ভূগর্ভস্থ জলাধার সংরক্ষণ ও পরিকল্পিত ব্যবহার by হাসান কামরুল
সম্প্রতি বিএডিসি (বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন) 'জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন : বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন ও পরিবেশের ওপর প্রভাব' শীর্ষক এক গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে।
তাদের নির্ণীত গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সমুদ্রতলের চেয়েও প্রায় ১৭০ ফুট নিচে নেমে গেছে এবং রাজশাহী অঞ্চলের আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল ১৮ থেকে ২০ ফুট নিচে রয়েছে। অর্থাৎ পানির স্তরের ক্রমাবনতি হচ্ছে। এতে করে সাগরের নোনাপানির আধিক্যে স্বাদু বা সুমিষ্ট পানির আধার ধ্বংস বা কলুষিত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে বলে গবেষণায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। সমুদ্রজলের অনুপ্রবেশ ইতিমধ্যেই দক্ষিণাঞ্চল ভেদ করে ঢাকা মহানগরীসহ দেশের মধ্যাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দেখানো হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে সমুদ্রের নোনাপানির উপস্থিতি লক্ষণীয়, যা পুরো ছয় কোটি মানুষের জীবনকে বিপদগ্রস্ত করে তুলছে। আর এতে শুধু কৃষি খাতে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২২ কোটি টাকা।
সমুদ্রজলের অনুপ্রবেশ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মতো অনেক কারণ রয়েছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম শহরে ভূগর্ভস্থ পানিতে নোনাপানির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। চিটাগাংয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে যেখানে সুমিষ্ট পানির আধার সর্বত্র পাওয়ার কথা, সেখানে অ্যাকুইফার সিস্টেমে সমুদ্রজলের উপস্থিতি রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। অ্যাকুইফার সিস্টেমে স্যালাইন ওয়াটারের অনুপ্রবেশ নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানের পর জানা গেল, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সুমিষ্ট পানির আধারের সঙ্গে প্রাকৃতিক ভাঁজ বা ফল্ট লাইনের অস্তিত্ব সম্পর্কিত, যা সমুদ্রের ভাঁজ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রকৃতির এ ধরনের দ্বৈত আচরণের কারণে জনজীবন প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে চট্টগ্রাম ও পাহাড়ি অঞ্চলের জনপদ অনাকাঙ্ক্ষিত এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি, যা হবে চরম ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, ফল্ট লাইন বিস্তৃতি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় এ অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যদি বড় মাত্রায় ভূমিকম্প বা জলোচ্ছ্বাস বা সুনামি এ অঞ্চলে আঘাত হানে তাহলে পাহাড়ি অঞ্চলের সুমিষ্ট পানির আধার চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে। ধারণা করা হয়, ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট সুনামির কারণে বঙ্গোপসাগরের পারের দেশগুলো বিভিন্ন রকমের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর চিটাগাং শহরের ভূগর্ভস্থ পানিতে নোনাপানির আধিক্য সেই সুনামিরই ফসল।
জাতিসংঘের আর্থিক সহায়তায় কয়েক বছর ধরেই ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিরূপণ নিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরে গবেষণা চলছে। আর এ গবেষণা শেষে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণে বোঝা যাবে, এই তিন শহরে ভূমিকম্পের পাশাপাশি খাবার পানির সংকট ভবিষ্যতে কতটা প্রকট হবে। দক্ষিণাঞ্চলে সিডর আঘাতের পরই ওই এলাকার দৃশ্যপট পুরোপুরি পাল্টে যায়। খুব দ্রুত বদলে যেতে থাকে কৃষিজমির ধরন ও প্রকৃতি। কৃষিজমিতে সমুদ্রজলের প্রবেশ, প্রচলিত কৃষি ও সেচব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায় দারুণ এক সংকট ঘনীভূত হয় দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে। আর পুরো ব্যাপারটিতে জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যক্ষভাবেই প্রভাব ফেলছে। ধারণা করা হয়, গত কয়েক বছরে সমুদ্রতলের উচ্চতাও বেড়েছে সমানতালে। ফলে নিচু অঞ্চলগুলো বিভিন্নভাবে জলমগ্ন হয়ে যাওয়ার অপেক্ষামাত্র।
ঢাকা শহরের পানির স্তর দিন দিন নিম্নদিকে ধাবিত হচ্ছে। শহরজুড়েই শুরু হয়েছে খাবার পানির তীব্র সংকট। কিন্তু কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। কারণ, গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ হওয়ার কোনো সুযোগই রাখা হয়নি নগর বর্ধনে। স্বেচ্ছাচারিতার আরেক নাম ঢাকা শহর। অপরিকল্পিতভাবে ভরাট করে ফেলা হয়েছে শহরের সব নদীনালা-খালবিল, পুকুর-ডোবা। সব শূন্যস্থান ভরাটে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে এখানে। কিন্তু নগর পরিকল্পনায় বরাবরের মতো বাদ পড়ে গেছে ভূগর্ভস্থ জলাধার সংরক্ষণের বিষয়টি। দেখা গেল, ভূগর্ভস্থ পানির আধারের জন্য যে জায়গাটা সংরক্ষণ করাটা জরুরি ছিল, সেখানে গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। অথচ একবারও কেউ ভাবল না অ্যাপার্টমেন্টবাসীদের খাবার পানির সংস্থান কোথা থেকে হবে। এমনকি রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) কাছেও ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের বিস্তৃতি নিয়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। যদি থাকতই তাহলে যত্রতত্র ভবন নির্মাণের অনুমোদন রাজউক থেকে মিলত না। পানি বিতরণকারী সংস্থা ওয়াসা ঢাকা শহরের আরেক ক্যান্সার। এ প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা শহরের পানির আধার সংরক্ষণে কোনো কালেই কোনোরূপ কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। বরং ওয়াসার কারণে শহরের গ্রাউন্ড ওয়াটারের আধারগুলো আরো ধ্বংস হয়েছে। পুরো শহরজুড়ে ওয়াসার রয়েছে ডিপ টিউবওয়েলের নেটওয়ার্কিং। ওয়াসার পলিসিতে গ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভ সংরক্ষণ ও চিহ্নিতকরণে প্রতি তিন কিলোমিটার এলাকায় দুটি ডিপ টিউবওয়েল থাকার কথা। কিন্তু ওয়াসার অসাধু কর্মকর্তারা অজ্ঞাতসারেই প্রতি তিন কিলোমিটার এলাকায় তিনটি, কোথাও কোথাও পাঁচটি ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করেছে। ফলে অতিরিক্ত পানির উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে রিচার্জ হওয়ার সুযোগ রহিত হচ্ছে। অর্থাৎ অ্যাকুইফার সিস্টেম থেকে যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করার কথা এর চেয়ে বেশি করা হচ্ছে। ফলে অ্যাকুইফার ডিচার্জ করতে গিয়ে রিচার্জ হওয়ার সময় ও সুযোগ না পাওয়ায় পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।
এসব কাজের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে অনেকটা জোর করেই ওয়াসাকে দিয়ে একই এলাকায় নিয়ম-বহির্ভূতভাবে একাধিক গভীর নলকূপ বসানোর কাজটি করিয়ে নিচ্ছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, মতিঝিল, মগবাজার, মালিবাগ, বাসাবো, খিলগাঁও এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে ৮০ মিটার। মিরপুর, কল্যাণপুর, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে ৪০ মিটার। হাজারীবাগ, ধানমণ্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল ডিক্লাইন করেছে ৩৫ মিটার। গুলশান, বনানী, শাহজাদপুর, বাড্ডা, রামপুরা এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে ৪২ মিটার। আর পুরান ঢাকার পানির স্তরের ডিক্লাইন হয়েছে সবচেয়ে বেশি কোথাও কোথাও সে চিত্র ১২০ মিটারেরও বেশি। অর্থাৎ পুরো ঢাকা শহরের আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেলের যে চিত্র, তাতে সামনের কয়েক বছর পর ঢাকা শহরের মাটির নিচ থেকে আর খাবার পানি পাওয়া যাবে না। তখন বাধ্য হয়েই বোতলজাত পানির ব্যবহার বাড়বে।
ঢাকাকে বাঁচাতে হলে এখন থেকেই পানির বিকল্প উৎসের অনুসন্ধান করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মেঘনা নদীর পানি পাইপলাইনে ঢাকা শহরে নিয়ে ট্রিটমেন্ট করার ব্যবস্থা করতে হবে। বুড়িগঙ্গার অবস্থা দিনদিন যা হচ্ছে তাতে বুড়িগঙ্গা কিংবা শীতলক্ষ্যার পানি পরিশোধন করেও খাওয়া যাবে না। ঢাকার কাছে মেঘনার পানি এখনো দূষণমুক্ত আছে বিধায় অতিদ্রুত মেঘনার পানিকে পরিশোধন করে ঢাকায় সরবরাহের স্কিম গ্রহণ করা যেতে পারে। ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখ্যা। আয়তন অনুপাতে লোকসংখ্যার পরিমাণ বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ঢাকা শহর ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। তাই ঢাকা থেকে জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে। কারণ, ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ধারণ ক্যাপাসিটি হচ্ছে ৫০ লাখ। অথচ এ শহরে এখন লোক বাস করছে দুই কোটিরও বেশি। তাই চার গুণ মানুষের জন্য নিত্যদিনের পানি সরবরাহে ভূগর্ভস্থ জলাধার নেই।
ঢাকা শহরের জমি-জায়গা তো দখল হয়েই আছে, যা ভবিষ্যৎকে আরো ভালনারেভল করে তুলছে। ভবিষ্যৎ ঢাকাকে নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে বর্ধিত ঢাকা নগরীকে গড়ে তুলতে না পারলে বর্তমানের চেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তখন হয়তো ঢাকা শহরকে 'ডেথ সিটি' বা 'মৃত নগরী' হিসেবেই দেখতে হবে।
বিএডিসির গবেষণায় আরো দেখা যায়, বাংলাদেশের সেচনির্ভর এলাকাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে। প্রায় ৮০ শতাংশই ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। তাই ইরি উৎপাদনে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহৃত হয় বিধায় কৃষিবিজ্ঞানীরা আবার বোরো উৎপাদনের ওপর জোর দিচ্ছেন। কারণ, বোরো উৎপাদনে নদীনালা-খালবিল অর্থাৎ ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহৃত হয়। পানির সংকট নিরসনে নদীনালা-খালবিলগুলোকে রক্ষা করতে হবে। বৃহৎ নদীগুলোকে ড্রেজিং করতে হবে। নদীর পানিকে সারা বছর সঞ্চারণের জন্য সঞ্চারণ-আধার সৃষ্টি করতে হবে। যাতে দৈনিক ব্যবহৃত পানির চাহিদার সিংহভাগ নদীর পানি থেকে গ্রহণ করা যায়।
পরিশেষে ঢাকাসহ দেশের প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ পানির আধারগুলোকে চিহ্নিতকরণসহ সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করতে হবে। সমুদ্রজলের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণসহ পানির আধারগুলোকে নবায়ন ও পুনঃ নবায়নের সুযোগ দিতে হবে। প্রচলিত জলাধারগুলোকে সংরক্ষণে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। কারণ, মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ জল হলেও মাত্র দুই শতাংশ খাবার জল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর এই দুই শতাংশ জলও বিভিন্ন উপায়ে দূষণের শিকার হচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে পৃথিবীজুড়ে জলযুদ্ধ আসন্ন বলে পানি বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
লেখক : ভূতত্ত্ববিদ ও কলাম লেখক
সমুদ্রজলের অনুপ্রবেশ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মতো অনেক কারণ রয়েছে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম শহরে ভূগর্ভস্থ পানিতে নোনাপানির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। চিটাগাংয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে যেখানে সুমিষ্ট পানির আধার সর্বত্র পাওয়ার কথা, সেখানে অ্যাকুইফার সিস্টেমে সমুদ্রজলের উপস্থিতি রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। অ্যাকুইফার সিস্টেমে স্যালাইন ওয়াটারের অনুপ্রবেশ নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানের পর জানা গেল, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সুমিষ্ট পানির আধারের সঙ্গে প্রাকৃতিক ভাঁজ বা ফল্ট লাইনের অস্তিত্ব সম্পর্কিত, যা সমুদ্রের ভাঁজ পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রকৃতির এ ধরনের দ্বৈত আচরণের কারণে জনজীবন প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে চট্টগ্রাম ও পাহাড়ি অঞ্চলের জনপদ অনাকাঙ্ক্ষিত এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি, যা হবে চরম ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, ফল্ট লাইন বিস্তৃতি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় এ অঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যদি বড় মাত্রায় ভূমিকম্প বা জলোচ্ছ্বাস বা সুনামি এ অঞ্চলে আঘাত হানে তাহলে পাহাড়ি অঞ্চলের সুমিষ্ট পানির আধার চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে। ধারণা করা হয়, ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট সুনামির কারণে বঙ্গোপসাগরের পারের দেশগুলো বিভিন্ন রকমের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর চিটাগাং শহরের ভূগর্ভস্থ পানিতে নোনাপানির আধিক্য সেই সুনামিরই ফসল।
জাতিসংঘের আর্থিক সহায়তায় কয়েক বছর ধরেই ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিরূপণ নিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট শহরে গবেষণা চলছে। আর এ গবেষণা শেষে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণে বোঝা যাবে, এই তিন শহরে ভূমিকম্পের পাশাপাশি খাবার পানির সংকট ভবিষ্যতে কতটা প্রকট হবে। দক্ষিণাঞ্চলে সিডর আঘাতের পরই ওই এলাকার দৃশ্যপট পুরোপুরি পাল্টে যায়। খুব দ্রুত বদলে যেতে থাকে কৃষিজমির ধরন ও প্রকৃতি। কৃষিজমিতে সমুদ্রজলের প্রবেশ, প্রচলিত কৃষি ও সেচব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ায় দারুণ এক সংকট ঘনীভূত হয় দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে। আর পুরো ব্যাপারটিতে জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যক্ষভাবেই প্রভাব ফেলছে। ধারণা করা হয়, গত কয়েক বছরে সমুদ্রতলের উচ্চতাও বেড়েছে সমানতালে। ফলে নিচু অঞ্চলগুলো বিভিন্নভাবে জলমগ্ন হয়ে যাওয়ার অপেক্ষামাত্র।
ঢাকা শহরের পানির স্তর দিন দিন নিম্নদিকে ধাবিত হচ্ছে। শহরজুড়েই শুরু হয়েছে খাবার পানির তীব্র সংকট। কিন্তু কেন? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। কারণ, গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ হওয়ার কোনো সুযোগই রাখা হয়নি নগর বর্ধনে। স্বেচ্ছাচারিতার আরেক নাম ঢাকা শহর। অপরিকল্পিতভাবে ভরাট করে ফেলা হয়েছে শহরের সব নদীনালা-খালবিল, পুকুর-ডোবা। সব শূন্যস্থান ভরাটে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে এখানে। কিন্তু নগর পরিকল্পনায় বরাবরের মতো বাদ পড়ে গেছে ভূগর্ভস্থ জলাধার সংরক্ষণের বিষয়টি। দেখা গেল, ভূগর্ভস্থ পানির আধারের জন্য যে জায়গাটা সংরক্ষণ করাটা জরুরি ছিল, সেখানে গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। অথচ একবারও কেউ ভাবল না অ্যাপার্টমেন্টবাসীদের খাবার পানির সংস্থান কোথা থেকে হবে। এমনকি রাজউকের (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) কাছেও ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের বিস্তৃতি নিয়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। যদি থাকতই তাহলে যত্রতত্র ভবন নির্মাণের অনুমোদন রাজউক থেকে মিলত না। পানি বিতরণকারী সংস্থা ওয়াসা ঢাকা শহরের আরেক ক্যান্সার। এ প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা শহরের পানির আধার সংরক্ষণে কোনো কালেই কোনোরূপ কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। বরং ওয়াসার কারণে শহরের গ্রাউন্ড ওয়াটারের আধারগুলো আরো ধ্বংস হয়েছে। পুরো শহরজুড়ে ওয়াসার রয়েছে ডিপ টিউবওয়েলের নেটওয়ার্কিং। ওয়াসার পলিসিতে গ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভ সংরক্ষণ ও চিহ্নিতকরণে প্রতি তিন কিলোমিটার এলাকায় দুটি ডিপ টিউবওয়েল থাকার কথা। কিন্তু ওয়াসার অসাধু কর্মকর্তারা অজ্ঞাতসারেই প্রতি তিন কিলোমিটার এলাকায় তিনটি, কোথাও কোথাও পাঁচটি ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করেছে। ফলে অতিরিক্ত পানির উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে রিচার্জ হওয়ার সুযোগ রহিত হচ্ছে। অর্থাৎ অ্যাকুইফার সিস্টেম থেকে যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করার কথা এর চেয়ে বেশি করা হচ্ছে। ফলে অ্যাকুইফার ডিচার্জ করতে গিয়ে রিচার্জ হওয়ার সময় ও সুযোগ না পাওয়ায় পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।
এসব কাজের নেপথ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে অনেকটা জোর করেই ওয়াসাকে দিয়ে একই এলাকায় নিয়ম-বহির্ভূতভাবে একাধিক গভীর নলকূপ বসানোর কাজটি করিয়ে নিচ্ছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, মতিঝিল, মগবাজার, মালিবাগ, বাসাবো, খিলগাঁও এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে ৮০ মিটার। মিরপুর, কল্যাণপুর, ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে ৪০ মিটার। হাজারীবাগ, ধানমণ্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেল ডিক্লাইন করেছে ৩৫ মিটার। গুলশান, বনানী, শাহজাদপুর, বাড্ডা, রামপুরা এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে ৪২ মিটার। আর পুরান ঢাকার পানির স্তরের ডিক্লাইন হয়েছে সবচেয়ে বেশি কোথাও কোথাও সে চিত্র ১২০ মিটারেরও বেশি। অর্থাৎ পুরো ঢাকা শহরের আন্ডার গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেলের যে চিত্র, তাতে সামনের কয়েক বছর পর ঢাকা শহরের মাটির নিচ থেকে আর খাবার পানি পাওয়া যাবে না। তখন বাধ্য হয়েই বোতলজাত পানির ব্যবহার বাড়বে।
ঢাকাকে বাঁচাতে হলে এখন থেকেই পানির বিকল্প উৎসের অনুসন্ধান করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মেঘনা নদীর পানি পাইপলাইনে ঢাকা শহরে নিয়ে ট্রিটমেন্ট করার ব্যবস্থা করতে হবে। বুড়িগঙ্গার অবস্থা দিনদিন যা হচ্ছে তাতে বুড়িগঙ্গা কিংবা শীতলক্ষ্যার পানি পরিশোধন করেও খাওয়া যাবে না। ঢাকার কাছে মেঘনার পানি এখনো দূষণমুক্ত আছে বিধায় অতিদ্রুত মেঘনার পানিকে পরিশোধন করে ঢাকায় সরবরাহের স্কিম গ্রহণ করা যেতে পারে। ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখ্যা। আয়তন অনুপাতে লোকসংখ্যার পরিমাণ বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ঢাকা শহর ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। তাই ঢাকা থেকে জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে। কারণ, ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা ধারণ ক্যাপাসিটি হচ্ছে ৫০ লাখ। অথচ এ শহরে এখন লোক বাস করছে দুই কোটিরও বেশি। তাই চার গুণ মানুষের জন্য নিত্যদিনের পানি সরবরাহে ভূগর্ভস্থ জলাধার নেই।
ঢাকা শহরের জমি-জায়গা তো দখল হয়েই আছে, যা ভবিষ্যৎকে আরো ভালনারেভল করে তুলছে। ভবিষ্যৎ ঢাকাকে নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে বর্ধিত ঢাকা নগরীকে গড়ে তুলতে না পারলে বর্তমানের চেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। তখন হয়তো ঢাকা শহরকে 'ডেথ সিটি' বা 'মৃত নগরী' হিসেবেই দেখতে হবে।
বিএডিসির গবেষণায় আরো দেখা যায়, বাংলাদেশের সেচনির্ভর এলাকাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে। প্রায় ৮০ শতাংশই ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। তাই ইরি উৎপাদনে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহৃত হয় বিধায় কৃষিবিজ্ঞানীরা আবার বোরো উৎপাদনের ওপর জোর দিচ্ছেন। কারণ, বোরো উৎপাদনে নদীনালা-খালবিল অর্থাৎ ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহৃত হয়। পানির সংকট নিরসনে নদীনালা-খালবিলগুলোকে রক্ষা করতে হবে। বৃহৎ নদীগুলোকে ড্রেজিং করতে হবে। নদীর পানিকে সারা বছর সঞ্চারণের জন্য সঞ্চারণ-আধার সৃষ্টি করতে হবে। যাতে দৈনিক ব্যবহৃত পানির চাহিদার সিংহভাগ নদীর পানি থেকে গ্রহণ করা যায়।
পরিশেষে ঢাকাসহ দেশের প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ পানির আধারগুলোকে চিহ্নিতকরণসহ সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ এখনই গ্রহণ করতে হবে। সমুদ্রজলের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণসহ পানির আধারগুলোকে নবায়ন ও পুনঃ নবায়নের সুযোগ দিতে হবে। প্রচলিত জলাধারগুলোকে সংরক্ষণে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অপরিহার্য। কারণ, মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ জল হলেও মাত্র দুই শতাংশ খাবার জল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর এই দুই শতাংশ জলও বিভিন্ন উপায়ে দূষণের শিকার হচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে পৃথিবীজুড়ে জলযুদ্ধ আসন্ন বলে পানি বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
লেখক : ভূতত্ত্ববিদ ও কলাম লেখক
No comments