তাজরীন অগ্নিকাণ্ড- প্রধানমন্ত্রীর কবে সময় হবে? by সায়দিয়া গুলরুখ, নাজনীন শিফা ও মাহমুদুল সুমন
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে শাহিদা বেগম ও তাঁর স্বামী আতিকুল ইসলামের বাড়ি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই গার্মেন্টস শ্রমিক। সাত বছর আগে জীবিকার সন্ধানে তাঁরা ঢাকায় এসেছিলেন। তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসারে নতুন সদস্যের আগমনের অপেক্ষায় দিন কাটছিল। শাহিদা বেগম আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সন্ধ্যা ছয়টা ৩৮ মিনিটে শাহিদাকে ফোন করেন আতিকুল, ‘ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে, দোয়া কোরো।’ আবার ফোন করেন সাতটা ২ মিনিটে, ‘আমি তিনতলায় আটকা পড়েছি, মনে হয় বের হতে পারব না।’ রাত সাতটা ৩৩ মিনিটে শেষ ফোন করেন তিনি, ক্ষীণ কণ্ঠ, ‘আমি মরে যাচ্ছি, ক্ষমা করে দিয়ো।’ তাৎক্ষণিকভাবে আতিকুল ইসলামের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। অগ্নিকাণ্ডের তিন মাস পর ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে কবর চিহ্নিত হয় (৩০ জানুয়ারি, ২০১৩)। তাঁর পাঁচ মাস পর প্রধানমন্ত্রী শাহিদার হাতে সাত লাখ টাকার চেক তুলে দেন (৭ মে, ২০১৩)। পাঁচ মাস বয়সের মেয়েকে কোলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আসেন শাহিদা, দেবরের হাতে চেকটি তুলে দেন, কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, ‘আমার জীবনটাই পুড়ে ছাই হয়ে গেল, আমার বাচ্চাটা জন্মের আগেই বাবা হারাল। আমরা ঢাকায় এসেছি বেঁচে থাকার তাগিদে, কত অবহেলা? তাই বলে কি একবারে মেরেই ফেলতে হবে?’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মীরা ইশারায় বলতে থাকেন, এবার চলে যান। উপস্থিত এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শাহিদা বলেন, ‘আমি স্বামী হারিয়ে বিধবা, আমার সন্তান জন্ম থেকে পিতৃহারা, এ ক্ষতির পূরণ নাই। যে আগুন জ্বলছে, তা টাকায় নেভে না। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ, টাকার দরকার আমাদের।’
২৩ মাস আগে আশুলিয়ায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে আগুন লেগে ১১২ জনের অধিক শ্রমিক নিহত হন। নিহত শ্রমিকদের মধ্যে ৫৩ জন শ্রমিকের দেহ আগুনের লেলিহান শিখায় ঝলসে যায়। সকালে যে শ্রমিক হেঁটে ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিলেন, পরদিন (২৫ নভেম্বর, ২০১৩) ভ্যানগাড়িতে সাদা বডিব্যাগে করে যে শ্রমিকের পোড়া হাড়গোড় আর কঙ্কাল বের করে আনা হয়েছিল, তা দেখে স্বজনেরা চিনতে পারেননি তাঁদের প্রিয়জনকে। সরকারের নির্দেশে অশনাক্তকৃত লাশ থেকে ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করে কবর দেওয়া হয় জুরাইন গোরস্থানে। অগ্নিকাণ্ডের তিন মাস পর শাহিদার স্বামীসহ ৪২ জন শ্রমিকের কবর শনাক্ত করা গেলেও বাদবাকি হাড়-কঙ্কাল হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারণ ও ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে চলছে দীর্ঘসূত্রতা।
তাজরীন অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজার ভবনধসের পর ডিএনএ পদ্ধতির মাধ্যমে অশনাক্তকৃত শ্রমিকের পরিচয় নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দুটি ঘটনায় নিখোঁজ/অশনাক্তকৃত ২৫০ জন শ্রমিকের কবর শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তবে আমাদের দেশের যে দুর্বল ও অদক্ষ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো, তা ডিএনএ টেস্টের মতো একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। যেমন: মৃতদেহ উদ্ধার, সংরক্ষণ ও পরিবহনের প্রক্রিয়া যদি ত্রুটিসম্পন্ন হয়, তাহলে তা ডিএনএ পদ্ধতির ফলাফলকে প্রভাবিত করবে। রানা প্লাজা ও তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে আমরা এটি ঘটতে দেখেছি, একটি বডিব্যাগে দুজন শ্রমিকের লাশের অংশবিশেষ থাকার কারণে একই কবরে দুজন শ্রমিকের ডিএনএ ম্যাচ করতে দেখা গিয়েছে। তাই ডিএনএ পদ্ধতির পাশাপাশি পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্যে এবং অশনাক্তকৃত/নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য দাবি আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে অশনাক্তকৃত নিহত শ্রমিকদের পরিচয় ও ওয়ারিশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এমনই একটি উদ্যোগ আমরা নিতে দেখেছি। হাইকোর্টের একটি রুলিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার সহযোগিতায় শ্রম মন্ত্রণালয় ১০ জন অশনাক্তকৃত শ্রমিকের পরিচয় নির্ধারণ করতে পেরেছে। এই মর্মে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বরাবর নিহত শ্রমিকদের অনুদান প্রদানের জন্য যথাযথ উদ্যোগের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি দেন (প্রথম আলো, আগস্ট ৩১, ২০১৪)। সরকারি তদন্তের মাধ্যমে শনাক্তকরণের পর ১০ মাস পার হতে চলল, অথচ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অনুদানের টাকা দেওয়ার জন্য এই শ্রমিক পরিবারগুলোর সঙ্গে আজ পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।
তাজরীন ফ্যাক্টরি যখন জ্বলছে দাউ দাউ করে, রেহানাও তাঁর ভাই মতিকুল ইসলামকে ফোন করেছিলেন। বেঁচে ফেরার কোনো আশা নেই বুঝে ভাইকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘সুমনকে (রেহানার সাত বছরের সন্তান) দেখে রাখিস ভাই।’ মতিকুল নিজেও গার্মেন্টস শ্রমিক ছিলেন, বোনের মৃত্যুর পর আর গার্মেন্টসে ফিরে যাননি। তিনি বোন হত্যার বিচার চান, ভাগনেটাকে মানুষের মতো মানুষ করতে চান। গত মে মাস থেকে বহুবার শ্রম মন্ত্রণালয়ে ফোন করে অনুদানের টাকার খোঁজ করেছেন। বারবার তাঁকে বলা হয়েছে, চেক প্রস্তুত আছে, প্রধানমন্ত্রী নিজে চেক বিতরণ করবেন, তাই একটু দেরি হচ্ছে। শেষবার যেদিন মতিকুল ফোন করলেন, প্রধানমন্ত্রী তখন আসেম সম্মেলনে যোগদান করতে ইতালির মিলান শহরে। মতিকুলের মতো হেনা, মাহফুজা, রেহানা, আহিনুর, রোজিনা, আকলিমা, সালমা, আসমা, শিলা, শাহানা, সবুজ মিঞা, শমসের, ও সাদেকুলের পরিবারের সবার একটাই প্রশ্ন, যার সদুত্তর কেউ দিতে পারছে না, ‘প্রধানমন্ত্রীর কবে সময় হবে, আমরা আর কত দিন অর্ধাহারে-অনাহারে থাকব?’
এই দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
২৩ মাস আগে আশুলিয়ায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে আগুন লেগে ১১২ জনের অধিক শ্রমিক নিহত হন। নিহত শ্রমিকদের মধ্যে ৫৩ জন শ্রমিকের দেহ আগুনের লেলিহান শিখায় ঝলসে যায়। সকালে যে শ্রমিক হেঁটে ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিলেন, পরদিন (২৫ নভেম্বর, ২০১৩) ভ্যানগাড়িতে সাদা বডিব্যাগে করে যে শ্রমিকের পোড়া হাড়গোড় আর কঙ্কাল বের করে আনা হয়েছিল, তা দেখে স্বজনেরা চিনতে পারেননি তাঁদের প্রিয়জনকে। সরকারের নির্দেশে অশনাক্তকৃত লাশ থেকে ডিএনএ স্যাম্পল সংগ্রহ করে কবর দেওয়া হয় জুরাইন গোরস্থানে। অগ্নিকাণ্ডের তিন মাস পর শাহিদার স্বামীসহ ৪২ জন শ্রমিকের কবর শনাক্ত করা গেলেও বাদবাকি হাড়-কঙ্কাল হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারণ ও ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে চলছে দীর্ঘসূত্রতা।
তাজরীন অগ্নিকাণ্ড ও রানা প্লাজার ভবনধসের পর ডিএনএ পদ্ধতির মাধ্যমে অশনাক্তকৃত শ্রমিকের পরিচয় নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে দুটি ঘটনায় নিখোঁজ/অশনাক্তকৃত ২৫০ জন শ্রমিকের কবর শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তবে আমাদের দেশের যে দুর্বল ও অদক্ষ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো, তা ডিএনএ টেস্টের মতো একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। যেমন: মৃতদেহ উদ্ধার, সংরক্ষণ ও পরিবহনের প্রক্রিয়া যদি ত্রুটিসম্পন্ন হয়, তাহলে তা ডিএনএ পদ্ধতির ফলাফলকে প্রভাবিত করবে। রানা প্লাজা ও তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে আমরা এটি ঘটতে দেখেছি, একটি বডিব্যাগে দুজন শ্রমিকের লাশের অংশবিশেষ থাকার কারণে একই কবরে দুজন শ্রমিকের ডিএনএ ম্যাচ করতে দেখা গিয়েছে। তাই ডিএনএ পদ্ধতির পাশাপাশি পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্যে এবং অশনাক্তকৃত/নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবারের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য দাবি আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে অশনাক্তকৃত নিহত শ্রমিকদের পরিচয় ও ওয়ারিশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এমনই একটি উদ্যোগ আমরা নিতে দেখেছি। হাইকোর্টের একটি রুলিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি বিভিন্ন তদন্ত সংস্থার সহযোগিতায় শ্রম মন্ত্রণালয় ১০ জন অশনাক্তকৃত শ্রমিকের পরিচয় নির্ধারণ করতে পেরেছে। এই মর্মে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বরাবর নিহত শ্রমিকদের অনুদান প্রদানের জন্য যথাযথ উদ্যোগের আহ্বান জানিয়ে একটি চিঠি দেন (প্রথম আলো, আগস্ট ৩১, ২০১৪)। সরকারি তদন্তের মাধ্যমে শনাক্তকরণের পর ১০ মাস পার হতে চলল, অথচ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে অনুদানের টাকা দেওয়ার জন্য এই শ্রমিক পরিবারগুলোর সঙ্গে আজ পর্যন্ত কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।
তাজরীন ফ্যাক্টরি যখন জ্বলছে দাউ দাউ করে, রেহানাও তাঁর ভাই মতিকুল ইসলামকে ফোন করেছিলেন। বেঁচে ফেরার কোনো আশা নেই বুঝে ভাইকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘সুমনকে (রেহানার সাত বছরের সন্তান) দেখে রাখিস ভাই।’ মতিকুল নিজেও গার্মেন্টস শ্রমিক ছিলেন, বোনের মৃত্যুর পর আর গার্মেন্টসে ফিরে যাননি। তিনি বোন হত্যার বিচার চান, ভাগনেটাকে মানুষের মতো মানুষ করতে চান। গত মে মাস থেকে বহুবার শ্রম মন্ত্রণালয়ে ফোন করে অনুদানের টাকার খোঁজ করেছেন। বারবার তাঁকে বলা হয়েছে, চেক প্রস্তুত আছে, প্রধানমন্ত্রী নিজে চেক বিতরণ করবেন, তাই একটু দেরি হচ্ছে। শেষবার যেদিন মতিকুল ফোন করলেন, প্রধানমন্ত্রী তখন আসেম সম্মেলনে যোগদান করতে ইতালির মিলান শহরে। মতিকুলের মতো হেনা, মাহফুজা, রেহানা, আহিনুর, রোজিনা, আকলিমা, সালমা, আসমা, শিলা, শাহানা, সবুজ মিঞা, শমসের, ও সাদেকুলের পরিবারের সবার একটাই প্রশ্ন, যার সদুত্তর কেউ দিতে পারছে না, ‘প্রধানমন্ত্রীর কবে সময় হবে, আমরা আর কত দিন অর্ধাহারে-অনাহারে থাকব?’
এই দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সায়দিয়া গুলরুখ, নাজনীন শিফা ও মাহমুদুল সুমন
লেখকেরা অ্যাক্টিভিস্ট নৃবিজ্ঞানীর সদস্য।
লেখকেরা অ্যাক্টিভিস্ট নৃবিজ্ঞানীর সদস্য।
No comments