গাজায় ৫১ দিনের যুদ্ধে হামাস কি জিতেছে? by মখাইমার আবুসাদা
এই গ্রীষ্মে গাজায় ৫১ দিনব্যাপী যে যুদ্ধ
হয়েছে, তাতে দুই হাজার ১০০ ফিলিস্তিনি মারা গেছেন, আহত হয়েছেন ১১ হাজার। আর
যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতেও কয়েক বছর লেগে যাবে। গত ছয় বছরের
মধ্যে গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এটা তৃতীয় যুদ্ধ, ফলে অনেক ফিলিস্তিনিই এই
যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা এখন এমন একটি
সমাধানের পথ খুঁজছেন, যাতে তাঁদের দুর্ভোগ কমবে। ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে
হামাস এখন নতুন করে সামনে চলে এসেছে, কিন্তু তারা কি এ সমাধান দিতে পারবে?
এই যুদ্ধের আগে হামাস রাজনৈতিকভাবে একলা হয়ে পড়েছিল। সিরিয়া, ইরান ও হিজবুল্লাহর মধ্যে তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র ছিল, তারাও এখন হামাসের পাশে নেই। তবে হামাসের জন্য সবচেয়ে ক্ষতির কারণ হয়েছে মিসরীয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির উৎখাত। মুসলিম ব্রাদারহুড সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় হামাসের এখন অস্ত্র ও অন্যান্য সরবরাহ প্রাপ্তি বন্ধ হয়ে গেছে।
মিসরে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির নেতৃত্বে গঠিত সামরিক সরকার হামাসের ঘোর শত্রু, তারা সিনাইয়ে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী দলের মধ্যকার যুদ্ধের জন্য হামাসের ওপর দায় চাপিয়েছে। এমনকি মিসর সিনাই ও গাজার মধ্যকার সুড়ঙ্গগুলো ধ্বংস করার জন্য অভিযানও চালিয়েছে, ফলে গাজা একদম একা হয়ে পড়েছে।
এদিকে হামাস নানা রকম সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গাজায় ৪০ হাজার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা দিতে না পারায় হামাস এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়েছে, তার ওপর আবার ইসরায়েল ও মিসরের চাপাচাপিতে তাদের অবস্থা এখন তথৈবচ। আর জুনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তারা ঐকমত্যের সরকার গঠন করলেও সেটা তাদের জন্য কোনো স্বস্তি বয়ে আনতে পারেনি।
হামাসের হারানোর কিছু ছিল না, ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে আরেক দফা যুদ্ধ বাধিয়ে দিলে একটি ঝাঁকুনি দেওয়া যাবে, এই যুদ্ধের পেছনে হয়তো এ চিন্তাই কাজ করেছে। হামাস ৫১ দিন নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারায় তারা এখন ফিলিস্তিনি ও আঞ্চলিক রাজনীতির কেন্দবিন্দু হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে ইসরায়েল তার কোনো লক্ষ্যই অর্জন করতে পারেনি। এর মধ্যে প্রথম ছিল তাদের সক্ষমতা পুনরুদ্ধার। হ্যাঁ, ইসরায়েলের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও হামাস গাজার উত্তরাঞ্চল হাইফা থেকে আশকেলন ও দক্ষিণের ডিমোনা থেকে ইসরায়েলের জনবহুল এলাকায় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। আর ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের মাধ্যমে যখন-তখন ইসরায়েলের স্থলসীমানায় ঢুকে পড়েছে।
এসব কারণে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অদম্য ভাবমূর্তি একদম ধসিয়ে দিয়েছে, তাদের যে দুর্বলতা দেখা গেছে, তার সুযোগ ইসলামপন্থী ও অন্যরা নেওয়ার চেষ্টা করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এটা কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে হামাস গাজার সীমান্তে বসবাসরত ইসরায়েলি নাগরিকদের পালাতে বাধ্য করতে পেরেছিল। ফলে বহু ইসরায়েলি নাগরিকই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন।
সংক্ষেপে বললে, এই গাজা যুদ্ধ বিদ্যমান অবস্থা ধসিয়ে দিয়েছে। এতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে না বা যে কারণে এই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে, সেই কারণও দূর হবে না। ২০১২ সালেও ইসরায়েল গাজার হামলা বন্ধে কিছু শর্ত মেনে নিয়েছিল, কিন্তু সেই ঐকমত্য কখনোই তারা বাস্তবায়ন করেনি।
ইসরায়েল এখন গাজার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে মানবিক ও নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সুযোগ করে দেবে, সেটা সবাই আশা করছে। আরও কিছু জটিল ইস্যু রয়েছে, যেমন: ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি, গাজায় একটি সমুদ্র ও বিমানবন্দর নির্মাণ প্রভৃতি বিষয় পরবর্তী বৈঠকে আলোচনার জন্য তুলে রাখা হবে। আর গাজায় কোনো নিরস্ত্রীকরণ না হলে ইসরায়েল হামাসের দাবি মেনে নেবে—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
হামাস এর চেয়ে বেশি কিছু পেত না। গাজার রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ভঙ্গ করে এই যুদ্ধবিরতিতে গাজা অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবে, এমনটা আশা করা হচ্ছে। হামাসই এখন সবকিছুর কেন্দ্রে, ফলে গাজার পুনর্গঠনকাজের সফলতার জন্যও তারা যেমন দায়ী থাকবে, তেমনি ফিলিস্তিনের সবকিছু মিটমাটের দায়ভারও তাদের ওপর বর্তেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও হামাসের ওপর নানা রকম চাপ দিচ্ছে। তারা যেমন ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কথা বলছে, তেমনি ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিয়েও তারা কথা তুলেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘এই সমস্যার মূলে না গেলে কোনো শান্তি আলোচনাই কাজে আসবে না, আবারও রক্তপাত শুরু হবে।’
আসলে এখানে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে, কিন্তু হামাস এই ছাড় দিতে রাজি নয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে, তাদের তরফে পরিষ্কার থাকার জন্য এই দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধানে হামাসকে সঙ্গে রাখা।
ইসরায়েলের সাবেক প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেস একবার বলেছিলেন, ‘আসল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কোনো সংকটকে কাজের সুযোগে পরিণত করা, তা সে সংকট যত বড়ই হোক না কেন।’ সব কুশীলবকেই এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে, সুনির্দিষ্ট, উৎপাদনমুখী ও সৃজনশীল পদক্ষেপ নিয়ে গাজায় শান্তি আনতে হবে।
হামাস তার ভূমি আঁকড়ে থাকার ক্ষমতা প্রমাণ করেছে। দশকের পর দশক ধরে অচলাবস্থা ও মুখ দেখাদেখি না থাকার পর হামাসের এখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে তেমন শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, তাদের উচিত দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করা।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
মখাইমার আবুসাদা: গাজার আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক।
No comments