স্পিকারের রুলিং নিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন নিষ্পত্তি

এক বিচারপতির বক্তব্যকে কেন্দ্র করে জাতীয় সংসদের স্পিকারের দেওয়া রুলিং চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে সরকারের আবেদন নিষ্পত্তি করেছেন আপিল বিভাগ। এ আদেশের পর রিট আবেদনকারীর আইনজীবী বলেছেন, হাইকোর্টের রায় বহাল রয়েছে।


তবে এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সরকারের আবেদন খারিজ হয়নি। আগের রায় পরিবর্তন করা হতে পারে।
গতকাল রবিবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সরকারকে আপিল করার অনুমতি না দিয়ে কয়েকটি পর্যবেক্ষণসহ আবেদনটি নিষ্পত্তির আদেশ দেন। সকালে বিচারপতিরা এজলাসে বসার পর আইনজীবীরা বিভিন্ন মামলা উপস্থাপন করেন। এরপর প্রধান বিচারপতি এই মামলার আদেশ দেন। আদেশে তিনি বলেন, ডিসপোজড উইথ অবজারভেশন্স (পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করা হলো)।
এ আদেশের পর রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার আখতার ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, 'আপিল বিভাগ কী পর্যবেক্ষণ দেন তা না দেখে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তার পরও বলা যায়, হাইকোর্টের রায় মোটামুটি ঠিক থাকবে বলে মনে করি। রায়ে বড় ধরনের পরিবর্তন থাকলে অবশ্যই আপিলের অনুমতি দেওয়া হতো।'
অন্যদিকে, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, 'আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণসহ আবেদন নিষ্পত্তি করেছেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের আবেদন খারিজ করেননি আপিল বিভাগ। এ আবেদনের ওপর শুনানিতে আমি বলেছি, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগ একটি অপরটির পরিপূরক। এই দুটি অঙ্গ সমন্বিতভাবে কাজ করলে রাষ্ট্রের উন্নতি হয়। তাই এমন কিছু করা যাবে না যার মাধ্যমে এ দুটি অঙ্গের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়। সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে সংবিধান নির্ধারিত কাজ করতে পারে- এটা সবার কাম্য। আশা করি, আমার এ বক্তব্য রায়ে প্রতিফলিত হবে।' তিনি আরো জানান, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আপিলের অনুমতি না দিয়েও হাইকোর্টের রায় পরিবর্তন করা হয়েছে। এই মামলায়ও আপিল বিভাগ চাইলে হাইকোর্টের রায় সংশোধন করতে পারেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, 'এ রায়ের মধ্য দিয়ে আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সংঘাতের অবসান হবে বলে আশা করি।'
সড়ক ভবন নিয়ে আদালত অবমাননা মামলায় বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ৫ জুনের মধ্যে ব্লক সি-এর বাকি অংশ ও ব্লক এ-এর দুটি কক্ষ সুপ্রিম কোর্টকে হস্তান্তর করতে গত ১৪ মে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ আদেশ নিয়ে গত ২৯ মে সংসদে আলোচনা হয়। এ আলোচনায় জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ কিছু মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন- এটি ভালো দেখায় না। আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে।'
৫ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ স্পিকারের এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। সংসদে স্পিকার আব্দুল হামিদের দেওয়া বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক হিসেবে অভিহিত করে হাইকোর্ট বলেন, 'এটা হলো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তাঁর (স্পিকার) বক্তব্য আদালত অবমাননাকর। ওই পদে থাকার অধিকার তাঁর নেই।'
আদালতের এ মন্তব্যের পর ওই দিন সন্ধ্যায়ই সংসদে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন সরকারদলীয় কয়েকজন সংসদ সদস্য। তাঁরা বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাঁকে অপসারণের দাবি জানান।
এ অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করার পক্ষে মত দেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। পরে ১৮ জুন স্পিকার আব্দুল হামিদ রুলিং দেন। রুলিংয়ে ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে তিনি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি প্রত্যাহারের জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, একজন বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদের লংঘন করেছেন। স্পিকার আরো বলেন, 'একই সঙ্গে বলব, আদালতের এ ধরনের আচরণে কী করণীয় থাকতে পারে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে।'
এ অবস্থায় ওই রুলিংয়ের দুটি অংশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন এ কে এম শফিউদ্দিন। আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আখতার ইমাম। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়।
এ রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে ২৪ জুলাই আদেশ দেন হাইকোর্ট। ২৭ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ আদেশ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, 'একজন বিচারক সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লংঘন করেছেন এবং এ বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি ভেবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন'- জাতীয় সংসদের স্পিকারের এই রুলিংয়ের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। স্পিকারের ওই অভিমত আইনগতভাবে অকার্যকর। হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে সরকার ৩ সেপ্টেম্বর লিভ টু আপিল আবেদন করে।

No comments

Powered by Blogger.