যেভাবে নৌকায় উঠিয়ে রাতে ছুড়ে ফেলা হয় জাহাজে
গত মাসের ঘটনা। টেকনাফ নিকটবর্তী এলাকার
বাসিন্দা আফসার মিয়া (২০)। একদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে মাকে বলেন,
শিগগিরই আবার দেখা হবে। সন্ধ্যার মধ্যে ফেরার কথা ছিল তার। কিন্তু আফসারের
মা শুধু অপেক্ষার প্রহরই গুনতে থাকেন। আফসার আর ফেরেনি। কাজের খোঁজে গিয়ে
সে পড়ে গেছে মানবপাচারকারী চক্রের হাতে। টেকনাফের অদূরে এক বাসায় কাজ নিতে
যায় আফসার। এক ব্যক্তি তাকে এক গ্লাস পানি পান করতে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে
চোখের পাতা বুজে আসে তার। মাথা ঘুরতে থাকে। যখন চেতনা ফেরে তখন চারপাশে
অন্ধকার। সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে। এরপর অপর দুই বাংলাদেশী তাকে ও আরও
সাতজনকে জোর করে একটি নৌকায় উঠিয়ে বেঁধে ফেলে। রাতভর নৌকা চলে। বড় একটি
জাহাজের কাছে গিয়ে জাহাজের ভেতর রীতিমতো ছুড়ে ফেলা হয় তাদেরকে। চারপাশে
সশস্ত্র প্রহরী। অপহৃত প্রত্যেকে ছিটেফোঁটা খাবার আর নোংরা পানি খেয়ে
কোনমতে দিন পার করেছে। কোনদিন একমুঠ ভাত জুটেছে কোনদিন দানাপানিও মেলেনি।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাদেরকে উবু হয়ে বসে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। কখনও বা
হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়েছে। আর প্রহরীরা লাঠি, রাবার বেল্ট দিয়ে প্রহার করেছে
নিয়মিত। অবর্ণনীয় এ দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে অনেকে গেছে কয়েক সপ্তাহ। শেষমেশ
জাহাজ যাত্রা করে থাইল্যান্ডের উদ্দেশে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বিশেষ এক
প্রতিবেদনে এভাবেই উঠে এসেছে বাংলাদেশ থেকে অপহরণ হওয়া ব্যক্তিদের দুর্দশার
চিত্র। গত বছর রয়টার্সের এক রিপোর্টে জানা যায়, মানবপাচার গ্যাংগুলো
হাজারও অপহৃতকে জঙ্গলের মধ্যে নির্মম ক্যাম্পগুলোতে আটকে রাখে। তাদের
পরিবারের সদস্যরা মুক্তিপণ দিলে পরে তাদের মুক্তি মেলে। অপহৃত হওয়ার পর
উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গাদের বক্তব্য থেকে এবার উঠে এসেছে এশিয়ার
ব্যস্ততম এ মানবপাচার রুটে পাচারকারীদের পরিবর্তিত কৌশল। অতীতে দেখা গেছে
অনেক মানুষ এসব পাচারকারী নৌকায় স্বেচ্ছায় উঠেছে। আর এখন তাদেরকে অপরহরণ
করা হচ্ছে বা ছলচাতুরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর তাদেরকে বাংলাদেশের নৌ
সীমানার বাইরে নিয়ে গিয়ে অপেক্ষমাণ বড় জাহাজে উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। নৌকাগুলোতে
ঠিক কত মানুষকে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তবে রয়টার্স যে
সাতজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে তারা বলেছে তাদেরকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এরপর শত শত মানুষে নৌকা ভর্তি হবার আগ পর্যন্ত তাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে।
কার্যত এসব নৌকা পরিণত হয় ভাসমান কারাগারে। এদের মধ্যে দু’জনকে নিয়ে যাওয়া
হয়েছিল থাইল্যান্ডের পাচার ক্যাম্পে। অপহৃত এসব ব্যক্তি যে অবর্ণনীয়
দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে গেছে তা শ’ শ’ বছর আগের দাস কেনা-বেচার কথা মনে করিয়ে
দেয়। আফসার ও আরও চার ব্যক্তিতে একই জাহাজে রাখা হয়েছিল। অন্ধকারের মধ্যে
তাদের ফেলে রাখা হয়। মারধর করা হয়। আরেকটি নৌকার দু’জন বলেছে, তাদেরকে উবু
হয়ে বসে থাকতে বাধ্য করা হয় আর বদ্ধ কামরার ঢাকনা তখনই খোলা হতো যখন কোন
মৃতদেহ সরিয়ে ফেলার প্রয়োজন হতো। আফসার ও আরও ৮০ জন ব্যক্তিকে প্রত্যন্ত এক
দ্বীপে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় অপহরণকারীরা। থাইল্যান্ডের ফুকেট দ্বীপের
উত্তরে ফ্যাং এনগা থেকে অপহৃতদের উদ্ধারদলের কর্মকর্তারা বললেন, পাচারের
তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে এমন আশঙ্কায় তারা পালিয়ে যায়। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় প্রতি
মুহূর্ত অনন্তকালের মতো কেটেছে অপহৃতদের। স্থানীয় এক কর্মকর্তা জাদসাদা
থিতিমুতা জানালেন, তাদের যে অবস্থা ছিল কোন মানুষের এমন পরিস্থিতির মধ্য
দিয়ে যাওয়া উচিত নয়। অসুস্থ আর কঙ্কালসার অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধার করা হয়।
তিনি আরও জানালেন, তারা গাছের পাতা খেয়ে বেচে ছিল। ১১ই অক্টোবরের পর থেকে
ফ্যাং এনগা এলাকা থেকে মানব পাচারের শিকার ১৩০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের
বেশির ভাগই বাংলাদেশী। এছাড়াও পশ্চিম মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমও রয়েছে।
ফ্যাং এনগা প্রদেশের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর রয়টার্সকে জানিয়েছেন, এদেরকে
জোরপূর্বক নিয়ে আসা হয়েছে। অনেককে নেশাদ্রব্য ও চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগ করে
আনা হয়েছে। তবে কতজন মানুষ পাচারকারীদের কবলে পড়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান
তাদের কাছে নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি। তথ্য-প্রমাণে ইঙ্গিত মিলছে পাচারে
ব্যবহৃত জাহাজহগুলো থাইল্যান্ডের। অপহৃত ব্যক্তিরা বলেছেন, জাহাজগুলোতে
তারা থাই পতাকা বা থাই ভাষায় কথোপকথন শুনেছেন। বাংলাদেশ কোস্টগার্ড
রয়টার্সকে জানিয়েছে তারা বাংলাদেশের নৌ সীমানার বাইরে ওঁৎ পেতে থাকা
পাচারকারী জাহাজের অবস্থান নিয়ে অবগত। রাতের আধারে সীমানার মধ্যে ঢুকে
মানুষ নিয়ে আবারও সীমানা পেরিয়ে যায়। গভীর রাতে সাগরে এসব জাহাজ শনাক্ত করা
বেশ কঠিন বলে মন্তব্য করেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম. আশিক মাহমুদ।
আফসারের সঙ্গে আরও ১৯০ জন অপহৃত ছিল বলে ধারণা থাই কর্মকর্তাদের। এদেরকে
এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। জাদসাদা বললেন, হয়তো বা তারা ইতিমধ্যে পাচার
ক্যাম্পগুলোতে আটকা পড়েছে।
No comments