ধন্যবাদ, শারমিন আহমদ by আমিরুল ইসলাম কাগজী
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদ প্রথম আলো পত্রিকায় ‘স্বাধীনতার অখণ্ডিত ইতিহাস ভবিষ্যতের পাথেয়’ শীর্ষক প্রতিক্রিয়া লিখে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে নতুন কিছু বলার চেষ্টা করেছেন যা তার বইতে উল্লেখ আছে বলে তিনি দাবি করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামালপুরের জনসভায় দেয়া বক্তব্য তুলে ধরে একচোট নেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমার লেখা তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা বইটি, যার কিছু ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ ুদ্র ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য যেসব রাজনীতিবিদ খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করছেন এবং তাদের প্রতি যারা আমার বইটিকে সম্পূর্ণ না পড়েই অথবা বইয়ে উল্লিখিত বিবরণ সত্য হলেও তার মধ্যে কিছু অংশ তাদের পছন্দনীয় না হওয়ায়, তারা কোনো যুক্তিবুদ্ধির অবতারণা না ঘটিয়ে, তথ্যে কোথায় ভুল উল্লেখ না করে, তারা এই লেখকের বিরুদ্ধে অশালীন, নির্লজ্জ, মিথ্যা প্রচারণা ও ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়েছেন।’
পরের অংশে লিখেছেন, ‘সম্প্রতি বিএনপির সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জামালপুরের জনসভায় (২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪) তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা বই থেকে আমার লেখার উদ্ধৃতি (৫৯-৬০ পৃষ্ঠা) দিয়ে বলেছেন, তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে এনেছিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেননি। তিনি সচেষ্ট থাকেন এ কথা প্রমাণ করতে যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। বক্তব্যে তিনি অনুল্লিখিত রাখেন আমার বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাকি অংশগুলোর বর্ণনা। বঙ্গবন্ধু আমার বাবা বা দলকে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও তিনি যে ভিন্ন মাধ্যমে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা তথ্য ও সারাৎসারসহ আমার বইয়ে স্পষ্ট উল্লিখিত (তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা ১৪৭-১৪৮, ২৭৪-২৯১, ৩০১-৩১০ পৃষ্ঠা)।’
শারমিন, আপনাকে ধন্যবাদ অনেক কষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক বইটি উপহার দেয়ার জন্য। তবে সবাই যে আপনার বইটি সম্পূর্ণ পড়বে এমনটি আশা করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কেউ যে আপনার বইটি সম্পূর্ণ পড়েনি এমন ভাবারও অবকাশ নেই। রাজনীতিবিদেরা আপনার বই হয়তো সম্পূর্ণ পড়েননি। কিন্তু যেটুকু তাদের দরকার সেখান থেকে উদ্ধৃত করতে ভুল করেছেন কি না সেটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত। খালেদা জিয়া সে ক্ষেত্রে কোনো ভুল করেননি।
শেখ মুজিব যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, তা আপনার পিতা তাজউদ্দীন আহমদ স্পষ্ট করে দিয়েছেন। মেজর জিয়াউর রহমানই যে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং প্রথম স্বাধীন বাংলার সরকার গঠন করেছিলেন সেটা তার ১০ এপ্রিলের ভাষণেই উল্লেখ আছে (আপনার বইয়ের ৩৯৭ পৃষ্ঠায় ১০ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিনটিতে তাজউদ্দীন আহমদের সম্পূর্ণ ভাষণ উল্লিখিত হয়েছে)। মঈদুল হাসান মূলধারা ৭১ এবং অতি সম্প্রতি এ কে খন্দকার তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, তিনি ২৭ মার্চ রেডিওতে প্রথম মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনেন (স্বাধীনতার দলিল খণ্ড ১৫)।
এ ছাড়া তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি বক্তব্যে আছে সে কথা। তিনি ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাষণ দেন তাতে তিনি বলেন, The cry for Independence (of Bangldesh) arose after Sheikh Mujib was arrested and not before.He (Mujib) himself, so far as I know, has not asked for Independence even now…অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রশ্ন ওঠে (বাংলাদেশের) শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পর, তার আগে নয়। আমি যত দূর জানি আজ পর্যন্ত শেখ মুজিব স্বাধীনতা দাবি করেননি। (অলি আহাদ : জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ খেকে ৭৫)।
এসব উল্লেখযোগ্য কোনো নেতার কথায় বিশ্বাস রাখতে পারেননি শারমিন আহমদ। তাই তিনি ছুটে গিয়েছেন শেখ মুজিবের পারসোনাল এইড হাজী গোলাম মোরশেদের বাসায় যাকে তিনি শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার একমাত্র জীবিত সাক্ষী বলে মনে করেন। কিন্তু সেখানে তিনি একরাশ হতাশা ছাড়া আর কিছুই উপহার দিতে পারেননি। কারণ হাজী গোলাম মোরশেদ এই ঘোষণাপত্রটির গ্রহণকারী হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছেন, চট্টগ্রামের সেই আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এমন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করার কথা তার জীবদ্দশায় বলে যাননি (দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের দলিল খণ্ড ১৫)। আর যে প্রকৌশলীর কথা বলা হয়েছে যিনি ট্রান্সমিটার সাপ্লাই দিয়েছেন বলে ধরা হয়, সেই ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হকের আপন খালাতো ভাই আমিনুল হক বাদশা ২৫ মার্চ রাতে কী ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটা একবার দেখা যাকÑ শেখ মুজিবের নির্দেশে তার প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশা (রাশেদুল হক নবার বড় ভাই) ২৫ মার্চ রাতে সাংবাদিকদের ডেকে সারা দেশে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ সর্বাত্মক হরতালের কথা জানিয়ে দেন।
ওই রাতে আওয়ামী লীগের আরো বহু বড় বড় নেতা ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কাউকেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলে যাননি; এমনকি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ফাঁসানো হবে বলে সবক দিতেও তিনি ভুল করেননি।
তবে শারমিন আহমদ এই লেখায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তার পিতার ভাষণের কথা উল্লেখ করে কিছুটা হলেও আওয়ামী বুদ্ধিজীবী মহলের তোতা মুখ ভোঁতা করে দিয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমদের সে দিনের ভাষণের পুরো অংশ তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই নির্বাচিত অংশ তুলে ধরছি, ‘এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি বেতার কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। আপাতত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত এলাকায় (সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা-পৃষ্ঠা ৩৯৯)।
তাজউদ্দীন তার ভাষণের মধ্য দিয়ে দুটো বিষয় স্পষ্ট করেছেন :
০১. মেজর জিয়াউর রহমানই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর অর্থাৎ তিনিই স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক। ০২. চট্টগ্রামেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হয় এবং জিয়াউর রহমানই সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সরকারপ্রধান অর্থাৎ প্রথম প্রেসিডেন্ট। তার ভাষায় বলতে গেলে, ২৬ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার শপথ নেয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনিই ছিলেন প্রেসিডেন্ট। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে এই দাবি করেছেন বলে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের গাত্রদাহ হয়েছিল। ০৩. মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার তার লেখা ১৯৭১ : ভেতরে বাইরে বইটিতে লিখেছেন ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান প্রথম যে ঘোষণা দেন, সেখানে তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেছিলেন, তবে পরে তিনি সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
শারমিন, আপনাকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাতে চাই খালেদা জিয়ার আরেকটি বক্তব্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য। সেটা এখানে তুলে ধরছি, “বেগম জিয়া তার সে দিনের বক্তব্যে আরো বলেন, ‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে দেশ স্বাধীন হতো না। শেখ সাহেব জেল থেকে বের হতেন কি না, সেটাও সন্দেহ ছিল।’ তার এই বক্তব্য ইতিহাসনির্ভর নয়। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করে, তখন জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারো স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য তারা অপেক্ষা করেনি। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা নিঃসন্দেহে জনগণের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু বিশ্ব ইতিহাস এটাই বলে যে, স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেই তো একটি দেশ স্বাধীন হয়ে যায় না। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ধাপে ধাপে মুক্তির আকাক্সায় পরিণত হয়ে স্বাধীনতার দুয়ারে পৌঁছেছিল দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ফলে (৭১ পৃষ্ঠা)।
এ প্রসঙ্গে এ কে খন্দকার বলেন, ‘মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি প্রচারের ফলে সারা দেশের ভেতরে ও সীমান্তে যারা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে জিয়ার ভাষণটি বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন জাতিকে কিছুটা হলেও শক্তি ও সাহস যোগায়। যুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শুনেছি এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময়ও শুনেছি, মেজর জিয়ার ঘোষণাটি তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে কতটা উদ্দীপ্ত করেছিল। মেজর জিয়ার ঘোষণায় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, হ্যাঁ, এইবার বাংলাদেশ সত্যিই একটা যুদ্ধে নেমেছে। ’
শারমিন আহমদ, আপনি আপনার বইতে ২৫ মার্চ রাতে ৩২ নম্বর রোডে আপনার ‘মুজিব কাকু’র কাছে আপনার পিতার স্বাধীনতার ঘোষণাসংবলিত ক্যাসেট নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে কিংবা লিখিত বিবৃতি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কোনো অন্যায় করেননি। আপনি ইতিহাসের সত্যটাই তুলে ধরেছেন মাত্র। এ কথাগুলো ইতঃপূর্বে অনেকেই বলেছেন, কিন্তু অবস্থানগত কারণে সেগুলো এত আলোচনায় আসেনি। আপনার সাথে আমিও একমত যে, বিগত শতাব্দীতে আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধকে কখনোই খণ্ডিতভাবে দেখতে চাই না। কিন্তু আপনি আপনার অজান্তেই স্বাধীনতার ইতিহাসকে খণ্ডিত করেছেন। আপনার লেখা দিয়ে আপনি আপনার পিতার অবদান ষোল আনা আদায় করে নিয়েছেন। আপনার মুজিব কাকুর অবদানও স্বীকার করেছেন। শুধু জিয়াউর রহমানের অবদান খাটো করতে গিয়ে শেখ মুজিবের পার্সোনাল এইড গোলাম মোরশেদকে মহীয়ান করতে ভুলে যাননি।
শেষ করব যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা বলে। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই আমেরিকা যখন গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন সেখানে যার যতটুকু অবদান তার ততটুকু মর্যাদা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রবাসী। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দান এবং স্বাধীনতার দলিলে স্বাক্ষর করার জন্য পাঁচজন নেতা জাতির পিতার স্বীকৃতি পান; তারা হলেন শেরম্যান, ফ্রাঙ্কলিন, জেফারসন, অ্যাডামস ও লিভিংস্টোন।
লেখক : সাংবাদিক
পরের অংশে লিখেছেন, ‘সম্প্রতি বিএনপির সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জামালপুরের জনসভায় (২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪) তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা বই থেকে আমার লেখার উদ্ধৃতি (৫৯-৬০ পৃষ্ঠা) দিয়ে বলেছেন, তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে এনেছিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেননি। তিনি সচেষ্ট থাকেন এ কথা প্রমাণ করতে যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। বক্তব্যে তিনি অনুল্লিখিত রাখেন আমার বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে উল্লিখিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাকি অংশগুলোর বর্ণনা। বঙ্গবন্ধু আমার বাবা বা দলকে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও তিনি যে ভিন্ন মাধ্যমে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা তথ্য ও সারাৎসারসহ আমার বইয়ে স্পষ্ট উল্লিখিত (তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা ১৪৭-১৪৮, ২৭৪-২৯১, ৩০১-৩১০ পৃষ্ঠা)।’
শারমিন, আপনাকে ধন্যবাদ অনেক কষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক বইটি উপহার দেয়ার জন্য। তবে সবাই যে আপনার বইটি সম্পূর্ণ পড়বে এমনটি আশা করা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কেউ যে আপনার বইটি সম্পূর্ণ পড়েনি এমন ভাবারও অবকাশ নেই। রাজনীতিবিদেরা আপনার বই হয়তো সম্পূর্ণ পড়েননি। কিন্তু যেটুকু তাদের দরকার সেখান থেকে উদ্ধৃত করতে ভুল করেছেন কি না সেটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত। খালেদা জিয়া সে ক্ষেত্রে কোনো ভুল করেননি।
শেখ মুজিব যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, তা আপনার পিতা তাজউদ্দীন আহমদ স্পষ্ট করে দিয়েছেন। মেজর জিয়াউর রহমানই যে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং প্রথম স্বাধীন বাংলার সরকার গঠন করেছিলেন সেটা তার ১০ এপ্রিলের ভাষণেই উল্লেখ আছে (আপনার বইয়ের ৩৯৭ পৃষ্ঠায় ১০ এপ্রিল প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিনটিতে তাজউদ্দীন আহমদের সম্পূর্ণ ভাষণ উল্লিখিত হয়েছে)। মঈদুল হাসান মূলধারা ৭১ এবং অতি সম্প্রতি এ কে খন্দকার তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, তিনি ২৭ মার্চ রেডিওতে প্রথম মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা শোনেন (স্বাধীনতার দলিল খণ্ড ১৫)।
এ ছাড়া তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি বক্তব্যে আছে সে কথা। তিনি ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাষণ দেন তাতে তিনি বলেন, The cry for Independence (of Bangldesh) arose after Sheikh Mujib was arrested and not before.He (Mujib) himself, so far as I know, has not asked for Independence even now…অর্থাৎ স্বাধীনতার প্রশ্ন ওঠে (বাংলাদেশের) শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পর, তার আগে নয়। আমি যত দূর জানি আজ পর্যন্ত শেখ মুজিব স্বাধীনতা দাবি করেননি। (অলি আহাদ : জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ খেকে ৭৫)।
এসব উল্লেখযোগ্য কোনো নেতার কথায় বিশ্বাস রাখতে পারেননি শারমিন আহমদ। তাই তিনি ছুটে গিয়েছেন শেখ মুজিবের পারসোনাল এইড হাজী গোলাম মোরশেদের বাসায় যাকে তিনি শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার একমাত্র জীবিত সাক্ষী বলে মনে করেন। কিন্তু সেখানে তিনি একরাশ হতাশা ছাড়া আর কিছুই উপহার দিতে পারেননি। কারণ হাজী গোলাম মোরশেদ এই ঘোষণাপত্রটির গ্রহণকারী হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছেন, চট্টগ্রামের সেই আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান এমন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করার কথা তার জীবদ্দশায় বলে যাননি (দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের দলিল খণ্ড ১৫)। আর যে প্রকৌশলীর কথা বলা হয়েছে যিনি ট্রান্সমিটার সাপ্লাই দিয়েছেন বলে ধরা হয়, সেই ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হকের আপন খালাতো ভাই আমিনুল হক বাদশা ২৫ মার্চ রাতে কী ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটা একবার দেখা যাকÑ শেখ মুজিবের নির্দেশে তার প্রেস সচিব আমিনুল হক বাদশা (রাশেদুল হক নবার বড় ভাই) ২৫ মার্চ রাতে সাংবাদিকদের ডেকে সারা দেশে হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ সর্বাত্মক হরতালের কথা জানিয়ে দেন।
ওই রাতে আওয়ামী লীগের আরো বহু বড় বড় নেতা ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কাউকেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলে যাননি; এমনকি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ফাঁসানো হবে বলে সবক দিতেও তিনি ভুল করেননি।
তবে শারমিন আহমদ এই লেখায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তার পিতার ভাষণের কথা উল্লেখ করে কিছুটা হলেও আওয়ামী বুদ্ধিজীবী মহলের তোতা মুখ ভোঁতা করে দিয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমদের সে দিনের ভাষণের পুরো অংশ তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই নির্বাচিত অংশ তুলে ধরছি, ‘এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি বেতার কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। আপাতত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত এলাকায় (সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা-পৃষ্ঠা ৩৯৯)।
তাজউদ্দীন তার ভাষণের মধ্য দিয়ে দুটো বিষয় স্পষ্ট করেছেন :
০১. মেজর জিয়াউর রহমানই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর অর্থাৎ তিনিই স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক। ০২. চট্টগ্রামেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হয় এবং জিয়াউর রহমানই সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সরকারপ্রধান অর্থাৎ প্রথম প্রেসিডেন্ট। তার ভাষায় বলতে গেলে, ২৬ মার্চ থেকে ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী সরকার শপথ নেয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তিনিই ছিলেন প্রেসিডেন্ট। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে এই দাবি করেছেন বলে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের গাত্রদাহ হয়েছিল। ০৩. মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার তার লেখা ১৯৭১ : ভেতরে বাইরে বইটিতে লিখেছেন ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান প্রথম যে ঘোষণা দেন, সেখানে তিনি নিজেকে প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করেছিলেন, তবে পরে তিনি সংশোধন করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
শারমিন, আপনাকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাতে চাই খালেদা জিয়ার আরেকটি বক্তব্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য। সেটা এখানে তুলে ধরছি, “বেগম জিয়া তার সে দিনের বক্তব্যে আরো বলেন, ‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে দেশ স্বাধীন হতো না। শেখ সাহেব জেল থেকে বের হতেন কি না, সেটাও সন্দেহ ছিল।’ তার এই বক্তব্য ইতিহাসনির্ভর নয়। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করে, তখন জাতি স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারো স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য তারা অপেক্ষা করেনি। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা নিঃসন্দেহে জনগণের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু বিশ্ব ইতিহাস এটাই বলে যে, স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেই তো একটি দেশ স্বাধীন হয়ে যায় না। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন ধাপে ধাপে মুক্তির আকাক্সায় পরিণত হয়ে স্বাধীনতার দুয়ারে পৌঁছেছিল দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ফলে (৭১ পৃষ্ঠা)।
এ প্রসঙ্গে এ কে খন্দকার বলেন, ‘মেজর জিয়ার এই ঘোষণাটি প্রচারের ফলে সারা দেশের ভেতরে ও সীমান্তে যারা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তাদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাংঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে জিয়ার ভাষণটি বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন জাতিকে কিছুটা হলেও শক্তি ও সাহস যোগায়। যুদ্ধের সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে শুনেছি এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময়ও শুনেছি, মেজর জিয়ার ঘোষণাটি তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে কতটা উদ্দীপ্ত করেছিল। মেজর জিয়ার ঘোষণায় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, হ্যাঁ, এইবার বাংলাদেশ সত্যিই একটা যুদ্ধে নেমেছে। ’
শারমিন আহমদ, আপনি আপনার বইতে ২৫ মার্চ রাতে ৩২ নম্বর রোডে আপনার ‘মুজিব কাকু’র কাছে আপনার পিতার স্বাধীনতার ঘোষণাসংবলিত ক্যাসেট নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে কিংবা লিখিত বিবৃতি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কোনো অন্যায় করেননি। আপনি ইতিহাসের সত্যটাই তুলে ধরেছেন মাত্র। এ কথাগুলো ইতঃপূর্বে অনেকেই বলেছেন, কিন্তু অবস্থানগত কারণে সেগুলো এত আলোচনায় আসেনি। আপনার সাথে আমিও একমত যে, বিগত শতাব্দীতে আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধকে কখনোই খণ্ডিতভাবে দেখতে চাই না। কিন্তু আপনি আপনার অজান্তেই স্বাধীনতার ইতিহাসকে খণ্ডিত করেছেন। আপনার লেখা দিয়ে আপনি আপনার পিতার অবদান ষোল আনা আদায় করে নিয়েছেন। আপনার মুজিব কাকুর অবদানও স্বীকার করেছেন। শুধু জিয়াউর রহমানের অবদান খাটো করতে গিয়ে শেখ মুজিবের পার্সোনাল এইড গোলাম মোরশেদকে মহীয়ান করতে ভুলে যাননি।
শেষ করব যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ইতিহাসের কথা বলে। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই আমেরিকা যখন গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন সেখানে যার যতটুকু অবদান তার ততটুকু মর্যাদা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রবাসী। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দান এবং স্বাধীনতার দলিলে স্বাক্ষর করার জন্য পাঁচজন নেতা জাতির পিতার স্বীকৃতি পান; তারা হলেন শেরম্যান, ফ্রাঙ্কলিন, জেফারসন, অ্যাডামস ও লিভিংস্টোন।
লেখক : সাংবাদিক
No comments