টাঙ্গাইলে খান পরিবার চাপে by তানভীর সোহেল ও কামনাশীষ শেখর
টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী খান পরিবারের চার
ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অর্ধশত মামলা হলেও কাউকেই বিচারের সম্মুখীন
হতে হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ফারুক আহমেদ হত্যার ঘটনায় এই
চার ভাইয়ের নাম আসায় নতুন করে চাপে পড়েছে পরিবারটি। প্রথম আলোর
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাদী ও সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে বেশির ভাগ মামলা
আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। কিছু মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার
প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। এভাবে সব মামলা থেকেই অব্যাহতি পেয়েছেন
তাঁরা।
>>সাংসদ আমানুর রহমান খান,মেয়র সহিদুর রহমান খান,জাহিদুর রহমান খান,সানিয়াত খান
খান
পরিবারের চার ভাই হলেন: আওয়ামী লীগের সাংসদ আমানুর রহমান খান (রানা),
টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র সহিদুর রহমান খান (মুক্তি), ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর
রহমান খান (কাকন) ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সানিয়াত খান
(বাপ্পা)। তাঁদের আরেক ভাই আমিনুর রহমান খানের (বাপ্পি) বিরুদ্ধে দুটি
হত্যা মামলাসহ কয়েকটি মামলা ছিল। ২০০৩ সালের নভেম্বরে শহরে নিজ বাড়ির
কাছে খুন হন তিনি।
জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফারুক হত্যা মামলার একাধিক আসামি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এই চার ভাইয়ের সম্পৃক্ততার কথা বলেছেন। এখন তদন্ত চলছে, দ্রুতই তা শেষ হবে। তথ্যপ্রমাণ পেলে তাঁদের আসামি করা হবে। সরকারের সকল পর্যায় থেকে পুলিশকে এমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতা জানান, সম্প্রতি ফারুকের স্ত্রীকে গণভবনে ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। একই বিষয়ে খান পরিবারের বাইরের নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। এর পর থেকেই খান পরিবার রাজনৈতিকভাবে কিছুটা চাপে পড়েছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মামলাটির ব্যাপারে তাঁরা আরও কিছু তথ্যপ্রমাণের অপেক্ষায় আছেন। ফারুককে যিনি সরাসরি গুলি করেছেন, সেই কবিরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া, চার ভাইকে গ্রেপ্তারে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিয়েছেন তাঁরা। উচ্চ আদালতের বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে পুলিশ আশা করছে।
খান পরিবারের দুই ঘনিষ্ঠ আনিসুল ইসলাম (রাজা) এবং মোহাম্মদ আলী যথাক্রমে গত ১৭ আগস্ট ও ৫ সেপ্টেম্বর ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁরা জবানবন্দিতে এই হত্যাকাণ্ডে চার ভাইয়ের জড়িত থাকার কথা জানিয়েছেন। এর পর থেকে আমানুর রহমান, জাহিদুর রহমান ও সানিয়াত এলাকায় আসা বন্ধ করে দেন। তবে সহিদুর রহমান এলাকাতেই আছেন।
সাংসদ আমানুর রহমান গ্রেপ্তার এড়াতে ১৭ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে রিট করেন। আদালত যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া তাঁদের গ্রেপ্তার না করতে পুলিশকে নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে কেন তাঁদের গ্রেপ্তার করা অবৈধ হবে না, তা জানতে চান। আদালতের এই নির্দেশনার পর সাংসদ মাঝেমধ্যে এলাকায় আসতে শুরু করেন।
চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলায় আসামি হয়েছেন বড় ভাই সাংসদ আমানুর রহমান। তাঁর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় ৪৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি হত্যা মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে সরকার। একটি হত্যাসহ দুটি মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে। ৪২টি মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন, কোনোটি আদালত থেকে আবার কোনোটি পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে। আরেক ভাই সহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৬টি। অপর দুই ভাই জাহিদুর রহমান ও সানিয়াত খানের বিরুদ্ধে দুটি হত্যাসহ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এই মুহূর্তে কোনো মামলায় তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা বলেছেন, এখন তিনি কোনো কথা বলতে চান না। তা ছাড়া এলাকায় আগের মতো না থাকায় তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ঢাকায় ন্যাম ভবনে তাঁর বাসায় গিয়ে কথা বলার জন্য সময় চাইলেও ঘনিষ্ঠজনেরা সাড়া দেননি। তবে সাংসদের ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র সহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে তাঁদের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হয়েছে, তার বেশির ভাগই মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক।
ফারুক হত্যা মামলায় তাঁদের নাম আসা প্রসঙ্গে সহিদুর রহমান বলেন, এটা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এতে তাঁরা ও দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁর আশা, এই মিথ্যা অভিযোগ থেকেও তাঁরা অব্যাহতি পাবেন।
যোগাযোগ করা হলে ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমেদ বলেন, ‘কারও নাম উল্লেখ করে কাউকে স্বামীর হত্যাকারী বলিনি। পুলিশের তদন্তে এঁদের নাম এসেছে। তাই এঁরা খুনি হলে অবশ্যই বিচার চাই।’ তাঁকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। বাড়িতে ইট মারা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, মামলা ঠিক পথেই এগোচ্ছে। আরও সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা চলছে। এই মামলায় প্রকৃত খুনিদের আসামি করা হবে।
ভয়ে লড়তে চান না বাদীরা: ২০০৪ সালের অক্টোবরে শহরে খুন হন জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি এম এ রউফ। এর কয়েক দিন আগে খুন হন সাবেক পৌর কমিশনার রুমি চৌধুরী। এই দুটি হত্যায় চার ভাইকে আসামি করে মামলা করা হয়। পুলিশ তদন্ত শেষে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এই মামলা দুটির বিচারকাজ চলছিল জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর মামলা দুটি প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। কিন্তু মামলা বিচারাধীন থাকা, হত্যা মামলা ও রাজনৈতিক কারণে এই মামলা করা হয়নি উল্লেখ করে কমিটি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। পরে ২০১২ সালের নভেম্বরে উপনির্বাচনে বড় ভাই আমানুর রহমান খান সাংসদ নির্বাচিত হলে পরের বছর আবার আবেদন করেন তাঁরা। ২০১৩ সালের শেষ দিকে মামলা দুটি প্রত্যাহারের সুপারিশ করে সরকারের মামলা প্রত্যাহার কমিটি।
রউফ হত্যা মামলার বাদী তাঁর বাবা দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘মামলাটি প্রত্যাহার হচ্ছে শুনেছি। এঁরা ক্ষমতাবান। এঁদের বিরুদ্ধে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কীই-বা করার আছে। কিছু করতে চাই না। কোনো রকমে বেঁচে আছি, সেভাবেই থাকতে চাই।’
আরও তিন মামলার তিন বাদীর অনুরোধ, তাঁদের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা হয়েছে, সেটা যেন প্রকাশ না পায়। তাঁদের বক্তব্য, এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এঁদের বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। এ জন্য মামলা নিয়ে তাঁরা কিছুই ভাবছেন না। আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ আসার পর তা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়েছে। এই সুপারিশের বিরুদ্ধে কেউ কোনো আপত্তি দেয়নি। ফলে এর কার্যক্রম চলছে না।
টাঙ্গাইলের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আকবর আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, কারও কোনো আপত্তি না থাকায় মামলা প্রত্যাহারের আবেদন আদালত গ্রহণ করেছেন। তবে আদালতের অপর একজন আইনজীবী বলেছেন, মামলা দুটি বাতিল হয়ে গেছে, তা এখনো বলা যাবে না। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে এটি আবারও পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।
আরও কয়েকটি মামলার বাদীর সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেছেন, খান ভাইদের বিরুদ্ধে করা মামলা নিয়ে কথা বলে তাঁরা আর নতুন করে বিপদে পড়তে চান না। কোনো রকমে এলাকায় আছেন, সেভাবেই থাকতে চান।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাদীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেন খান পরিবারের সদস্যরা। মামলা নিয়ে পুলিশ ও আদালতে দৌড়ঝাঁপ করা তো দূরের কথা, অন্তত চারটি বাদী পরিবার এখন এলাকাছাড়া হয়েছে। তারা এখন আর শহরে থাকে না। একটি পরিবারের কয়েকজন নারী সদস্য শুধু নিয়মিত বাসায় থাকেন। ছেলে সদস্যরা ঢাকা বা অন্য কোথাও থাকছেন।
মামলা চলছে না কেন, জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, বাদীদের অসহযোগিতার কারণে অনেক মামলাই আর চলেনি। তবে এ জন্য বাদীদের দোষ দেওয়া যায় না। নানা কারণে তাঁরা মামলা চালাতে চাননি। পুলিশেরও কিছু দায় ছিল।
এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ’৯৭ সালের এপ্রিলে টাঙ্গাইল শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম তালুকদার খুন হন। ঘটনার পর তাঁর চাচা মতিয়ার রহমান তালুকদার বাদী হয়ে মামলা করেন। তদন্তে দুই ভাই মেয়র সহিদুর রহমান ও আমিনুর রহমানের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে আসে। তাঁদের গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তদন্ত আর এগোয়নি।
১৯৯৯ সালের মে মাসে শহর ছাত্রলীগের সভাপতি খোরশেদ আলম খুন হন। তিনি খান পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু দরপত্র নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে খান পরিবারের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। খোরশেদের মা মাজেদা বেগম বাদী হয়ে তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু পুলিশ খান পরিবারের তিন ভাইয়ের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এর বিরুদ্ধে মাজেদা বেগম নারাজি জানালেও ফলাফল শূন্য।
এদিকে ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় গণভবনে ফারুকের স্ত্রী নাহারকে ডেকে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নাহার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বিচারের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। খুনিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করলে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, খুনি যে-ই হোক, তাদের ছাড় নেই। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাহার জানান, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, কাদের সিদ্দিকীর মতো নেতাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কোনো নেতাই দলের চেয়ে বড় নয়।
খান পরিবারের নেতাদের বাইরে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন। তিনি পৃথক সময়ে টাঙ্গাইলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী খান ও সিদ্দিকী দুই পরিবারেরই সমালোচনা করেন বলে স্থানীয় নেতারা জানান।
জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফারুক হত্যা মামলার একাধিক আসামি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এই চার ভাইয়ের সম্পৃক্ততার কথা বলেছেন। এখন তদন্ত চলছে, দ্রুতই তা শেষ হবে। তথ্যপ্রমাণ পেলে তাঁদের আসামি করা হবে। সরকারের সকল পর্যায় থেকে পুলিশকে এমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় একাধিক নেতা জানান, সম্প্রতি ফারুকের স্ত্রীকে গণভবনে ডেকে নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। একই বিষয়ে খান পরিবারের বাইরের নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। এর পর থেকেই খান পরিবার রাজনৈতিকভাবে কিছুটা চাপে পড়েছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মামলাটির ব্যাপারে তাঁরা আরও কিছু তথ্যপ্রমাণের অপেক্ষায় আছেন। ফারুককে যিনি সরাসরি গুলি করেছেন, সেই কবিরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া, চার ভাইকে গ্রেপ্তারে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব দিয়েছেন তাঁরা। উচ্চ আদালতের বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে পুলিশ আশা করছে।
খান পরিবারের দুই ঘনিষ্ঠ আনিসুল ইসলাম (রাজা) এবং মোহাম্মদ আলী যথাক্রমে গত ১৭ আগস্ট ও ৫ সেপ্টেম্বর ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁরা জবানবন্দিতে এই হত্যাকাণ্ডে চার ভাইয়ের জড়িত থাকার কথা জানিয়েছেন। এর পর থেকে আমানুর রহমান, জাহিদুর রহমান ও সানিয়াত এলাকায় আসা বন্ধ করে দেন। তবে সহিদুর রহমান এলাকাতেই আছেন।
সাংসদ আমানুর রহমান গ্রেপ্তার এড়াতে ১৭ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে রিট করেন। আদালত যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ ছাড়া তাঁদের গ্রেপ্তার না করতে পুলিশকে নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে কেন তাঁদের গ্রেপ্তার করা অবৈধ হবে না, তা জানতে চান। আদালতের এই নির্দেশনার পর সাংসদ মাঝেমধ্যে এলাকায় আসতে শুরু করেন।
চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলায় আসামি হয়েছেন বড় ভাই সাংসদ আমানুর রহমান। তাঁর বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় ৪৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি হত্যা মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে সরকার। একটি হত্যাসহ দুটি মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে। ৪২টি মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন, কোনোটি আদালত থেকে আবার কোনোটি পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে। আরেক ভাই সহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৬টি। অপর দুই ভাই জাহিদুর রহমান ও সানিয়াত খানের বিরুদ্ধে দুটি হত্যাসহ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এই মুহূর্তে কোনো মামলায় তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা বলেছেন, এখন তিনি কোনো কথা বলতে চান না। তা ছাড়া এলাকায় আগের মতো না থাকায় তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। ঢাকায় ন্যাম ভবনে তাঁর বাসায় গিয়ে কথা বলার জন্য সময় চাইলেও ঘনিষ্ঠজনেরা সাড়া দেননি। তবে সাংসদের ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র সহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে তাঁদের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হয়েছে, তার বেশির ভাগই মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক।
ফারুক হত্যা মামলায় তাঁদের নাম আসা প্রসঙ্গে সহিদুর রহমান বলেন, এটা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। এতে তাঁরা ও দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁর আশা, এই মিথ্যা অভিযোগ থেকেও তাঁরা অব্যাহতি পাবেন।
যোগাযোগ করা হলে ফারুক আহমেদের স্ত্রী নাহার আহমেদ বলেন, ‘কারও নাম উল্লেখ করে কাউকে স্বামীর হত্যাকারী বলিনি। পুলিশের তদন্তে এঁদের নাম এসেছে। তাই এঁরা খুনি হলে অবশ্যই বিচার চাই।’ তাঁকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। বাড়িতে ইট মারা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, মামলা ঠিক পথেই এগোচ্ছে। আরও সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড়ের চেষ্টা চলছে। এই মামলায় প্রকৃত খুনিদের আসামি করা হবে।
ভয়ে লড়তে চান না বাদীরা: ২০০৪ সালের অক্টোবরে শহরে খুন হন জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি এম এ রউফ। এর কয়েক দিন আগে খুন হন সাবেক পৌর কমিশনার রুমি চৌধুরী। এই দুটি হত্যায় চার ভাইকে আসামি করে মামলা করা হয়। পুলিশ তদন্ত শেষে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এই মামলা দুটির বিচারকাজ চলছিল জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর মামলা দুটি প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। কিন্তু মামলা বিচারাধীন থাকা, হত্যা মামলা ও রাজনৈতিক কারণে এই মামলা করা হয়নি উল্লেখ করে কমিটি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। পরে ২০১২ সালের নভেম্বরে উপনির্বাচনে বড় ভাই আমানুর রহমান খান সাংসদ নির্বাচিত হলে পরের বছর আবার আবেদন করেন তাঁরা। ২০১৩ সালের শেষ দিকে মামলা দুটি প্রত্যাহারের সুপারিশ করে সরকারের মামলা প্রত্যাহার কমিটি।
রউফ হত্যা মামলার বাদী তাঁর বাবা দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘মামলাটি প্রত্যাহার হচ্ছে শুনেছি। এঁরা ক্ষমতাবান। এঁদের বিরুদ্ধে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কীই-বা করার আছে। কিছু করতে চাই না। কোনো রকমে বেঁচে আছি, সেভাবেই থাকতে চাই।’
আরও তিন মামলার তিন বাদীর অনুরোধ, তাঁদের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা হয়েছে, সেটা যেন প্রকাশ না পায়। তাঁদের বক্তব্য, এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এঁদের বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। এ জন্য মামলা নিয়ে তাঁরা কিছুই ভাবছেন না। আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ আসার পর তা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়েছে। এই সুপারিশের বিরুদ্ধে কেউ কোনো আপত্তি দেয়নি। ফলে এর কার্যক্রম চলছে না।
টাঙ্গাইলের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আকবর আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, কারও কোনো আপত্তি না থাকায় মামলা প্রত্যাহারের আবেদন আদালত গ্রহণ করেছেন। তবে আদালতের অপর একজন আইনজীবী বলেছেন, মামলা দুটি বাতিল হয়ে গেছে, তা এখনো বলা যাবে না। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে এটি আবারও পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।
আরও কয়েকটি মামলার বাদীর সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা প্রথম আলোকে বলেছেন, খান ভাইদের বিরুদ্ধে করা মামলা নিয়ে কথা বলে তাঁরা আর নতুন করে বিপদে পড়তে চান না। কোনো রকমে এলাকায় আছেন, সেভাবেই থাকতে চান।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাদীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেন খান পরিবারের সদস্যরা। মামলা নিয়ে পুলিশ ও আদালতে দৌড়ঝাঁপ করা তো দূরের কথা, অন্তত চারটি বাদী পরিবার এখন এলাকাছাড়া হয়েছে। তারা এখন আর শহরে থাকে না। একটি পরিবারের কয়েকজন নারী সদস্য শুধু নিয়মিত বাসায় থাকেন। ছেলে সদস্যরা ঢাকা বা অন্য কোথাও থাকছেন।
মামলা চলছে না কেন, জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, বাদীদের অসহযোগিতার কারণে অনেক মামলাই আর চলেনি। তবে এ জন্য বাদীদের দোষ দেওয়া যায় না। নানা কারণে তাঁরা মামলা চালাতে চাননি। পুলিশেরও কিছু দায় ছিল।
এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ’৯৭ সালের এপ্রিলে টাঙ্গাইল শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম তালুকদার খুন হন। ঘটনার পর তাঁর চাচা মতিয়ার রহমান তালুকদার বাদী হয়ে মামলা করেন। তদন্তে দুই ভাই মেয়র সহিদুর রহমান ও আমিনুর রহমানের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে আসে। তাঁদের গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদও করে পুলিশ। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তদন্ত আর এগোয়নি।
১৯৯৯ সালের মে মাসে শহর ছাত্রলীগের সভাপতি খোরশেদ আলম খুন হন। তিনি খান পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু দরপত্র নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে খান পরিবারের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। খোরশেদের মা মাজেদা বেগম বাদী হয়ে তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু পুলিশ খান পরিবারের তিন ভাইয়ের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এর বিরুদ্ধে মাজেদা বেগম নারাজি জানালেও ফলাফল শূন্য।
এদিকে ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় গণভবনে ফারুকের স্ত্রী নাহারকে ডেকে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নাহার আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বিচারের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। খুনিদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করলে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, খুনি যে-ই হোক, তাদের ছাড় নেই। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাহার জানান, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন, কাদের সিদ্দিকীর মতো নেতাকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কোনো নেতাই দলের চেয়ে বড় নয়।
খান পরিবারের নেতাদের বাইরে আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন। তিনি পৃথক সময়ে টাঙ্গাইলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী খান ও সিদ্দিকী দুই পরিবারেরই সমালোচনা করেন বলে স্থানীয় নেতারা জানান।
No comments