বুকভরা বাঁওড়ে বালু উত্তোলন
অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ঘটনায় যশোর সদর
উপজেলার ১০ গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে
পড়েছে। দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ভূমিধস। কমে গেছে ফসলের আবাদ। মড়ক দেখা দিয়েছে
আশপাশের গাছগাছালিতে। মাত্রাতিরিক্ত বালু উত্তোলনের ফলে পার্শ্ববর্তী মাছের
খামার বা পুকুরগুলোতেও দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। প্রশাসনিক
কর্মকর্তারা বলছেন, বালু উত্তোলনকারীরা সরকারের কোন দপ্তরের অনুমতি নেয়নি।
বালুর কারবারিরা একথা স্বীকারও করেছেন। বাঁওড়ের আশপাশের কয়েক গ্রামের লোক
বলছেন, এভাবে বালু উত্তোলনের কারণে তারা ভীষণ ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। যশোর
সদর উপজেলার দেয়াড়া ইউনিয়নে অবস্থিত এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাঁওড় ‘বুকভরা
বাঁওড়’। প্রায় ১৫৩ হেক্টর জমির ওপর এ জলাশয়টি অবস্থিত। চান্দুটিয়া,
আরিচপুর, হালসা, ইছাপুর, নারাঙ্গালি, দেয়াড়া, ফরিদপুর, মঠবাড়িসহ আশপাশের ১০
গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার এই বাঁওড়ে মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। গত
মওসুমে বুকভরা বাঁওড় থেকে প্রথম বালু উত্তোলন শুরু হয়। ফলে বাঁওড়টির গভীরতা
দ্রুত বাড়তে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মৎস্য চাষ। আশপাশের ধানি জমিতে ধান
উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামগুলোর বেশ কিছু বাড়িঘরে ফাটল দেখা দেয়। বালু
বহনের জন্য ভারি যানবাহন চলাচল শুরু হওয়ায় গ্রাম্য রাস্তাগুলো হয়ে পড়ে
বেহাল। এ অবস্থায় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সরজমিন গিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলন
বন্ধ করে দেন। কিন্তু চলতি শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই কতিপয় ব্যক্তি বেশি লাভের
আশায় নতুন করে বালু উত্তোলন শুরু করেছে। সমপ্রতি বুকভরা বাঁওড়ে গিয়ে দেখা
যায়, এলাকার হজরত আলী, রফি, আনু, আনিসসহ কয়েক ব্যক্তি বাঁওড়ের ধারে শ্যালো
মেশিন বসিয়ে ভূগর্ভের বালু উঠাচ্ছে। জানতে চাইলে তারা স্বীকার করেন, বালু
উত্তোলনের জন্য তাদের কোন প্রশাসনিক অনুমতি নেই। শুধু বাড়তি লাভের আশায়
তারা এ কাজ করছেন। তারা জানান, প্রতিদিন একটি শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে ১০-১২
ট্রাক বালু তোলা যায়, যা চাষ কাজের চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক। এক প্রশ্নের
জবাবে বালু উত্তোলনকারী হজরত আলী বলেন, ‘আমি যে জমি থেকে বালু উঠাচ্ছি তা
সরকার থেকে লিজ নেয়া চাষাবাদের উদ্দেশ্যে। যদি সরকারি কর্মকর্তারা বালু
উঠানো বন্ধের নির্দেশ দেন, তাহলে আমি মেশিন সরিয়ে নেবো।’ দেখা যায়,
উত্তোলিত বালু ভারি যানবাহনের মাধ্যমে শহরে আনা হচ্ছে। ফলে গ্রামের
রাস্তাগুলো হয়ে উঠেছে বেহাল। গ্রামের শিশুরা গাড়িচাপা পড়ার ভয়ে রাস্তায়
উঠতে পারছে না। বাঁওড়ের পাশে হালসা থেকে মঠবাড়ি পর্যন্ত প্রায় চার
কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ছিল। অবাধে বালু উত্তোলন ও তা বহনের কারণে বেড়িবাঁধের
অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। প্রচুর বালু ও পানি তোলায় ধানি জমিতে চাষবাস
বন্ধ হয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে ভাঙন আর ভূমিধস। ইতিমধ্যে নদী পাড়ের কয়েকশ’
বিঘা চাষের জমি ভাঙনে ধসে গেছে। মঠবাড়ি গ্রামের কৃষক ইদ্রিস আলী ও আতর আলী
জানান, ধানের জমিতে সেচ দেয়ার আধঘণ্টার মধ্যে পানি শুকিয়ে যায় বালুর কারণে।
সে কারণে তাদের চাষবাস এক প্রকার বন্ধ। জমির উর্বরা শক্তি দ্রুত হ্রাস
পাচ্ছে। ফসল ফলছে না। অথচ তাদের বিঘাপ্রতি জমিতে ২০-২২ মণ করে ধান হতো।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রমজান আলী জানান, বুকভরা বাঁওড়ে কার্প জাতীয় মাছের
পাশাপাশি দেশীয় প্রজাতির সব মাছের চাষ হতো। নিয়মিত বালু তোলার ফলে বাঁওড়ের
পলিমাটির স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি বাঁওড়ের গভীরতাও বাড়ছে। এসব
কারণে মাছের প্রাকৃৃতিক ফুড সোর্স নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই মাছ চাষও হুমকির
মুখে পড়েছে। বুকভরা বাঁওড়ের মৎস্যজীবী শীতল বিশ্বাস বলেন, ‘বালু উত্তোলনের
কারণে জলাশয়টির গভীরতা বেড়েছে অনেক। এখন দুই-তিনটা বড় বাঁশ জোড়া দিয়েও ঠাঁই
পাওয়া যায় না। তাই আগের মতো মাছও ধরতে পারছি না। ফলে জীবন জীবিকা নির্বাহ
করা কঠিন হয়ে পড়ছে।’ বুকভরা বাঁওড় মৎস্যজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অভিমন্যু
বিশ্বাস জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে কিছুদিন বালু
উত্তোলন বন্ধ ছিল। কিন্তু চলতি শুষ্ক মওসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আবারও শুরু
হয়েছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। এভাবে চলতে থাকলে তাদের পথে বসা ছাড়া বিকল্প
থাকবে না। যশোর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুল আরিফ বলেন, ‘অবৈধভাবে
বালু উত্তোলনের অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করে
২-১ দিনের মধ্যে অভিযানের মাধ্যমে বালু উত্তোলনকারীদের নিবৃত্ত করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু এটি একটি বড় ঘটনা, সে কারণে প্রস্তুতি নিয়েই সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু এটি একটি বড় ঘটনা, সে কারণে প্রস্তুতি নিয়েই সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হবে।’
No comments