টাঙ্গাইলে ২১০০ বিঘা জমির মালিক লতিফ সিদ্দিকী ও তার স্ত্রী-পুত্র by মো. কামাল হোসেন
আবদুল লতিফ সিদ্দিকীসহ স্ত্রী-পুত্র এখন প্রায় ২১ শ’ বিঘা জমির মালিক। আর এ সব জমি সরকারি খাস ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে জোর করে এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্য দিয়ে তিনি লিখে নিয়েছেন। আর এসব কাজে সহায়তা করেছে তারই ঘনিষ্ঠ এলাকার ক্যাডার বাহিনী। এ নিয়ে লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, নিজের জমি বাঁচাতে গিয়ে উল্টো জেল খাটতে হয়েছে জমির মালিকদের। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে সরকারি খাসজমি দখল এবং বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে জোর করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্য দিয়ে লিখে নিয়ে জমিদার বনে গেছে লতিফ সিদ্দিকীর পরিবার। স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইল শহরের আকুরটাকুরপাড়ায় সরকারি ৭৯ শতাংশের একটি বাড়ি জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লিজ নিয়ে বসবাস করেন লতিফ সিদ্দিকী। এরপর জাল দলিল সৃষ্টি করে সরকারি আইন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মামলায় তার নামে ডিগ্রি নিয়ে নেন। আর এ জমির আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কালিহাতীর নাগবাড়ী ইউনিয়নের পশ্চিম পাকুটিয়া গ্রামের মজিদ ও রশিদের ১১৫ শতাংশ জমি দখল করে সেখানে গড়ে তুলেছেন রূপসী টেক্সটাইল কারখানা। এ কারখানার মালিক লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী। কালিহাতী উপজেলায় ছাতিহাটি-এলেঙ্গা সড়কের ঠিক পাশেই ছিল একটি গরুর খামার, সঙ্গে বিশাল পুকুর, দু’টি টিনশেড ঘর, নানা জাতের গাছগাছালি। ১১৫ শতাংশ আয়তনের এ জমির মালিক দুই ভাই আবদুল মজিদ ও আবদুর রশিদ। জমিটি কেনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই তৎপর ছিলেন তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। কিন্তু মজিদ আর রশিদ বাপ-দাদার জমি বিক্রি করতে রাজি হননি। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী নাছোড়বান্দা। শেষে দুই ভাইয়ের নামে দেন চুরি ও ছিনতাইয়ের মিথ্যা মামলা। সেই মামলায় পুলিশ রশিদ ও তার ভাইপো আনোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তারও করে। দু’দিন পরই অবশ্য জামিন পান তারা। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন তাদের খামার, ঘর, গাছগাছালির চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে ওই সব স্থাপনা। পুকুরটাও ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এক রাতের মধ্যে জমিটি দখল করে ফেলেন লতিফ সিদ্দিকী। রশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মন্ত্রী তার ক্ষমতার জোরেই আমাদের জমি দখলে নিয়েছেন। জমির সব বৈধ কাগজপত্র আমাদের কাছে আছে। জমির দাম দেয়া তো দূরের কথা, উল্টো আমাকে ও আমার ভাইপোকে চুরি ও ছিনতাইয়ের মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছিলেন। আমরা জেলে যাওয়ার পর জমি দখলে নেয় মন্ত্রীর লোকজন। দুই দিনের মধ্যে সেখানকার সব স্থাপনা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। পুকুর ভরাট করে ফেলে। মালামালও লুট করে নিয়ে যায়। শুধু মজিদ ও রশিদ নয়, একই গ্রামের ইদ্রিস আলী, সবুর আলী, ইউসুফ আলী ও শাহজাহান আলীসহ পাঁচ পরিবারের ১২৫ শতাংশ জমির মালিকও এখন লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী। নামমাত্র মূল্যে বসতবাড়িসহ তাদের জমি স্ত্রীর নামে কিনে নিয়েছেন লতিফ সিদ্দিকী। কেবল বায়নার টাকা দিয়েই জমির দখল নিয়েছেন তিনি। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতি শতাংশ জমির মূল্য দুই থেকে তিন লাখ টাকা। কিন্তু তাদের দেয়ার কথা ছিল এক লাখ ১০ হাজার টাকা করে। সেই টাকারও পুরোটা দেয়া হয়নি। শাহজাহান আলী বললেন, ‘আট বছর সৌদি আরবে ছিলাম। দেশে ফিরে নিজের জমিতে নতুন ঘর তুলেছিলাম। কিন্তু থাকার ভাগ্য হলো না। জমিটি বিক্রির জন্য চাপ দিতে থাকে লতিফ সিদ্দিকীর লোকজন। এক পর্যায়ে বিক্রি করতে বাধ্য হন। জমির দাম ২০ লাখ টাকারও বেশি। অথচ দিয়েছে মাত্র ১০ লাখ টাকা। ভয়ে মুখ খুলতে পারিনি।’ এভাবে দখল ও নামমাত্র মূল্যে পশ্চিম পাকুটিয়া গ্রামের অর্ধশতাধিক লোকের কাছ থেকে ৪০০ বিঘার বেশি জমির মালিক হয়েছেন লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী। ছাতিহাটিতে তার নামে লতিফ সিদ্দিকীর হয়ে জমি কিনেছেন নাগবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মিল্টন সিদ্দিকী, সুধীর কুমার দত্ত, হিরু সরকার ও আবুল কাশেম। লায়লা সিদ্দিকীর নামে পাকুটিয়া মৌজায় গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল তাঁতশিল্প কারখানা। প্রায় ১২০ বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে কারখানাটি। বাকি প্রায় ৩০০ বিঘা জমি এখনও পতিত অবস্থায় আছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তার পাশের ১ শতাংশ জমির মূল্য দুই থেকে তিন লাখ টাকা। একটু ভেতরের দিকে জমির দাম ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা শতাংশ। পাকুটিয়া মৌজায় লায়লা সিদ্দিকীর নামে আছে ৪০০ বিঘার (১৩ হাজার ২০০ শতাংশ) বেশি জমি। শতাংশের মূল্য গড়ে এক লাখ টাকা করে হলেও ১৩ হাজার ২০০ শতাংশ জমিন মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৩২ কোটি টাকা। ১২০ বিঘার ওপর তাঁত কারখানার পাঁচটি ইউনিট নির্মাণ করতে আরও খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। সে হিসাবে লায়লা সিদ্দিকী এখন প্রায় ১৮২ কোটি টাকার মালিক। অথচ ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হলফনামায় লতিফ সিদ্দিকী উল্লেখ করেছিলেন, তার স্ত্রীর নামে নগদ আছে মাত্র ৪১ হাজার টাকা। সম্পদ হিসেবে আছে ২০ ভরি স্বর্ণ, ৯.২৮ একর জমি ও দু’টি দালান। আর গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে জমা দেয়া হলফনামায় দেখা গেছে, দু’টি ব্যাংকে লায়লা সিদ্দিকীর নামে ২৬ লাখ ৬০ হাজার ৬০৪ টাকা আছে। অথচ বাস্তবে তার জমিই আছে ৪০০ বিঘারও বেশি। তাঁত কারখানা তো আছেই। শুধু লতিফ সিদ্দিকী দম্পতি নন, তাদের ছেলে অনীক সিদ্দিকীও ‘জমিদার’! ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাশে কালিহাতী উপজেলার গোহালিয়া বাড়ি ইউনিয়নের পাঁচটি মৌজায় অনীকের নামে প্রায় ১৬০০ (৫২ হাজার ৮০০ শতাংশ) বিঘা জমি রয়েছে। এর মধ্যে খাসজমি দখল ও স্থানীয়দের ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে কেনা জমি রয়েছে। সবই ফসলি জমি। ইতিমধ্যে প্রায় ৬০০ বিঘা জমিতে মাটি ভরাট করে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। যোগারচর গ্রামে অনীক সিদ্দিকী গড়ে তুলেছেন ম্যাজিসটিকা হোল্ডিং লিমিটেড। তবে কি কারখানা হবে কেউ তা জানে না। অনীক মাঝেমধ্যে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে গিয়ে জমি দেখে চলে আসতেন। তার লোকজনই মূলত জমি দেখাশোনা করতো। স্থানীয় যোগারচর গ্রামে অনীক সিদ্দিকীর হয়ে জমি কিনে দিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আবদুল হাই আকন্দ, আবু সাঈদ, মজিবুর রহমান ও কালিহাতী উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মোল্লা। ৬০০ বিঘা জমি ভরাট করা হয়েছে, বাকি এক হাজার বিঘার বেশির ভাগ রেজিস্ট্রি করে কেনা হয়েছে। কিছু জমি কেনা হয়েছে বায়না সূত্রে। এসব জমির প্রতি শতাংশের দাম ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। সে হিসাবে ১৬০০ বিঘা জমির গড় মূল্য প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। যোগারচর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ১০০০ বিঘা জমি পড়েছে গোহালিয়া ইউনিয়নের কদিম হামজানি, কুশাবেনু ও গোবিন্দপুর মৌজায়। আলীপুর ও বেইলতা মৌজায় পড়েছে বাকি প্রায় ৬০০ বিঘা জমি। তাদের অভিযোগ, জমি বিক্রি করতে না চাইলেও অনীকের ক্যাডার বাহিনী এসে ভয় দেখিয়েছে, জমি বিক্রি না করলে জোর করেই নাকি নিয়ে যাবে। অনেকের জমি শুধু বায়না করেই মাটি ফেলে ভরাট করে দখলে নিয়েছে। শুধু নামমাত্র মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। যোগারচর গ্রামের আশিফ হোসেন বলেন, ‘মন্ত্রীর পোলায় জমি কিনবে, তার কথার ওপর না করার ক্ষমতা কার আছে? জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে, আর আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছি, কিছুই করার ছিল না।’ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার জমি রাস্তার পাশে ছিল, ইচ্ছা ছিল নিজেই সেখানে তাঁত কারখানা দিব, কিন্তু মন্ত্রীর ছেলে জমি ভরাট করে ফেলেছেন। পরে বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করে টাকা নিয়েছি।’ লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কার করা হচ্ছে শুনে এখন পশ্চিম পাকুটিয়া গ্রামের অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ষাটোর্ধ্ব আনছার উদ্দিন আহামেদ বললেন, ‘মনে যা চাইত লতিফ সিদ্দিকী তা-ই করত। জমি বিক্রি করতে না চাইলেও জোর করে কিনে নিছে। মামলা দিয়ে হলেও জমি নিছে।’ তাঁত কারখানার ব্যবস্থাপক সুধীর কুমার দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকাজ আমাদের ম্যাডামই (লায়লা সিদ্দিকী) দেখাশোনা করেছেন। উনার তত্ত্বাবধানেই সব কিছু হয়েছে।’
No comments