রইসউদ্দিনকে নিয়ে বই, ছবি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী রইসউদ্দিন
ভূঁইয়ার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় নিয়ে লিখেছেন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর
সাংবাদিক আনন্দ গিরিধরদাস। বইয়ের শিরোনাম ‘দ্য ট্রু আমেরিকান: মার্ডার
অ্যান্ড মার্সি ইন টেক্সাস’। এতে উঠে এসেছে এক প্রবাসীর অনন্য কীর্তি। তাকে
যে বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ হত্যার চেষ্টা করেছিল, তারই প্রাণরক্ষায় প্রচারণা
চালান রইসউদ্দিন। আনন্দের লেখায় ফুটে উঠেছে ঘটনার ইতিবৃত্ত। আইরিশ টাইমসে
বইটি নিয়ে একটি রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়, রইসউদ্দিন ‘রইস’ ভূঁইয়া
২০০১ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে পৌঁছান তখন তার বয়স ছিল ২৭ বছর।
বাংলাদেশী বিমানবাহিনীর একজন প্রশিক্ষিত বিমানচালক ছিলেন তিনি। একাধারে
কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে তিনি পারদর্শী। রইস এমন একজন প্রবাসী যাকে ভালবাসে
যুক্তরাষ্ট্র। উচ্চাকাঙ্ক্ষী, শিক্ষিত, নিজ দেশে তাদের সম্ভাবনা
বাধাগ্রস্ত হয়েছে আর আমেরিকান স্বপ্ন বাস্তবায়নের একনিষ্ঠ লক্ষ্যে এন্ট্রি
লেভেল চাকরিতে দীর্ঘ ঘণ্টা ধরে পরিশ্রম করতে আগ্রহী। রইসের মতো অভিবাসীদের
নিয়ে কখনও কখনও ধাঁধায় পড়ে যান মার্ক স্ট্রোম্যানের মতো মার্কিনিরা। এমনকি
খোদ যুক্তরাষ্ট্রই বিভ্রান্ত হয়ে যায় তারা কোথা থেকে গেছেন সেটা বিবেচনায়,
যেখানে মার্কিনিদের বড় গর্বের স্বাধীনতা সীমিত। বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক
দ্বন্দ্বে এ স্বাধীনতা জটিল রূপ ধারণ করেছে। সেখানে স্বাধীনতা আর নিজস্বতা
ঊর্ধ্বমুখী গতিময়তার দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে মানুষকে ব্যর্থ করে তুলতে
পারে। বাংলাদেশের মতো সমালোচনামূলক একটি কঠোর সমাজে যেমনটা হওয়া অসম্ভব নয়।
ভিন্ন দুই পথের যাত্রী এ দু’টি মানুষের দেখা হয়েছিল যেদিন স্ট্রোম্যান
হিংস্রতা নিয়ে ডালাসের রাস্তায় ‘আরবদের’ শিকার করতে বেরিয়েছিল। সেটা ছিল
১১ই সেপ্টেম্বর হামলা-পরবর্তী সময়ের ঘটনা। আনন্দ গিরিধরদাস তার দ্য ট্রু
আমেরিকান বইতে সে কাহিনীই তুলে ধরেছেন। ২০০১ সালে স্ট্রোম্যানের বয়স ছিল ৩১
বছর। তার জীবন এমনিতেই ছিল বিশৃঙ্খল। বেড়ে ওঠছিল ভারসাম্যহীনতা আর
নির্যাতনের মধ্য দিয়ে। সম্ভবত অ্যালকোহলে টান ছিল জন্মগতভাবেই। নানা ধরনের
মাদক নিতো সে। ছিল সাম্প্রদায়িক বৈষম্যমূলক বর্ণবাদী। বিদেশীদের প্রতি
অহেতুক ঘৃণা বা ভয় কাজ করতো তার মধ্যে। আর তার কাছে ছিল উল্লেখযোগ্য
আগ্নেয়াস্ত্র। জেলে যাওয়া-আসা হয়েছে কয়েকবার। ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলা
স্ট্রোম্যানের ক্রোধ উসকে দেয়। সে নিজেকে আমেরিকান সন্ত্রাসী ঘোষণা দেয়। আর
৯/১১-এর কয়েক দিন বাদে তিনজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে টার্গেট করে। বাসুদেব
পাটেল নামক এক ভারতীয়, ওয়াকার হাসান নামক এক পাকিস্তানিকে হত্যা করে। আর
বাংলাদেশী রইসউদ্দিন ভূঁইয়াকে হত্যার চেষ্টা করে। নিজের এহেন অপরাধকে
দেশপ্রেম বলে আখ্যা দেয়। পরে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। দোষী
সাব্যস্ত হয়ে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়। হামলায় রইস গুরুতর আহত হন। এক চোখের
দৃষ্টি হারান। ইনস্যুরেন্স না থাকায় দ্রুতই হাজার হাজার ডলার মেডিকেল বিল
জমতে থাকে। ঢাকায় তার বাগদত্তা তাকে ছেড়ে চলে যায়। প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন
দেখতে থাকেন রইস। অতীতের ফ্ল্যাশব্যাক নাড়া দেয় অহরহ। হতাশায় ডুবে যান
তিনি। তবে রইস হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র ছিলেন না। ওয়েটার হিসেবে চাকরি পান।
আবারও শুরু করেন পড়াশোনা। শেষ পর্যন্ত ভাল একটি আইটি চাকরি পান। ২০০৯ সালে
রইস তার মাকে মক্কায় নিয়ে যান। পুণ্যভূমিতে গিয়ে রইসের মনে পড়ে মিনিমার্টে
গোলাগুলির দিন অঙ্গীকার করেছিলেন, সৃষ্টিকর্তা যদি তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেন
তাহলে অন্যদের জন্য ভাল কিছু করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করবেন। যুক্তরাষ্ট্রে
ফিরে গিয়ে রইস পরিকল্পনা করলেন, তিনি জনসমক্ষে স্ট্রোম্যানকে ক্ষমা করে
দেবেন। শুধু তাই নয়, তার ওপর হামলাকারীর প্রাণরক্ষা করতে প্রচারণা চালাবেন।
রইসউদ্দিন ভূঁইয়া একজন মুসলিম আর তিনি ক্ষমা প্রদর্শনের বার্তা খুঁজে
নিলেন পবিত্র কোরান থেকে। এদিকে স্ট্রোম্যান এক রকম মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত
সেলিব্রিটি হয়ে পড়লো। ইসরাইলি ডকুমেন্টারি নির্মাতা ইলান জিভের সহযোগিতায়
একটি ব্লগ লেখা শুরু করে সে। তৃণমূল শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি কর্মকাণ্ড নিয়ে
গবেষণা করতে গিয়ে স্ট্রোম্যানকে খুঁজে পান ইলান। তিনিসহ অনেকেরই বিশ্বাস
ছিল স্ট্রোম্যানের মধ্যে পরিবর্তন আসছিল। কিন্তু স্ট্রোম্যানের পরিবারের
দু’জন সদস্যের ধারণা ছিল, সে এসব ভাল মানুষকে ঠকাচ্ছে আর নিজেকে বাঁচানোর
জন্য সব কিছুই বলবে সে। এদিকে স্ট্রোম্যানের দণ্ড লঘু করতে টেক্সাসের
আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে রইসের প্রচারণার অগ্রগতি হচ্ছিল সামান্যই। ২০১১ সালে
দণ্ড কার্যকরের যখন আর বেশি দিন বাকি নেই, তখন রইস একটি মামলা করেন। তিনি
যুক্তি উপস্থাপন করেন, স্ট্রোম্যানের মৃত্যুদণ্ড হলে টেক্সাস আইনের অধীনে
হামলার শিকার ও হামলাকারীর মধ্যে মধ্যস্থতায় স্ট্রোম্যানের অধিকার
প্রত্যাখ্যান করা হবে। শেষ পর্যন্ত মামলায় হেরে যান রইস আর স্ট্রোম্যানের
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। রইসউদ্দিন ভূঁইয়া তার এ প্রচারণা শুরুর সময়
‘ওয়ার্ল্ড উইদাউট হেট’ নামে যে ফাউন্ডেশন স্থাপন করেছিলেন তা এখনও
ঘৃণাপ্রসূত অপরাধকর্ম প্রতিহত করতে কাজ করে যাচ্ছে। গিরিধরদাস তার বইয়ে
সত্যিকারের আমেরিকান স্বপ্নের বাস্তবতা আসলে কি তা নিয়ে বারবার প্রশ্ন
তুলেছেন। এক পর্যায়ে তিনি লিখেছেন, বিড়ম্বনা হলো, উদাহরণস্বরূপ আজকের
সত্যিকারের আমেরিকান হয়তো হতে পারে একজন মুসলিম, যিনি ভাঙা ভাঙা ইংলিশ
বলেন। কিন্তু স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান, যারা কিনা তাকে ভয় করে বা অবজ্ঞা
করে তাদের থেকে অনেক বেশি বিনয় আর আবেগ দিয়ে ওই স্বপ্নে বিশ্বাস করেন।
ইতিমধ্যে গিরিধরদাসের ট্রু আমেরিকান বইয়ের ফিল্ম রাইটস বিক্রি হয়ে গেছে।
হলিউডের পর্দায় আসার অপেক্ষায় থাকা চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করবেন প্রখ্যাত
পরিচালক ক্যাথরিন বাইগেলো।
No comments