সালামাত দাতাং ডি ইন্দোনেশিয়া by ড. মাওলানা ইমতিয়াজ আহমদ
ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের তথা ইউএসএআইডি’র আমন্ত্রণে ইন্দোনেশিয়ার মাদরাসা শিাকার্যক্রম পরিদর্শনের এক স্টাডি ট্যুরে গত ১৪ সেপ্টেম্বর জাকার্তায় পৌঁছি। পাঁচতারকা হোটেল গ্রান্ড হায়াতে যখন পৌঁছলাম, তখন স্থানীয় সময় রাত সাড়ে বারোটা। পরদিন সকাল আটটায় ইন্দোনেশিয়ার মিনিস্ট্রি অব রিলিজিয়াস অ্যাফেয়ার্স কার্যালয়ে মাদরাসা শিা পরিচালকের সভাকে ধর্মসচিব প্রফেসর ড. এইচ নুর সিয়ামের সাথে আমরা বৈঠকে মিলিত হই। আমাদের শিক্ষা সফরে বাংলাদেশের শিা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হোসনে আরা বেগম এবং প্রাথমিক ও গণশিা মন্ত্রণালয়ের সহকারী প্রধান মোহাম্মদ জালাল হাবিবুর রহমানও ছিলেন। জোহরের নামাজ পড়তে যাই ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় মসজিদ ইসতেকলাল বা স্বাধীনতা মসজিদে। দণি-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় এ মসজিদে একসাথে এক লাখ ২০ হাজারের বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। দৈর্ঘ-প্রস্থ-উচ্চতায় মসজিদের বিশালতায় নিজেকে খুবই ক্ষুদ্র মনে হলো।
ওই দিন সন্ধ্যায় প্লেনে চেপে জাকার্তা থেকে সেন্ট্রাল জাভা প্রদেশের রাজধানী সেমারাং পৌঁছলাম। উঠলাম গাজা মাদা স্ট্রিটের হোটেল গুমাইয়াতে। পরদিন ১৬ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে দশটার দিকে সেন্ট্রাল জাভার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রধান ড. এইচ খাইরুদ্দিনের কার্যালয়ে পৌঁছলাম। এখানে মাদরাসা শিা বিভাগের প্রধান ড. এইচ জামুন এফেন্দিও উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়ার মাদরাসা শিা এবং প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ইসলাম ধর্ম শিা কার্যক্রম সে দেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় দেখাশোনা করে। ড. খাইরুদ্দিন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রাদেশিক প্রধান হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজিতে না বলে বাহাসা ইন্দোনেশিয়া ভাষায় কথা বললেন। দোভাষীর মাধ্যমে আমরা তার কথা বুঝলাম। প্রশ্নোত্তর পর্বও চলল দোভাষীর মাধ্যমে। সরকারি একটা মন্ত্রণালয়ের একজন প্রাদেশিক প্রধান ইংরেজি জানেন না, এটা কি দোষের? আমি তো মনে করি, এটা মোটেও দোষের নয়। ইরানেও দেখেছি, বড় বড় পদস্থ কর্মকর্তা ইংরেজি জানেন না। শুনেছি জাপানে এমন অনেক বড় বিজ্ঞানী আছেন, যারা মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষাই জানেন না। ইংরেজি না জানার কারণে কি তারা পিছিয়ে আছেন? মোটেও না। ইংরেজি জানার কারণে অনেক ক্ষেত্রে মেধার পাচার হয়, অপর দিকে ইংরেজি শিার চাপের কারণে অনেক মেধার অপমৃত্যুও ঘটে। ইন্দোনেশিয়ায় মাতৃভাষায় শিা দেয়া হয়। এমনকি মাদরাসাতেও পড়ালেখা হয় মাতৃভাষা বাহাসা ইন্দোনেশিয়ার মাধ্যমে। তারা মাতৃভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া করে যতটুকু এগিয়েছে, আমরা মাতৃভাষার কম গুরুত্ব দিয়ে তার ধারেকাছেও যেতে পারিনি। তবে আমি ইংরেজি পড়ার বিরুদ্ধে নই।
ড. খাইরুদ্দিন তার বক্তৃতার মাঝে বললেন, বহির্দেশ থেকে অপবাদ দেয়া হয়েছে, আমাদের আবাসিক মাদরাসাগুলোতে জঙ্গিচর্চা হয়। আপনারা মাদরাসাগুলো যখন পরিদর্শন করবেন, তখন একটু ভালো করে দেখবেন, বাস্তবে এখানে তেমন কিছু হচ্ছে কি না। ইন্দোনেশিয়ার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রাদেশিক প্রধানের মুখে জঙ্গিবাদের কথা শুনে চমকে উঠলাম। এখানেও সেই জুজুবুড়ির কিসসা! মনে পড়ল বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোর ওপর ভিত্তিহীন এই অপবাদের কথা। ওই মাদরাসাগুলো জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র, জঙ্গি তৈরির কারখানা প্রভৃতি অপবাদ শুনতে শুনতে আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। কওমি মাদরাসাগুলোতে বহু তদন্ত হয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও হয়েছে। সব তদন্তের ফলাফল হচ্ছে, কওমি মাদরাসা জঙ্গি কারখানা নয়। এর পরও আমাদের জুজুর ভয় দেখানোর জন্য প্রাচীন কল্পকাহিনীর মুখস্থ কথা শুনতে হয়। ইন্দোনেশিয়ার আবাসিক মাদরাসাগুলোকে শুধু বাইরের দেশ থেকে অপবাদ শুনতে হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোর ওপর দেশের ভেতর থেকেই একের পর এক অপবাদের ঢিল ছোড়া হয়। যারা অপবাদ দেয়, তাদের কোনো-না-কোনো স্বার্থ অবশ্যই আছে। যারা দেশের ভেতরে থেকে এই অপবাদে লিপ্ত, কখনো কি তারা ভেবে দেখেছে, কওমি মাদরাসাকে জঙ্গিবাদের কারখানা প্রমাণ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এরা দেশকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে। বাংলাদেশে কওমি মাদরাসাকে বলা হয় ‘জঙ্গিদের নিরাপদ আস্তানা’। অথচ এ কথা প্রমাণিত, কওমি মাদরাসায় কোনো সময় সামরিক ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা ছিল না এবং এখনো নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনসিসির অধীনে যে সামরিক প্রশিণ দেয়া হয়, তারও কোনো ব্যবস্থা কওমি মাদরাসায় নেই। এমনকি এ ধরনের মাদরাসাগুলোতে শরীরচর্চারও কার্যক্রম নেই। তা সত্ত্বেও কওমি মাদরাসাকে জঙ্গি তৈরির উর্বর ত্রে হিসেবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ-ইন্দোনেশিয়া নয়, ভারত-পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বে মাদরাসা শিা তথা ইসলামি শিাকেন্দ্র মূলত আবাসিক। সর্বত্রই এ মাদরাসাগুলোকে ‘জঙ্গিবাদের
আস্তানা’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য ধর্মীয় শিা প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রায় আবাসিক। আমরা কিন্তু সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতা বা জঙ্গিপনার অভিযোগ কখনো শুনিনি। ইসলামি শিাকেন্দ্রগুলো পরিদর্শন ও তদন্তের নিমিত্তে সর্বদা সবার জন্য উন্মুক্ত। পান্তরে অন্যান্য ধর্মের এমন অনেক ধর্মীয় শিা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোতে প্রবেশাধিকার সবার জন্য উন্মুক্ত নয়।
প্রশ্ন করলাম, ইন্দোনেশিয়ায় জঙ্গিবাদের অভিযোগ কিভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে? ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রাদেশিক প্রধান ড. এইচ খাইরুদ্দিন জানালেন, তারা সমালোচনার দিকে না তাকিয়ে বরং মাদরাসা শিাকে সুন্দরভাবে পরিচালনার পাশাপাশি এর মান আরো উন্নত করার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। এর পাশাপাশি জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়েছেন। তিনি আরো জানালেন, এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিতে এক ইন্দোনেশিয়া গড়ার স্লোগান নিয়ে দেশের সামগ্রিক শিাব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করলেন, ইন্দোনেশিয়ায় সাড়ে সতেরো হাজারা বড়-ছোট দ্বীপ রয়েছে। কেউ যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাষ্ট্রের ঘোষণা না দেয়, তাই এক ইন্দোনেশিয়া গড়ার কথা বলা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮৭ ভাগ মুসলমান। এ জন্য এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিতেই ‘এক ইন্দোনেশিয়া’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে দেশটি এগিয়ে চলেছে। উল্লেখ্য, ২০০২ সালে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে পূর্ব তিমুর ইন্দোনেশিয়া থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এরপর থেকেই ইন্দোনেশিয়া সরকার ‘এক ইন্দোনেশিয়া’ গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে করে পূর্ব তিমুরের মতো আর কেউ পৃথক হয়ে না যায়।
বাতাং জেলার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জেলা প্রধান ও জেলা শিা কর্মকর্তার সাথেও আমাদের বৈঠক হলো। অনেক মাদরাসাও ঘুরে দেখলাম। যেখানেই গেছি, সেখানেই আমাদের উষ্ণ সংবর্ধনা ও আতিথেয়তা দেয়া হয়েছে। সর্বত্রই ইন্দোনেশিয়ান বাহাসা ভাষায় ‘সালামাত দাতাং’ বলে আমাদের শুভেচ্ছা জানানো হয়। সালামাত দাতাং অর্থ স্বাগতম। ‘সালামাত দাতাং ডি ইন্দোনেশিয়া’ অর্থ ইন্দোনেশিয়ায় স্বাগতম। বাহাসা ইন্দোনেশিয়া ভাষা আমার কাছে খুব সহজ মনে হলো। বাংলায় ব্যবহৃত সংস্কৃত (তৎসম) শব্দ এ ভাষায় প্রচুর রয়েছে। আরবি ও ফার্সি ভাষার শব্দও রয়েছে অনেক। ল্যাটিন অরে লেখা এ ভাষায় ১০ হাজারের মতো ইংরেজি মিশ্রিত ডাচ শব্দ রয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায় বেসরকারি মাদরাসাগুলো বিভিন্ন কমিউনিটির মাধ্যমে পরিচালিত। তন্মধ্যে মুহাম্মাদিয়া ফাউন্ডেশন, মাআরিফ ও নাহদাতুল উলামা উল্লেখযোগ্য। আমরা বাতাং জেলার কারাঙ্গাসেমে অবস্থিত মুহাম্মাদিয়া ফাউন্ডেশনের মাদারাসা ইবতিদায়িয়্যাহতে প্রবেশের সময় ছাত্রছাত্রীরা দুই দিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাগতম জানায়। এ সময় আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...’ বেজে ওঠে। জাতীয় সঙ্গীত জীবনে অনেক গেয়েছি, শুনেছি। কিন্তু এ বিদেশ বিভুঁইয়ে ভিনদেশী পরিবেশে জাতীয় সঙ্গীত হৃদয়ে অন্য রকম অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। প্রতিটি কাসের দরজায় ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দেখে আরো অবাক হলাম। সর্বত্র ঘুরে ইন্দোনেশিয়ার মাদরাসা শিার অগ্রগতি দেখলাম। শিার অগ্রগতির মাধ্যমে তারা এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। এ েেত্র সরকারের সহায়তা বেশ ইতিবাচক ও আন্তরিকতাপূর্ণ। জঙ্গিবাদের অপবাদ ঘুচিয়ে আমাদেরকেও মাদরাসা শিায় অগ্রগতি আনতে হবে। এ েেত্র সরকারের পর্যাপ্ত ভূমিকা খুবই প্রয়োজন।
লেখক : গবেষক ও অনুবাদক
ahmadimtiajdr@gmail.com
ওই দিন সন্ধ্যায় প্লেনে চেপে জাকার্তা থেকে সেন্ট্রাল জাভা প্রদেশের রাজধানী সেমারাং পৌঁছলাম। উঠলাম গাজা মাদা স্ট্রিটের হোটেল গুমাইয়াতে। পরদিন ১৬ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে দশটার দিকে সেন্ট্রাল জাভার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রধান ড. এইচ খাইরুদ্দিনের কার্যালয়ে পৌঁছলাম। এখানে মাদরাসা শিা বিভাগের প্রধান ড. এইচ জামুন এফেন্দিও উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়ার মাদরাসা শিা এবং প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ইসলাম ধর্ম শিা কার্যক্রম সে দেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় দেখাশোনা করে। ড. খাইরুদ্দিন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রাদেশিক প্রধান হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজিতে না বলে বাহাসা ইন্দোনেশিয়া ভাষায় কথা বললেন। দোভাষীর মাধ্যমে আমরা তার কথা বুঝলাম। প্রশ্নোত্তর পর্বও চলল দোভাষীর মাধ্যমে। সরকারি একটা মন্ত্রণালয়ের একজন প্রাদেশিক প্রধান ইংরেজি জানেন না, এটা কি দোষের? আমি তো মনে করি, এটা মোটেও দোষের নয়। ইরানেও দেখেছি, বড় বড় পদস্থ কর্মকর্তা ইংরেজি জানেন না। শুনেছি জাপানে এমন অনেক বড় বিজ্ঞানী আছেন, যারা মাতৃভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষাই জানেন না। ইংরেজি না জানার কারণে কি তারা পিছিয়ে আছেন? মোটেও না। ইংরেজি জানার কারণে অনেক ক্ষেত্রে মেধার পাচার হয়, অপর দিকে ইংরেজি শিার চাপের কারণে অনেক মেধার অপমৃত্যুও ঘটে। ইন্দোনেশিয়ায় মাতৃভাষায় শিা দেয়া হয়। এমনকি মাদরাসাতেও পড়ালেখা হয় মাতৃভাষা বাহাসা ইন্দোনেশিয়ার মাধ্যমে। তারা মাতৃভাষার মাধ্যমে লেখাপড়া করে যতটুকু এগিয়েছে, আমরা মাতৃভাষার কম গুরুত্ব দিয়ে তার ধারেকাছেও যেতে পারিনি। তবে আমি ইংরেজি পড়ার বিরুদ্ধে নই।
ড. খাইরুদ্দিন তার বক্তৃতার মাঝে বললেন, বহির্দেশ থেকে অপবাদ দেয়া হয়েছে, আমাদের আবাসিক মাদরাসাগুলোতে জঙ্গিচর্চা হয়। আপনারা মাদরাসাগুলো যখন পরিদর্শন করবেন, তখন একটু ভালো করে দেখবেন, বাস্তবে এখানে তেমন কিছু হচ্ছে কি না। ইন্দোনেশিয়ার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রাদেশিক প্রধানের মুখে জঙ্গিবাদের কথা শুনে চমকে উঠলাম। এখানেও সেই জুজুবুড়ির কিসসা! মনে পড়ল বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোর ওপর ভিত্তিহীন এই অপবাদের কথা। ওই মাদরাসাগুলো জঙ্গি প্রজননকেন্দ্র, জঙ্গি তৈরির কারখানা প্রভৃতি অপবাদ শুনতে শুনতে আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। কওমি মাদরাসাগুলোতে বহু তদন্ত হয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয়ভাবে। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবেও হয়েছে। সব তদন্তের ফলাফল হচ্ছে, কওমি মাদরাসা জঙ্গি কারখানা নয়। এর পরও আমাদের জুজুর ভয় দেখানোর জন্য প্রাচীন কল্পকাহিনীর মুখস্থ কথা শুনতে হয়। ইন্দোনেশিয়ার আবাসিক মাদরাসাগুলোকে শুধু বাইরের দেশ থেকে অপবাদ শুনতে হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোর ওপর দেশের ভেতর থেকেই একের পর এক অপবাদের ঢিল ছোড়া হয়। যারা অপবাদ দেয়, তাদের কোনো-না-কোনো স্বার্থ অবশ্যই আছে। যারা দেশের ভেতরে থেকে এই অপবাদে লিপ্ত, কখনো কি তারা ভেবে দেখেছে, কওমি মাদরাসাকে জঙ্গিবাদের কারখানা প্রমাণ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এরা দেশকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে। বাংলাদেশে কওমি মাদরাসাকে বলা হয় ‘জঙ্গিদের নিরাপদ আস্তানা’। অথচ এ কথা প্রমাণিত, কওমি মাদরাসায় কোনো সময় সামরিক ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা ছিল না এবং এখনো নেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনসিসির অধীনে যে সামরিক প্রশিণ দেয়া হয়, তারও কোনো ব্যবস্থা কওমি মাদরাসায় নেই। এমনকি এ ধরনের মাদরাসাগুলোতে শরীরচর্চারও কার্যক্রম নেই। তা সত্ত্বেও কওমি মাদরাসাকে জঙ্গি তৈরির উর্বর ত্রে হিসেবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ-ইন্দোনেশিয়া নয়, ভারত-পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বে মাদরাসা শিা তথা ইসলামি শিাকেন্দ্র মূলত আবাসিক। সর্বত্রই এ মাদরাসাগুলোকে ‘জঙ্গিবাদের
আস্তানা’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য ধর্মীয় শিা প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রায় আবাসিক। আমরা কিন্তু সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো সহিংসতা বা জঙ্গিপনার অভিযোগ কখনো শুনিনি। ইসলামি শিাকেন্দ্রগুলো পরিদর্শন ও তদন্তের নিমিত্তে সর্বদা সবার জন্য উন্মুক্ত। পান্তরে অন্যান্য ধর্মের এমন অনেক ধর্মীয় শিা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোতে প্রবেশাধিকার সবার জন্য উন্মুক্ত নয়।
প্রশ্ন করলাম, ইন্দোনেশিয়ায় জঙ্গিবাদের অভিযোগ কিভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে? ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রাদেশিক প্রধান ড. এইচ খাইরুদ্দিন জানালেন, তারা সমালোচনার দিকে না তাকিয়ে বরং মাদরাসা শিাকে সুন্দরভাবে পরিচালনার পাশাপাশি এর মান আরো উন্নত করার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। এর পাশাপাশি জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়েছেন। তিনি আরো জানালেন, এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিতে এক ইন্দোনেশিয়া গড়ার স্লোগান নিয়ে দেশের সামগ্রিক শিাব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করলেন, ইন্দোনেশিয়ায় সাড়ে সতেরো হাজারা বড়-ছোট দ্বীপ রয়েছে। কেউ যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক রাষ্ট্রের ঘোষণা না দেয়, তাই এক ইন্দোনেশিয়া গড়ার কথা বলা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮৭ ভাগ মুসলমান। এ জন্য এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিতেই ‘এক ইন্দোনেশিয়া’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে দেশটি এগিয়ে চলেছে। উল্লেখ্য, ২০০২ সালে জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে পূর্ব তিমুর ইন্দোনেশিয়া থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এরপর থেকেই ইন্দোনেশিয়া সরকার ‘এক ইন্দোনেশিয়া’ গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে করে পূর্ব তিমুরের মতো আর কেউ পৃথক হয়ে না যায়।
বাতাং জেলার ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জেলা প্রধান ও জেলা শিা কর্মকর্তার সাথেও আমাদের বৈঠক হলো। অনেক মাদরাসাও ঘুরে দেখলাম। যেখানেই গেছি, সেখানেই আমাদের উষ্ণ সংবর্ধনা ও আতিথেয়তা দেয়া হয়েছে। সর্বত্রই ইন্দোনেশিয়ান বাহাসা ভাষায় ‘সালামাত দাতাং’ বলে আমাদের শুভেচ্ছা জানানো হয়। সালামাত দাতাং অর্থ স্বাগতম। ‘সালামাত দাতাং ডি ইন্দোনেশিয়া’ অর্থ ইন্দোনেশিয়ায় স্বাগতম। বাহাসা ইন্দোনেশিয়া ভাষা আমার কাছে খুব সহজ মনে হলো। বাংলায় ব্যবহৃত সংস্কৃত (তৎসম) শব্দ এ ভাষায় প্রচুর রয়েছে। আরবি ও ফার্সি ভাষার শব্দও রয়েছে অনেক। ল্যাটিন অরে লেখা এ ভাষায় ১০ হাজারের মতো ইংরেজি মিশ্রিত ডাচ শব্দ রয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায় বেসরকারি মাদরাসাগুলো বিভিন্ন কমিউনিটির মাধ্যমে পরিচালিত। তন্মধ্যে মুহাম্মাদিয়া ফাউন্ডেশন, মাআরিফ ও নাহদাতুল উলামা উল্লেখযোগ্য। আমরা বাতাং জেলার কারাঙ্গাসেমে অবস্থিত মুহাম্মাদিয়া ফাউন্ডেশনের মাদারাসা ইবতিদায়িয়্যাহতে প্রবেশের সময় ছাত্রছাত্রীরা দুই দিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাগতম জানায়। এ সময় আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...’ বেজে ওঠে। জাতীয় সঙ্গীত জীবনে অনেক গেয়েছি, শুনেছি। কিন্তু এ বিদেশ বিভুঁইয়ে ভিনদেশী পরিবেশে জাতীয় সঙ্গীত হৃদয়ে অন্য রকম অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। প্রতিটি কাসের দরজায় ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দেখে আরো অবাক হলাম। সর্বত্র ঘুরে ইন্দোনেশিয়ার মাদরাসা শিার অগ্রগতি দেখলাম। শিার অগ্রগতির মাধ্যমে তারা এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। এ েেত্র সরকারের সহায়তা বেশ ইতিবাচক ও আন্তরিকতাপূর্ণ। জঙ্গিবাদের অপবাদ ঘুচিয়ে আমাদেরকেও মাদরাসা শিায় অগ্রগতি আনতে হবে। এ েেত্র সরকারের পর্যাপ্ত ভূমিকা খুবই প্রয়োজন।
লেখক : গবেষক ও অনুবাদক
ahmadimtiajdr@gmail.com
No comments