ভূমিকা ও চিত্রকল্প by মোস্তফা জামান
সঞ্জয় দাস স্থানের নানা মাত্রা নিয়ে কাজ করেন; আরও ভিন্নভাবেও এটি ব্যাখ্যা করা চলে, তিনি স্থান-কাল-পাত্রের মধ্য দিয়ে যে বাস্তবতার নির্মাণ সম্ভব—সেই সম্ভাবনা অপর এক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই করে দেখতে চান।
প্রথম দৃষ্টিতে, শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা কাজগুলো যথেষ্ট জাড্য ও কম্পোজিশনের নিয়মে বাঁধা বলে মনে হয়। নানা ডিটেলের মধ্য থেকে যখন মূলে অভিনিবেশ সম্ভব হয়, লক্ষণীয় হয়ে ওঠে স্থান-কালের এক বিভ্রম। স্বপ্ন কিংবা ফ্যান্টাসির ধারণা সাপেক্ষে এমন চিত্রজ উপস্থাপনার ব্যাখ্যা যদি কেউ করতে চান, তা অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু, বর্তমান আধুনিক বিশ্বের নগরজীবনে সে সময় ও স্থানে অভিঘাত, টেকনোলজির সুবাদে যে স্থানিকতার নানা ধরন উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে—এসব বিষয়ের নিমিত্তে সঞ্জয়ের চিত্রে নির্দিষ্ট একটি চরিত্রের অনুপ্রবেশ লক্ষ করে তাকে ব্যাখ্যা করলে নতুনত্বের মাত্রাটি ধরা সহজতর হয়।
নগরজীবনের যাতনা শুধু ছকে বাঁধা জীবনের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই; একে যাতনা না বলে মানব স্বভাবে নব আবিষ্কার ও জ্ঞাননির্ভর আচার-আচরণে অনুপ্রবেশ বলে আখ্যা দেওয়া চলে, যা নানা মাত্রায় নগরে ক্রিয়াশীল। টেকনোলজির সূত্রে ওই জটিলতা আরও বেড়ে গিয়ে মানুষের শারীরিক অস্তিত্ব অন্য মাত্রার দিকে চালিত করে; এমনকি স্থানিকতার একমাত্রিক ধারণার সমাপ্তি ঘটায়। যেমন কম্পিউটার সূত্রে বাড়িঘরের স্থান-কালের মধ্যে ওয়েবসাইটের ভিন্ন স্থান-কাল এসে হানা দেয়। স্থান-কালের এমন বিবিধতা মানব অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে, নাকি কেবল অস্থিরতা নামের বিকার জন্ম দিয়ে ক্ষান্ত হয়, এ বিষয়ে এখনো হলফ করে কিছু না বলা গেলেও অনুমানের অবকাশ রয়ে যায়। এই অবকাশ সঞ্জয়ের ছবি দেখে মনে জাগে। সভ্যতার যে সরল পাঠে আমরা অভ্যস্ত, দর্শক হিসেবে তখন তা কিয়ৎ জটিল রূপ নেয়, আমাদের মনে ভিন্ন ভাবনার উদয়ে শিল্পীর চিত্রকল্প সহায়ক ভূমিকা রাখে।
‘আগামী পরশু’ শিরোনামের ছবিতে লক্ষযোগ্য হয়ে ওঠে গাড়ির অভ্যন্তরে পাহাড় ও বনানীর শ্যামল দৃশ্যের বিস্তার। চালক ও সহযাত্রীর পশ্চাতে যখন ছোট আকারের হরিণ আপন আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সামনে দুই স্তরে শহরের কংক্রিট বিন্যাস ও পাহাড়িয়া পথ দৃশ্যমানতা পায়। আর সবচেয়ে অব্যর্থ প্রতীক হিসেবে দুটি রিয়ারভিউ আয়নার একটিতে সিংহ ও অপরটিতে সিংহ বধ করার ভঙ্গিতে এক শিকারি বন্দুক তাক করে আছে—এমন ছবিতে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মধ্যস্থতা সম্পর্কে ভাষ্যটি লাগসই মাত্রা পায়, এটি ছবিকে চিত্রজ জগৎ থেকে ডিসকোর্সের দুনিয়ায় নিয়ে আসে, অর্থাৎ ভাষ্য তৈরির সূচনা করে।
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, ল্যাপটপ, টেলিভিশন কিংবা ওয়াকম্যান বা ক্যামেরার রেফারেন্স হাজির করে শিল্পী ব্যক্তি ও স্থানকে নাটকীয় করে তোলেন। এই নাটকীয়তার ভাষা আপাতদৃষ্টিতে রং ও ফর্মের বিন্যাসনির্ভর। যে আপাত একরৈখিক ফেসাড বা মেকি চেহারায় তিনি ছবিকে দর্শকের সামনে হাজির করেন, তার নাটকীয়তা বুঝতে একটু সময় ক্ষেপণের প্রয়োজন হয়। কোনো তির্যক দৃষ্টিপাত বা সমালোচনার কড়া গন্ধ নেই শিল্পীর কাজে; যা আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমান্তরাল স্থিতিশীল মনের ধীর ও সজাগ উন্মোচন। এই সূত্রেই স্বপ্নিল আবহ তৈরি হয়, যা শিল্পীর বর্তমান প্রদর্শনীর শিরোনামের সঙ্গে খাপ খায়। অস্তিত্বের রহস্য উন্মোচন শিল্পীর তৃতীয় একক প্রদর্শনী বিশেষমাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছে। আধুনিক জীবন ও প্রকৃতি—এই দুই মেরুর যে সংযোগ ও বিরোধ, এর ওপর স্পষ্ট আলো না ফেলেই এই শিল্পী একধরনের বোধের জন্ম দিতে সক্ষম, যা সময় ও স্থানিকতার ডিসকোর্স জন্ম দেয়। ফলে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সঞ্জয়ের ছবির ভাষা ও বক্তব্য আসলে বৈশ্বিক মাত্রার। প্যারিসের আভা-গার্দের যে অভিঘাত ভারতে আঞ্চলিক রূপ ধারণ করেছে, তার সঙ্গেও শিল্পীর যোগসূত্র স্থাপন করা যায়। এর পরও কথা থাকে—স্থানিকতা নিয়ে যে নব অভিনিবেশ, যার সূত্রে বাস্তবতা আর সরল থাকে না, এর দার্শনিক কিছু আলামত শিল্পীর কাজে উপস্থিত। এই ডিসকোর্সকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় শিল্পীর ভবিষ্যৎ কাজ।
চাটগাঁয়ের প্রকৃতির মধ্যে থেকে যে শিল্পীর আবির্ভাব, যিনি উচ্চশিক্ষার্থে শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন অনেকটা সময়, তাঁর কাজে প্রকৃতির নির্মল বিস্তার ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা নয়। সঞ্জয় কুমার দাস শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যে চোখ না রেখে মানব অস্তিত্বে অনুষঙ্গে প্রকৃতিকে সামনে নিয়ে এসে ডিসকোর্স নির্মাণের প্রাথমিক কাজটি সেরে ফেলেছেন। এর নানাবিধ ডিসকোর্স ও অভিব্যক্তি আমরা হয়তো তাঁর পরবর্তী প্রদর্শনীতে দেখতে পাব।
এ প্রদর্শনী চলবে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত, ঢাকা আর্ট সেন্টারে।
নগরজীবনের যাতনা শুধু ছকে বাঁধা জীবনের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই; একে যাতনা না বলে মানব স্বভাবে নব আবিষ্কার ও জ্ঞাননির্ভর আচার-আচরণে অনুপ্রবেশ বলে আখ্যা দেওয়া চলে, যা নানা মাত্রায় নগরে ক্রিয়াশীল। টেকনোলজির সূত্রে ওই জটিলতা আরও বেড়ে গিয়ে মানুষের শারীরিক অস্তিত্ব অন্য মাত্রার দিকে চালিত করে; এমনকি স্থানিকতার একমাত্রিক ধারণার সমাপ্তি ঘটায়। যেমন কম্পিউটার সূত্রে বাড়িঘরের স্থান-কালের মধ্যে ওয়েবসাইটের ভিন্ন স্থান-কাল এসে হানা দেয়। স্থান-কালের এমন বিবিধতা মানব অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে, নাকি কেবল অস্থিরতা নামের বিকার জন্ম দিয়ে ক্ষান্ত হয়, এ বিষয়ে এখনো হলফ করে কিছু না বলা গেলেও অনুমানের অবকাশ রয়ে যায়। এই অবকাশ সঞ্জয়ের ছবি দেখে মনে জাগে। সভ্যতার যে সরল পাঠে আমরা অভ্যস্ত, দর্শক হিসেবে তখন তা কিয়ৎ জটিল রূপ নেয়, আমাদের মনে ভিন্ন ভাবনার উদয়ে শিল্পীর চিত্রকল্প সহায়ক ভূমিকা রাখে।
‘আগামী পরশু’ শিরোনামের ছবিতে লক্ষযোগ্য হয়ে ওঠে গাড়ির অভ্যন্তরে পাহাড় ও বনানীর শ্যামল দৃশ্যের বিস্তার। চালক ও সহযাত্রীর পশ্চাতে যখন ছোট আকারের হরিণ আপন আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সামনে দুই স্তরে শহরের কংক্রিট বিন্যাস ও পাহাড়িয়া পথ দৃশ্যমানতা পায়। আর সবচেয়ে অব্যর্থ প্রতীক হিসেবে দুটি রিয়ারভিউ আয়নার একটিতে সিংহ ও অপরটিতে সিংহ বধ করার ভঙ্গিতে এক শিকারি বন্দুক তাক করে আছে—এমন ছবিতে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মধ্যস্থতা সম্পর্কে ভাষ্যটি লাগসই মাত্রা পায়, এটি ছবিকে চিত্রজ জগৎ থেকে ডিসকোর্সের দুনিয়ায় নিয়ে আসে, অর্থাৎ ভাষ্য তৈরির সূচনা করে।
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, ল্যাপটপ, টেলিভিশন কিংবা ওয়াকম্যান বা ক্যামেরার রেফারেন্স হাজির করে শিল্পী ব্যক্তি ও স্থানকে নাটকীয় করে তোলেন। এই নাটকীয়তার ভাষা আপাতদৃষ্টিতে রং ও ফর্মের বিন্যাসনির্ভর। যে আপাত একরৈখিক ফেসাড বা মেকি চেহারায় তিনি ছবিকে দর্শকের সামনে হাজির করেন, তার নাটকীয়তা বুঝতে একটু সময় ক্ষেপণের প্রয়োজন হয়। কোনো তির্যক দৃষ্টিপাত বা সমালোচনার কড়া গন্ধ নেই শিল্পীর কাজে; যা আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমান্তরাল স্থিতিশীল মনের ধীর ও সজাগ উন্মোচন। এই সূত্রেই স্বপ্নিল আবহ তৈরি হয়, যা শিল্পীর বর্তমান প্রদর্শনীর শিরোনামের সঙ্গে খাপ খায়। অস্তিত্বের রহস্য উন্মোচন শিল্পীর তৃতীয় একক প্রদর্শনী বিশেষমাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছে। আধুনিক জীবন ও প্রকৃতি—এই দুই মেরুর যে সংযোগ ও বিরোধ, এর ওপর স্পষ্ট আলো না ফেলেই এই শিল্পী একধরনের বোধের জন্ম দিতে সক্ষম, যা সময় ও স্থানিকতার ডিসকোর্স জন্ম দেয়। ফলে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সঞ্জয়ের ছবির ভাষা ও বক্তব্য আসলে বৈশ্বিক মাত্রার। প্যারিসের আভা-গার্দের যে অভিঘাত ভারতে আঞ্চলিক রূপ ধারণ করেছে, তার সঙ্গেও শিল্পীর যোগসূত্র স্থাপন করা যায়। এর পরও কথা থাকে—স্থানিকতা নিয়ে যে নব অভিনিবেশ, যার সূত্রে বাস্তবতা আর সরল থাকে না, এর দার্শনিক কিছু আলামত শিল্পীর কাজে উপস্থিত। এই ডিসকোর্সকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় শিল্পীর ভবিষ্যৎ কাজ।
চাটগাঁয়ের প্রকৃতির মধ্যে থেকে যে শিল্পীর আবির্ভাব, যিনি উচ্চশিক্ষার্থে শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন অনেকটা সময়, তাঁর কাজে প্রকৃতির নির্মল বিস্তার ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা নয়। সঞ্জয় কুমার দাস শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যে চোখ না রেখে মানব অস্তিত্বে অনুষঙ্গে প্রকৃতিকে সামনে নিয়ে এসে ডিসকোর্স নির্মাণের প্রাথমিক কাজটি সেরে ফেলেছেন। এর নানাবিধ ডিসকোর্স ও অভিব্যক্তি আমরা হয়তো তাঁর পরবর্তী প্রদর্শনীতে দেখতে পাব।
এ প্রদর্শনী চলবে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত, ঢাকা আর্ট সেন্টারে।
No comments