নাইকোর চক্রে উল্টো প্যাঁচে বাংলাদেশ by বদরূল ইমাম
নাইকো রিসোর্সেস, ভিনদেশি এক তেল কোম্পানি। বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলন কার্যক্রমে সবচেয়ে বড় ভিলেন। এই কোম্পানি সুনামগঞ্জের ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে একটি এবং ওই বছরেরই জুলাই মাসে অপর একটি গ্যাসকূপ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বিপুল গ্যাস ও পরিবেশ বিনষ্ট করে। এর ক্রমধারায় পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীকে জড়িয়ে নাইকো দুর্নীতির যে চাল চেলেছিল, তাতে বাংলাদেশে তার ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। কেবল তা-ই নয়, বরং তার নিজ দেশ কানাডায় এই দুর্নীতির অপরাধে নাইকো আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হয়েছিল। বাংলাদেশ নাইকোর কাছে ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে বিনষ্ট গ্যাস ও পরিবেশের ক্ষতিপূরণ বাবদ একটি রক্ষণশীল হিসাব অনুযায়ী যে অর্থ দাবি করেছিল, তার প্রতি নাইকো কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলিই প্রদর্শন করেছে। উপরন্তু, বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে নাইকোর উৎপাদিত গ্যাসমূল্য পরিশোধ করা স্থগিত রাখার যে ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছিল, তা বাতিল করতে নাইকো আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মামলা করে। ওয়াশিংটনভিত্তিক এই আদালত ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিসপিউট বা সংক্ষেপে ইকসিড নামে পরিচিত।
গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে আদালত নাইকোর পক্ষে রায় ঘোষণা করেন যে বাংলাদেশকে নাইকোর পাওনা ২১৬ কোটি টাকা সুদসহ পরিশোধ করে দিতে হবে। এদিকে নাইকোর কাছে ৭৪৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের যে দাবি বাংলাদেশ করে রেখেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নাইকোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে কোনো মামলা করেনি। আর দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে ঢাকায় স্থানীয় আদালতে নাইকোর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলার রায়ে যে নির্দেশনা পাওয়া যায়, সেটি মান্য করার কোনো তাগিদ নাইকোকে স্পর্শ করেনি। নাইকো সম্পদ ও পরিবেশ বিনষ্ট করে এবং ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বাংলাদেশের হাতে একটি প্যাঁচ মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, উপরন্তু বাংলাদেশকে গ্যাসমূল্য পরিশোধ করতে বাধ্য করার ব্যবস্থা নিয়ে সে যেন অপর হাতটিতেও উল্টোমুখী প্যাঁচ কষেছে।
আরও বিস্ময়ের কথা এই যে নাইকো কেবল তার গ্যাস বিক্রির পাওনা টাকা আদায়ের জন্যই আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে মামলা করেনি, বরং ওই আদালতে দ্বিতীয় একটি মামলা করেছে। দ্বিতীয় মামলাটির লক্ষ্য হলো, বাংলাদেশে নাইকো যে দুই দুটি গ্যাসকূপ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, তার জন্য যে সে দায়ী নয়, সে মর্মে আদালতে রায় চাওয়া। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম: কালু নামে এক লোক বুলু নামক যুবকটিকে খুন করল। তারপর কালু আদালতে গিয়ে নিজেই একটি মামলা করল যেন আদালত এই মর্মে দায়মুক্তি দেন যে কালু বুলুকে খুন করেনি। এখানে তুলনাটা এ কারণেই প্রযোজ্য যে বাংলাদেশ নাইকোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে গ্যাসকূপ দুর্ঘটনার জন্য নাইকোকে দায়ী করে বা কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করে কোনো মামলা করেনি। কিন্তু তবু নাইকো কালুর মতোই আদালতে গিয়ে আগে থেকেই একটি রায় বের করে নিয়ে আসতে চায় যে সে কূপ দুর্ঘটনায় নির্দোষ।
অনেকের মনেই এ প্রশ্ন যে বাংলাদেশ কেন আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য মামলা করেনি। দীর্ঘ নয় বছর বাংলাদেশ তার সমূহ ক্ষতিপূরণ দাবিকে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখে কী আশায় বসে আছে। কেনই–বা এই দীর্ঘ সময় নাইকোকে বাংলাদেশের মাটিতে অবস্থান করতে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটানো এবং সম্পদ বিনষ্ট করার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি কর্তৃক নাইকো দায়ী সাব্যস্ত হওয়ার পরও কেন নাইকোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়নি। বাংলাদেশ বর্তমানে যখন গ্যাস তথা জ্বালানিসংকটে নিমজ্জিত, তখন ছাতকের মতো উৎপাদনক্ষম গ্যাসক্ষেত্রটিকে পঙ্গুত্বের বেড়ি পরিয়ে রেখে আর কত দিন নাইকো বাংলাদেশকে তার নিজস্ব গ্যাসসম্পদ থেকে বঞ্চিত করে রাখবে।
বাংলাদেশের নরম হাত নাইকোকে শক্ত করেছে: পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তেল কোম্পানি কর্তৃক গ্যাস বা তেল কূপ দুর্ঘটনা ঘটানো এবং সম্পদ ও পরিবেশের ক্ষতি করার পরিপ্রেক্ষিতে তেল কোম্পানিকে যে দায় বহন করতে হয়, তা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। ২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেক্সিকো উপসাগরে তেল কূপ ‘হরাইজন’ দুর্ঘটনা পতিত হলে বিপুল তেলসম্পদ ও পরিবেশের যে ক্ষতি হয়, তার জন্য ওই কূপ খননকারী ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানিকে ১১ বিলিয়ন ডলার (৮০ হাজার কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তেল কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার ও নাগরিক সমাজের যৌথ চাপ এতটাই প্রকট ছিল যে কোম্পানিটির প্রধান কর্মকর্তাকে তার প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব রক্ষার শঙ্কায় মেক্সিকো উপসাগরের তীরে হাঁটু গেড়ে নতজানু হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। কূপ দুর্ঘটনার দায় মেটাতে গিয়ে বহু তেল কোম্পানির যে বেহাল অবস্থা হয়ে থাকে, তার মূল কারণ এই যে তেল-গ্যাস দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বা জনপথ কর্তৃক তেল কোম্পানির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান।
এর ব্যতিক্রম ঘটে বাংলাদেশে। নাইকো কর্তৃক গ্যাসকূপ দুর্ঘটনা–পরবর্তী সময়ে দেশের বিশেষজ্ঞ দল (কোম্পানির প্রতিনিধিসহ) গঠিত অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্টে নাইকোর কারিগরি ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতাকে দুর্ঘটনার জন্য সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হলেও বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপে কোনো শক্ত হাতের চিহ্ন মেলে না। আর এর কয়েকটি নমুনা নিম্নরূপ:
ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে যে সম্পদ ও পরিবেশের বিনষ্ট করা হয়েছে, দাবি করা ক্ষতির পরিমাণ তার চেয়ে অনেক কম। যে গ্যাসস্তরটি দুর্ঘটনাকবলিত, নাইকোর হিসাবমতে, তার মধ্যে গ্যাস ছিল ১১৫ বিলিয়ন ঘনফুট, যার মূল্য প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই গ্যাসের পুরোটাই দুর্ঘটনার ফলে ভূগর্ভে নিজ স্থান থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওপরে নরম বালুস্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে, যা কিনা আর কখনো উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। নাইকো দুর্ঘটনার পর এই নয় বছরে এটি থেকে এক বিন্দু গ্যাস উৎপাদন করে দেখাতে পারেনি যে এটির অস্তিত্ব বিদ্যমান। সেটি সম্ভব হলে সে তা করে দাবি করা ক্ষতিপূরণের হিসাবে তর্কের অবতারণা করত নিশ্চয়ই। আর বাংলাদেশ পরিবেশের যে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে, তাও নেহাত আংশিক। দৃশ্যত পরিবেশদূষণ ছাড়াও আন্তর্জাতিক রীতিতে মানুষের ক্ষতি তা পারিপার্শ্বিক, ভৌত বা মানসিক—সবই অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ২০০৫ সালে এক পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবে দাবি করে, নাইকো কূপ দুর্ঘটনায় ক্ষতির মোট পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকা থেকে সাত হাজার কোটি টাকা (আবুল বারকাত ২০০৫)। উল্লিখিত হিসাবের তুলনায় বাংলাদেশ কর্তৃক ৭৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি নেহাতই কম।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য বাংলাদেশ নাইকোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে মামলা করেনি। নাইকোর কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে তা আদায়ে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ২০০৮ সালে ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে নাইকোর বিরুদ্ধে ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করে। আদালত ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করে এবং ক্ষতিপূরণ না দেওয়া পর্যন্ত নাইকোর ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে কেনা গ্যাসের মূল্য পরিশোধ না করার আদেশ দেন। কিন্তু বিদেশি কোম্পানি নাইকো বাংলাদেশের আদালতের রায়কে গ্রাহ্য করার করার কারণ খুঁজে পায়নি বিধায় ক্ষতিপূরণ না দিয়ে কেবল প্রদত্ত রায়কে উপেক্ষা করে।
ওদিকে নাইকো ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত ইকসিডে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে। একটি মামলা ‘পেমেন্ট ক্লেম’, যার রায়ে (সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে প্রদত্ত) বাংলাদেশকে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করতে বলা হয়েছে, আর অপরটি ‘কম্পেনসেশন ক্লেম’ যেটিতে নাইকো কূপ দুর্ঘটনার জন্য নিজের দায় অস্বীকার করে দায়মুক্তি প্রার্থনা করেছে (যার রায় আগামী মাসে দেবে বলে ধারণা করা হয়)। যেখানে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ তার ক্ষতিপূরণের জন্য নাইকোকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে দেখা যায় যে নাইকো বাংলাদেশকে আদালতে নিয়ে গিয়ে তার স্বার্থ রক্ষায় রায় বের করে আনে। বাংলাদেশের এই দুর্বল আইনি ব্যবস্থাপনা অগ্রহণযোগ্য।
নাইকোর অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতায় দুর্ঘটনা ঘটানো, বিপুল সম্পদ ও পরিবেশ বিনষ্ট করে তার ক্ষতিপূরণ না দেওয়া এবং বড় আকারের দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া—এসব কার্যকলাপের পরও তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত জেভিএ চুক্তিটি আজ প্রায় ১০ বছর পরও বাতিল করা হয়নি। এসবই বাংলাদেশের দুর্বলতার সাক্ষ্য বহন করে।
বাংলাদেশের বর্তমান গ্যাস তথা জ্বালানিসংকটের সময়ে ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের মতো উৎপাদনক্ষম ক্ষেত্র নাইকোর মতো দুষ্ট চক্রে ঘেরা এক কোম্পানির কাছে কেন জিম্মি হয়ে থাকছে, তা বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুর্বল আইনি তৎপরতা ও ব্যবস্থাপনা ইতিমধ্যেই জাতীয় স্বার্থকে পর্যুদস্ত করেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং ত্বরিত কর্মতৎপরতার মাধ্যমে নাইকোর অশুভ ছায়া থেকে জাতিকে রেহাই দেওয়া অত্যাবশ্যক।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে আদালত নাইকোর পক্ষে রায় ঘোষণা করেন যে বাংলাদেশকে নাইকোর পাওনা ২১৬ কোটি টাকা সুদসহ পরিশোধ করে দিতে হবে। এদিকে নাইকোর কাছে ৭৪৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের যে দাবি বাংলাদেশ করে রেখেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নাইকোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে কোনো মামলা করেনি। আর দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে ঢাকায় স্থানীয় আদালতে নাইকোর বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ মামলার রায়ে যে নির্দেশনা পাওয়া যায়, সেটি মান্য করার কোনো তাগিদ নাইকোকে স্পর্শ করেনি। নাইকো সম্পদ ও পরিবেশ বিনষ্ট করে এবং ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বাংলাদেশের হাতে একটি প্যাঁচ মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, উপরন্তু বাংলাদেশকে গ্যাসমূল্য পরিশোধ করতে বাধ্য করার ব্যবস্থা নিয়ে সে যেন অপর হাতটিতেও উল্টোমুখী প্যাঁচ কষেছে।
আরও বিস্ময়ের কথা এই যে নাইকো কেবল তার গ্যাস বিক্রির পাওনা টাকা আদায়ের জন্যই আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে মামলা করেনি, বরং ওই আদালতে দ্বিতীয় একটি মামলা করেছে। দ্বিতীয় মামলাটির লক্ষ্য হলো, বাংলাদেশে নাইকো যে দুই দুটি গ্যাসকূপ দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, তার জন্য যে সে দায়ী নয়, সে মর্মে আদালতে রায় চাওয়া। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম: কালু নামে এক লোক বুলু নামক যুবকটিকে খুন করল। তারপর কালু আদালতে গিয়ে নিজেই একটি মামলা করল যেন আদালত এই মর্মে দায়মুক্তি দেন যে কালু বুলুকে খুন করেনি। এখানে তুলনাটা এ কারণেই প্রযোজ্য যে বাংলাদেশ নাইকোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে গ্যাসকূপ দুর্ঘটনার জন্য নাইকোকে দায়ী করে বা কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি করে কোনো মামলা করেনি। কিন্তু তবু নাইকো কালুর মতোই আদালতে গিয়ে আগে থেকেই একটি রায় বের করে নিয়ে আসতে চায় যে সে কূপ দুর্ঘটনায় নির্দোষ।
অনেকের মনেই এ প্রশ্ন যে বাংলাদেশ কেন আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করার জন্য মামলা করেনি। দীর্ঘ নয় বছর বাংলাদেশ তার সমূহ ক্ষতিপূরণ দাবিকে শূন্যে ঝুলিয়ে রেখে কী আশায় বসে আছে। কেনই–বা এই দীর্ঘ সময় নাইকোকে বাংলাদেশের মাটিতে অবস্থান করতে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটানো এবং সম্পদ বিনষ্ট করার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত অনুসন্ধান কমিটি কর্তৃক নাইকো দায়ী সাব্যস্ত হওয়ার পরও কেন নাইকোর সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়নি। বাংলাদেশ বর্তমানে যখন গ্যাস তথা জ্বালানিসংকটে নিমজ্জিত, তখন ছাতকের মতো উৎপাদনক্ষম গ্যাসক্ষেত্রটিকে পঙ্গুত্বের বেড়ি পরিয়ে রেখে আর কত দিন নাইকো বাংলাদেশকে তার নিজস্ব গ্যাসসম্পদ থেকে বঞ্চিত করে রাখবে।
বাংলাদেশের নরম হাত নাইকোকে শক্ত করেছে: পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তেল কোম্পানি কর্তৃক গ্যাস বা তেল কূপ দুর্ঘটনা ঘটানো এবং সম্পদ ও পরিবেশের ক্ষতি করার পরিপ্রেক্ষিতে তেল কোম্পানিকে যে দায় বহন করতে হয়, তা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। ২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেক্সিকো উপসাগরে তেল কূপ ‘হরাইজন’ দুর্ঘটনা পতিত হলে বিপুল তেলসম্পদ ও পরিবেশের যে ক্ষতি হয়, তার জন্য ওই কূপ খননকারী ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানিকে ১১ বিলিয়ন ডলার (৮০ হাজার কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। তেল কোম্পানিটির বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার ও নাগরিক সমাজের যৌথ চাপ এতটাই প্রকট ছিল যে কোম্পানিটির প্রধান কর্মকর্তাকে তার প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব রক্ষার শঙ্কায় মেক্সিকো উপসাগরের তীরে হাঁটু গেড়ে নতজানু হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। কূপ দুর্ঘটনার দায় মেটাতে গিয়ে বহু তেল কোম্পানির যে বেহাল অবস্থা হয়ে থাকে, তার মূল কারণ এই যে তেল-গ্যাস দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বা জনপথ কর্তৃক তেল কোম্পানির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান।
এর ব্যতিক্রম ঘটে বাংলাদেশে। নাইকো কর্তৃক গ্যাসকূপ দুর্ঘটনা–পরবর্তী সময়ে দেশের বিশেষজ্ঞ দল (কোম্পানির প্রতিনিধিসহ) গঠিত অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্টে নাইকোর কারিগরি ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতাকে দুর্ঘটনার জন্য সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হলেও বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপে কোনো শক্ত হাতের চিহ্ন মেলে না। আর এর কয়েকটি নমুনা নিম্নরূপ:
ছাতক গ্যাসক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে যে সম্পদ ও পরিবেশের বিনষ্ট করা হয়েছে, দাবি করা ক্ষতির পরিমাণ তার চেয়ে অনেক কম। যে গ্যাসস্তরটি দুর্ঘটনাকবলিত, নাইকোর হিসাবমতে, তার মধ্যে গ্যাস ছিল ১১৫ বিলিয়ন ঘনফুট, যার মূল্য প্রায় এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই গ্যাসের পুরোটাই দুর্ঘটনার ফলে ভূগর্ভে নিজ স্থান থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওপরে নরম বালুস্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে, যা কিনা আর কখনো উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। নাইকো দুর্ঘটনার পর এই নয় বছরে এটি থেকে এক বিন্দু গ্যাস উৎপাদন করে দেখাতে পারেনি যে এটির অস্তিত্ব বিদ্যমান। সেটি সম্ভব হলে সে তা করে দাবি করা ক্ষতিপূরণের হিসাবে তর্কের অবতারণা করত নিশ্চয়ই। আর বাংলাদেশ পরিবেশের যে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে, তাও নেহাত আংশিক। দৃশ্যত পরিবেশদূষণ ছাড়াও আন্তর্জাতিক রীতিতে মানুষের ক্ষতি তা পারিপার্শ্বিক, ভৌত বা মানসিক—সবই অন্তর্ভুক্ত করার নিয়ম। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ২০০৫ সালে এক পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবে দাবি করে, নাইকো কূপ দুর্ঘটনায় ক্ষতির মোট পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকা থেকে সাত হাজার কোটি টাকা (আবুল বারকাত ২০০৫)। উল্লিখিত হিসাবের তুলনায় বাংলাদেশ কর্তৃক ৭৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি নেহাতই কম।
ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য বাংলাদেশ নাইকোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতে মামলা করেনি। নাইকোর কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে তা আদায়ে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ২০০৮ সালে ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে নাইকোর বিরুদ্ধে ৭৫০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করে। আদালত ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করে এবং ক্ষতিপূরণ না দেওয়া পর্যন্ত নাইকোর ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে কেনা গ্যাসের মূল্য পরিশোধ না করার আদেশ দেন। কিন্তু বিদেশি কোম্পানি নাইকো বাংলাদেশের আদালতের রায়কে গ্রাহ্য করার করার কারণ খুঁজে পায়নি বিধায় ক্ষতিপূরণ না দিয়ে কেবল প্রদত্ত রায়কে উপেক্ষা করে।
ওদিকে নাইকো ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক সালিসি আদালত ইকসিডে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে। একটি মামলা ‘পেমেন্ট ক্লেম’, যার রায়ে (সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে প্রদত্ত) বাংলাদেশকে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করতে বলা হয়েছে, আর অপরটি ‘কম্পেনসেশন ক্লেম’ যেটিতে নাইকো কূপ দুর্ঘটনার জন্য নিজের দায় অস্বীকার করে দায়মুক্তি প্রার্থনা করেছে (যার রায় আগামী মাসে দেবে বলে ধারণা করা হয়)। যেখানে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ তার ক্ষতিপূরণের জন্য নাইকোকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে দেখা যায় যে নাইকো বাংলাদেশকে আদালতে নিয়ে গিয়ে তার স্বার্থ রক্ষায় রায় বের করে আনে। বাংলাদেশের এই দুর্বল আইনি ব্যবস্থাপনা অগ্রহণযোগ্য।
নাইকোর অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতায় দুর্ঘটনা ঘটানো, বিপুল সম্পদ ও পরিবেশ বিনষ্ট করে তার ক্ষতিপূরণ না দেওয়া এবং বড় আকারের দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া—এসব কার্যকলাপের পরও তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পাদিত জেভিএ চুক্তিটি আজ প্রায় ১০ বছর পরও বাতিল করা হয়নি। এসবই বাংলাদেশের দুর্বলতার সাক্ষ্য বহন করে।
বাংলাদেশের বর্তমান গ্যাস তথা জ্বালানিসংকটের সময়ে ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের মতো উৎপাদনক্ষম ক্ষেত্র নাইকোর মতো দুষ্ট চক্রে ঘেরা এক কোম্পানির কাছে কেন জিম্মি হয়ে থাকছে, তা বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুর্বল আইনি তৎপরতা ও ব্যবস্থাপনা ইতিমধ্যেই জাতীয় স্বার্থকে পর্যুদস্ত করেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের পক্ষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং ত্বরিত কর্মতৎপরতার মাধ্যমে নাইকোর অশুভ ছায়া থেকে জাতিকে রেহাই দেওয়া অত্যাবশ্যক।
ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments