চট্টগ্রামে বিচারক খুন- কাবিননামা নিয়ে লুকোচুরি by মহিউদ্দীন জুয়েল
মুখ খুলছেন না মিশু। রহস্যজনকভাবে চুপচাপ
রয়েছেন তার মা লাকী আক্তার। আদালতে বড় দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা চলছিল। এ
সময় একদিন মায়ের সঙ্গে সেখানে যান মিশু। তারপর নজরে পড়ে যান বিচারক সাঈদের।
আদালতপাড়ায় ঘোরাঘুরি করতে দেখে তাদের ডাক দেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে
গিয়ে সুসম্পর্ক তৈরি হয় দু’জনের মধ্যে। সেখান থেকেই সাঈদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ
সম্পর্ক তৈরি হয় কথিত স্ত্রী বলে পরিচয় দেয়া মিশুর।
তবে বিচারক সাঈদকে বিয়ে করেছে বলে দাবি করলেও কোন ধরনের কাগজপত্র কিংবা কাবিননামার কপি উপস্থাপন করতে পারেন নি। এ ঘটনায় একজন কাজীর কথা বললেও তার কোন হদিস মিলছে না। খুনের ব্যাপারেও কোন ধরনের তথ্য দিতে চাইছে না মা-মেয়ে। গত দু’দিন ধরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বিচারকের মারা যাওয়ার ব্যাপারে নীরব রয়েছে তারা। গতকাল সকালে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিশুর আচরণ সন্দেহজনক বলে জানান নগর পুলিশের কর্মকর্তারা।
রিমান্ডে মিশু ও তার মায়ের কাছে একাধিকবার খুনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু বারবারই তারা প্রসঙ্গ এড়িয়ে কিভাবে পরিচয় হলো সে বিষয়ে কথা বলে। তবে দু’জনই একই ধরনের তথ্য দিয়েছে রিমান্ডে। বলেছে খুন হওয়ার কথা তারা কিছুই জানেন না। বিচারক সাঈদ নিজেই রুমের দরজা বন্ধ করে ধারালো কাঁচি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ ক্ষেত্রে মাথার পেছনে আঘাত পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোন জবাব দেয়নি।
রিমান্ডে মিশুকে জিজ্ঞাসা করা হয় বিচারক সাঈদের প্রথম স্ত্রী রয়েছে। তার পরও কেন তাকে বিয়ে করা? তা ছাড়া বিয়ে যদি হয়েই থাকে তাহলে তা গোপন করা হলো কেন? বিয়ের কাবিননামার কথা বলা হলেও তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জবাবে মিশু প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেন, ঘটনার আগে আমার সঙ্গে তার (বিচারক) অনেক ঝগড়াঝাঁটি হয়। পারিবারিক মান-অভিমান। সেই অভিমান থেকে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় সাঈদ। অনেক ডাকাডাকি করার পর দরজা না খোলায় সন্দেহ হয় আমার। পরে ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখি জানালার গ্রিলের সঙ্গে সে ঝুলে আছে। বিয়ের প্রসঙ্গে বলে, আদালতে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। সে দেখতে হ্যান্ডসাম। আমারও ভাল লাগে। সেখান থেকে একদিন বাসার ঠিকানা চায়। আমিও না করিনি। এরপর একদিন-দু’দিন থেকে ঘন ঘন আসা-যাওয়া করতো। গত জুন মাসে আমরা বিয়ে করি। তবে কাউকেই কিছু জানাইনি। ভেবেছি সময় হলে জানতে পারবে সবাই। তার প্রথম স্ত্রীর বিষয়ে কিছুটা জানতাম।
তাহলে মাথায় আঘাত করলো কে? রক্ত এলো কোথা থেকে- প্রশ্ন করায় শিশু বলেন, আমরা তাকে কোন ধরনের আঘাত করিনি। সে ধারালো কাঁচি দিয়ে নিজেকে আঘাত করতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। কেননা ঘটনার সময় সে বেশ রাগান্বিত ছিল।
মিশুর মা লাকী আক্তারও পুলিশের রিমান্ডে খুনের বিষয়টি অনেকখানি চেপে গেছেন। তার কাছে এক কর্মকর্তা জানতে চান, মাথায় কাঁচি দিয়ে আঘাত করার পর তার শরীর থেকে যে পরিমাণ রক্ত গেছে তাতে আত্মহত্যা করার মতো কোন ঘটনা ঘটানো তার পক্ষে সে সময় সম্ভব নয়। তা ছাড়া আগে যদি আত্মহত্যা করেন তাহলে মাথায় আঘাত করলো কে? কেননা ময়না তদন্ত রিপোর্টে লোহা বা রডজাতীয় কিছু দিয়ে পেছন থেকে আঘাত করার আলামত পাওয়া গেছে।
জবাবে মিশুর মা লাকী আক্তার বলেন, কে মেরেছে তা আমরা দেখিনি। দরজা ভেঙে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে মেডিকেল পুলিশ আমাদের আটকে রাখে। আবু সাঈদের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এটি মিথ্যা নয়। এ ব্যাপারে আর কিছু জানি না।
নগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মিশু, তার মা লাকী আক্তার, মিশুর ভাই ইমরান আহমেদ ও বাসার কাজের পরিচারিকা রীমা আক্তারকে আরও দু’দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, খুব সহজে এ বিষয়ে তারা কোন ধরনের তথ্য দেবে না। এ ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদে আরও কৌশল অবলম্বন করার ছক কষছেন কর্মকর্তারা। সবাই খুনের প্রসঙ্গটি এড়িয়ে পূর্বপরিচয়ের বিষয়ে কথা বলছে।
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের প্রসঙ্গে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (পশ্চিম) এস এম তানভির আরাফাত মানবজমিনকে বলেন, খুনিরা কৌশলী। তবে সব কিছুই উন্মোচিত হয়ে যাবে।
গত ১৭ই সেপ্টেম্বর রাতে নগরীর হালিশহরের মোল্লাপাড়া এলাকার একটি বাসা থেকে কাজী আবদুল হাসিব আবু সাঈদ (৪৭) নামের এক বিচারককে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান গ্রেপ্তার হওয়া ওই দুই নারী। ওই সময় তারা দাবি করেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। পরে তাদের কথাবার্তায় সন্দেহ হয় মেডিকেল পুলিশের। এরপর দু’জনকে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে চারজনকে আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বিচারক সাঈদের নওগাঁয় এক স্ত্রী রয়েছে। সেখানে আছে দুই সন্তান। পরিবারের লোকজন জানতেন সেটিই সুখের সংসার। কিন্তু মৃত্যুর পর বেরিয়ে এসেছে আরেক নতুন তথ্য। মিশু নামের এক মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক ছিল তার। গত জুন মাসে গোপনে বিয়ে হয় তাদের। এরপর থেকে আলাদা বাসা নিয়ে প্রথম স্ত্রীর অগোচরে থাকতেন তিনি। আর এ নিয়ে অশান্তি শুরু। সেখান থেকেই হত্যা বলে ধারণা স্থানীয় লোকজনের।
No comments