োগ খুব জরুরি। শামীমা বেগম আশা প্রকাশ করেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে পুলিশ কোনো ছাড় দেবে না। তিনি বলেন, কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায়, বাল্যবিবাহ বন্ধ করার ক্ষেত্রে আইনগতভাবে পুলিশের করার কিছু থাকে না। আইনমন্ত্রী বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধে যে আইন করা হবে, সেখানে এ ধরনের ঘটনার বিচার করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত করা হবে, যেন সঙ্গে সঙ্গেই বিচার করা যায়।
সমন্বিত আইন দরকার: বিয়ের বিষয়ে একটি সমন্বিত আইন করার বিষয়ে প্রস্তাব করেন সারা হোসেন। তিনি বলেন, আইনে বিয়ের বয়স নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। বিষয়টি সব ধর্মের সবার জন্য এক করতে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা করা দরকার।
সক্রিয় করতে হবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের: রীনা রায় বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সক্রিয় হলেই বাল্যবিবাহ কমানো সম্ভব। কিন্তু অনেক সময় ভোটের কথা চিন্তা করে তাঁরা সেটি করেন না। শাবনাজ জাহেরিন বলেন, জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি ইমামদেরও বিষয়টি বোঝানো উচিত। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যেখানেই যাই, জনপ্রতিনিধিদের বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য কাজ করতে বলি।’
সচেতন হতে হবে সবাইকে: নাজমা চৌধুরী বলেন, কেবল আইন দিয়ে হবে না, সচেতনতা সৃষ্টি করা খুব জরুরি। শামীমা বেগম বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, একটি কিশোর ছেলে বা মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করে। অভিভাবকেরা অপহরণের মামলা দেয়। এটি আরেক ধরনের সমস্যা। আমার কাছে মনে হয়, এ ক্ষেত্রে ছেলেমেয়ে দুজনকেই বুঝতে হবে, তারা যেন ১৮ না হলে বিয়ে না করে।
পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বদলাতে হবে: বাল্যবিবাহ বন্ধে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বদলানোর কথা বললেন সব বক্তাই। মেহতাব খানম বলেন, একটি ছেলের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের প্রতি অবহেলার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। এটি বদলাতে হবে। আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে কিশোর ছেলেদের জন্যও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আয়েশা বানু বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধে পুরুষের সম্পৃক্ততা খুব জরুরি। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকেই মা-বোন-স্ত্রী আছে। তাদের প্রতেকের অধিকার আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।’
No comments