বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৬১০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আবদুল আজিজ, বীর বিক্রম সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে বৃহত্তর সিলেট জেলায় একের পর এক যুদ্ধ করেন আবদুল আজিজ ও তাঁর সহযোদ্ধারা।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে বৃহত্তর সিলেট জেলায় একের পর এক যুদ্ধ করেন আবদুল আজিজ ও তাঁর সহযোদ্ধারা।
ধলই, পাত্রখোলা, চারগ্রাম, কানাইঘাট প্রভৃতি স্থানে একটানা যুদ্ধ করে পরিশ্রান্ত হলেও তাঁদের যুদ্ধ করার আগ্রহে ভাটা পড়েনি, বরং আরও বেড়ে যায়। কারণ, তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে।
নভেম্বরে কানাইঘাট দখলের পর আবদুল আজিজ ও তাঁর সহযোদ্ধারা রওনা হন সিলেট শহর অভিমুখে। তাঁরা ছিলেন কয়েকটি দলে (কোম্পানি) বিভক্ত। তাঁদের দলনেতা ছিলেন ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম, পরে মেজর)। সব দলের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম)।
জিয়াউদ্দিন আহমেদের যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী আবদুল আজিজসহ মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটির মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে অ্যাডভান্স টু কন্টাক্ট পদ্ধতিতে এগিয়ে যান। তিনি জানতেন, রণকৌশলের দিক বিচার করলে কোনো দূরদর্শী বাহিনীই শত্রুকে পেছনে ফেলে রাখতে চায় না। কারণ পেছনের আক্রমণ প্রতিহত করা অনেক সময় বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
আবদুল আজিজরা ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কানাইঘাট থেকে সিলেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। মাঝেমধ্যে একটু বিশ্রাম নিয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর একটি চা-বাগানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। তাঁদের অধিনায়ক জানতেন, সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরাট একটা দুর্গে পরিণত করেছে।
সে জন্য তাঁদের অধিনায়ক রাতের বেলা একটি প্যাট্রোল দলকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গতিবিধির খোঁজখবর নিতে পাঠান। খোঁজখবর পাওয়ার পর তাঁর নির্দেশে আবদুল আজিজরা সকালবেলা সামনে অগ্রসর হন। পথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের বাধা দেয়। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তাঁরা কতক্ষণ অপেক্ষা করেন।
আবদুল আজিজ ও তাঁর সহযোদ্ধারা সারা দিন সেখানেই অবস্থান করেন। সন্ধ্যায় তাঁরা এমসি কলেজ অভিমুখে পুনরায় যাত্রা করেন। পরদিন ভোর চারটার সময় এমসি কলেজের কাছে টিলার ওপর অবস্থান নেন। অদূরেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা ও ঘাঁটি।
একটু পর সকাল হয়। মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পান, পাকিস্তানিরা তাদের ডিফেন্সের মধ্যে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে খালি চোখেই দেখা যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি সম্পর্কে তারা তেমন সজাগ ছিল না। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য দলও সেখানে এসে অবস্থান নেয়।
এদিকে অনেক পাকিস্তানি সেনা একসঙ্গে দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের অধিনায়ক নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। তাঁর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের আক্রমণ শুরু করেন। ছয়টা মেশিনগান তিন দিক থেকে ফায়ার শুরু করে। এতে পাকিস্তানি সেনাদের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে।
এরপর সেখানে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আবদুল আজিজ ও তাঁর সহযোদ্ধারা ১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকে ১৭ ডিসেম্বর বেলা ১১টা পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটানা যুদ্ধ করেন। তারপর পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে।
আবদুল আজিজ চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। ৩০ মার্চ আক্রান্ত হওয়ার পর ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ১১ নম্বর সেক্টরে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। কামালপুর যুদ্ধে তিনি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত কামালপুর যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবদুল আজিজকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭০।
আবদুল আজিজ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে হাবিলদার হিসেবে অবসর নেন। তিনি মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার মাঝকান্দি গ্রামে। বাবার নাম খলিল মোল্লা, মা আমিরুন নেছা। স্ত্রী মোরশেদা বেগম। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
র্যা ashedtর্যা @pর্যা othom-alo.info
নভেম্বরে কানাইঘাট দখলের পর আবদুল আজিজ ও তাঁর সহযোদ্ধারা রওনা হন সিলেট শহর অভিমুখে। তাঁরা ছিলেন কয়েকটি দলে (কোম্পানি) বিভক্ত। তাঁদের দলনেতা ছিলেন ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম, পরে মেজর)। সব দলের সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম)।
জিয়াউদ্দিন আহমেদের যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী আবদুল আজিজসহ মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটির মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে অ্যাডভান্স টু কন্টাক্ট পদ্ধতিতে এগিয়ে যান। তিনি জানতেন, রণকৌশলের দিক বিচার করলে কোনো দূরদর্শী বাহিনীই শত্রুকে পেছনে ফেলে রাখতে চায় না। কারণ পেছনের আক্রমণ প্রতিহত করা অনেক সময় বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
আবদুল আজিজরা ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কানাইঘাট থেকে সিলেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। মাঝেমধ্যে একটু বিশ্রাম নিয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর একটি চা-বাগানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। তাঁদের অধিনায়ক জানতেন, সিলেট শহরের উপকণ্ঠে এমসি কলেজকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিরাট একটা দুর্গে পরিণত করেছে।
সে জন্য তাঁদের অধিনায়ক রাতের বেলা একটি প্যাট্রোল দলকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গতিবিধির খোঁজখবর নিতে পাঠান। খোঁজখবর পাওয়ার পর তাঁর নির্দেশে আবদুল আজিজরা সকালবেলা সামনে অগ্রসর হন। পথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁদের বাধা দেয়। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তাঁরা কতক্ষণ অপেক্ষা করেন।
আবদুল আজিজ ও তাঁর সহযোদ্ধারা সারা দিন সেখানেই অবস্থান করেন। সন্ধ্যায় তাঁরা এমসি কলেজ অভিমুখে পুনরায় যাত্রা করেন। পরদিন ভোর চারটার সময় এমসি কলেজের কাছে টিলার ওপর অবস্থান নেন। অদূরেই ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা ও ঘাঁটি।
একটু পর সকাল হয়। মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পান, পাকিস্তানিরা তাদের ডিফেন্সের মধ্যে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে খালি চোখেই দেখা যাচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি সম্পর্কে তারা তেমন সজাগ ছিল না। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য দলও সেখানে এসে অবস্থান নেয়।
এদিকে অনেক পাকিস্তানি সেনা একসঙ্গে দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের অধিনায়ক নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। তাঁর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানিদের আক্রমণ শুরু করেন। ছয়টা মেশিনগান তিন দিক থেকে ফায়ার শুরু করে। এতে পাকিস্তানি সেনাদের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ে।
এরপর সেখানে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আবদুল আজিজ ও তাঁর সহযোদ্ধারা ১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকে ১৭ ডিসেম্বর বেলা ১১টা পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটানা যুদ্ধ করেন। তারপর পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে।
আবদুল আজিজ চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল যশোর সেনানিবাসে। ৩০ মার্চ আক্রান্ত হওয়ার পর ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ১১ নম্বর সেক্টরে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন। কামালপুর যুদ্ধে তিনি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত কামালপুর যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য আবদুল আজিজকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭০।
আবদুল আজিজ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে হাবিলদার হিসেবে অবসর নেন। তিনি মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার মাঝকান্দি গ্রামে। বাবার নাম খলিল মোল্লা, মা আমিরুন নেছা। স্ত্রী মোরশেদা বেগম। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
র্যা ashedtর্যা @pর্যা othom-alo.info
No comments