ভারত-বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা একটি পর্যালোচনা by এম সাখাওয়াত হোসেন
কয়েকদিন আগে ভারতের সদ্য বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কোরেইশি রচিত বই অ্যান আনডকুমেন্টেড ওয়ান্ডার : দ্য মেকিং অফ দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ইলেকশন পড়া শেষ করেছি। যারা ভারতীয় নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে অধিকতর জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা রাখেন, তাদের জন্য এ বইটি অবশ্য পাঠ্য। প্রসঙ্গত, ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের গঠন, দায়িত্ব ইত্যাদি ভারতের সংবিধানের ধারা ৩২৪ দ্বারা নির্ধারিত, যা হুবহু আমাদের সংবিধানে উল্লেখিত বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া, দায়িত্ব ইত্যাদির অনুরূপ। ভারতীয় সংবিধানের ধারা ৩২৪-এর ছয়টি উপধারায় যা বলা হয়েছে, তা আমাদের সংবিধানের ধারা ১১৮, ১২৯সহ অন্যান্য ধারায় বর্ণিত রয়েছে।
যা হোক, উল্লিখিত বইটিতে ভারতের সাবেক সিইসি বেশ বিস্তারিতভাবে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের গঠন এবং এর সাংবিধানিক ক্ষমতা, স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা, নির্বাচন পদ্ধতি, পরিচালনা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। বহু উদাহরণ টেনেছেন বইটিতে, নির্বাচন পরিচালনাকালে বড় বড় চ্যালেঞ্জের বর্ণনা দিয়েছেন। তেমনি ভবিষ্যতে সংস্কারের জন্য বেশকিছু সুপারিশও রেখেছেন। সম্পূর্ণ বইটিতে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও স্বাধীনতার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতার বিষয়ে তিনি ভারতীয় উচ্চ আদালতের সহায়ক ভূমিকার কথা বলেছেন, বিশেষ করে ধারা ৩২৪(১)-এর অধিকতর ব্যাখ্যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের গঠন, কাঠামো এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানকল্পে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার বিষয়ে একাধিক রায় ও পর্যবেক্ষণের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ভারতীয় সংবিধানের আওতায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব এককভাবে নির্বাচন কমিশনকে দেয়া হয়েছে। ওই দায়িত্ব পালনে কমিশনের বাইরে কারও হস্তক্ষেপ অথবা প্রভাব বিস্তার সম্পূর্ণভাবে আইন ও সংবিধানবহির্ভূত কর্মকাণ্ড বলে উচ্চতর আদালতের
পর্যবেক্ষণ দেয়া আছে।
ভারতীয় নির্বাচন কমিশনকে কতখানি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং উচ্চ আদালত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে কতখানি বলিষ্ঠ সহায়তা করে থাকে, তার বেশকিছু উদাহরণ কোরাইশি তার বইয়ে উদ্ধৃত করেছেন। উচ্চ আদালতের ১৯৭৮ সালের একটি রিট, এআইআর ১৯৭৮ এসসি ৮৫১ (AIR 1978 SC 851)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, আদালতের রায়ে আলোচিত ধারা ৩২৪(১)-এর অধিকতর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ধারায় বর্ণিত কালা-সাদাতে মোটা দাগের ক্ষমতার উল্লেখই করা হয়েছে মাত্র। এর বাইরেও নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা রয়েছে। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, স্বাধীন কমিশনের গঠন ও দায়িত্ব সংবিধানের মৌলিক কাঠামো, যা সংসদের কোনো আইন দ্বারা পরিবর্তন করা যাবে না। একই সঙ্গে আরও বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনকল্পে উল্লিখিত ধারার বাইরে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এমন যে কোনো ক্ষমতা নির্বাচন কমিশন প্রয়োগ করতে পারবে। এসব ক্ষমতা সংসদ কোনো আইন দ্বারা হ্রাস অথবা স্থগিত করতে পারবে না।
উপরে উল্লিখিত রিটের পর্যবেক্ষণে আরও যা বলা হয়েছে তাতেই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, ক্ষমতা ও স্বাধীনতার বিষয়টি আরও শক্ত ভিত পেয়েছে। এক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট অব ইন্ডিয়া বলেছে, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সময় যে আইন বা বিধি উহ্য অথচ এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যা নিয়ন্ত্রণ না করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে অথবা দায়িত্ব পালনে সমস্যার সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে হাত গুটিয়ে সৃষ্টিকর্তার শরণাপন্ন হওয়া অথবা কমিশনের বাইরে কোনো শক্তির কাছে উপদেশ, নির্দেশ চাওয়ার কোনো প্রয়োজন ও অবকাশ নেই। এখানে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করবে। এক কথায়, নির্বাচন কমিশনের কাজে কোনো ধরনের বাধা, প্রভাব বিস্তার ও হস্তক্ষেপের পর্যায়ে পড়ে এমন কোনো কাজ হবে সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী।
আমি ভারতের নির্বাচন কমিশন ও সংবিধানের ধারার উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, আমাদের ও ভারতের সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের গঠন, দায়িত্ব এবং নির্বাচন পরিচালনার প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। ভারতের সংবিধানের ধারা ৩২৪(১)-এ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব যেভাবে বিন্যাস করা হয়েছে, অনুরূপভাবে আমাদের সংবিধানে ধারা ১১৯-এ একই বিষয় সংযোজিত হয়েছে। এমনকি আক্ষরিক অর্থে শব্দ প্রয়োগেও কোনো তফাৎ নেই। ধারা ১১৯-এ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ কথার উল্লেখ রয়েছে। ধারা ১২৬ নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক নির্বাচন কমিশনকে সহায়তার কথা বলা
হয়েছে। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের পর্যবেক্ষণ এবং নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন প্রক্রিয়াকালে অগাধ ক্ষমতা ব্যবহারের বিষয়ের অনুরূপ ব্যাখ্যা ও পর্যবেক্ষণ আমাদের উচ্চ আদালতেও গৃহীত হয়েছে। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত বিষয়টি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ, যা সংবিধানের সপ্তম
অধ্যায় হিসেবে সংযোজিত।
বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে যদি ভারতের ও আমাদের নির্বাচন কমিশনের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা যায় তাহলে প্রতীয়মান হয়, নির্বাচন পরিচালনায় বাংলাদেশের কমিশন, অন্তত আইনের দিক থেকে, উপমহাদেশের অন্যান্য কমিশন থেকে শক্তিশালী। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন উপরে উল্লিখিত ভারতীয় কমিশনের অনুরূপ ক্ষমতা রাখে। কোথাও কোথাও একটু বেশিই রাখে। তথাপি আমাদের নির্বাচন কমিশন এখনও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। যতটুকু অগ্রসর হয়, পরবর্তী সময়ে তারও বেশি পেছনে পড়তে হয়। এর একাধিক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর সময় গঠিত নির্বাচন কমিশনগুলোর সমালোচনা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ তেমন না থাকলেও সে ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। অপরদিকে সরকার দ্বারা গঠিত কমিশন প্রথম থেকেই বিতর্কিত হয়ে পড়ে, যদিও ১৯৯১ সালের পর জনাব আবু সাঈদ বাদে এবারই প্রথম রাজনৈতিক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতি দ্বারা নিয়োজিত সংক্ষিপ্ত সার্চ-কমিটির মাধ্যমে বর্তমান কমিশন গঠিত হয়েছে। তথাপি বিভিন্ন কারণে কমিশন নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। অবশ্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও শরিকরা এই নিয়োগও সরাসরি গ্রহণ করেনি।
নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা শুধু আইন দ্বারাই সুরক্ষিত নয়, ক্ষমতা প্রয়োগে এবং স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে উচ্চ আদালতসহ দেশের রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সব নির্বাহীর সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। যার নিশ্চয়তা বিধানের জন্যই এত আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট বলীয়ান। সে তুলনায় আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন তেমন সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। আমাদের দেশের দুর্বল রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে নির্বাচন কমিশন অনেকাংশে রাজনৈতিক সরকার ও তার তত্ত্বাবধানে থাকা প্রশাসন থেকে তেমন সহযোগিতা পায় না। তদুপরি অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে, বিশেষ করে রাজনৈতিক সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কখনও সরাসরি আবার কখনও পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে একাধিকবার। বিশেষ করে আমাদের দেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক সরকারই প্রশাসনকে দলীয়করণ করেছে, তাদের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার একাধিক প্রমাণ জনসম্মুখে এসেছে। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে মাগুরা এবং ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনের বিষয় দুটি বহুল আলোচিত। উভয় ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন অসহায় ভূমিকা পালন করেছে। প্রয়োগ করতে পারেনি সংবিধানের ধারা ১১৯ প্রদত্ত ক্ষমতার। মাগুরার নির্বাচনে সরকার ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়েছিল।
আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাও ভারতের অনুরূপ, যদিও ভারতের নির্বাচনী যজ্ঞ বিশ্বে সর্ববৃহৎ। তবে সে অনুপাতে না হলেও বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাও প্রচুর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। আমি মাগুরার নির্বাচনের কথা উল্লেখ করেছি, কারণ ওই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি রাজনৈতিক সরকারের সময়। ওই নির্বাচনে তৎকালীন সরকারি দলের ছত্রছায়ায় যে অব্যবস্থাপনা উদ্ভব হয়েছিল, তাতে নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। একইভাবে ১৯৯৯ সালে আরেক রাজনৈতিক সরকারের তত্ত্বাবধানে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে একজন কমিশনারের উপস্থিতি এবং কিছু ব্যবস্থা নেয়ার পরও ফলাফল জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। ফলে নির্বাচন কমিশন প্রায় ছয় মাস গেজেট স্থগিত রেখেছিল। তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের, বিভিন্ন কারণে, পদত্যাগের পর গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল। অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও প্রভাবিত করার যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের নির্বাচনী দুর্নীতির কারণ, আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ধারণা শুধু কাগজ-কলমে আর বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাও ভারতের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্ভর, তবে ভারতের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অতখানি দলদাস নয়, যতখানি আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিটি শাসক দল তৈরি করে থাকে। এটাই বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর পর এ বিষয়টি শুধু চ্যালেঞ্জের মধ্যেই থাকেনি, বরং নির্বাচন কমিশনের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশোধিত সংবিধানের আওতায় ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচনে কী ঘটেছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই নির্বাচন এবং তার অব্যবহিত পরে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে যেভাবে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে উচ্চ এবং স্থানীয় পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ হয়েছে, তা এখন আর অনুমানভিত্তিক নয় বরং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং সরকারি দলের নির্বাচন সমন্বয়কারী এবং গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সাম্প্রতিক এক বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত, যদিও তিনি কয়েকদিন পর অন্য ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তবু তাতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার উপাদান থেকেই যায়। উপজেলা নির্বাচনের অব্যবস্থার প্রেক্ষাপটেই হয়তো ওই সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অনুপস্থিত থেকেছেন। আলোচিত উপদেষ্টা নিজেই তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যে ধরনের বিষয় জনসম্মুখে নিয়ে এসেছেন তাতে আগামী নির্বাচনকেও, যা এ সরকারের তত্ত্বাবধানেই হবে, আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করবে, যদি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ রাখার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রীয় সহায়ক শক্তি তেমন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিতে না পারে। খবরে প্রকাশ, উপদেষ্টার এহেন বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এমনকি দলের ভেতরেও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক।
জনাব এইচটি ইমামের বক্তব্যের ওপরে নির্বাচন কমিশন তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও ওই বক্তব্য সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকেই যে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। সংবিধানের আলোকে উপদেষ্টার বক্তব্য নির্বাচন পরিচালনায় এক ধরনের হস্তক্ষেপেরই শামিল, যা ধারা ১১৯-এর এবং নির্বাচনী আইনের পরিপন্থী।
আমি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় ভারতের উদাহরণ এ কারণে টেনেছি যে, সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা, নির্বাচনী আইন ও ব্যবস্থাপনা, এমনকি নির্বাচন কমিশনের গঠন একরকম হলেও যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা পিছিয়ে আছি তা হল, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাব। ভারতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পরিচালনায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ অথবা প্রভাব বিস্তার যেমন সরকার, রাজনৈতিক দলও করে না, তেমনি ভারতে বিচার ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনের শক্তি সহায়ক হিসেবে পরিগণিত। আমাদের দেশের রাজনীতিক থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের সদস্যরা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বললেও তা কার্যকর হতে দেখা যায় না। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে তার দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ কাম্য হতে পারে না। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারলে আমাদের দেশে কেন তা হবে না, সেটা ভেবে দেখা দরকার।
পরিশেষে আলোচিত বইয়ের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করব। বইয়ের লেখক বলেছেন, ভারত তিনটি জিনিসের জন্য বিশ্বে অধিক পরিচিত- তাজমহল, মহাত্মা গান্ধী এবং নির্বাচনী গণতন্ত্র। আমরা কি কখনও এমন কিছু বলতে পারব?
এম সাখাওয়াত হোসেন : সাবেক নির্বাচন কমিশনার, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
যা হোক, উল্লিখিত বইটিতে ভারতের সাবেক সিইসি বেশ বিস্তারিতভাবে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের গঠন এবং এর সাংবিধানিক ক্ষমতা, স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা, নির্বাচন পদ্ধতি, পরিচালনা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। বহু উদাহরণ টেনেছেন বইটিতে, নির্বাচন পরিচালনাকালে বড় বড় চ্যালেঞ্জের বর্ণনা দিয়েছেন। তেমনি ভবিষ্যতে সংস্কারের জন্য বেশকিছু সুপারিশও রেখেছেন। সম্পূর্ণ বইটিতে ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও স্বাধীনতার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। কমিশনের সাংবিধানিক ক্ষমতার বিষয়ে তিনি ভারতীয় উচ্চ আদালতের সহায়ক ভূমিকার কথা বলেছেন, বিশেষ করে ধারা ৩২৪(১)-এর অধিকতর ব্যাখ্যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের গঠন, কাঠামো এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানকল্পে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার বিষয়ে একাধিক রায় ও পর্যবেক্ষণের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ভারতীয় সংবিধানের আওতায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব এককভাবে নির্বাচন কমিশনকে দেয়া হয়েছে। ওই দায়িত্ব পালনে কমিশনের বাইরে কারও হস্তক্ষেপ অথবা প্রভাব বিস্তার সম্পূর্ণভাবে আইন ও সংবিধানবহির্ভূত কর্মকাণ্ড বলে উচ্চতর আদালতের
পর্যবেক্ষণ দেয়া আছে।
ভারতীয় নির্বাচন কমিশনকে কতখানি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে এবং উচ্চ আদালত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে কতখানি বলিষ্ঠ সহায়তা করে থাকে, তার বেশকিছু উদাহরণ কোরাইশি তার বইয়ে উদ্ধৃত করেছেন। উচ্চ আদালতের ১৯৭৮ সালের একটি রিট, এআইআর ১৯৭৮ এসসি ৮৫১ (AIR 1978 SC 851)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, আদালতের রায়ে আলোচিত ধারা ৩২৪(১)-এর অধিকতর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ধারায় বর্ণিত কালা-সাদাতে মোটা দাগের ক্ষমতার উল্লেখই করা হয়েছে মাত্র। এর বাইরেও নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা রয়েছে। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, স্বাধীন কমিশনের গঠন ও দায়িত্ব সংবিধানের মৌলিক কাঠামো, যা সংসদের কোনো আইন দ্বারা পরিবর্তন করা যাবে না। একই সঙ্গে আরও বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনকল্পে উল্লিখিত ধারার বাইরে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এমন যে কোনো ক্ষমতা নির্বাচন কমিশন প্রয়োগ করতে পারবে। এসব ক্ষমতা সংসদ কোনো আইন দ্বারা হ্রাস অথবা স্থগিত করতে পারবে না।
উপরে উল্লিখিত রিটের পর্যবেক্ষণে আরও যা বলা হয়েছে তাতেই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, ক্ষমতা ও স্বাধীনতার বিষয়টি আরও শক্ত ভিত পেয়েছে। এক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট অব ইন্ডিয়া বলেছে, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সময় যে আইন বা বিধি উহ্য অথচ এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যা নিয়ন্ত্রণ না করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে অথবা দায়িত্ব পালনে সমস্যার সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে হাত গুটিয়ে সৃষ্টিকর্তার শরণাপন্ন হওয়া অথবা কমিশনের বাইরে কোনো শক্তির কাছে উপদেশ, নির্দেশ চাওয়ার কোনো প্রয়োজন ও অবকাশ নেই। এখানে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে সমগ্র নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করবে। এক কথায়, নির্বাচন কমিশনের কাজে কোনো ধরনের বাধা, প্রভাব বিস্তার ও হস্তক্ষেপের পর্যায়ে পড়ে এমন কোনো কাজ হবে সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী।
আমি ভারতের নির্বাচন কমিশন ও সংবিধানের ধারার উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, আমাদের ও ভারতের সংবিধানে নির্বাচন কমিশনের গঠন, দায়িত্ব এবং নির্বাচন পরিচালনার প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। ভারতের সংবিধানের ধারা ৩২৪(১)-এ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব যেভাবে বিন্যাস করা হয়েছে, অনুরূপভাবে আমাদের সংবিধানে ধারা ১১৯-এ একই বিষয় সংযোজিত হয়েছে। এমনকি আক্ষরিক অর্থে শব্দ প্রয়োগেও কোনো তফাৎ নেই। ধারা ১১৯-এ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ কথার উল্লেখ রয়েছে। ধারা ১২৬ নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক নির্বাচন কমিশনকে সহায়তার কথা বলা
হয়েছে। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের পর্যবেক্ষণ এবং নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন প্রক্রিয়াকালে অগাধ ক্ষমতা ব্যবহারের বিষয়ের অনুরূপ ব্যাখ্যা ও পর্যবেক্ষণ আমাদের উচ্চ আদালতেও গৃহীত হয়েছে। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত বিষয়টি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ, যা সংবিধানের সপ্তম
অধ্যায় হিসেবে সংযোজিত।
বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে যদি ভারতের ও আমাদের নির্বাচন কমিশনের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা যায় তাহলে প্রতীয়মান হয়, নির্বাচন পরিচালনায় বাংলাদেশের কমিশন, অন্তত আইনের দিক থেকে, উপমহাদেশের অন্যান্য কমিশন থেকে শক্তিশালী। আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন উপরে উল্লিখিত ভারতীয় কমিশনের অনুরূপ ক্ষমতা রাখে। কোথাও কোথাও একটু বেশিই রাখে। তথাপি আমাদের নির্বাচন কমিশন এখনও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারেনি। যতটুকু অগ্রসর হয়, পরবর্তী সময়ে তারও বেশি পেছনে পড়তে হয়। এর একাধিক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর সময় গঠিত নির্বাচন কমিশনগুলোর সমালোচনা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ তেমন না থাকলেও সে ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। অপরদিকে সরকার দ্বারা গঠিত কমিশন প্রথম থেকেই বিতর্কিত হয়ে পড়ে, যদিও ১৯৯১ সালের পর জনাব আবু সাঈদ বাদে এবারই প্রথম রাজনৈতিক সরকারের সময় রাষ্ট্রপতি দ্বারা নিয়োজিত সংক্ষিপ্ত সার্চ-কমিটির মাধ্যমে বর্তমান কমিশন গঠিত হয়েছে। তথাপি বিভিন্ন কারণে কমিশন নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। অবশ্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও শরিকরা এই নিয়োগও সরাসরি গ্রহণ করেনি।
নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা শুধু আইন দ্বারাই সুরক্ষিত নয়, ক্ষমতা প্রয়োগে এবং স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে উচ্চ আদালতসহ দেশের রাজনৈতিক দল এবং সরকারের সব নির্বাহীর সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। যার নিশ্চয়তা বিধানের জন্যই এত আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট বলীয়ান। সে তুলনায় আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশন তেমন সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। আমাদের দেশের দুর্বল রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে নির্বাচন কমিশন অনেকাংশে রাজনৈতিক সরকার ও তার তত্ত্বাবধানে থাকা প্রশাসন থেকে তেমন সহযোগিতা পায় না। তদুপরি অতীতে বিভিন্ন নির্বাচনে, বিশেষ করে রাজনৈতিক সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কখনও সরাসরি আবার কখনও পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে একাধিকবার। বিশেষ করে আমাদের দেশের প্রত্যেক রাজনৈতিক সরকারই প্রশাসনকে দলীয়করণ করেছে, তাদের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার একাধিক প্রমাণ জনসম্মুখে এসেছে। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে মাগুরা এবং ১৯৯৯ সালে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনের বিষয় দুটি বহুল আলোচিত। উভয় ক্ষেত্রেই নির্বাচন কমিশন অসহায় ভূমিকা পালন করেছে। প্রয়োগ করতে পারেনি সংবিধানের ধারা ১১৯ প্রদত্ত ক্ষমতার। মাগুরার নির্বাচনে সরকার ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়েছিল।
আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাও ভারতের অনুরূপ, যদিও ভারতের নির্বাচনী যজ্ঞ বিশ্বে সর্ববৃহৎ। তবে সে অনুপাতে না হলেও বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাও প্রচুর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। আমি মাগুরার নির্বাচনের কথা উল্লেখ করেছি, কারণ ওই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি রাজনৈতিক সরকারের সময়। ওই নির্বাচনে তৎকালীন সরকারি দলের ছত্রছায়ায় যে অব্যবস্থাপনা উদ্ভব হয়েছিল, তাতে নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। একইভাবে ১৯৯৯ সালে আরেক রাজনৈতিক সরকারের তত্ত্বাবধানে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে একজন কমিশনারের উপস্থিতি এবং কিছু ব্যবস্থা নেয়ার পরও ফলাফল জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। ফলে নির্বাচন কমিশন প্রায় ছয় মাস গেজেট স্থগিত রেখেছিল। তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের, বিভিন্ন কারণে, পদত্যাগের পর গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল। অতীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও প্রভাবিত করার যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের নির্বাচনী দুর্নীতির কারণ, আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ধারণা শুধু কাগজ-কলমে আর বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাও ভারতের মতো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্ভর, তবে ভারতের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অতখানি দলদাস নয়, যতখানি আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিটি শাসক দল তৈরি করে থাকে। এটাই বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর পর এ বিষয়টি শুধু চ্যালেঞ্জের মধ্যেই থাকেনি, বরং নির্বাচন কমিশনের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশোধিত সংবিধানের আওতায় ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর নির্বাচনে কী ঘটেছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই নির্বাচন এবং তার অব্যবহিত পরে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে যেভাবে নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে উচ্চ এবং স্থানীয় পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ হয়েছে, তা এখন আর অনুমানভিত্তিক নয় বরং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং সরকারি দলের নির্বাচন সমন্বয়কারী এবং গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সাম্প্রতিক এক বক্তব্য থেকেই প্রমাণিত, যদিও তিনি কয়েকদিন পর অন্য ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তবু তাতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার উপাদান থেকেই যায়। উপজেলা নির্বাচনের অব্যবস্থার প্রেক্ষাপটেই হয়তো ওই সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অনুপস্থিত থেকেছেন। আলোচিত উপদেষ্টা নিজেই তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে যে ধরনের বিষয় জনসম্মুখে নিয়ে এসেছেন তাতে আগামী নির্বাচনকেও, যা এ সরকারের তত্ত্বাবধানেই হবে, আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করবে, যদি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ রাখার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রীয় সহায়ক শক্তি তেমন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিতে না পারে। খবরে প্রকাশ, উপদেষ্টার এহেন বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এমনকি দলের ভেতরেও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক।
জনাব এইচটি ইমামের বক্তব্যের ওপরে নির্বাচন কমিশন তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া না জানালেও ওই বক্তব্য সমগ্র নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকেই যে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। সংবিধানের আলোকে উপদেষ্টার বক্তব্য নির্বাচন পরিচালনায় এক ধরনের হস্তক্ষেপেরই শামিল, যা ধারা ১১৯-এর এবং নির্বাচনী আইনের পরিপন্থী।
আমি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় ভারতের উদাহরণ এ কারণে টেনেছি যে, সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা, নির্বাচনী আইন ও ব্যবস্থাপনা, এমনকি নির্বাচন কমিশনের গঠন একরকম হলেও যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমরা পিছিয়ে আছি তা হল, রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাব। ভারতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পরিচালনায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ অথবা প্রভাব বিস্তার যেমন সরকার, রাজনৈতিক দলও করে না, তেমনি ভারতে বিচার ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনের শক্তি সহায়ক হিসেবে পরিগণিত। আমাদের দেশের রাজনীতিক থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের সদস্যরা নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বললেও তা কার্যকর হতে দেখা যায় না। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে তার দায়িত্ব পালনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ কাম্য হতে পারে না। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হতে পারলে আমাদের দেশে কেন তা হবে না, সেটা ভেবে দেখা দরকার।
পরিশেষে আলোচিত বইয়ের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করব। বইয়ের লেখক বলেছেন, ভারত তিনটি জিনিসের জন্য বিশ্বে অধিক পরিচিত- তাজমহল, মহাত্মা গান্ধী এবং নির্বাচনী গণতন্ত্র। আমরা কি কখনও এমন কিছু বলতে পারব?
এম সাখাওয়াত হোসেন : সাবেক নির্বাচন কমিশনার, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
No comments