স্মরণে মননেঃ অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে by কে জি মোস্তফা
জীবন কী? কতটা অদ্ভুত হতে পারে জীবন! জীবন কি ডিজাইন না কো-ইনসিডেন্স! সবকিছুর কি কোনো কারণ আছে বলে ঘটে? কেউ কি এসবের পেছনে রয়েছে? কেউ কি চকখড়ি দিয়ে অলক্ষ্যে একটা আজগুবি জীবনের চালচিত্র আঁকছে? সময় ১৯৫৪-৫৬। নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে লেটারসহ ১ম বিভাগে পাস করলাম। এর আগে দূরসম্পর্কের এক মামার মাধ্যমে চিটাগং পেপার মিলে আমার জন্য চাকরি ঠিক করা আছে।
যেহেতু পারিবারিক আর্থিক সঙ্কট চরম, জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে আমাকেই হাল ধরতে হবে। ছত্রখান বাড়িঘর, মা-বাবা ভাইবোনদের অপেক্ষমাণ কাতর মুখ! রুক্ষ নিশ্বাসে জেগে ওঠে আমার দিন, মুখ লুকায় স্বপ্নরা। এদিকে স্কুল জীবনের শ্রদ্ধেয় স্যারদের আক্কেল গুড়ুম! বলে কী! এমন মেধাবী ছাত্রের এমন করুণ অবস্থা! তাদের অনুরোধ-উপরোধে শেষ পর্যন্ত আমাকে স্থানীয় চৌমুহনী কলেজে আইএ পর্যন্ত পড়াতে রাজি হলেন অভিভাবকরা। মাত্র তো দু’বছর। আইএ পাস করলে আরেকটু ভালো চাকরি পাওয়া যেতে পারে—এমন আশা ও আশ্বাস পেল তারা। যথারীতি ফুল-ফ্রি নিয়ে ভর্তি হলাম চৌমুহনী কলেজে। বিনামূল্যে কিছু পাঠ্যবইও পেলাম। সেই সময় প্রিন্সিপাল ছিলেন স্বনামধন্য টি. হোসেন। জীবন্ত এক কিংবদন্তি। ইংরেজি-বাংলা সাহিত্যের সবদিকেই সজাগ এই মানুষটির রসিকতাবোধ ছিল প্রবল। তার কথা, তার হাসি, তার রস-রসিকতাই ছিল তার মনের বিরাটত্ব। তার আমলের অনেক কৃতী ছাত্র পরবর্তীকালে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কীর্তিমান হয়ে ওঠেন। অধ্যাপকরা ছিলেন পাণ্ডিত্যে ও ব্যক্তিত্বে অসাধারণ। মনে পড়ে তাদের কথা। ভাইস প্রিন্সিপাল কালি বাবু, বাংলা সাহিত্যের অরুণ বাবু, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আফতাব আহমেদ, অর্থনীতির এজি চৌধুরী, জেনারেল ইতিহাসের মোঃ ইসমাইল, ইসলামিক ইতিহাসের আবদুল্লা সাহেব প্রমুখ। আমি থাকতাম কলেজ থেকে দূরে লজিংবাড়িতে। শিক্ষিত সচ্ছল সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে। গৃহকর্ত্রী ছিলেন উদার ও স্নেহশীল। ক্রমেই আমার প্রতি তার আগ্রহ যেন বাড়তে থাকল। মাঝেমাঝে হাতখরচ দিতেন। তার এই অপ্রত্যাশিত জামাই-আদর বাড়ির অন্য হিস্্সাদারদের গা-জ্বালার কারণ হয়ে উঠল। একসময় গুজবে কান দিতে হলো। তার ছিল একাধিক মেয়ে। এবং পাত্র হিসেবে আমি নাকি মন্দ নই। দিশাহীন সেই সময়টায় আমারও সেরকম ইচ্ছা যে ছিল না তা নয়। কোনো অবলম্বন না থাকলে তো স্বাবলম্বনই শেষ কথা। একটা জীবন, সেটা টিমটিমে শিখার মতো টিকে থাকুক, কিংবা তরঙ্গবিহীন স্রোতস্বিনী হয়ে প্রবাহিত হয়ে যাক যেমন খুশি দিক বদল করে। টিকে আছে কিংবা বয়ে যাচ্ছে আমার কাছে সেটাই বড় কথা।
সে যাই হোক, কলেজে দীর্ঘদিন ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন না। অতঃপর সদ্য মাস্টার্স পাস একজন যোগদান করলেন। নাম শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইসহাক। দেখতে যেমন সুদর্শন, রাজকুমারের মতো চেহারা, তেমনি ছিলেন মিষ্টভাষী। ক্লাসে একদিন জানতে চাইলেন, কেউ সেদিনের ইংরেজি পত্রিকা অজারভার পড়েছি কিনা। কয়েকজন হাত তুলল। এরপর জানতে চাইলেন, সেদিনের সম্পাদকীয় কী ছিল। দৈবাত্ সেটা আমার জানা ছিল। আমি হাত তুললাম। আমি ছাড়া আর কেউ বলতে পারেনি। ক্লাস শেষে টিচার্সরুমে আমাকে দেখা করতে বললেন। সেদিন থেকেই তার সুনজরে পড়ে গেলাম। এরপর প্রায়ই তার বাসস্থানে ডেকে পাঠাতেন। দুজনের মধ্যে একটু একটু করে অনেক কথা হতে লাগল। শুধু ছাত্র-শিক্ষক নয়, দুজনের মধ্যে কেমন একটা প্রীতির সম্পর্কও গড়ে উঠল। তিনি আমার পারিবারিক বিষয়াদি, দারিদ্র্য, অনটন এবং আইএ পরীক্ষার পর আমার চাকরিতে যোগদান করার কথা ইত্যাদি মন দিয়ে শুনলেন। এক পর্যায়ে খুব গম্ভীর হয়ে রইলেন। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে আমাকে তার সংগ্রামময় জীবনের অবিশ্বাস্য এক করুণ কাহিনী শোনালেন। শুনে আমি স্তম্ভিত। এই প্রথম যেন কাউকে মন খুলে বলতে পেরে ভেতরে একটা শান্তি পেলেন। গাঢ়স্বরে বললেন—সব ভুলে যাও, সবাইকে ভুলে যাও। তোমাকে লেখাপড়ায় আরও এগিয়ে যেতে হবে। আইএ’র পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স, মাস্টার্স পড়তে হবে। ইচ্ছে থাকলে উপায় হবেই। নিম্নশ্রেণীর একজন কর্মচারী হয়ে না পারবে নিজেকে চালাতে, না পারবে পরিবারকে সাহায্য করতে। বললেন—জীবনে কখনও হার মানবে না। কোনো সমস্যাই জীবনের চেয়ে বড় নয়। নেতিবাচক দিক নিয়ে কখনও মাথা ঘামাবে না। এটাই সাফল্যের রহস্য। আসলে আমি কখনও সচেতনভাবে চাইনি এ জীবন জ্বলে ওঠুক। শান্ত বহতা খোলস থেকে বেরিয়ে এসে প্রবল উচ্ছ্বাসে জানান দিক তার অস্তিত্ব। ভবিষ্যতের কাছে আমার আদৌ কোনো দাবি আছে—এমন প্রত্যাশা ছিল না কখনও। কিন্তু সেই পরম প্রিয় স্যারের কথা শুনে মনে হলো, আমি যেন পান্থ সুহৃদের ঘরে এসেছি ফিরে এতদিন পর। এক জীবন থেকে অন্য জীবনের দিকে, এক স্বপ্ন থেকে অজস্র স্বপ্নের বীজ যেন বোনা হয়ে গেল নিমিষেই।
যথাসময় এক বিকালে আইএ পরীক্ষার ফলসহ দৈনিক পত্রিকা হাতে পেলাম। কাউকে কিছু না জানিয়ে জায়গীর বাড়ির সেই স্নেহকাতর খালাম্মার কাছ থেকে ২০ টাকা চেয়ে নিলাম। বললাম, ঢাকায় বেড়াতে যাব। সরল মনে তিনি বিশ্বাস করলেন। স্নেহ, ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি ছাড়াও জীবনের অন্য প্রয়োজন আছে। ভালোবাসা না হয় খুঁজে নেয়া যাবে অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। এর আগে ওই বাড়ির এক জামাতার ঢাকার ঠিকানা ছিল আমার কাছে। আজিমপুর এলাকায় তিনি ছোটখাটো এক ব্যবসায়ী। প্রায়ই আমাকে ঢাকা যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতেন। আগে কখনও ঢাকা যাইনি। রাত ১০টায় ট্রেন। অনিশ্চিত জীবনের এক অজানা পথে তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী হয়ে পাড়ি জমালাম। বিনিদ্র রাতের আসনে বসে আছি একা, রাস্তার ওপারে পোড়া চাঁদ জেগে আছে সঙ্গে।
লেখক : কবি ও গীতিকার
সে যাই হোক, কলেজে দীর্ঘদিন ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন না। অতঃপর সদ্য মাস্টার্স পাস একজন যোগদান করলেন। নাম শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ইসহাক। দেখতে যেমন সুদর্শন, রাজকুমারের মতো চেহারা, তেমনি ছিলেন মিষ্টভাষী। ক্লাসে একদিন জানতে চাইলেন, কেউ সেদিনের ইংরেজি পত্রিকা অজারভার পড়েছি কিনা। কয়েকজন হাত তুলল। এরপর জানতে চাইলেন, সেদিনের সম্পাদকীয় কী ছিল। দৈবাত্ সেটা আমার জানা ছিল। আমি হাত তুললাম। আমি ছাড়া আর কেউ বলতে পারেনি। ক্লাস শেষে টিচার্সরুমে আমাকে দেখা করতে বললেন। সেদিন থেকেই তার সুনজরে পড়ে গেলাম। এরপর প্রায়ই তার বাসস্থানে ডেকে পাঠাতেন। দুজনের মধ্যে একটু একটু করে অনেক কথা হতে লাগল। শুধু ছাত্র-শিক্ষক নয়, দুজনের মধ্যে কেমন একটা প্রীতির সম্পর্কও গড়ে উঠল। তিনি আমার পারিবারিক বিষয়াদি, দারিদ্র্য, অনটন এবং আইএ পরীক্ষার পর আমার চাকরিতে যোগদান করার কথা ইত্যাদি মন দিয়ে শুনলেন। এক পর্যায়ে খুব গম্ভীর হয়ে রইলেন। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে আমাকে তার সংগ্রামময় জীবনের অবিশ্বাস্য এক করুণ কাহিনী শোনালেন। শুনে আমি স্তম্ভিত। এই প্রথম যেন কাউকে মন খুলে বলতে পেরে ভেতরে একটা শান্তি পেলেন। গাঢ়স্বরে বললেন—সব ভুলে যাও, সবাইকে ভুলে যাও। তোমাকে লেখাপড়ায় আরও এগিয়ে যেতে হবে। আইএ’র পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স, মাস্টার্স পড়তে হবে। ইচ্ছে থাকলে উপায় হবেই। নিম্নশ্রেণীর একজন কর্মচারী হয়ে না পারবে নিজেকে চালাতে, না পারবে পরিবারকে সাহায্য করতে। বললেন—জীবনে কখনও হার মানবে না। কোনো সমস্যাই জীবনের চেয়ে বড় নয়। নেতিবাচক দিক নিয়ে কখনও মাথা ঘামাবে না। এটাই সাফল্যের রহস্য। আসলে আমি কখনও সচেতনভাবে চাইনি এ জীবন জ্বলে ওঠুক। শান্ত বহতা খোলস থেকে বেরিয়ে এসে প্রবল উচ্ছ্বাসে জানান দিক তার অস্তিত্ব। ভবিষ্যতের কাছে আমার আদৌ কোনো দাবি আছে—এমন প্রত্যাশা ছিল না কখনও। কিন্তু সেই পরম প্রিয় স্যারের কথা শুনে মনে হলো, আমি যেন পান্থ সুহৃদের ঘরে এসেছি ফিরে এতদিন পর। এক জীবন থেকে অন্য জীবনের দিকে, এক স্বপ্ন থেকে অজস্র স্বপ্নের বীজ যেন বোনা হয়ে গেল নিমিষেই।
যথাসময় এক বিকালে আইএ পরীক্ষার ফলসহ দৈনিক পত্রিকা হাতে পেলাম। কাউকে কিছু না জানিয়ে জায়গীর বাড়ির সেই স্নেহকাতর খালাম্মার কাছ থেকে ২০ টাকা চেয়ে নিলাম। বললাম, ঢাকায় বেড়াতে যাব। সরল মনে তিনি বিশ্বাস করলেন। স্নেহ, ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি ছাড়াও জীবনের অন্য প্রয়োজন আছে। ভালোবাসা না হয় খুঁজে নেয়া যাবে অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে। এর আগে ওই বাড়ির এক জামাতার ঢাকার ঠিকানা ছিল আমার কাছে। আজিমপুর এলাকায় তিনি ছোটখাটো এক ব্যবসায়ী। প্রায়ই আমাকে ঢাকা যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাতেন। আগে কখনও ঢাকা যাইনি। রাত ১০টায় ট্রেন। অনিশ্চিত জীবনের এক অজানা পথে তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী হয়ে পাড়ি জমালাম। বিনিদ্র রাতের আসনে বসে আছি একা, রাস্তার ওপারে পোড়া চাঁদ জেগে আছে সঙ্গে।
লেখক : কবি ও গীতিকার
No comments