বইপত্র- আধুনিক কবিতার জন্মলগ্ন by মেহেদি হাসান
গিয়োম আপোলিনেরের কবিতা—অশ্রুভেজা চোখে করাঘাত \ ভূমিকা ও অনুবাদ: হায়দার আলী খান, মনজুরুল হক \ প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০১২ \ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন \ প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী \ দাম: ১৫০ টাকা
গিয়োম আপোলিনেরের কবিতার এক উজ্জ্বল গতিশীলতা সমকালীন এবং পরবর্তী প্রজন্মকে দিনের পর দিন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পরিবর্তনশীল ইউরোপের মতোই জীবনকে দেখেছেন তিনি। বর্তমান মুহূর্ত থেকে কয়েক শতাব্দী আগে যেমন তাঁর বিচরণ, তেমনি ভবিষ্যৎ গমনের এক অদ্ভুত রূপ রয়েছে তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে। নিজস্ব যাপনের বহুমাত্রিক বোহেমিয়ানতার আশ্চর্য ফলাফল হলো তার কবিতাগুলো। বিংশ শতকের কবিতার ভূমি নির্মাণে তাই বোদলেয়ার ও র্যা বোর সমান্তরালে একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন আপোলিনের। ব্যক্তিত্বের সুষমা, রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা ও বোহেমিয়ান জীবনযাপন তাঁকে গত শতাব্দীর একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৮০ সালে রোমে জন্মগ্রহণ করেন আপোলিনের। তাঁর বাবা ইতালিয়ান (যদিও পিতৃপরিচয় নিয়ে সংশয় তাঁর আজীবন দূর হয়নি) আর মা পোলিশ । আপোলিনেরের মা ভাগ্যান্বেষণে একসময় রোম থেকে ফ্রান্সে চলে আসেন। দক্ষিণ ফ্রান্সের বিভিন্ন এলাকার স্কুলে আপোলিনেরের লেখাপড়া চলে। ১৯০০ বা ১৮৯৯ সালে তিনি ভাগ্য যাচাই করার ব্রত নিয়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমান। জার্মান-পোলিশ অংশ বাদ দিয়ে নিজের নামের ফরাসীকরণ করেন তিনি। সেই সময়ে ফ্রান্সের তরুণ প্রজন্মের সাহিত্যিক, শিল্পীরা প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নতুন শিল্প নির্মাণে সাহসী সব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিলেন। ফলে, এটি আপোলিনেরের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি হয়ে ধরা দিয়েছিল। অল্প সময়েই তিনি ফ্রান্সের শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। আন্দ্রে জিতের সহযোগিতায় ১৯০৩ সালে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। তৎকালীন পরিস্থিতিতে জীবনধারণের জন্য তাঁকে ছোটখাটো অনেক খুচরা কাজও করতে হয়েছে। ব্যাংকের কেরানিগিরি থেকে শুরু করে এসব কাজের মধ্যে রয়েছে পর্নো ম্যাগাজিনের জন্য যৌনতাপূর্ণ লেখা সরবরাহ করা।
দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে শিল্প-সাহিত্য-দর্শনে যেসব আন্দোলন তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছিল, যেমন সুররিয়ালিজম, ফিউচারিজম, দাদাইজম, কিউবিজম—এসবেরই এক অর্থে পূর্বসূরি তিনি। আপোলিনেরের বন্ধুতালিকায় ছিলেন পাবলো পিকাসো, অঁরি মাতিস, আন্দ্রে ব্রেতো, জাঁ ককতো, মার্শেল দুশঁ ও মার্ক শাগালের মতো ব্যক্তিত্ব। এসব বোহেমিয়ান শিল্পী-সাহিত্যিকের আসরে তিনি ছিলেন মধ্যমণি। প্যারিসের শিল্পকলাবিষয়ক সাময়িকী ল্যা প্লুম-এ স্পেন থেকে আগত তরুণ পাবলো পিকাসোর শিল্পচর্চা নিয়ে ১৯০৫ সালে যে নিবন্ধ লিখেছিলেন আপোলিনের, সেখানে সর্বপ্রথম পিকাসোকে আবিষ্কার করেন তিনি। তাঁর নির্ভুল চোখ ভবিষ্যতের মণিমুক্তার সন্ধান পেয়েছিল পিকাসোর ভেতর। গদ্যকবিতার ঢঙে ওই লেখার পুরোটাই ছিল পিকাসোর প্রতি তাঁর মুগ্ধতার প্রকাশ।
১৯১৩ সালে আপোলিনেরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ আলকুলুস প্রকাশিত হয়। এটি সম্ভবত কবিতায় বিশ শতকীয় আধুনিকতার প্রথম প্রকাশ। প্রথম বইয়েই তিনি সমকালীন সাহিত্যিক, সমালোচকদের নজর কাড়েন। বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব, যতিচিহ্নহীনতা, রূপকের ব্যবহার তাঁর কবিতাকে ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল করে তোলে। আপোলিনের কবিতায় আধুনিকতার যেসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, তারই ঘোষণাপত্র হয়ে ওঠে যেন এ বইয়ের প্রথম কবিতা জোন। প্রথম বই থেকেই আপোলিনেরের কবিতা যতিচিহ্নমুক্ত। ১৯১৮ সালে, কবির মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ক্যালিগ্রামস প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর কাব্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিরাজমান বিতর্কের অবসান হয়। কবি হিসেবে খ্যাতির এক উচ্চতর শিখরে আসীন হন তিনি। কবিতার বিগত সময়ের অনুশাসন না মেনে আপোলিনের সম্পূর্ণ নিজস্ব রচনারীতিতে অগ্রসর হন। সেখানে ধ্রুপদ আর খিস্তিখেউড়ের মিলন যেমন দেখা যায়, তেমনি রূপকের ব্যবহার আর ছন্দের ভিন্ন মাত্রার টেকনিকও দৃশ্যমান।
আপোলিনের কবি হিসেবে পরিচিত হলেও সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর আবির্ভাব আধুনিক চিত্রকলার একজন কড়া সমর্থক হিসেবে। ১৯০৫ থেকে ১৯১২ সাল নাগাদ প্যারিসের তরুণ আধুনিক শিল্পীদের নিয়ে বিভিন্ন সাময়িকীতে নিয়মিত নিবন্ধ লেখেন তিনি। তরুণ শিল্পীদের আত্মপ্রকাশের লগ্নে এসব লেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
অশ্রুভেজা চোখে করাঘাত বইটিতে গিয়োম আপোলিনের সম্পর্কে পাঠকের কৌতূহলের একটি বিস্তারিত উত্তর পাওয়া যাবে। কবির প্রতিনিধিত্বশীল কবিতাগুলোর অনুবাদ করেছেন হায়দার আলী খান ও মনজুরুল হক। অনুবাদ করা হয়েছে ইংরেজি ও ফরাসি উভয় ভাষা থেকে। যেহেতু কবিতা, তাই অনুবাদকদ্বয় প্রাসঙ্গিক স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদের ব্যাপারে। হায়দার আলী খান আপোলিনেরের জীবনীভিত্তিক একটি চমৎকার নিবন্ধ লিখেছেন, যার মাধ্যমে কবির বেড়ে ওঠা এবং তাঁর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকাণ্ড বুঝে নিতে পাঠকের সুবিধা হয়। অন্য লেখাটিতে আপোলিনেরের কবিতার বৈশিষ্ট্য, আধুনিকতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ দুটি নিবন্ধ ছাড়াও পাবলো পিকাসো, অঁরি মাতিস, পল সেজান, মার্ক শাগাল প্রমুখ শিল্পীর আঁকা আপোলিনেরের বেশ কিছু প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে বইটিতে। বাংলা ভাষায় আপোলিনেরের কবিতা ও ব্যক্তিসত্তার একটি সামগ্রিক রূপ জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে বইটি।
১৯৮০ সালে রোমে জন্মগ্রহণ করেন আপোলিনের। তাঁর বাবা ইতালিয়ান (যদিও পিতৃপরিচয় নিয়ে সংশয় তাঁর আজীবন দূর হয়নি) আর মা পোলিশ । আপোলিনেরের মা ভাগ্যান্বেষণে একসময় রোম থেকে ফ্রান্সে চলে আসেন। দক্ষিণ ফ্রান্সের বিভিন্ন এলাকার স্কুলে আপোলিনেরের লেখাপড়া চলে। ১৯০০ বা ১৮৯৯ সালে তিনি ভাগ্য যাচাই করার ব্রত নিয়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমান। জার্মান-পোলিশ অংশ বাদ দিয়ে নিজের নামের ফরাসীকরণ করেন তিনি। সেই সময়ে ফ্রান্সের তরুণ প্রজন্মের সাহিত্যিক, শিল্পীরা প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নতুন শিল্প নির্মাণে সাহসী সব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছিলেন। ফলে, এটি আপোলিনেরের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি হয়ে ধরা দিয়েছিল। অল্প সময়েই তিনি ফ্রান্সের শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। আন্দ্রে জিতের সহযোগিতায় ১৯০৩ সালে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। তৎকালীন পরিস্থিতিতে জীবনধারণের জন্য তাঁকে ছোটখাটো অনেক খুচরা কাজও করতে হয়েছে। ব্যাংকের কেরানিগিরি থেকে শুরু করে এসব কাজের মধ্যে রয়েছে পর্নো ম্যাগাজিনের জন্য যৌনতাপূর্ণ লেখা সরবরাহ করা।
দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে শিল্প-সাহিত্য-দর্শনে যেসব আন্দোলন তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছিল, যেমন সুররিয়ালিজম, ফিউচারিজম, দাদাইজম, কিউবিজম—এসবেরই এক অর্থে পূর্বসূরি তিনি। আপোলিনেরের বন্ধুতালিকায় ছিলেন পাবলো পিকাসো, অঁরি মাতিস, আন্দ্রে ব্রেতো, জাঁ ককতো, মার্শেল দুশঁ ও মার্ক শাগালের মতো ব্যক্তিত্ব। এসব বোহেমিয়ান শিল্পী-সাহিত্যিকের আসরে তিনি ছিলেন মধ্যমণি। প্যারিসের শিল্পকলাবিষয়ক সাময়িকী ল্যা প্লুম-এ স্পেন থেকে আগত তরুণ পাবলো পিকাসোর শিল্পচর্চা নিয়ে ১৯০৫ সালে যে নিবন্ধ লিখেছিলেন আপোলিনের, সেখানে সর্বপ্রথম পিকাসোকে আবিষ্কার করেন তিনি। তাঁর নির্ভুল চোখ ভবিষ্যতের মণিমুক্তার সন্ধান পেয়েছিল পিকাসোর ভেতর। গদ্যকবিতার ঢঙে ওই লেখার পুরোটাই ছিল পিকাসোর প্রতি তাঁর মুগ্ধতার প্রকাশ।
১৯১৩ সালে আপোলিনেরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ আলকুলুস প্রকাশিত হয়। এটি সম্ভবত কবিতায় বিশ শতকীয় আধুনিকতার প্রথম প্রকাশ। প্রথম বইয়েই তিনি সমকালীন সাহিত্যিক, সমালোচকদের নজর কাড়েন। বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব, যতিচিহ্নহীনতা, রূপকের ব্যবহার তাঁর কবিতাকে ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল করে তোলে। আপোলিনের কবিতায় আধুনিকতার যেসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, তারই ঘোষণাপত্র হয়ে ওঠে যেন এ বইয়ের প্রথম কবিতা জোন। প্রথম বই থেকেই আপোলিনেরের কবিতা যতিচিহ্নমুক্ত। ১৯১৮ সালে, কবির মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ক্যালিগ্রামস প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর কাব্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিরাজমান বিতর্কের অবসান হয়। কবি হিসেবে খ্যাতির এক উচ্চতর শিখরে আসীন হন তিনি। কবিতার বিগত সময়ের অনুশাসন না মেনে আপোলিনের সম্পূর্ণ নিজস্ব রচনারীতিতে অগ্রসর হন। সেখানে ধ্রুপদ আর খিস্তিখেউড়ের মিলন যেমন দেখা যায়, তেমনি রূপকের ব্যবহার আর ছন্দের ভিন্ন মাত্রার টেকনিকও দৃশ্যমান।
আপোলিনের কবি হিসেবে পরিচিত হলেও সাহিত্যাঙ্গনে তাঁর আবির্ভাব আধুনিক চিত্রকলার একজন কড়া সমর্থক হিসেবে। ১৯০৫ থেকে ১৯১২ সাল নাগাদ প্যারিসের তরুণ আধুনিক শিল্পীদের নিয়ে বিভিন্ন সাময়িকীতে নিয়মিত নিবন্ধ লেখেন তিনি। তরুণ শিল্পীদের আত্মপ্রকাশের লগ্নে এসব লেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
অশ্রুভেজা চোখে করাঘাত বইটিতে গিয়োম আপোলিনের সম্পর্কে পাঠকের কৌতূহলের একটি বিস্তারিত উত্তর পাওয়া যাবে। কবির প্রতিনিধিত্বশীল কবিতাগুলোর অনুবাদ করেছেন হায়দার আলী খান ও মনজুরুল হক। অনুবাদ করা হয়েছে ইংরেজি ও ফরাসি উভয় ভাষা থেকে। যেহেতু কবিতা, তাই অনুবাদকদ্বয় প্রাসঙ্গিক স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদের ব্যাপারে। হায়দার আলী খান আপোলিনেরের জীবনীভিত্তিক একটি চমৎকার নিবন্ধ লিখেছেন, যার মাধ্যমে কবির বেড়ে ওঠা এবং তাঁর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকাণ্ড বুঝে নিতে পাঠকের সুবিধা হয়। অন্য লেখাটিতে আপোলিনেরের কবিতার বৈশিষ্ট্য, আধুনিকতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ দুটি নিবন্ধ ছাড়াও পাবলো পিকাসো, অঁরি মাতিস, পল সেজান, মার্ক শাগাল প্রমুখ শিল্পীর আঁকা আপোলিনেরের বেশ কিছু প্রতিকৃতি স্থান পেয়েছে বইটিতে। বাংলা ভাষায় আপোলিনেরের কবিতা ও ব্যক্তিসত্তার একটি সামগ্রিক রূপ জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে বইটি।
No comments