চারুশিল্প- আলোর ছায়া ও মায়া by জাফরিন গুলশান
নাসির আলী মামুন বাংলাদেশের বিখ্যাত আলোকচিত্রী। ১৯৭২ সালে তাঁর হাতেই এ দেশে পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির সূচনা ঘটে। তিনি এ ক্ষেত্রে একটি নতুন ঘরানার সৃষ্টি করেন।
চার দশক ধরে দেশ-বিদেশের সংখ্যাহীন বিখ্যাত মানুষের পোর্ট্রেট করেছেন।ছবি তোলার পাশাপাশি এঁদের হাতে আঁকা বিভিন্ন মাধ্যমের ড্রয়িং তিনি সংগ্রহ ও যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করছেন দীর্ঘদিনধরে।
নাসির আলী মামুনের সংগ্রহশালা থেকে একটি ড্রয়িংয়ের প্রদর্শনী সম্প্রতি হয়ে গেল বেঙ্গল শিল্পালয়ের আয়োজনে। বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের আঁকা ছবির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবি ও চিত্রকরদের আঁকা ছবিও স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে। এসব চিত্রকর্মে কবিতা হয়েছে ছবি, ছবি (মূলত রেখাচিত্র বা ড্রয়িং) হয়েছে কবিতা। মোট ৩৭ জন খ্যাতিমান ব্যক্তির ১০১টি চিত্রকর্ম নিয়ে বেঙ্গল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘তার আলো, তার ছায়া’। ১৮ ডিসেম্বর শুরু হয়ে এই প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ২৫ ডিসেম্বর। প্রদর্শনী দেখতে এসে দর্শকদের মধ্যে স্মৃতিবিধুর মনোভাবের সঞ্চার হয়েছে। ড্রয়িংগুলো নান্দনিক দিক থেকেও মুগ্ধ করেছে দর্শকদের।
নাসির আলী মামুন এই প্রদর্শনীর বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত আর্কাইভ ‘ফটোজিয়াম’ তৈরির প্রস্তুতিপর্বের কাজ শুরু করবেন। মামুনের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন এই ফটোজিয়াম, আর এ জন্য তাঁর অন্তরের দরদও স্পষ্ট হয়ে গেছে প্রদর্শনীর মাধ্যমে। একজন শিল্পপ্রেমীর পক্ষে বহু কষ্টে সংগ্রহ করা দুর্লভ সব শিল্পকর্ম বিক্রি করে দেওয়াটা নিদারুণ বেদনার ব্যাপার। মামুন ফটোজিয়ামের জন্য ভালোবাসা থেকেই এই ক্ষতি স্বীকারে রাজি হয়েছেন—সন্দেহ নেই।
প্রদর্শনীতে আমরা দেখি, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১২.৫×৭.৫ সে. মি. কাগজে কালিতে করা ধানের শীষের রেখা ড্রয়িং। ড্রয়িংয়ের সঙ্গে নন্দলাল বসুর শিল্পকথা বই থেকে নেওয়া নোট, ‘সৌন্দর্য্যবোধের অভাবে মানুষ যে কেবল রসের ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়, তা নয়, তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের দিক দিয়েও সে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।’ লেখার পাশে নন্দলাল বসুর স্বাক্ষর আছে। কামরুল হাসানের অনেক ড্রয়িং দেখা যায় এই প্রদর্শনীতে। কামরুল মানেই সার্বক্ষণিক আঁকাআঁকি, লেখালেখি করা আপদমস্তক একজন শিল্পী। ‘মাই ওম্যান-১, ২’ শীর্ষক ছবিতে রেখার মুনশিয়ানা, ললিত ছন্দ, ঢং—সবকিছুর মধ্যেই কামরুল হাসানের মহান শিল্পী-সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর আঁকা নারী এক ভিন্ন রোমান্টিক রসমাধুর্য সৃষ্টি করে। ‘কম্পোজিশন’ ছবিতে কিউবিজমের প্রতি, বিশেষত, স্পেনীয় শিল্পী পাবলো পিকাসোর প্রতি তাঁর অনুরাগ লক্ষণীয়।
শিল্পী এস এম সুলতানের সান্নিধ্য পাওয়া মামুনের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। মইনুদ্দীন খালেদ এ প্রদর্শনীর ক্যাটালগে লিখেছেন, ‘মামুনের সবচেয়ে বড়-মানুষী ঠিকানা সুলতান। এ শিল্পীর কাজে সবচেয়ে বড় জাগরণ আসে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। অধুনালুপ্ত শিল্পকলা একাডেমীর গোলঘরটা তখন প্রহোলিকাময় মানুষ সুলতানের মন্দিরে পরিণত হয়েছিল। সেই মন্দিরেই আমরা কৈশোরোত্তীর্ণ উষার আলোর মতো প্রথম যৌবনের চোখের মণিতে শিল্পী সুলতানকে ছবি আঁকতে দেখি। সেই ঋষির সান্নিধ্যে থেকেছেন মামুন।...মামুন সুলতানকে নানা কৌণিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকালের কৃচ্ছ্রসাধনায় প্রায় ৫০০ বার আলোকোচিত্রিত করেছেন।’
২২ নভেম্বর, ১৯৯১-তে আঁকা সুলতানের রেখাচিত্র ‘ভিলেজ ওম্যান’ কালি কাগজে আঁকা। সভ্যতার বিনির্মাণে মানুষের প্রাণশক্তি তুলে ধরাই সুলতানের শিল্পের মৌলিকত্ব।
জয়নুল আবেদিনের সমসাময়িক আরেক শিল্পী কাজী আবুল কাসেম। প্রায় বিস্মৃত। চল্লিশের দশকে প্রতিবাদী কার্টুন এঁকেছিলেন। তাঁর আঁকাও স্থান পেয়েছে এখানে। স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে আবারও মনে করিয়ে দেওয়া এই প্রদর্শনীর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মনে পড়ছে শফিকুল আমিনের কথা। এ ছাড়া মোহাম্মদ কিবরিয়া আছেন। হামিদুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা রেখাচিত্রগুলো একটা সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আবার মনিরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দীন, আব্দুশ শাকুর, হামিদুজ্জামান প্রমুখের ড্রয়িং দেখার সুযোগ মিলেছে এই প্রদর্শনীতে। এই প্রদর্শনী থেকে একটি বিরাট প্রাপ্তির দিক হলো, এখানে একসঙ্গে অনেক গুণী মানুষের ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে এবং এর মাধ্যমে প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্বতার দিকটি আরও ভালোভাবে চোখে পড়েছে।
ওপার বাংলার পরিতোষ সেন, পুর্ণেন্দু পত্রী, গণেশ পাইন, গণেশ হালুই, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ প্রমুখ কীর্তিমানের আঁকা ছবিও স্থান পেয়েছে এখানে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ ও শামসুর রাহমানের আঁকা নজর কেড়েছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সূর্যমুখী ফুলের সরল ছেলেমানুষী ড্রয়িং ও তাঁর স্বাক্ষর সারল্যের কারণেই চোখ টানে। নওয়াজেশ আহমদ লাল রঙে এঁকেছেন তাঁর ‘বনলতা সেন’।
মামুন নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে দিয়েও আঁকিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের আঁকাও রয়েছে তাঁর সংগ্রহশালায়। মামুন শিল্পীদের প্রতিকৃতি ক্যামেরা বন্দী করেছেন, আর শিল্পীরা এঁকেছেন মামুনের প্রতিকৃতি। অবশ্য সবাই নন, কেউ কেউ। কাজী আবুল কাশেম, এস এম সুলতান, কামরুল হাসান, শিশির ভট্টাচার্য, আমিনুল ইসলাম প্রমুখ এঁকেছেন মামুনকে। একসঙ্গে এত গুণী ব্যক্তির রেখাচিত্র দেখবার সুযোগ আনন্দদায়ক নিঃসন্দেহে।
নাসির আলী মামুনের সংগ্রহশালা থেকে একটি ড্রয়িংয়ের প্রদর্শনী সম্প্রতি হয়ে গেল বেঙ্গল শিল্পালয়ের আয়োজনে। বাংলাদেশের খ্যাতিমান শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের আঁকা ছবির পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবি ও চিত্রকরদের আঁকা ছবিও স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে। এসব চিত্রকর্মে কবিতা হয়েছে ছবি, ছবি (মূলত রেখাচিত্র বা ড্রয়িং) হয়েছে কবিতা। মোট ৩৭ জন খ্যাতিমান ব্যক্তির ১০১টি চিত্রকর্ম নিয়ে বেঙ্গল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘তার আলো, তার ছায়া’। ১৮ ডিসেম্বর শুরু হয়ে এই প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ২৫ ডিসেম্বর। প্রদর্শনী দেখতে এসে দর্শকদের মধ্যে স্মৃতিবিধুর মনোভাবের সঞ্চার হয়েছে। ড্রয়িংগুলো নান্দনিক দিক থেকেও মুগ্ধ করেছে দর্শকদের।
নাসির আলী মামুন এই প্রদর্শনীর বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত আর্কাইভ ‘ফটোজিয়াম’ তৈরির প্রস্তুতিপর্বের কাজ শুরু করবেন। মামুনের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন এই ফটোজিয়াম, আর এ জন্য তাঁর অন্তরের দরদও স্পষ্ট হয়ে গেছে প্রদর্শনীর মাধ্যমে। একজন শিল্পপ্রেমীর পক্ষে বহু কষ্টে সংগ্রহ করা দুর্লভ সব শিল্পকর্ম বিক্রি করে দেওয়াটা নিদারুণ বেদনার ব্যাপার। মামুন ফটোজিয়ামের জন্য ভালোবাসা থেকেই এই ক্ষতি স্বীকারে রাজি হয়েছেন—সন্দেহ নেই।
প্রদর্শনীতে আমরা দেখি, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১২.৫×৭.৫ সে. মি. কাগজে কালিতে করা ধানের শীষের রেখা ড্রয়িং। ড্রয়িংয়ের সঙ্গে নন্দলাল বসুর শিল্পকথা বই থেকে নেওয়া নোট, ‘সৌন্দর্য্যবোধের অভাবে মানুষ যে কেবল রসের ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়, তা নয়, তার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের দিক দিয়েও সে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।’ লেখার পাশে নন্দলাল বসুর স্বাক্ষর আছে। কামরুল হাসানের অনেক ড্রয়িং দেখা যায় এই প্রদর্শনীতে। কামরুল মানেই সার্বক্ষণিক আঁকাআঁকি, লেখালেখি করা আপদমস্তক একজন শিল্পী। ‘মাই ওম্যান-১, ২’ শীর্ষক ছবিতে রেখার মুনশিয়ানা, ললিত ছন্দ, ঢং—সবকিছুর মধ্যেই কামরুল হাসানের মহান শিল্পী-সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর আঁকা নারী এক ভিন্ন রোমান্টিক রসমাধুর্য সৃষ্টি করে। ‘কম্পোজিশন’ ছবিতে কিউবিজমের প্রতি, বিশেষত, স্পেনীয় শিল্পী পাবলো পিকাসোর প্রতি তাঁর অনুরাগ লক্ষণীয়।
শিল্পী এস এম সুলতানের সান্নিধ্য পাওয়া মামুনের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। মইনুদ্দীন খালেদ এ প্রদর্শনীর ক্যাটালগে লিখেছেন, ‘মামুনের সবচেয়ে বড়-মানুষী ঠিকানা সুলতান। এ শিল্পীর কাজে সবচেয়ে বড় জাগরণ আসে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। অধুনালুপ্ত শিল্পকলা একাডেমীর গোলঘরটা তখন প্রহোলিকাময় মানুষ সুলতানের মন্দিরে পরিণত হয়েছিল। সেই মন্দিরেই আমরা কৈশোরোত্তীর্ণ উষার আলোর মতো প্রথম যৌবনের চোখের মণিতে শিল্পী সুলতানকে ছবি আঁকতে দেখি। সেই ঋষির সান্নিধ্যে থেকেছেন মামুন।...মামুন সুলতানকে নানা কৌণিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকালের কৃচ্ছ্রসাধনায় প্রায় ৫০০ বার আলোকোচিত্রিত করেছেন।’
২২ নভেম্বর, ১৯৯১-তে আঁকা সুলতানের রেখাচিত্র ‘ভিলেজ ওম্যান’ কালি কাগজে আঁকা। সভ্যতার বিনির্মাণে মানুষের প্রাণশক্তি তুলে ধরাই সুলতানের শিল্পের মৌলিকত্ব।
জয়নুল আবেদিনের সমসাময়িক আরেক শিল্পী কাজী আবুল কাসেম। প্রায় বিস্মৃত। চল্লিশের দশকে প্রতিবাদী কার্টুন এঁকেছিলেন। তাঁর আঁকাও স্থান পেয়েছে এখানে। স্মৃতি-বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে আবারও মনে করিয়ে দেওয়া এই প্রদর্শনীর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মনে পড়ছে শফিকুল আমিনের কথা। এ ছাড়া মোহাম্মদ কিবরিয়া আছেন। হামিদুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, মুর্তজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা রেখাচিত্রগুলো একটা সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে। আবার মনিরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দীন, আব্দুশ শাকুর, হামিদুজ্জামান প্রমুখের ড্রয়িং দেখার সুযোগ মিলেছে এই প্রদর্শনীতে। এই প্রদর্শনী থেকে একটি বিরাট প্রাপ্তির দিক হলো, এখানে একসঙ্গে অনেক গুণী মানুষের ছবি দেখার সুযোগ হয়েছে এবং এর মাধ্যমে প্রত্যেক শিল্পীর নিজস্বতার দিকটি আরও ভালোভাবে চোখে পড়েছে।
ওপার বাংলার পরিতোষ সেন, পুর্ণেন্দু পত্রী, গণেশ পাইন, গণেশ হালুই, মৃণাল সেন, গৌতম ঘোষ প্রমুখ কীর্তিমানের আঁকা ছবিও স্থান পেয়েছে এখানে।
কবি নির্মলেন্দু গুণ ও শামসুর রাহমানের আঁকা নজর কেড়েছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সূর্যমুখী ফুলের সরল ছেলেমানুষী ড্রয়িং ও তাঁর স্বাক্ষর সারল্যের কারণেই চোখ টানে। নওয়াজেশ আহমদ লাল রঙে এঁকেছেন তাঁর ‘বনলতা সেন’।
মামুন নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসকে দিয়েও আঁকিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের আঁকাও রয়েছে তাঁর সংগ্রহশালায়। মামুন শিল্পীদের প্রতিকৃতি ক্যামেরা বন্দী করেছেন, আর শিল্পীরা এঁকেছেন মামুনের প্রতিকৃতি। অবশ্য সবাই নন, কেউ কেউ। কাজী আবুল কাশেম, এস এম সুলতান, কামরুল হাসান, শিশির ভট্টাচার্য, আমিনুল ইসলাম প্রমুখ এঁকেছেন মামুনকে। একসঙ্গে এত গুণী ব্যক্তির রেখাচিত্র দেখবার সুযোগ আনন্দদায়ক নিঃসন্দেহে।
No comments