স্যালুট, বিচারপতি নিজামুল হক by জাকিয়া আহমেদ
একজন বিচারপতি শপথ নেন, দায়িত্ব পালন করেন। তাই বলে কি তিনি রোবট? তিনিও তো একজন মানুষ। নতুন একটি আইন নিয়ে একজন আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে তিনি কথা বলতেই পারেন। সব সময়ই তিনি ওপেন কোর্টে বলেছেন, ‘এটি একটি নতুন আইন। আমরা সবার কাছ থেকেই শিখছি।’
নতুন একটি আইন নিয়ে তিনি বিচার করতে যাচ্ছেন। তাই সে বিচারের একটি আন্তর্জাতিক মান তিনি বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। যে কারণে ইন্টারনেটের এই যুগে স্কাইপেতে একজন অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গে আইন নিয়েই কথা বলেছেন তিনি।
তিনি হচ্ছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম। গত মঙ্গলবার তিনি পদত্যাগ করেছেন।
স্কাইপিতে বেলজিয়াম প্রবাসী বাংলাদেশি আন্তর্জাতিক ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে তার কথোপকথন ধারাবাহিকভাবে গত কয়েকদিন ধরে প্রকাশ করে আসছে দৈনিক আমার দেশ। কিন্তু আমার দেশে প্রকাশিত কথোপকথনের কোথাও কি সদ্য বিদায়ী এই বিচারপতি রায় কি হবে বা কিভাবে হবে সে নিয়ে কোনো একটি কথাও বলেছেন? চার দিন ধরে প্রকাশিত বিশাল বিশাল প্রতিবেদনগুলোর কোথাও বিচারপতি নিজামুল হক কিংবা আহমেদ জিয়াউদ্দিন কার মামলার রায় কি হবে সে বিষয়ে কোনো কথা বলেছেন বলে প্রকাশ করতে পারেনি। বরং প্রতিবেদনগুলোতেই বোঝা যাচ্ছে, তারা কথা বলেছেন ট্রায়ালের প্রসিডিংস নিয়ে। প্রতিদিনের বিচার সর্ম্পকিত আলোচনা করেছেন তারা।
বিচারপতি নিজামুল হক জিজ্ঞেস করেননি, ‘কাকে কি করবো?’। কিংবা এতোদিন ধরে চলা এই বিচারে নিজামুল হকের দেওয়া কোনো আদেশ নিয়েও তারা কথা বলেননি কিংবা হয়নি কোনো এভিডেন্স টেকিং নিয়ে কথা। কথোপকথন যা কিছু হয়েছে সবই দু’জন বন্ধুর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা।
সেখানে কথা হয়েছে শারীরিক অসুবিধা, পারিবারিক দাওয়াত এবং সামাজিক অনুষ্ঠান নিয়েও। হ্যাঁ, সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীদের নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু নিজেদের ঘরে আমরা যখন কথা বলি রাজা, উজির আমরা সবাই মারি। একান্তই ব্যক্তিগত আলাপে আমরা এভাবে কথা বলে থাকি। এখানেও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ২৫ বছরের বন্ধু তারা। দু’জন আইনের মানুষ ব্যক্তিগত আলাপে আইন নিয়েই বেশি কথা বলবেন, এটাই স্বাভাবিক।
দৈনিক আমার দেশ যে কথোপকথন প্রকাশ করেছে, সেখানে রায় নিয়ে একটি মাত্র কথা রয়েছে। সেটি হলো ‘সরকার গেছে পাগল হইয়া, তারা একটা রায় চায়’। আর এখানেই রয়েছে বিচারপতি নিজামুল হকের সততার পরিচয়। তিনি জানেন, সরকার একটা রায় চায়। কিন্তু তিনি যে কোনো উপায়ে রায় চাননি। তিনি শুধু সরকারের চাওয়াটাকে তার বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করেছেন। আর এটা খুবই স্বাভাবিক।
ইকোনোমিস্ট তাদের চলতি সংখ্যায় (১৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত) বলেছে, সরকার নিজামুল হকের ওপর চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছে, যদিও তিনি তা ঠেকানোর চেষ্টা করছেন বলে মনে হয় (The material suggests the government tried to put pressure on Mr Nizamul, albeit he seems to have resisted it)।
আর আহমেদ জিয়াউদ্দিনও নিজামুল হককে বলেছেন, ‘আমাদেরকে একটা ব্যাপার তাদের বোঝাতে হবে, যে এটি কোনো পণ্য নয় যে, আপনি হুকুম করবেন আর যন্ত্রের মাধ্যমে তা তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসবে’। এই বলে তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা বিষয়টি তাদেরকে বোঝানোর অবস্থাতেও নেই। তারপরও আমরা চেষ্টা করতে পারি, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি’।
পরের দিন বিচারপতি নিজামুল হক ড. আহমেদকে বলেছেন, সেদিন সন্ধ্যাতেই সরকারের একজন তাকে দ্রæত রায় দেওয়ার কথা বলেছেন কিন্তু বিচারপতি তাকে বলেছেন, ‘আমি তাকে বললাম, সেটা কিভাবে সম্ভব?’ (In a conversation the next day, Mr Nizamul described how a member of the government “came to visit me this evening. He asked me to pass this verdict fast. I told him ‘how can I do that?’..)
এখানেইতো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিচারপতি নিজামুল হক কারো কাছে নতি স্বীকার করতে চাননি। তিনি চেয়েছেন, আইন তার নিজ গতিতে চলবে। আহমেদ জিয়াউদ্দিনও চেয়েছেন সরকারকে বোঝাতে। তাহলে কি নিজামুল হকের সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা চলে?
এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘সরকার একটা রায় চায়। এই তথ্যতো নতুন কিছু নয়। এই সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেই রয়েছে মানবতাবিরোধীদের বিচার। তাই তারা সেটা করতেই চাইবে। তারা এটা নিয়ে সব সময় কথা বলে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রী এটা নিয়ে কথা বলছেন।’’
‘‘কিন্তু এখানে বিচারপতি নিজামুল হক কি করেছেন, সেটাই হলো দেখার বিষয়। বিচারপতি নিজামুল হক আন্তর্জাতিক এবং সরকারের কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। তিনি তার মতো করে আইন অনুযায়ী বিচার কাজ চালিয়ে গেছেন এবং বিচার নিয়ে কোনো কথা বলেননি। বিচার নিয়ে যা কথা হয়েছে, সেটা হয়েছে কি করে বিচারকে স্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক মানের করা যায় এবং বিচার কাঠামো নিয়ে।’’
ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজ আরও বলেন, ‘‘কথিত ওই কথোপকথন শুনলে মনে হয়, সরকারের এই চাওয়া নিয়ে কিছুটা বিরক্তই ছিলেন নিজামুল হক। সেই সঙ্গে বিরক্ত ছিলেন ড. জিয়াউদ্দিনও। আর বিচারপতির কথিত কথোপকথনে আইনের লাভ ক্ষতি কিছুই হয়নি। বরং তিনি বিচার ব্যবস্থার প্রতি সংশয়ের জন্ম না দিয়ে চলে গেছেন। তার জন্য এই বিচার নিয়ে জনগনের মনে কোনো সংশয় থাক, সেটাও তিনি চাননি। ধন্যবাদ তাকে।’’
শুরু থেকেই আসামিপক্ষ এই বিচারকে প্রহসনমূলক বলে এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলেন। এবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ট্রাইব্যুনাল-১ এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন। তারা এরই মধ্যে বলেছেন, ‘সাঈদীর মামলার অভিযোগ (চার্জ) পুনরায় গঠন করতে হবে। রিট্রায়াল শুরু করতে হবে আবার।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘‘তাদের এই সব কথা জাতি আর শুনতে চায় না। বর্তমান সময়ে যে কেস যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকেই নতুন চেয়ারম্যান কাজ শুরু করতে পারবেন।’’
অপরদিকে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট’৭৩ এর ৬(৪) এবং ৬(৬) এ স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘বিচার কাজ যেটা যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকেই শুরু করা যাবে’। একজন বিচারপতি অনুপস্থিত থাকলে বা না থাকলে (যে কোনো কারণেই বিচারপতি পরিবর্তন হতে পারেন) বিচার ব্যবস্থা কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে না।’’
অভিযোগ দাখিলের পর অভিযোগ আমলে নেওয়ার সময় আর রায় দেওয়ার সময় তিন জন বিচারপতি থাকতে হবে বলে জানান প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। যুক্তিতর্ক এবং অন্যান্য সময়ে দু’জন বিচারপতিও বিচারকাজ চালিয়ে নিতে পারেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম আসামি হিসেবে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার এখন শুধু রায়ের জন্য অপেক্ষা। যে কোনো দিন রায় দেবেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সুত্র বাংলানিউজকে বলেন, যদি কোনো বিচারপতি পরিবর্তন হয় এবং তার স্থানে আসা নতুন বিচারপতি যদি যুক্তিতর্ক শুনতে চান, তাহলে তিনি শুনতে পারবেন। কিন্তু এতে কোনো বাধাধরা নিয়ম নেই। এটা পুরোপুরি নতুন বিচারপতির ওপর নির্ভর করে। আর এই মামলায় যুক্তিতর্কের লিখিত কপি উভয়পক্ষই জমা দিয়েছেন। তাই আসামিপক্ষের নতুন করে ট্রায়াল করতে হবে এ দাবি অযৌক্তিক।
বিচারপতি নিজামুল হক একটা ল্যান্ডমার্ক জাজমেন্ট দিতে চেয়েছিলেন বলেই তিনি আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আইন নিয়ে আলাপ করেছেন। তিনি ড. জিয়াউদ্দিনের কাছে জানতে চাননি, ‘কাকে কিভাবে রায় দিলে ঝুলানো যাবে, সে উপায় বাৎলে দিন।’
বিচারপতি নিজামুল হকের উদ্দেশ্য ছিল, নতুন আইন নিয়ে জানা।
একটি শীর্ষ স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক, যিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাভার করেন, তিনি বলেন, ‘‘এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেদিন থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া বিচারপতি নিজামুল হক একটি দিনের জন্যও ট্রাইব্যুনালে আসা থেকে বিরত থাকেননি। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল ৪টা, কখনো সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এজলাস কক্ষে বিচার কাজ পরিচালনা করেছেন। আবার রাতেও তিনি কিভাবে এই বিচারকে আন্তর্জাতিক মানের করা যায় সেটা নিয়েও কথা বলেছেন আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। এখানেও পাওয়া যায় তার সততার পরিচয়।’’
তাই বলতে চাই, ফেয়ার ট্রায়াল নিশ্চিত করতে কোনো বিতর্ক যেন এ বিচারকে কালিমা লেপন করতে না পারে, তাই তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে চলে গেছেন।
তাই বিচারপতি নিজামুল হক, আপনাকে স্যালুট। জাতি আপনার কথা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।
স্কাইপিতে বেলজিয়াম প্রবাসী বাংলাদেশি আন্তর্জাতিক ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে তার কথোপকথন ধারাবাহিকভাবে গত কয়েকদিন ধরে প্রকাশ করে আসছে দৈনিক আমার দেশ। কিন্তু আমার দেশে প্রকাশিত কথোপকথনের কোথাও কি সদ্য বিদায়ী এই বিচারপতি রায় কি হবে বা কিভাবে হবে সে নিয়ে কোনো একটি কথাও বলেছেন? চার দিন ধরে প্রকাশিত বিশাল বিশাল প্রতিবেদনগুলোর কোথাও বিচারপতি নিজামুল হক কিংবা আহমেদ জিয়াউদ্দিন কার মামলার রায় কি হবে সে বিষয়ে কোনো কথা বলেছেন বলে প্রকাশ করতে পারেনি। বরং প্রতিবেদনগুলোতেই বোঝা যাচ্ছে, তারা কথা বলেছেন ট্রায়ালের প্রসিডিংস নিয়ে। প্রতিদিনের বিচার সর্ম্পকিত আলোচনা করেছেন তারা।
বিচারপতি নিজামুল হক জিজ্ঞেস করেননি, ‘কাকে কি করবো?’। কিংবা এতোদিন ধরে চলা এই বিচারে নিজামুল হকের দেওয়া কোনো আদেশ নিয়েও তারা কথা বলেননি কিংবা হয়নি কোনো এভিডেন্স টেকিং নিয়ে কথা। কথোপকথন যা কিছু হয়েছে সবই দু’জন বন্ধুর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা।
সেখানে কথা হয়েছে শারীরিক অসুবিধা, পারিবারিক দাওয়াত এবং সামাজিক অনুষ্ঠান নিয়েও। হ্যাঁ, সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীদের নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু নিজেদের ঘরে আমরা যখন কথা বলি রাজা, উজির আমরা সবাই মারি। একান্তই ব্যক্তিগত আলাপে আমরা এভাবে কথা বলে থাকি। এখানেও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। ২৫ বছরের বন্ধু তারা। দু’জন আইনের মানুষ ব্যক্তিগত আলাপে আইন নিয়েই বেশি কথা বলবেন, এটাই স্বাভাবিক।
দৈনিক আমার দেশ যে কথোপকথন প্রকাশ করেছে, সেখানে রায় নিয়ে একটি মাত্র কথা রয়েছে। সেটি হলো ‘সরকার গেছে পাগল হইয়া, তারা একটা রায় চায়’। আর এখানেই রয়েছে বিচারপতি নিজামুল হকের সততার পরিচয়। তিনি জানেন, সরকার একটা রায় চায়। কিন্তু তিনি যে কোনো উপায়ে রায় চাননি। তিনি শুধু সরকারের চাওয়াটাকে তার বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করেছেন। আর এটা খুবই স্বাভাবিক।
ইকোনোমিস্ট তাদের চলতি সংখ্যায় (১৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত) বলেছে, সরকার নিজামুল হকের ওপর চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছে, যদিও তিনি তা ঠেকানোর চেষ্টা করছেন বলে মনে হয় (The material suggests the government tried to put pressure on Mr Nizamul, albeit he seems to have resisted it)।
আর আহমেদ জিয়াউদ্দিনও নিজামুল হককে বলেছেন, ‘আমাদেরকে একটা ব্যাপার তাদের বোঝাতে হবে, যে এটি কোনো পণ্য নয় যে, আপনি হুকুম করবেন আর যন্ত্রের মাধ্যমে তা তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসবে’। এই বলে তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা বিষয়টি তাদেরকে বোঝানোর অবস্থাতেও নেই। তারপরও আমরা চেষ্টা করতে পারি, তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি’।
পরের দিন বিচারপতি নিজামুল হক ড. আহমেদকে বলেছেন, সেদিন সন্ধ্যাতেই সরকারের একজন তাকে দ্রæত রায় দেওয়ার কথা বলেছেন কিন্তু বিচারপতি তাকে বলেছেন, ‘আমি তাকে বললাম, সেটা কিভাবে সম্ভব?’ (In a conversation the next day, Mr Nizamul described how a member of the government “came to visit me this evening. He asked me to pass this verdict fast. I told him ‘how can I do that?’..)
এখানেইতো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বিচারপতি নিজামুল হক কারো কাছে নতি স্বীকার করতে চাননি। তিনি চেয়েছেন, আইন তার নিজ গতিতে চলবে। আহমেদ জিয়াউদ্দিনও চেয়েছেন সরকারকে বোঝাতে। তাহলে কি নিজামুল হকের সততা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা চলে?
এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘সরকার একটা রায় চায়। এই তথ্যতো নতুন কিছু নয়। এই সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেই রয়েছে মানবতাবিরোধীদের বিচার। তাই তারা সেটা করতেই চাইবে। তারা এটা নিয়ে সব সময় কথা বলে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রী এটা নিয়ে কথা বলছেন।’’
‘‘কিন্তু এখানে বিচারপতি নিজামুল হক কি করেছেন, সেটাই হলো দেখার বিষয়। বিচারপতি নিজামুল হক আন্তর্জাতিক এবং সরকারের কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। তিনি তার মতো করে আইন অনুযায়ী বিচার কাজ চালিয়ে গেছেন এবং বিচার নিয়ে কোনো কথা বলেননি। বিচার নিয়ে যা কথা হয়েছে, সেটা হয়েছে কি করে বিচারকে স্বচ্ছ, আন্তর্জাতিক মানের করা যায় এবং বিচার কাঠামো নিয়ে।’’
ব্যারিষ্টার তুরিন আফরোজ আরও বলেন, ‘‘কথিত ওই কথোপকথন শুনলে মনে হয়, সরকারের এই চাওয়া নিয়ে কিছুটা বিরক্তই ছিলেন নিজামুল হক। সেই সঙ্গে বিরক্ত ছিলেন ড. জিয়াউদ্দিনও। আর বিচারপতির কথিত কথোপকথনে আইনের লাভ ক্ষতি কিছুই হয়নি। বরং তিনি বিচার ব্যবস্থার প্রতি সংশয়ের জন্ম না দিয়ে চলে গেছেন। তার জন্য এই বিচার নিয়ে জনগনের মনে কোনো সংশয় থাক, সেটাও তিনি চাননি। ধন্যবাদ তাকে।’’
শুরু থেকেই আসামিপক্ষ এই বিচারকে প্রহসনমূলক বলে এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে আসছিলেন। এবার এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ট্রাইব্যুনাল-১ এর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন। তারা এরই মধ্যে বলেছেন, ‘সাঈদীর মামলার অভিযোগ (চার্জ) পুনরায় গঠন করতে হবে। রিট্রায়াল শুরু করতে হবে আবার।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘‘তাদের এই সব কথা জাতি আর শুনতে চায় না। বর্তমান সময়ে যে কেস যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকেই নতুন চেয়ারম্যান কাজ শুরু করতে পারবেন।’’
অপরদিকে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট’৭৩ এর ৬(৪) এবং ৬(৬) এ স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘বিচার কাজ যেটা যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকেই শুরু করা যাবে’। একজন বিচারপতি অনুপস্থিত থাকলে বা না থাকলে (যে কোনো কারণেই বিচারপতি পরিবর্তন হতে পারেন) বিচার ব্যবস্থা কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে না।’’
অভিযোগ দাখিলের পর অভিযোগ আমলে নেওয়ার সময় আর রায় দেওয়ার সময় তিন জন বিচারপতি থাকতে হবে বলে জানান প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত। যুক্তিতর্ক এবং অন্যান্য সময়ে দু’জন বিচারপতিও বিচারকাজ চালিয়ে নিতে পারেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম আসামি হিসেবে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার এখন শুধু রায়ের জন্য অপেক্ষা। যে কোনো দিন রায় দেবেন ট্রাইব্যুনাল-১।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সুত্র বাংলানিউজকে বলেন, যদি কোনো বিচারপতি পরিবর্তন হয় এবং তার স্থানে আসা নতুন বিচারপতি যদি যুক্তিতর্ক শুনতে চান, তাহলে তিনি শুনতে পারবেন। কিন্তু এতে কোনো বাধাধরা নিয়ম নেই। এটা পুরোপুরি নতুন বিচারপতির ওপর নির্ভর করে। আর এই মামলায় যুক্তিতর্কের লিখিত কপি উভয়পক্ষই জমা দিয়েছেন। তাই আসামিপক্ষের নতুন করে ট্রায়াল করতে হবে এ দাবি অযৌক্তিক।
বিচারপতি নিজামুল হক একটা ল্যান্ডমার্ক জাজমেন্ট দিতে চেয়েছিলেন বলেই তিনি আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আইন নিয়ে আলাপ করেছেন। তিনি ড. জিয়াউদ্দিনের কাছে জানতে চাননি, ‘কাকে কিভাবে রায় দিলে ঝুলানো যাবে, সে উপায় বাৎলে দিন।’
বিচারপতি নিজামুল হকের উদ্দেশ্য ছিল, নতুন আইন নিয়ে জানা।
একটি শীর্ষ স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক, যিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাভার করেন, তিনি বলেন, ‘‘এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেদিন থেকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া বিচারপতি নিজামুল হক একটি দিনের জন্যও ট্রাইব্যুনালে আসা থেকে বিরত থাকেননি। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল ৪টা, কখনো সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এজলাস কক্ষে বিচার কাজ পরিচালনা করেছেন। আবার রাতেও তিনি কিভাবে এই বিচারকে আন্তর্জাতিক মানের করা যায় সেটা নিয়েও কথা বলেছেন আইন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে। এখানেও পাওয়া যায় তার সততার পরিচয়।’’
তাই বলতে চাই, ফেয়ার ট্রায়াল নিশ্চিত করতে কোনো বিতর্ক যেন এ বিচারকে কালিমা লেপন করতে না পারে, তাই তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে চলে গেছেন।
তাই বিচারপতি নিজামুল হক, আপনাকে স্যালুট। জাতি আপনার কথা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।
No comments