বহুরূপী ডাক্তারঃ হাসপাতালে গেলে তাকান না, ক্লিনিকে গেলে আদর by মিলন রহমান
যশোরসহ আশপাশের কয়েকটি জেলা ও উপজেলার আশা ভরসার স্থল যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল। কিন্তু এ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে রোগীদের অভিযোগের শেষ নেই। একদিকে, সেবার পরিবর্তে বাণিজ্যিক মানসিকতা, অন্যদিকে, অনিয়ম অব্যবস্থাপনা হাসপাতালটিকে বর্তমান এ পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছে।
যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু ধারণক্ষমতার তুলনায় বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
যশোর জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালটিতে প্রতিদিনই ৪শ থেকে ৫শ রোগী ভর্তি থাকেন। আর বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নেন গড়ে প্রতিদিন ১২শ থেকে ১৪শ রোগী।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সালাউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, হাসপাতালের অন্তঃবিভাগের ২৫০ রোগীর যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের সক্ষমতা তাদের রয়েছে, তা দিয়েই ৪শ থেকে ৫শ রোগীর সেবা দিতে হয়।
আর বহির্বিভাগের এক একজন কনসালটেন্টকেই ১শ থেকে দেড়শ রোগীর ব্যবস্থাপত্র দিতে হয়। একারণেই সময় বেশি লাগায় অনেক সময় কিছু রোগীরা ক্ষুব্ধ হন।
তবে হাসপাতাল নিয়ে রোগীদের অভিযোগও কম নয়। হাসপাতালের কতিপয় চিকিৎসক, কর্মচারীসহ দালাল গোষ্ঠীর কারণে প্রতিনিয়তই নাজেহাল হচ্ছেন এখানে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা।
অনেক সময় চিকিৎসকের অবহেলার কারণে তার স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়ে হাসপাতালে ভাঙচুর চালিয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত।
বহিরাগত এবং হাসপাতালের কর্মচারী বেশে দালালরা কৌশলে রোগীদের পাঠিয়ে দিচ্ছেন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। আবার হাসপাতালের মালিও চিকিৎসক সেজে দিচ্ছেন রোগীর পরামর্শপত্র।
হাসপাতালে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি সংকট, রয়েছে দু’একটি পদের চিকিৎসকও সংকট। এখানকার বাথরুমগুলোর নোংরা পরিবেশ, কয়েকটি ওয়ার্ডে দুর্গন্ধে রোগীদের নাভিশ্বাস হলেও পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটে না।
বহির্বিভাগ: গত ১০ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা শহরের গৃহবধূ রাজিয়া আক্তার যশোর জেনারেল হাসপাতালে আসেন মাজায় ব্যথার জন্য চিকিৎসক দেখাতে। নিয়মমত টিকিট কেটে বসে আছেন বহির্বিভাগে চিকিৎসকের কক্ষের সামনে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে গেলেও লাইন আর শেষ হয় না।
তিনি জানান, বিরাট বড় লাইন দিয়ে তারা দাঁড়িয়ে থাকলেও ডাক্তার রোগী দেখছেন লাইনের বাইরে থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, পাশে অবস্থানরত কিছু দালাল ভেতরে রোগী পাঠাচ্ছেন।
এসময় বর্হিবিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা আরও কয়েকজন রোগী বাংলানিউজকে জানান, অধিকাংশ চিকিৎসকই সকাল ১০টা পার করে বহির্বিভাগে আসেন। এরপর আবার কয়েকটা রোগী দেখেই চা নাস্তা করতে বেরিয়ে পড়েন।
ফলে শ’ শ’ রোগীকে লাইনে দাঁড়িয়েই দিন পার করতে হয়। অনেকে আবার অতিষ্ঠ হয়ে ফিরে যেতেও বাধ্য হন।
অন্তঃবিভাগ: গত ২৬ আগস্ট বুধবার ঝিনাইদহ-বেনাপোল মহাসড়কের খোলাডাঙ্গায় ট্রাকের ধাক্কায় সাজ্জাদ হোসেন নামে এক নসিমন চালক আহত হন। দুপুর ১২টার দিকে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বিকেলে তার মৃত্যু হয়।
কর্তব্যরত চিকিৎসকের অবহেলায় সঠিক সময়ে চিকিৎসা সেবা না পাওয়ায় সাজ্জাদ মারা যান বলে অভিযোগ। তার বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ এলাকায়।
এদিকে, হাসপাতলে অন্তঃবিভাগের বাথরুম ও কয়েকটি ওয়ার্ড ঠিকমত পরিস্কার না করায় সেগুলো যেন ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। অথচ এ কাজের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট কর্মচারী। হাসপাতাল কর্মকর্তাদের তদারকি না থাকায় কর্মচারীরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না বলেও ভর্তি রোগীদের অভিযোগ।
দালাল চক্র: যশোর জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় দুই ধরণের দালাল চক্রের অবস্থান থাকে সব সময়। এর একটি গ্রুপ ফার্মেসির দালাল, অন্যটি প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল। হাসপাতালে ভর্তির জন্য কোনো রোগী আসলেই হামলে পড়ে ফার্মেসির দালালরা। রোগীর ট্রলি ধরে ওয়ার্ডে নিয়ে সহযোগিতা করে প্রথমে এরা স্বজনদের আস্থাভাজন হয়।
এরপর বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যায় ওষুধের দোকানে। অতি আপনজনের মতো বাকিতেও ওষুধ নিয়ে দেয়।
কিন্তু পরে দামের হিসাব কষার সময় শুরু হয় কারিশমা। একেকটি ওষুধের দাম দ্বিগুণ, তিনগুণ ধরে হিসেব করে রোগীর স্বজনদের গলাকাটা হয়। আর এর কমিশনও বুঝে পান ‘রোগী ধরে আনা দালাল’।
অন্যদিকে, প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা সুযোগ বুঝে রোগীর স্বজনদের ভাগিয়ে নিয়ে যায় ক্লিনিকে। ‘হাসপাতালের ইসিজি এক্সরে মেশিন ভালো না থাকায় এখানে রিপোর্ট ভাল হয় না’- এটা দালালের মুখের বুলি।
যশোরের শার্শার লক্ষণপুর গ্রামের ইসহাক ফকিরের স্ত্রী জরিনা বেগম (৬০) হাসপাতালের বহির্বিভাগে এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে তিনি চিহ্নিত দুই দালালের খপ্পরে পড়েন।
দালালরা তাকে ভুল বুঝিয়ে সরকারি হাসপাতালের সামনে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষার নামে হাতিয়ে নেয় ১৪শ টাকা। দালাল দু’জন উধাও হওয়ার পর তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
ঝিনাইদহের বারোবাজার এলাকার গৃহবধূ চামেলী আক্তার যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে এসেছিলেন গাইনি চিকিৎসক দেখাতে।
চামেলী বাংলানিউজকে জানান, আর্থিক অবস্থাও খুব বেশি ভালো না হওয়ায় তিনি সরকারি হাসপাতালে এসেছিলেন। কিন্তু ওই গাইনি চিকিৎসক যশোর শহরের আলোচিত একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত বসেন।
প্রথম দিনেই একগাদা টেস্ট লিখে তিনি পাঠিয়ে দেন। কয়েক হাজার টাকা ব্যয় করে চিকিৎসা নিয়েও তিনি সুস্থ না হওয়ায় ওই ডাক্তার দেখাতে তার প্রাইভেট ক্লিনিকে যান। সেখানে যাওয়ার পর ওষুধ বদলে দেওয়ায় তিনি কিছুটা সুস্থ হয়েছেন।
একই অঙ্গে বহুরূপ: গৃহবধূ চামেলী আক্তারের মতো অনেকেরই অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক মাথা তুলেও দেখেন না। দু’একটি সমস্যা শুনেই ওষুধ বা টেস্ট লিখতে শুরু করেন। তারপরও রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হন।
আর প্রাইভেট ক্লিনিকে সেই চিকিৎসকই অতিদ্রুত সেই রোগীর রোগ নির্ণয় করে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। সরকারি হাসপাতালে গেলে যে চিকিৎসক মাথা তোলেন না, প্রাইভেট ক্লিনিকেই তার ব্যবহারে থাকে মধু মেশানো। কারণ একটাই, সরকারি হাসপাতালে গেলে রোগীর কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কোনো উপায় থাকে না।
অন্যদিকে, প্রাইভেট ক্লিনিকে গেলে ক্লিনিক মালিকও খুশি হন, চিকিৎসকেরও পকেট ভারী হয়। বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মালিক ও চিকিৎসকের সমঝোতায় বর্তমানে এ ব্যবসা জমজমাট।
সমস্যা সংকট: যশোর জেনারেল হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ অনেক চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। করোনারী কেয়ার ইউনিটের ইকো কার্ডিওগ্রাম, ইটিটি, হলটার মনিটর নেই।
৮৮ লাখ টাকা দামি একটি এক্সরে মেশিন নষ্ট হয়ে রয়েছে। এক বছরের মধ্যে ১০ বার এটি নষ্ট হয়েছে।
হাসপাতালে নিউরো (মেডিসিন), নিউরো (সার্জারি), চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ পদগুলো খালি রয়েছে। এছাড়াও অধিকাংশ যন্ত্রপাতি বছরের একটি বড় সময় ধরে নষ্ট থাকে।
মালি যখন চিকিৎসক: গত ২৫ আগস্ট হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে রেজাউল ইসলাম (৬০) নামে এক বৃদ্ধ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন।
হাসপাতালে মালি পদে কর্মরত আব্দুল কাদের ওরফে জেলি কাদের ওয়ার্ড বয়ের কাজ করার সুযোগে চিকিৎসক সেজে ওই রোগীকে পরামর্শপত্র লিখে দেন।
পরে তাকে বেসরকারি একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে প্যাথলজি পরীক্ষাও করান তিনি। এভাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়ায় এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় হাসপাতালে।
কর্মকর্তার বক্তব্য: যশোর ২৫ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সালাউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, কিছু সমস্যা সংকট নিয়েই সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়।
এক্সরে মেশিনটির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “৮৮ লাখ টাকা দামের মেশিনটি এক বছরে ১০ বার নষ্ট হয়েছে। নষ্ট হলে তারা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি লিখেন, এরপর সংশ্লিষ্টরা এসে ঠিক করে দিয়ে যান। বছর ঘুরে যাওয়ায় ওয়ারেন্টি পিরিয়ডও শেষ হয়ে এসেছে।”
অথচ ঢাকার একটি শীর্ষ প্রাইভেট ক্লিনিকের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, একই মূল্যমানের সেখানকার মেশিন বছরে একদিনও নষ্ট হয়নি।
একইভাবে সরবরাহকৃত অনেক মেশিন মানসম্পন্ন না হওয়ায় দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায়। আবার নষ্ট হয়ে গেলেও তাৎক্ষণিক মেরামত করার সুযোগ নেই। চিঠি লিখে দু’এক মাস বসে থাকার পর তা ঠিক হয়।
হাসপাতালের দালাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “হাসপাতাল চত্বর ও চত্বরের বাইরে দালালদের তৎপরতা রয়েছে। এ চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় অনেক সময় হাসপাতালে অবস্থানরত পুলিশও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস পায় না।”
তারপরও প্রশাসনের সহযোগিতায় তারা চেষ্টা করছেন হাসপাতালে দালালদের তৎপরতা কমিয়ে আনতে।
সেবার মান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “হাসপাতালের সক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ রোগীকে তাদের সামলাতে হয়। ফলে আন্তরিকতা থাকলেও অনেক সময় সবরোগীকে দ্রুত সময়ে যথাযথ সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু তারপরও তারা আন্তরিক বলেই বিপুল পরিমাণ রোগী এখানে চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন।”
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সালাউদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, হাসপাতালের অন্তঃবিভাগের ২৫০ রোগীর যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের সক্ষমতা তাদের রয়েছে, তা দিয়েই ৪শ থেকে ৫শ রোগীর সেবা দিতে হয়।
আর বহির্বিভাগের এক একজন কনসালটেন্টকেই ১শ থেকে দেড়শ রোগীর ব্যবস্থাপত্র দিতে হয়। একারণেই সময় বেশি লাগায় অনেক সময় কিছু রোগীরা ক্ষুব্ধ হন।
তবে হাসপাতাল নিয়ে রোগীদের অভিযোগও কম নয়। হাসপাতালের কতিপয় চিকিৎসক, কর্মচারীসহ দালাল গোষ্ঠীর কারণে প্রতিনিয়তই নাজেহাল হচ্ছেন এখানে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা।
অনেক সময় চিকিৎসকের অবহেলার কারণে তার স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়ে হাসপাতালে ভাঙচুর চালিয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত।
বহিরাগত এবং হাসপাতালের কর্মচারী বেশে দালালরা কৌশলে রোগীদের পাঠিয়ে দিচ্ছেন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। আবার হাসপাতালের মালিও চিকিৎসক সেজে দিচ্ছেন রোগীর পরামর্শপত্র।
হাসপাতালে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি সংকট, রয়েছে দু’একটি পদের চিকিৎসকও সংকট। এখানকার বাথরুমগুলোর নোংরা পরিবেশ, কয়েকটি ওয়ার্ডে দুর্গন্ধে রোগীদের নাভিশ্বাস হলেও পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটে না।
বহির্বিভাগ: গত ১০ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা শহরের গৃহবধূ রাজিয়া আক্তার যশোর জেনারেল হাসপাতালে আসেন মাজায় ব্যথার জন্য চিকিৎসক দেখাতে। নিয়মমত টিকিট কেটে বসে আছেন বহির্বিভাগে চিকিৎসকের কক্ষের সামনে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে গেলেও লাইন আর শেষ হয় না।
তিনি জানান, বিরাট বড় লাইন দিয়ে তারা দাঁড়িয়ে থাকলেও ডাক্তার রোগী দেখছেন লাইনের বাইরে থেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, পাশে অবস্থানরত কিছু দালাল ভেতরে রোগী পাঠাচ্ছেন।
এসময় বর্হিবিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা আরও কয়েকজন রোগী বাংলানিউজকে জানান, অধিকাংশ চিকিৎসকই সকাল ১০টা পার করে বহির্বিভাগে আসেন। এরপর আবার কয়েকটা রোগী দেখেই চা নাস্তা করতে বেরিয়ে পড়েন।
ফলে শ’ শ’ রোগীকে লাইনে দাঁড়িয়েই দিন পার করতে হয়। অনেকে আবার অতিষ্ঠ হয়ে ফিরে যেতেও বাধ্য হন।
অন্তঃবিভাগ: গত ২৬ আগস্ট বুধবার ঝিনাইদহ-বেনাপোল মহাসড়কের খোলাডাঙ্গায় ট্রাকের ধাক্কায় সাজ্জাদ হোসেন নামে এক নসিমন চালক আহত হন। দুপুর ১২টার দিকে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বিকেলে তার মৃত্যু হয়।
কর্তব্যরত চিকিৎসকের অবহেলায় সঠিক সময়ে চিকিৎসা সেবা না পাওয়ায় সাজ্জাদ মারা যান বলে অভিযোগ। তার বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ এলাকায়।
এদিকে, হাসপাতলে অন্তঃবিভাগের বাথরুম ও কয়েকটি ওয়ার্ড ঠিকমত পরিস্কার না করায় সেগুলো যেন ডাস্টবিনে পরিণত হয়েছে। অথচ এ কাজের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট কর্মচারী। হাসপাতাল কর্মকর্তাদের তদারকি না থাকায় কর্মচারীরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে না বলেও ভর্তি রোগীদের অভিযোগ।
দালাল চক্র: যশোর জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় দুই ধরণের দালাল চক্রের অবস্থান থাকে সব সময়। এর একটি গ্রুপ ফার্মেসির দালাল, অন্যটি প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল। হাসপাতালে ভর্তির জন্য কোনো রোগী আসলেই হামলে পড়ে ফার্মেসির দালালরা। রোগীর ট্রলি ধরে ওয়ার্ডে নিয়ে সহযোগিতা করে প্রথমে এরা স্বজনদের আস্থাভাজন হয়।
এরপর বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যায় ওষুধের দোকানে। অতি আপনজনের মতো বাকিতেও ওষুধ নিয়ে দেয়।
কিন্তু পরে দামের হিসাব কষার সময় শুরু হয় কারিশমা। একেকটি ওষুধের দাম দ্বিগুণ, তিনগুণ ধরে হিসেব করে রোগীর স্বজনদের গলাকাটা হয়। আর এর কমিশনও বুঝে পান ‘রোগী ধরে আনা দালাল’।
অন্যদিকে, প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা সুযোগ বুঝে রোগীর স্বজনদের ভাগিয়ে নিয়ে যায় ক্লিনিকে। ‘হাসপাতালের ইসিজি এক্সরে মেশিন ভালো না থাকায় এখানে রিপোর্ট ভাল হয় না’- এটা দালালের মুখের বুলি।
যশোরের শার্শার লক্ষণপুর গ্রামের ইসহাক ফকিরের স্ত্রী জরিনা বেগম (৬০) হাসপাতালের বহির্বিভাগে এসেছিলেন ডাক্তার দেখাতে। টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে তিনি চিহ্নিত দুই দালালের খপ্পরে পড়েন।
দালালরা তাকে ভুল বুঝিয়ে সরকারি হাসপাতালের সামনে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষার নামে হাতিয়ে নেয় ১৪শ টাকা। দালাল দু’জন উধাও হওয়ার পর তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
ঝিনাইদহের বারোবাজার এলাকার গৃহবধূ চামেলী আক্তার যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে এসেছিলেন গাইনি চিকিৎসক দেখাতে।
চামেলী বাংলানিউজকে জানান, আর্থিক অবস্থাও খুব বেশি ভালো না হওয়ায় তিনি সরকারি হাসপাতালে এসেছিলেন। কিন্তু ওই গাইনি চিকিৎসক যশোর শহরের আলোচিত একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত বসেন।
প্রথম দিনেই একগাদা টেস্ট লিখে তিনি পাঠিয়ে দেন। কয়েক হাজার টাকা ব্যয় করে চিকিৎসা নিয়েও তিনি সুস্থ না হওয়ায় ওই ডাক্তার দেখাতে তার প্রাইভেট ক্লিনিকে যান। সেখানে যাওয়ার পর ওষুধ বদলে দেওয়ায় তিনি কিছুটা সুস্থ হয়েছেন।
একই অঙ্গে বহুরূপ: গৃহবধূ চামেলী আক্তারের মতো অনেকেরই অভিযোগ, সরকারি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক মাথা তুলেও দেখেন না। দু’একটি সমস্যা শুনেই ওষুধ বা টেস্ট লিখতে শুরু করেন। তারপরও রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হন।
আর প্রাইভেট ক্লিনিকে সেই চিকিৎসকই অতিদ্রুত সেই রোগীর রোগ নির্ণয় করে ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। সরকারি হাসপাতালে গেলে যে চিকিৎসক মাথা তোলেন না, প্রাইভেট ক্লিনিকেই তার ব্যবহারে থাকে মধু মেশানো। কারণ একটাই, সরকারি হাসপাতালে গেলে রোগীর কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কোনো উপায় থাকে না।
অন্যদিকে, প্রাইভেট ক্লিনিকে গেলে ক্লিনিক মালিকও খুশি হন, চিকিৎসকেরও পকেট ভারী হয়। বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মালিক ও চিকিৎসকের সমঝোতায় বর্তমানে এ ব্যবসা জমজমাট।
সমস্যা সংকট: যশোর জেনারেল হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ অনেক চিকিৎসা সরঞ্জামাদি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। করোনারী কেয়ার ইউনিটের ইকো কার্ডিওগ্রাম, ইটিটি, হলটার মনিটর নেই।
৮৮ লাখ টাকা দামি একটি এক্সরে মেশিন নষ্ট হয়ে রয়েছে। এক বছরের মধ্যে ১০ বার এটি নষ্ট হয়েছে।
হাসপাতালে নিউরো (মেডিসিন), নিউরো (সার্জারি), চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ পদগুলো খালি রয়েছে। এছাড়াও অধিকাংশ যন্ত্রপাতি বছরের একটি বড় সময় ধরে নষ্ট থাকে।
মালি যখন চিকিৎসক: গত ২৫ আগস্ট হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে রেজাউল ইসলাম (৬০) নামে এক বৃদ্ধ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হন।
হাসপাতালে মালি পদে কর্মরত আব্দুল কাদের ওরফে জেলি কাদের ওয়ার্ড বয়ের কাজ করার সুযোগে চিকিৎসক সেজে ওই রোগীকে পরামর্শপত্র লিখে দেন।
পরে তাকে বেসরকারি একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে প্যাথলজি পরীক্ষাও করান তিনি। এভাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়ায় এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় হাসপাতালে।
এক্সরে মেশিনটির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “৮৮ লাখ টাকা দামের মেশিনটি এক বছরে ১০ বার নষ্ট হয়েছে। নষ্ট হলে তারা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি লিখেন, এরপর সংশ্লিষ্টরা এসে ঠিক করে দিয়ে যান। বছর ঘুরে যাওয়ায় ওয়ারেন্টি পিরিয়ডও শেষ হয়ে এসেছে।”
অথচ ঢাকার একটি শীর্ষ প্রাইভেট ক্লিনিকের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, একই মূল্যমানের সেখানকার মেশিন বছরে একদিনও নষ্ট হয়নি।
একইভাবে সরবরাহকৃত অনেক মেশিন মানসম্পন্ন না হওয়ায় দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায়। আবার নষ্ট হয়ে গেলেও তাৎক্ষণিক মেরামত করার সুযোগ নেই। চিঠি লিখে দু’এক মাস বসে থাকার পর তা ঠিক হয়।
হাসপাতালের দালাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “হাসপাতাল চত্বর ও চত্বরের বাইরে দালালদের তৎপরতা রয়েছে। এ চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় অনেক সময় হাসপাতালে অবস্থানরত পুলিশও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস পায় না।”
তারপরও প্রশাসনের সহযোগিতায় তারা চেষ্টা করছেন হাসপাতালে দালালদের তৎপরতা কমিয়ে আনতে।
সেবার মান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “হাসপাতালের সক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ রোগীকে তাদের সামলাতে হয়। ফলে আন্তরিকতা থাকলেও অনেক সময় সবরোগীকে দ্রুত সময়ে যথাযথ সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু তারপরও তারা আন্তরিক বলেই বিপুল পরিমাণ রোগী এখানে চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন।”
No comments